প্রেসিডেন্সি কলেজে সুভাষচন্দ্র যখন ভর্তি হলেন তখন তাঁর বয়স ষোল। কটকের শৈশব ও কৈশোরের পরিবেশ ও দিনগুলির সঙ্গে কলকাতার তফাৎ প্রায় আকাশ-জমিন। তার ওপর সুভাষের মনের মধ্যে তখন এক ঝড় চলেছে। তিনি স্থির করে ফেলেছেন যে, “গতানুগতিক পথে” চলবেন না। আধ্যাত্মিক কল্যাণ ও মানব-কল্যাণ তাঁর আদর্শ। দর্শন নিয়ে পড়াশোনা আর বাস্তব জীবনে ‘যতটা সম্ভব’ রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দকে অনুসরণ করা তাঁর লক্ষ্য। কিন্তু জীবনের বাস্তব সমস্যা সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা প্রায় কিছুই হয়নি। কটকের স্কুলের সহপাঠীদের তুলনায় প্রেসিডেন্সি কলেজের সহপাঠীদের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থা, জীবন সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গির অনেক পার্থক্য। কলেজে উচ্চবিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তিসম্পন্ন পরিবারের কিছু ছেলেদের একটি দল ছিল। শুধুমাত্র ‘বই-এর পোকা’ আর লেখাপড়ায় ‘ভাল ছেলে’ হতে চায় এমন আর একটি গোষ্ঠী ছিল। সুভাষচন্দ্রের মতো নিষ্ঠাবান উচ্চ আদর্শে বিশ্বাসী আর একদল ছাত্র ছিল। এরা নিজেদের রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ‘আধ্যাত্মিকতার উত্তরাধিকারী’ বলে ভাবত। এ ছাড়া ছিল অল্প কিছু ছেলে যারা বিপ্লবী মতবাদ ও দলের সঙ্গে যুক্ত।
প্রেসিডেন্সি কলেজে সুভাষচন্দ্র যখন পড়তে এলেন তখন তাঁর মানসিক গঠন কেমন ছিল, কলকাতার উচ্চ-মধ্যবিত্ত ‘বাবু’ সমাজ সম্পর্কে তিনি কী ধারণা পোষণ করতেন তা জানা দরকার। কেননা, শুধু প্রেসিডেন্সি কলেজ বলেই নয়, কলকাতার ছাত্র সমাজের বেশির ভাগই ছাত্রই ছিল ওইরকম পরিবারের। কটক থেকে তাঁর মাকে একটি চিঠিতে শ্লেষ ও বিদ্রুপের সঙ্গে সুভাষ লিখেছিলেন, “ভগবান কলি যুগে একটি নতুন সৃষ্টি করিয়াছেন—যাহা অন্য কোনও যুগে ছিল না। সেই নতুন—“বাবু” সৃষ্টি। আমরাই সেই “বাবু” সম্প্রদায়ভুক্ত। আমাদের ঈশ্বরদত্ত পদান আছে। কিন্তু আমরা ২০/২২ ক্রোশ হাঁটিয়া যাইতে পারি না—কারণ আমরা “বাবু”। আমাদের দুইটি অমূল্য হস্ত আছে—কিন্তু আমরা শারীরিক পরিশ্রমে কুণ্ঠিত হই—আমরা হস্তের উপযুক্ত ব্যবহার করি না—কারণ আমরা “বাবু”। আমাদের এই ঈশ্বরদত্ত সবল দেহ আছে কিন্তু আমরা শারীরিক পরিশ্রমকে “ছোটলোকের কাজ” বলিয়া ঘৃণা করি কারণ আমরা “বাবুলোক”। আমরা সব কাজে চাকরকে হাঁক মারি—আমাদের হাত-পা চালাইতে যে কষ্ট হয়—কারণ আমরা যে “বাবু”। গ্রীষ্মপ্রধান দেশে জন্মিলেও আমরা গ্রীষ্ম সহ্য করিতে পারি না কারণ আমরা “বাবু”। আমরা সামান্য শীতকে এত ভয় করি যে সর্বাঙ্গ বোঝায় চাপাইয়া রাখি কারণ আমরা ‘বাবু”। আমরা সর্বত্র “বাবু” বলিয়া পরিচয় দিই কারণ আমরা “বাবু”। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে আমরা মনুষ্যত্বহীন মনুষ্যরূপধারী পশু। পশু অপেক্ষা আমরা অধম—কারণ আমাদের জ্ঞান ও বিবেক আছে—পশুদিগের তাহাও নাই।” ভাবাবেগের উচ্ছ্বাসে কিশোর বালক গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে মাকে ওই চিঠিতে লিখেছেন, “আমি ভাবি—বাঙালি কবে মানুষ হইবে। কে বঙ্গমাতাকে উদ্ধার করিবে? কবে বাঙালি নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে শিখিবে?” চিঠির শেষে মাতা প্রভাবতীকে কিশোর সুভাষ লিখেছে, “এবার পাগলের মতো অনেক লিখিয়াছি। পড়িতে কষ্ট হয় তো ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিবেন।”
পুত্রের ওই ‘পাগলামি’ ভরা চিঠি মা ছিঁড়ে ফেলে দেননি। সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন। আর, রেখেছিলেন বলেই ভবিষ্যতের ‘নেতাজি’-র বিবর্তনের এক বিরল চিত্র ধরা রয়েছে। অনুমান করতে পারি যে, ওই চিঠি পড়ে একদিকে মা যেমন পুত্রের ভবিষ্যতের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন আশঙ্কিত হয়েছিলেন, অন্যদিকে তেমনি এমন এক অনন্য পুত্রের জননী বলে গর্ববোধও করেছিলেন। লক্ষণীয় হল যে সুভাষ তাঁর মনের সব কথা খোলামেলাভাবে লিখতেন তাঁর মাকে। মাকে তিনি নির্ভরযোগ্য বন্ধুর মতো মনে করতেন। মা প্রভাবতীও পুত্রের ধ্যানধারণা, আচরণ ও মতিগতিতে স্বভাবতই বিচলিত ও উদ্বিগ্ন হলেও কখনও জোর করে বাধা দেননি। ক্ষোভ ও অভিমানে চোখে জল এসেছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত অসীম মাতৃস্নেহে পুত্রকে সমর্থন করেছেন। এই প্রসঙ্গে একটি কাহিনী উল্লেখযোগ্য।
১৯১৬ সালের কথা। প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপক ওটেনকে লাঞ্ছনা করার অভিযোগে কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হবার পর (এই ঘটনার কথা পরে আসবে) সুভাষচন্দ্র কটকে ফিরে গিয়ে সমাজসেবার কাজে নেমে পড়েন। এই কাজে সুভাষ ও তাঁর সহকর্মীরা এক বড় সমস্যার মুখোমুখি হন। সমস্যাটি ছিল—অস্পৃশ্যতা। ছাত্রদের একটি হোস্টেল ছিল। এই হোস্টেলে একটি সাঁওতাল বাসিন্দা ছিল। তার নাম মাঝি। সেই সময় সাঁওতালদের নিম্নজাতি বলে মনে করা হত। তার থাকা নিয়ে কিছু আপত্তি-অশান্তি হলেও হোস্টেলের অন্য ছাত্ররা তা পাত্তা দেয়নি। কিছুদিন পর ওই সাঁওতাল ছেলেটি টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার সেবা শুশ্রূষা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। সুভাষ ও তাঁর বন্ধুরা ছেলেটির দেখাশোনা করতে থাকে। খবর পেয়ে, প্রভাবতী দেবী নিজে তাদের সঙ্গে যোগ দেন। সেবা-যত্ন করে মাঝিকে সুস্থ করে তোলেন। তাঁর মা এইভাবে একটি নিচু জাতের ‘অস্পৃশ্য’ ছেলেকে সেবা করতে এসেছেন দেখে সুভাষচন্দ্র পরম বিস্মিত হন ও গভীর আনন্দ পান। তখনকার দিনে অভিজাত উচ্চ বংশের কোনও মহিলার পক্ষে ছাত্রদের হোস্টেলে গিয়ে এক ‘অস্পৃশ্য’ রোগীর সেবা করা সহজ ছিল না।
প্রেসিডেন্সি কলেজের কথায় ফিরে আসি। সুভাষচন্দ্র কলেজে পড়তে আসার আগেই তাঁর নাম ছাত্র মহলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর প্রধান কারণ প্রবেশিকা পরীক্ষায় তাঁর দ্বিতীয় স্থান অধিকার করা। এই বিষয়ে সুভাষচন্দ্রের সহপাঠী ও নিকট বন্ধু দিলীপকুমার রায় তাঁর ‘আমার বন্ধু সুভাষ’ বইটিতে খুব সরলভাবে স্মৃতিচারণ করেছেন। দিলীপকুমার নিজে কলকাতার মেট্রোপলিটান স্কুলে পড়তেন। ওঁদের ক্লাসের সবচেয়ে ভাল ছাত্র ছিলেন ক্ষিতীশ চট্টোপাধ্যায়। ক্লাসের অন্য সব ছেলেরা ক্ষিতীশকে খুব শ্রদ্ধা ও সমীহ করত। তার থেকেও ভাল কোনও ছাত্র থাকতে পারে এটা তারা বিশ্বাসই করত না। একদিন নিবারণ নামে একটি ছেলে হঠাৎ বলল, “রেখে দে তোদের ক্ষিতীশকে। আমাদের কটকে র্যাভেন শ’ স্কুলে সুভাষ বলে একটি ছেলে পড়ে। তার কড়ে আঙুলের নখের কাছেও ক্ষিতীশকে ঘেঁষতে হয় না। জানকীনাথ বোসের ছেলে সুভাষ, হীরের টুকরো ছেলে। এই বলে দিলাম। ক্ষিতীশ তার কাছে স্রেফ নট্ কিচ্ছু নাথিং।” নিবারণ মেট্রোপলিটান স্কুলেরই ছাত্র। বাড়ি কটকে। তার কথা শুনে সবাই অবাক, অখুশি। দিলীপকুমার তার কথা তো হেসেই উড়িয়ে দিলেন। কিন্তু প্রবেশিকা পরীক্ষার ফল বেরতে সবাই অবাক। প্রথম হয়েছে মিত্র স্কুলের প্রমথ সরকার। দ্বিতীয় সুভাষচন্দ্র বসু। আর ক্ষিতীশ পেয়েছে সপ্তম স্থান। নিবারণ এবার বিজ্ঞের মতো হেসে বলল, “কী, এবার?” দিলীপকুমার আর অন্যদের মুখে কথা নেই। কী তাজ্জব ব্যাপার! কটকের ছেলে কলকাতার বাঘা বাঘা ছেলেদের টপকে দ্বিতীয়! কিন্তু সেই থেকে দিলীপকুমারের কাছে সুভাষচন্দ্র হয়ে উঠলেন সত্যিই ‘হীরের টুকরো’। দু’জনেই ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। প্রথম দেখা হল দু’জনের। অল্প দিনের মধ্যেই সুভাষ আর দিলীপ হয়ে উঠলেন প্রিয় সহপাঠী, সহমর্মী।
কটকে স্কুল জীবনের দিকে ফিরে তাকিয়ে সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন যে, সকলে তাঁকে একগুঁয়ে খামখেয়ালি ও অবাধ্য বলেই ধরে নিয়েছিল। কথাটা একেবারে ভুল নয়। সত্যিই তিনি প্রচলিত ধারণায় বাধ্য সুবোধ ভাল ছেলে ছিলেন না। সুভাষ যে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল না। কিন্তু ভাল ছেলের মতো মাথা গুঁজে একমনে পড়াশোনা না করে তিনি সাধুদের পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছেন, নিজের বিচারবুদ্ধি মতো যা ভাল মনে করছেন তাই করছেন, কারও কথায় বা ভয়ে যা করবেন স্থির করছেন তার থেকেও একটুও নড়ছেন না, এসব শিক্ষক, অভিভাবকস্থানীয় বা পিতা-মাতার মনঃপূত হবার কথা নয়। কিন্তু পরীক্ষায় ভাল ফল করে তিনি সবাইকে যেমন অবাক ও খুশি করলেন, তেমনই দেখালেন তিনি অন্য ধাতুতে গড়া। কোনও বাঁধা ছকে তাঁকে ফেলা বা মাপা সম্ভব নয়।
১৯১৩ সালে যখন সুভাষচন্দ্র কটক থেকে কলকাতায় এলেন তার অল্প কিছুকাল আগে স্বদেশী আন্দোলনের প্রবল জোয়ার শেষ হয়েছে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন রূপে শুরু হয়ে স্বদেশী আন্দোলন শুধুমাত্র বাংলাদেশেই নয়, সারা ভারতবর্ষে এক বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। জাতীয় চেতনা তথা স্বাধীনতা সংগ্রামকে নতুন স্তরে পৌঁছে দিয়েছিল, যদিও সামগ্রিকভাবে স্বদেশী আন্দোলনের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। স্বদেশী আন্দোলনের ফলে বিপ্লবী চিন্তাধারা ও তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর ফলে কংগ্রেসের মূলত নিয়মান্ত্রিক পথে পরিচালিত জাতীয় আন্দোলনের পাশাপাশি সশস্ত্র বিপ্লব আন্দোলনের এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছিল। দেশের, বিশেষ করে বাংলার, এই রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও পরিবেশ ছাত্রদের প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করেছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজ যে এর ব্যতিক্রম ছিল না তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদের ‘দুর্নাম’ ছিল। কলেজের প্রধান হোস্টেলে (ইডেন হিন্দু হোস্টেল) প্রায় পুলিশি তল্লাশি চলত। গোয়েন্দা বিভাগের সন্দেহ ছিল যে, ওই হোস্টেলে বিপ্লবীদের প্রায়ই গোপন মিটিং হয়।
সুভাষচন্দ্রে মনের মধ্যে তখন প্রচণ্ড দ্বন্দ্ব ও সংশয় চলেছে। ধর্মীয় আবেগ ও আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা, স্বদেশ-কল্যাণ চিন্তা, সমাজ সেবার আদর্শ, দেশের বর্তমান দুরবস্থা ও তার প্রতিকারের পথ—সবকিছু মিলিয়ে তাঁর মনে এক অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও সংশয় সৃষ্টি করেছিল। সবকটি চিন্তা ও লক্ষ্যের মধ্যে এক সমন্বয় ও সংযোগ স্থাপনের অনুভূতি তাঁর হলেও, তা তখনও তেমন গভীর ও সুদৃঢ় হয়নি। তাঁর ‘জীবন জিজ্ঞাসা’র সঠিক উত্তরের সন্ধান পান তিনি প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের জীবন ও বাণীতে।
কলেজ জীবনের সূচনায় সুভাষচন্দ্র যেসব মনীষী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন তাঁদের মধ্যে ছিলেন শ্রীঅরবিন্দ। ওই প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র লিখেছেন যে শ্রীঅরবিন্দ তখন এক কিংবদন্তি পুরুষ হয়ে উঠেছেন। কোনও নেতা সম্বন্ধে লোককে এমন গভীর উৎসাহের সঙ্গে কথা বলতে তিনি খুব কমই দেখেছেন। এ সময় গুজব রটেছিল যে শ্রীঅরবিন্দ বারো বছর ধরে ধ্যান সাধনার জন্যে পণ্ডিচেরীতে আশ্রয় নিয়েছেন। এই সময়কাল পূর্ণ হলে গৌতম বুদ্ধের মতো বোধিপ্রাপ্ত হয়ে তিনি আবার স্বদেশের মুক্তির জন্যে সক্রিয় জীবনে ফিরে আসবেন। সুভাষচন্দ্র বলেছেন, “অরবিন্দের নাম ঘিরে যে মরমিয়তার মণ্ডল তা আমার মনে রেখাপাত করেনি, আমায় আকৃষ্ট করেছিল তাঁর রচনা ও চিঠিপত্র।” অরবিন্দ তখন ‘আর্য’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ওই পত্রিকায় তিনি তাঁর দর্শন ব্যাখ্যা করতেন। বাংলার কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে তিনি চিঠিপত্রও লিখতেন। তাঁর ওই লেখা আর চিঠিপত্র সুভাষচন্দ্রের সহপাঠীদের মধ্যে একজন কেউ উচ্চকণ্ঠে পড়তেন। অন্যরা তা শুনতেন, উদ্দীপ্ত হতেন। সুভাষচন্দ্রের মনে অরবিন্দের একটি উক্তি বিশেষ দাগ কেটেছিল—জাতীয় সেবাকে ফলপ্রসূ করতে হলে আধ্যাত্মিক আলোকপ্রাপ্তি অত্যাবশ্যক।
তরুণ ছাত্র সুভাষচন্দ্রের জীবনে অরবিন্দের স্থায়ী প্রভাব কতটা ছিল তা নিয়ে কিছুটা সংশয় বোধহয় সুভাষের নিজের মনেই ছিল। আর, এই সংশয়ের মূলে ছিল সুভাষের মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্ব। জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে এক দৃঢ় প্রত্যয়ের অভাব। মনে হয় একদিকে স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি তাঁর গভীর আকর্ষণ, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস, অন্যদিকে অরবিন্দের দর্শন ও দিব্যজীবন লাভের পথ নির্দেশ—এই দুই-এর মধ্যে কোনটি তাঁর নিজের জীবনে অধিকতর আকর্ষণীয় ও প্রভাবশালী সে নিয়ে তিনি আত্মসমীক্ষা করেছিলেন বেশ কিছুকাল ধরে। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন যে অরবিন্দের গভীর দর্শন চিন্তা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। “আমার গায়ে কাঁটার মতো বিধে ছিল শঙ্করের মায়াবাদ। তার অনুযায়ী আমি চলতেও পারছিলাম না, তার থেকে অব্যাহতিও মিলছিল না সহজে। আরেকটি কোনও দর্শনের বিকল্প আমার প্রয়োজন হয়েছিল।” রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ‘ঈশ্বর ও সৃষ্টির সাযুজ্যের কথা” তাঁর মনে দাগ কাটলেও তিনি তখনও ‘মায়ার লতাজাল’ থেকে মুক্ত হতে পারেননি। এই বন্ধন মুক্তিতে সুভাষকে সাহায্য করেছিলেন অরবিন্দ। সার্বিক চারিত্রিক বিকাশের জন্যে জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মের প্রয়োজনের কথা বিবেকানন্দও বলেছিলেন। কিন্তু অরবিন্দের যোগসমন্বয় ও জ্ঞানমার্গে সত্যে পৌঁছবার প্রণালীর মধ্যে সুভাষচন্দ্র মৌলিক ও অদ্বিতীয় কিছু পেয়েছিলেন। এই বিষয়ে অরবিন্দের রচনা তাঁর কাছে ‘সজীবক ও প্রেরণাময়’ মনে হয়েছিল। অরবিন্দের স্বাধীনতার অখণ্ড রূপের বাণী সুভাষচন্দ্রের প্রজন্মের কাছে এক স্বপ্নময় সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছিল। এই স্বপ্ন বিবেকানন্দও দেখেছিলেন। কিন্তু বিবেকানন্দের যুগে রাষ্ট্রচিন্তায় তার প্রবেশ তখনও ঘটেনি।
সুভাষচন্দ্রের জীবনে অরবিন্দের প্রভাব, অরবিন্দের প্রতি গভীরতর আকর্ষণের পিছনে অন্যতম কারণ ছিল দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব, উভয়ের পারস্পরিক প্রীতি ও শ্রদ্ধা। সুভাষচন্দ্র এক সময়ে চেয়েছিলেন দিলীপকুমার সক্রিয় রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দেন। কিন্তু দিলীপকুমার প্রিয় বন্ধুর একান্ত ইচ্ছা পূর্ণ না করে ১৯২৮ সালে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে শ্রীঅরবিন্দের পণ্ডিচেরীর আশ্রমে জীবনযাপনের জন্যে চলে যান। এতে সুভাষচন্দ্র গভীর দুঃখ পেলেও দুই বন্ধুর মধ্যে সম্পর্ক অটুট ছিল। উভয়ের মধ্যে চিঠিপত্রে, কথাবার্তায় বারবার অরবিন্দ প্রসঙ্গ উঠেছে।
দিলীপকুমার স্বভাবতই চেয়েছিলেন অরবিন্দের প্রতি সুভাষচন্দ্রকে আরও বেশি আকৃষ্ট করে তুলতে। অরবিন্দের প্রতি শ্রদ্ধা বরাবরই অটুট থাকলেও সুভাষচন্দ্রের কিন্তু স্থির বিশ্বাস ছিল যে তাঁর জীবনে, দেশের মুক্তি সাধনে ও বাস্তবধর্মী অগ্রগতির জন্যে, স্বামী বিবেকানন্দের নির্দিষ্ট পথই অধিকতর প্রয়োজন ও কার্যকর। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ও মনের কথাটি অত্যন্ত সুন্দর ও সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছিলেন দিলীপকুমার রায়কে মান্দালয় জেল থেকে লেখা একটি চিঠিতে (৯ অক্টোবর, ১৯২৫)। বন্ধুর চিঠির প্রত্যুত্তরে সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন, “তুমি শ্রীঅরবিন্দ সম্বন্ধে যা লিখেছ, তার সবটা না হলেও বেশির ভাগই আমি মানি। তিনি ধ্যানী, আর আমার মনে হয়, বিবেকানন্দের চেয়েও গভীর, যদিও বিবেকানন্দের প্রতি আমার শ্রদ্ধা প্রগাঢ়। আমিও তোমার কথায় সায় দিই যে, ‘নীরব ভাবনা, কর্মবিহীন বিজন সাধনা’ সময়ে সময়ে দরকার হয়, এমনকি দীর্ঘকালের জন্যেও। কিন্তু আশঙ্কা এই যে, সমাজের বা জীবনের স্রোত থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখলে মানুষের কর্মের দিকটা পঙ্গু হয়ে যেতে পারে, আর তার প্রতিভার একপেশে বিকাশের ফলে সে সমাজবিচ্ছিন্ন অতি মানুষের মতন কিছু একটা হয়ে উঠতে পারে। অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন দু-চারজন প্রকৃত সাধকের কথা অবশ্য আলদা, কিন্তু বেশির ভাগ লোকের পক্ষে ধর্ম বা লোকহিতই সাধনার একটি প্রধান অঙ্গ। নানা কারণে আমাদের জাতির কর্মের দিকটা শূন্য হয়ে এসেছে। তাই এখন আমাদের দরকার রজোগুণের “double dose” …সাধক নিজে হয়তো নিস্তেজকারী সকল প্রভাব এড়িয়ে চলতে পারেন,—কিন্তু চেলারা?”
সুভাষচন্দ্রের মনের কথাটি ছিল যে, মানব সমাজের আদর্শ গুরুরূপে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্যে আবশ্যক ছিল সক্রিয় জীবনে অরবিন্দের প্রত্যাবর্তন। তাঁর ওই ইচ্ছা ও অভিমত নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু আশৈশব সুভাষচন্দ্র বাক্যে ও কর্মে নির্ভীক ছিলেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন