দেশনায়ক – ১১

সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার সাফল্য সুভাষচন্দ্রকে এক বিরাট সমস্যার মধ্যে ফেলল। এতদিনের সব বিশ্বাস, আদর্শ, আকাঙক্ষা বিসর্জন দিয়ে তিনি কি এবার পরম নিশ্চিন্ত হয়ে সরকারি চাকরি গ্রহণ করবেন? এরকম সুযোগ পেয়ে সেটা করাই একান্ত স্বাভাবিক বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত হবে। সবাই তাই করে থাকে। নানা প্রশ্ন জাগতে লাগল তাঁর মনে। ইতিপূর্বে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর সিভিল সার্ভিসে যোগ দেবার সুযোগ প্রত্যাখ্যান কোনও ভারতীয় করেননি। এরপরে চূড়ান্ত পরীক্ষা বাকি ছিল। এ পরীক্ষা হবার কথা ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে। সুভাষের হাতে প্রস্তুতির সময় ছিল প্রায় ন’মাস। যে বিষয়গুলি বাকি ছিল সেগুলিতে পাস করা তাঁর পক্ষে মোটেই কঠিন ছিল না। যেমন, ভারতীয় ফৌজদারি আইন (Indian Penal Code), ভারতবর্ষের ইতিহাস, ভারতীয় ভাষা প্রভৃতি। এর সঙ্গে ছিল অশ্বারোহণ পরীক্ষা (riding test)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে অরবিন্দ অশ্বারোহণ পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি, যদিও অন্যসব বিষয়ে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেছিলেন। সুভাষের পক্ষে অশ্বারোহণে পাস করা মোটেই দুরূহ হত না। কিন্তু চূড়ান্ত পরীক্ষায় বসবেন কি না এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে তিনি দারুণ মানসিক অশান্তি ও যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন।

বাবা-মা, বাড়ির সবাই, আত্মীয় বন্ধুরা এবং (সম্ভবত) শরৎচন্দ্র পর্যন্ত চাইছিলেন সুভাষ যেন এত বড় সম্মান, সুযোগ ছেড়ে না দেন। শুধু কলকাতার কয়েকজন আদর্শনিষ্ঠ, স্বদেশপ্রেমিক ও তীব্র রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন বন্ধু সুভাষের আই সি এস-এ যোগদান না করার সিদ্ধান্তের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের মনে এক ঝড় চলছিল। তিনি তাঁর বাবা-মা ও অগ্রজদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁদের মনে আঘাত দেওয়ার চিন্তা তাঁকে বিচলিত করছিল। অন্যদিকে তাঁর নিজের আদর্শ ও জীবনের লক্ষ্য। তখনও তিনি সুনিশ্চিত হতে পারছেন না যে, যাই সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত নিন না কেন, তা ঠিক হবে কি না।

প্রায় সাত মাস ধরে তাঁর তীব্র মানসিক যন্ত্রণা ও সঙ্কটের সময় যাঁর সঙ্গে তিনি তাঁর সব কথা মন খুলে বলতে পারতেন, পরামর্শ চাইতেন, তিনি ছিলেন মেজদাদা শরৎচন্দ্র। পরীক্ষার খবর বেরবার পর সুভাষচন্দ্র অসংখ্য শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন বার্তা পেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে তিনি খুশি হতে পারেননি। শরৎচন্দ্রকে সেই কথা জানিয়ে তিনি লেখেন, “চাকরিকেই কি আমার জীবনের শেষ লক্ষ্য বলে মেনে নিতে হবে? চাকরিতে সাংসারিক সুখ পাওয়া যাবে, কিন্তু সেটা কি আত্মার মূল্যের বিনিময়ে?” আই সি এস-এর চাকরি অবশ্যই লোভনীয়। কিন্তু সুভাষের মতো মানুষের কাছে জীবনে সুনিশ্চিত সাফল্য ও নিরাপত্তা সর্বোত্তম লক্ষ্য হতে পারে না। কারণ, তাঁর মতে, “সংগ্রামহীন ঝুঁকিহীন জীবন তার অর্ধেক মাধুর্য হারায়”। কেউ কেউ বলতে পারেন যে, একবার সিভিল সার্ভিসে ঢুকলে আর তাঁর ‘তেজ’ থাকবে না, চাকরির মোহে পড়ে যাবেন। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তাঁর ক্ষেত্রে এরকম ঘটবে না। তিনি শরৎচন্দ্রকে জানান, “আমি বিবাহ করব না।” ফলে নিজের জাগতিক স্বার্থের চিন্তা তাঁর ক্ষেত্রে অন্তরায় হবে না। সুভাষ বিশেষ উদ্বিগ্ন ছিলেন তাঁর পিতার মতামত জানার জন্যে। কিন্তু নিজে তাঁর সঙ্গে সরাসরি কোনও কথাবার্তা না বলে তিনি মেজদাদাকে অনুরোধ করেন এই ব্যাপারটা তাঁকে জানাতে। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, শরৎচন্দ্র তাঁর ছোটভায়ের সঙ্গে একমত হবেন। জানকীনাথকে বোঝাবার চেষ্টা করবেন। এই চিঠিটি সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।

শরৎচন্দ্রকে লেখা সুভাষচন্দ্রের এই চিঠি বাড়িতে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আই সি এস-এ যোগদানের ব্যাপারে তাঁর মনোভাব ও নিজের ভবিষ্যৎ জীবন সম্বন্ধে তাঁর পরিকল্পনা জেনে সবাই ক্ষুব্ধ, হতবাক হয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র তা অনুমানই করেছিলেন। তাই, নিজের ওই চিঠিকে ‘বিস্ফোরক’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। জানকীনাথ পুত্রকে বোঝাবার চেষ্টা করেন যে, সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়ে ওই চাকরির দোষ-ত্রুটি সংশোধনের চেষ্টা করা এবং দেশের কল্যাণ করা সম্ভব। দৃষ্টান্তরূপে রমেশচন্দ্র দত্তের কথা ওঠা স্বাভাবিক ছিল। সুভাষ এই বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, রমেশচন্দ্র দত্ত সিভিল সার্ভিসের বাইরে থাকলে দেশের অনেক বেশি মঙ্গল হত। তাঁকে নিয়ে কলকাতার আত্মীয়-বন্ধু মহলে যে হইচই ও সমালোচনার গুঞ্জন হচ্ছিল তাতে সুভাষ অসহিষ্ণু ও বিরক্ত হয়ে উঠছিলেন। ১৯২১ সালের ২৬ জানুয়ারির এক চিঠিতে তিনি শরৎচন্দ্রকে লেখেন যে, অন্য কে কী বলল বা ভাবল তাতে তাঁর কিছু যায় আসে না। তাঁর আবেদন মেজদাদার আদর্শবাদের কাছে। একদিন ‘ওটেন ঘটনা’কে কেন্দ্র করে যখন তাঁর জীবনে এক বিপর্যয় ঘটেছিল তখন শরৎচন্দ্র তাঁকে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছিলেন। আজ আবার সেই সমর্থনই তিনি আশা করছেন। তিনি জানান, “ভবিষ্যতে আত্মত্যাগের যে কোনও আহ্বানকে আমি দৃঢ়তা, সাহস ও ধৈর্যের সঙ্গে গ্রহণ করব।” কয়েকদিন পরে (১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯২১) তিনি আর এক চিঠিতে চিত্তরঞ্জন দাশের সবকিছু ত্যাগের আদর্শের উল্লেখ করে লেখেন যে, আত্মত্যাগ, সরল জীবন, উচ্চ চিন্তা এবং দেশের কাজে সর্বান্তঃকরণে আত্মনিয়োগই হল তাঁর জীবনের লক্ষ্য। অরবিন্দ ঘোষের আদর্শ তাঁর কাছে রমেশচন্দ্র দত্তের কর্মপথের চেয়ে বেশি মহৎ, উন্নত ও অনুপ্রেরণাদায়ক। এক সপ্তাহ পরে আর একটি চিঠিতে তিনি অরবিন্দকে তাঁর “আধ্যাত্মিক গুরু” বলে শ্রদ্ধা জানান। জীবনের ওই সন্ধিক্ষণে শ্রীঅরবিন্দ ও স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে সুভাষ তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ২২ এপ্রিল (১৯২১) ভারত-সচিব ই.এস. মন্টেগুকে চিঠি লিখে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের প্রবেশনার্স (Probationers) তালিকা থেকে তাঁর নাম প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। তার দু’সপ্তাহ আগে (৬ এপ্রিল) শরৎচন্দ্রকে বসুকে নিজের মানসিক দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গে লেখেন, “মনের দীর্ঘ বিরোধ আমি মেটাতে সক্ষম হইনি। একদিকে স্বামী বিবেকানন্দ, অন্যদিকে অরবিন্দ ঘোষের প্রভাবে আমরা যারা বড় হয়েছি—দুর্ভাগ্যজনকভাবেই হোক আর সৌভাগ্যজনকভাবেই হোক তাদের মানসিকতা এইরকম দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত মতামতের মধ্যস্থ কোন কিছুকে গ্রহণযোগ্য মনে করে না।”

শেষপর্যন্ত যে মানসিকতায় সুভাষচন্দ্র গড়ে উঠেছিলেন তারই জয় হয়েছিল। যেদিন তিনি চিত্তরঞ্জনের সর্বস্ব ত্যাগের উল্লেখ করে চিঠিতে শরৎচন্দ্রকে কার্যত জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি সিভিল সার্ভিস প্রত্যাখ্যান করে বিকল্প “অন্ন সংস্থানের” মতো চাকরির কথা চিন্তা করেছেন, ওইদিনই (১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯২১) তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে কেমব্রিজ থেকে নিজের পরিচয়, ইংলন্ডে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সাফল্য, সরকারি চাকরি গ্রহণে তীব্র অনিচ্ছা ও দেশবন্ধুর স্বদেশসেবার কাজে যোগদানের ইচ্ছা জানিয়ে একটি চিঠি দেন। ওই ঐতিহাসিক চিঠিতে কংগ্রেস সম্বন্ধে তাঁর কিছু প্রস্তাবও ছিল। সুভাষচন্দ্র তাঁর নিজের ইচ্ছা সম্বন্ধে জানান যে, দেশে প্রত্যাবর্তন করে তিনি অধ্যাপনা ও পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির কাজ করলে খুশি হবেন। আরও জানান যে, তাঁর মনোগত বাসনার কথা শুধুমাত্র তাঁর বাবা ও দাদাকে জানিয়েছেন। এখনও তিনি আই সি এস-এ ‘শিক্ষানবিশ’ (Probationer)। সুতরাং তাঁর চিঠির কথা জানাজানি হওয়া কাম্য নয়। তিনি দেশবন্ধুকে লেখেন, “আমি আজ প্রস্তুত—আপনি শুধু কর্মের আদেশ দিন।” দু’সপ্তাহ পরে দেশবন্ধুকে জানান যে চাকরি ছাড়া সম্বন্ধে তিনি কৃতসঙ্কল্প। তিনি কী কী কাজ করতে পারেন সে বিষয়েও সুভাষ আবার লেখেন। কংগ্রেস সংগঠন ও কর্মসূচী কীভাবে আরও সুদৃঢ় এবং কার্যকর করা যেতে পারে সেই বিষয়ে তাঁর ভাবনা-চিন্তার কথা বিশদভাবে জানান।

শরৎচন্দ্র বসু সুভাষকে পরামর্শ দিয়েছিলেন দেশে ফেরার পর পদত্যাগ করাই সুবিবেচকের কাজ হবে। কিন্তু সুভাষ জানান যে কিছু আইনগত অসুবিধা ছাড়াও, ‘দাসত্বের প্রতীক চুক্তিপত্রে’ সই করা তাঁর পক্ষে কোনও মতেই সম্ভব নয়। প্রায় আট মাস আগে ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল (১ আগস্ট, ১৯২০)। শরৎচন্দ্র সেই প্রসঙ্গে লিখেছিলেন যে ওই আন্দোলনের তখন এক অস্পষ্ট ও বিশৃঙ্খল অবস্থা। এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ কোনও সিদ্ধান্ত না নিয়ে অপেক্ষা ও লক্ষ্য করাই ভাল। শরৎচন্দ্রের ইঙ্গিত ছিল যে, বর্তমান অবস্থায় সুভাষের রাজনৈতিক আন্দোলনে সরাসরি জড়িয়ে পড়া ঠিক হবে না। সুভাষচন্দ্র তার উত্তরে যা লেখেন তা ছিল তাঁর চরিত্র ও লৌহ সঙ্কল্পের পরিচয়। তিনি লেখেন, “আন্দোলন বিফল হওয়ার কিংবা শিথিল হওয়ার আশঙ্কাতেই আমি এখনই ঝাঁপিয়ে পড়তে চাই, যাতে অবস্থার উন্নতি ঘটাতে খুব বেশি দেরি না হয়ে যায়।” যেদিন মন্টেগুর কাছে পদত্যাগপত্র লেখেন সেইদিনই বন্ধু চারুচন্দ্র গাঙ্গুলীকে লেখেন, ‘Power, Property, Wealth’ যখন করতলগত তখন তাঁর মন তাঁকে বলেছে—‘এতে তোমার আনন্দ নেই। তোমার আনন্দ সমুদ্রের ঢেউ’এর সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে বেড়ানো’।

জানকীনাথ পুত্রের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করতে পারেননি। তাঁর দৃঢ় ধারণা ছিল যে সিভিল সার্ভিসে থেকেও সুভাষ দেশের মঙ্গল করতে পারবে। তাছাড়া, তাঁর মতে আগামী দশ বছরের মধ্যেই ভারতবর্ষ স্বায়ত্তশাসনের অধিকার অর্জন করবে। সুভাষ পিতার এই অভিমত ও যুক্তি মানতে পারেননি। তিনি ত্যাগের একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন। দেশে যে অসহযোগ আন্দোলনের জোয়ার চলছিল তার প্রেরণায় একজনও সিভিল সারভেন্ট চাকরি থেকে ইস্তফা দেননি। সুভাষ তা প্রথম করে সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। কেমব্রিজের সিভিল সার্ভিস বোর্ডের সচিব রবার্টস, সহকারী ভারত-সচিব স্যার উইলিয়াম ডিউক ও আরও অনেকেই সুভাষচন্দ্রকে তাঁর পদত্যাগের সিদ্ধান্ত পুনর্বিচার করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তাতে কোনও ফল হয়নি। বাবা-মা, অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় মেজদাদার অনুরোধ, পরামর্শ পর্যন্ত তিনি শোনেননি। এরজন্যে তিনি গভীর মনোবেদনা অনুভব করেছিলেন। কিন্তু আদর্শ ও কর্তব্যবোধের জন্যে তিনি তাও সহ্য করতে পেরেছিলেন। তবে সুভাষের এক গভীর সান্ত্বনা ছিল যে তাঁর মা তাঁকে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছিলেন। প্রভাবতী পুত্রকে চিঠি লিখে জানান যে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে তাঁর নিজের আস্থা আছে। মা’র ওই চিঠি পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে সুভাষচন্দ্র মেজদাদাকে লেখেন, “এটি আমার কাছে একটি স্থায়ী সম্পদ হয়ে থাকবে কারণ এটি আমার মন থেকে একটি ভারী বোঝা নামিয়ে দিয়েছে।” শরৎচন্দ্রও কিন্তু তাঁর স্নেহের অনুজের বলিষ্ঠ আদর্শবাদী সিদ্ধান্ত মনে মনে সমর্থন করেছিলেন। তাঁর উপদেশ সুভাষচন্দ্র না মানলেও তাঁর প্রতি শরৎচন্দ্রের গভীর স্নেহ এতটুকু কমেনি। পিতা জানকীনাথ যে পুত্রের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি তাও প্রত্যাশিত ছিল। তাঁর কর্মজীবন, সামাজিক প্রতিষ্ঠা, রাজ আনুগত্য ও চারিত্রিক গঠনের কথা মনে রাখলে এটা স্বাভাবিক মনে হবে। কিন্তু পুত্রের সৎ সাহস; আত্মত্যাগ ও গভীর স্বদেশপ্রেম এবং দেশের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক আন্দোলন তাঁকেও ক্রমেই বিচলিত করে তুলছিল। তারই পরিণতি রূপে তিনি কয়েক বছর পরেই তাঁর ‘রায়বাহাদুর’ খেতাব বর্জন করেছিলেন।

আই সি এস থেকে পদত্যাগের পর সুভাষচন্দ্র আরও কয়েক মাস কেমব্রিজে পড়াশোনা করে ট্রাইপোজ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তখন আর তাঁর পড়াশোনায় একেবারেই মন ছিল না। তাঁর মন তখন স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে জাতীয় আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে উন্মুখ। ট্রাইপোজে তাই তাঁর ফল তেমন ভাল হয়নি। অত্যন্ত মেধাবী বলেই তিনি প্রায় পড়াশোনা না করেই ওই কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছিলেন। দেশে ফিরতে এতই অধীর হয়েছিলেন যে, পরীক্ষা পাসের ‘ডিপ্লোমা’ নেবার জন্যেও তাঁর তর সয়নি। সতীর্থ বন্ধু ক্ষিতীশকে বলে যান তাঁর হয়ে ‘ডিপ্লোমা’টি সংগ্রহ করতে।

ইংলন্ডে সুভাষচন্দ্রের দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন দিলীপকুমার রায় ও ক্ষিতীশ চট্টোপাধ্যায়। তিন বন্ধুর সঙ্গে ধর্মবীর নামে এক পাঞ্জাবি ডাক্তার, তাঁর বিদেশিনী স্ত্রী ও তাঁদের দুই কন্যার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। প্রায়ই তাঁরা ওই পরিবারের বাড়িতে যেতেন। ডাঃ ধর্মবীরের স্ত্রীকে সুভাষচন্দ্র ‘দিদি’ বলতেন। ধর্মবীরদের দুই কন্যাকে তিনি ছোটবোনের মতো স্নেহ করতেন। ধর্মবীরদের বাড়িতে প্রায়ই গান ও কবিতা পাঠের আসর বসত। দিলীপকুমার গান গাইতেন। সুভাষ আবৃত্তি করতেন। ইংলন্ড ছেড়ে চলে আসার আগে শ্রীমতী ধর্মবীরকে এক চিঠিতে সুভাষচন্দ্র লেখেন যে ইংলন্ডে প্রবাস জীবনে তিনি কখনই সুখী হতে পারেননি। ভারত ও ব্রিটেনের রাজনৈতিক যা সম্পর্ক তাতে তা হওয়া সম্ভব নয়। প্রতিটি মুহূর্ত একজন স্পর্শকাতর ভারতীয়কে স্মরণ করিয়ে দেয় তার মাতৃভূমির করুণ অবস্থা। স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেই যে তিনি খুশি হতে পারবেন তা নয়। সেখানেও একই অনুভূতি তাঁকে অস্থির করে তুলবে। তবে তার একটাই সান্ত্বনা থাকবে—সেটি হল যে, স্বদেশে তিনি নতুন ভারত গড়ে তোলার কাজে সাধ্যমত কিছু করার চেষ্টা করবেন। শ্ৰীমতী ধর্মবীর সুভাষের কাছে ছিলেন মাতা ও ভগিনীর মতো। দেশে ফিরেও ধর্মবীর পরিবারের সঙ্গে তাঁর চিঠিতে যোগাযোগ ছিল। শ্রীমতী ধর্মবীরকে ভারত ভ্রমণে আসার অনুরোধ করে সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন যে, এদেশের অনেককিছুই তাঁদের ভাল লাগবে না। কিন্তু একটি নিশ্চয়তা তিনি দিতে পারেন—প্রাচ্যের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তেলা পাশ্চাত্যের মানুষের তুলনায় অনেক বেশি সহজ। আর একটি কথা—ভারতের মানুষের কাছে ‘সভ্যতা’র নিদর্শন বলতে কলকারখানা, আকাশচুম্বী বাড়ি বা সুন্দর সুন্দর সাজপোশাকের মালিকানা বোঝায় না। ভারতীয়দের কাছে উন্নত মানবাত্মা, দিব্যশক্তির সঙ্গে মানুষের নৈকট্যই সভ্যতার লক্ষণ। ভারতের মানুষ রাজনৈতিক নেতা, ধনকুবের বা ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করে না। কপর্দকহীন, একমাত্র ঈশ্বর-সম্বল কঠোর যোগী তপস্বীই তাদের কাছে অধিকতর শ্রদ্ধেয়।

সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার একটি ঘটনা তেমন পরিচিত নয়। পরীক্ষায় মুদ্রিত নির্দেশগুলিতে ভারতীয়দের প্রতি অপমানকর কিছু মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র। যেমন একটি নির্দেশে ‘ভারতে অশ্বের পরিচর্যা’ প্রসঙ্গে লেখা ছিল যে, ‘ভারতীয় সহিস তার অশ্ব যা খায় সেই একই খাদ্য খেয়ে থাকে।’ আর এক স্থানে লেখা ছিল, ‘ভারতীয় ব্যবসায়ীরা যে অসাধু তা একরকম প্রবাদবাক্যে দাঁড়িয়ে গেছে।’ এক বড় কর্তার কাছে গিয়ে এইরকম সব আপত্তিকর মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে তিনি প্রথমে রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে সুভাষকে বলেন, “দেখ, মিঃ বোস, যদি তুমি সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি স্বীকার না করো, তাহলে আশঙ্কা হয় তোমাকে বিদায় নিতে হবে।” চোখ রাঙানোতে কাজ না হওয়ায় তাঁর সুর নরম হয়। তিনি এই বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন বলে কথা দেন। দিন পনেরো পরে তিনি সুভাষকে ডেকে পাঠিয়ে জানান যে পরবর্তী মুদ্রণের সময় এইসব আপত্তিকর মন্তব্য বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। যাঁর কাছে সুভাষ প্রতিবাদ জানাতে গিয়েছিলেন, যাঁর সঙ্গে তাঁর বাদানুবাদ হয়েছিল তিনি হলেন মিঃ রবার্টস। এই রবার্টসই সুভাষকে তাঁর পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে বিশেষ অনুরোধ করেছিলেন।

সকল অধ্যায়

১. দেশনায়ক – ১
২. দেশনায়ক – ২
৩. দেশনায়ক – ৩
৪. দেশনায়ক – ৪
৫. দেশনায়ক – ৫
৬. দেশনায়ক – ৬
৭. দেশনায়ক – ৭
৮. দেশনায়ক – ৮
৯. দেশনায়ক – ৯
১০. দেশনায়ক – ১০
১১. দেশনায়ক – ১১
১২. দেশনায়ক – ১২
১৩. দেশনায়ক – ১৩
১৪. দেশনায়ক – ১৪
১৫. দেশনায়ক – ১৫
১৬. দেশনায়ক – ১৬
১৭. দেশনায়ক – ১৭
১৮. দেশনায়ক – ১৮
১৯. দেশনায়ক – ১৯
২০. দেশনায়ক – ২০
২১. দেশনায়ক – ২১
২২. দেশনায়ক – ২২
২৩. দেশনায়ক – ২৩
২৪. দেশনায়ক – ২৪
২৫. দেশনায়ক – ২৫
২৬. দেশনায়ক – ২৬
২৭. দেশনায়ক – ২৭
২৮. দেশনায়ক – ২৮
২৯. দেশনায়ক – ২৯
৩০. দেশনায়ক – ৩০
৩১. দেশনায়ক – ৩১
৩২. দেশনায়ক – ৩২
৩৩. দেশনায়ক – ৩৩
৩৪. দেশনায়ক – ৩৪
৩৫. দেশনায়ক – ৩৫
৩৬. দেশনায়ক – ৩৬
৩৭. দেশনায়ক – ৩৭
৩৮. দেশনায়ক – ৩৮
৩৯. দেশনায়ক – ৩৯
৪০. দেশনায়ক – ৪০
৪১. দেশনায়ক – ৪১
৪২. দেশনায়ক – ৪২
৪৩. দেশনায়ক – ৪৩
৪৪. দেশনায়ক – ৪৪
৪৫. দেশনায়ক – ৪৫
৪৬. দেশনায়ক – ৪৬
৪৭. দেশনায়ক – ৪৭
৪৮. দেশনায়ক – ৪৮
৪৯. দেশনায়ক – ৪৯
৫০. দেশনায়ক – ৫০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন