আইন অমান্য আন্দোলন, বিপ্লবী তৎপরতা বৃদ্ধি ও বিভিন্ন আনুষঙ্গিক কারণে জেলগুলিতে বন্দীর সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। প্রতিদিনই দলে দলে নতুন রাজনৈতিক বন্দী আসার ফলে কারাগারগুলিতে স্থান সঙ্কুলানের চরম সমস্যা দেখা দেয়। প্রায়ই জেলের প্রহরীরা ধৈর্যচ্যুত হয়ে বন্দীদের ওপর শারীরিক নিগ্রহ করতে থাকে। একদিন (২২ এপ্রিল, ১৯৩০) অবস্থা চরমে ওঠে। নবাগত কিছু বিপ্লবী বন্দীদের ওপর আলিপুর জেলের প্রহরীরা বর্বর আক্রমণ করলে সুভাষচন্দ্র, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ও অন্যান্য বিশেষ শ্রেণীর বন্দীরা (Special class prisoners) এর প্রতিবাদে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি তুলে চিৎকার শুরু করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে জেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট তাঁর প্রহরীবাহিনী সমেত Special Yard-এ এসে তাঁদের ওপরও নৃশংসভাবে আক্রমণ করে। যতীন্দ্রমোহনকে জোর করে তাঁর সেলে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। সুভাষচন্দ্রের ওপর আক্রমণ ছিল আরও নির্মম। তিনি কিছুক্ষণের জন্যে অজ্ঞান হয়ে যান। সারা দেহে তিনি আঘাত পান ও তাঁর প্রবল জ্বর হয়। সত্যরঞ্জন বক্সী ও অন্য কয়েকজন সহবন্দী সুভাষচন্দ্রকে কোনওক্রমে তুলে নিয়ে তাঁর সেলে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার ডাকার জন্যে বলেন। কিন্তু তাঁদের কথায় কোনও কান দেওয়া হয়নি। এই ঘটনার কথা রটে যায়। এমনকি গুজব রটে যে সুভাষচন্দ্র ও যতীন্দ্রমোহন মারা গেছেন। জেল গেটের বাইরে জনতা উত্তেজিত হয়ে পড়ে সঠিক খবর জানার জন্যে। সৌভাগ্যবশত সুভাষচন্দ্র অল্প দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে ওঠেন। এই অভিজ্ঞতা সুভাষচন্দ্রের মনে ব্রিটিশ শাসনের চণ্ডরূপ সম্বন্ধে কী ধারণার সৃষ্টি করেছিল তা অনুমেয়। যথারীতি জেল কর্তৃপক্ষ নির্লজ্জের মতো সমস্ত ঘটনাটি অস্বীকার করে এক বিবৃতি দিয়েছিল। গান্ধীজি, জওহরলাল প্রমুখ নেতারাও একাধিক কারাগারে বন্দী ছিলেন। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের মতো এত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন তাঁদের বা অন্য কোনও সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতাকে জেলের মধ্যে সহ্য করতে হয়েছিল বলে জানা যায় না। অপেক্ষাকৃত অল্পখ্যাত, সাধারণ কংগ্রেস কর্মী ও বিপ্লবীদের ওপর অবশ্য অনেক অমানবিক অত্যাচার হয়েছিল। অনেকে জেলের মধ্যেই লোকচক্ষুর অন্তরালে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
১৯৩০ সালের ২২ আগস্ট সুভাষচন্দ্র কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। তিনি তখনও কারাগারে। তাঁর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলা প্রদেশ কংগ্রেসের অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকট হয়েছিল। এক মাস পরে সুভাষচন্দ্র মুক্তি লাভ করেন ও পরের দিন (২৩ সেপ্টেম্বর) মেয়ররূপে বিপুল উচ্ছ্বাস ও অভিনন্দনের মধ্যে শপথ গ্রহণ করেন। কর্পোরেশনের সভায় মেয়ররূপে তাঁর ভাষণে প্রথমেই তিনি স্মরণ করেন দেশবন্ধুর প্রতি তাঁর অসীম ঋণ। তাঁর যদি কোনও গুণ আদৌ থাকে তা হল, তিনি (সুভাষচন্দ্র) “দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের এক বিশ্বস্ত এবং উৎসাহী অনুগামী।” কর্পোরেশনের সমস্যার সমাধানের জন্যে তিনি যে কর্মসূচীর উল্লেখ করেন তা মূলত ইতিপূর্বে তিনি চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার রূপে যা কার্যকর করতে চেষ্টা করেছিলেন তার পুনরাবৃত্তি। সকল সম্প্রদায়ের প্রতি ন্যায়পরায়ণ ও নিরপেক্ষ হওয়ার ওপর তিনি গুরুত্ব দেন। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভারতবর্ষ বিপ্লবের যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে, তা হিংসকই হোক বা অহিংসই হোক। “ব্রিটিশদের সঙ্গে আমাদের অপরিহার্য কোনও বিবাদ আছে বলে আমি মনে করি না। পৃথিবীটা আমাদের উভয়ের স্থান দেওয়ার মতো যথেষ্ট বড়। আমরা স্বাধীন মানুষ এবং বন্ধুর মতো বাঁচতে চাই।” পরিশেষে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন, “আমরা সেই দিনটি আকুলভাবে আকাঙ্ক্ষা করছি, যে দিন ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আসবে এবং পৃথিবীর সর্বত্র আসবে শান্তি।”
তাঁর ভাষণেই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও প্রবণতা সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের মনোভাব সুস্পষ্ট হয়েছিল। সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য থেকে কোনও মতেই সরে যেতে তিনি সম্মত ছিলেন না। তিনি বলেন, তাঁর ‘রাজনৈতিক অধৈর্যের’ কথা কেউ কেউ তুলেছেন। কিন্তু এ অভিযোগ ঠিক নয়। ‘রাজনৈতিক অধৈর্য’ নামক অসুখে তিনি কখনও ভুগেছেন বলে নিজে জানেন না। সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে অধৈর্য (impatient) হবার সমালোচনা বা অভিযোগ গান্ধীজি থেকে শুরু করে অনেক বিশিষ্ট নেতা এবং সমসাময়িক ঐতিহাসিকেরাও করেছেন। সত্যিই কিছু নীতি ও প্রশ্নে ধৈর্যের ও নমনীয়তার (flexibility) অভাব তাঁর মধ্যে ছিল। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু তারই সঙ্গে বিচার্য হল, ‘অধৈর্য’ হওয়া মানেই একটি দোষ বা দুর্বলতা বোঝায় কি না। বাংলা অভিধানে ‘অধৈর্য’ কথাটির বিভিন্ন অর্থের মধ্যে রয়েছে— ‘ব্যাকুল’, ‘অস্থির’, ‘কাতর’, ‘অধীর’। মনে হয়, সুভাষচন্দ্র এইসব অর্থেই পূর্ণ স্বাধীনতার জন্যে ‘অধৈর্য’ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল যে, যখনই স্বাধীনতা সংগ্রাম দুর্বার গতি ও শক্তি অর্জন করার মুখে তখনই গান্ধীজি তার রাশ টেনে ধরছেন। তিনি গণশক্তি ও বিক্ষোভকে জাগ্রত করলেও সঙ্কটমুহূর্তে আপস নীতি গ্রহণ করছেন। কংগ্রেসের বড় বড় নেতাদের গান্ধীজির ওই নীতির প্রতিবাদ করার মতো সাহস ও নৈতিক বল নেই। এর ব্যতিক্রম জওহরলালও হতে পারেননি, যদিও এক সময় তাঁকে ও সুভাষচন্দ্রকে নবীন ‘বামপন্থী’দের মুখপত্র ও নেতা রূপে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
বাংলার বিপ্লবী ও তরুণ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দৃষ্টিতে গান্ধীজির নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি কতটা ক্ষোভের সৃষ্টি করছিল তার একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করি। ১৯৩০ সালে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে থাকাকালে সুভাষচন্দ্র রোজনামচা লিখেছিলেন। ক’দিন ধরেই রাজনৈতিক বন্দীদের মধ্যে বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ইতিহাস, দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা চলছিল। একদিন নৃপেন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কয়েকজন ‘তার্কিক’ যুবকের গান্ধীজিকে নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু হয়। কয়েক ঘণ্টা তর্কের পর নৃপেনবাবু বুঝতে পারলেন যে তাঁর অবস্থা ক্রমেই অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে। তরুণ বিপ্লবীরা তাঁকে প্রায় ‘চরমপত্র’ দিয়ে জানিয়ে দিলেন যে, আজকের কোনও নেতা যদি না তাঁর অনুগামীদের কথায় কান দেন তাহলে তিনি নেতৃত্ব হারাতে বাধ্য। নৃপেনবাবুও যদি তা না বোঝেন ও তাঁর মত (অবশ্যই গান্ধীজি সম্পর্কে) পরিবর্তন না করেন তাহলে তাঁরা বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারেন। এর পর আর নৃপেনবাবু ওই বিষয়ে আলোচনা করেননি। এই আপাত ছোট্ট ঘটনাটি ইঙ্গিতবাহী ছিল।
গান্ধী-আরউইন চুক্তিতে সুভাষচন্দ্র খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তাঁর দৃঢ় ধারণা হয়েছিল, যেসব ‘ধনী অভিজাতরা’ ও আপস-মীমাংসায় উৎসুক রাজনীতিবিদরা গান্ধীজিকে ঘিরে ছিলেন তাঁরাই গান্ধীজিকে আরউইনের সঙ্গে দেখা করতে উৎসাহিত করেছিলেন। ভাইসরয় আরউইনকে সুভাষচন্দ্র একজন উদার দৃষ্টিভঙ্গির রাজনীতিক বলে মনে করতেন। তাঁর মধ্যে এক স্বাভাবিক ন্যায় ও বিচারবোধ ছিল বলে সুভাষচন্দ্র স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু গান্ধী-আরউইনের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল তার শর্তগুলি তাঁর কাছে অভাবনীয় ছিল। যে উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে আইন অমান্য আন্দোলন হয়েছিল তার সম্বন্ধে চুক্তিতে কার্যত কোনও উল্লেখ করা হয়নি। আসন্ন দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে কংগ্রেস যে শর্তে যোগ দিতে সম্মত হয়েছিল তাতে কংগ্রেসের জিত হয়েছে এমন কোনও ইঙ্গিত ছিল না। সুভাষচন্দ্রের মনে হয়েছিল যথেষ্ট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এমন কোনও কংগ্রেস নেতা ছিলেন না যিনি গান্ধীজিকে প্রভাবিত করতে পারেন। একমাত্র মতিলাল নেহরু হয়তো পারতেন, কিন্তু তিনি তখন গুরুতরভাবে অসুস্থ। সুভাষচন্দ্র সবচেয়ে বেশি ক্ষুন্ন এবং হতাশ হয়েছিলেন জওহরলালের ভূমিকায়। জওহরলাল একটি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিলেন, তিনি ওই চুক্তির কতকগুলি শর্ত অনুমোদন করেন না, কিন্তু একজন ‘আজ্ঞাবহ সৈনিক’ হিসেবে তিনি তা মেনে নিয়েছেন। কিছুটা শ্লেষের সঙ্গে জওহরলালের বিবৃতি সম্বন্ধে সুভাষচন্দ্র মন্তব্য করেছিলেন, জওহরলাল শুধু “একজন আজ্ঞাবহ সৈনিক নন, বরং তার বেশি কিছু, দেশবাসীর এই রকমই ধারণা ছিল”।
গান্ধীজির ভূমিকা সম্পর্কেও সুভাষচন্দ্রের সমালোচনা ছিল খুবই তীক্ষ্ম। তিনি বিশ্লেষণ করেছিলেন যে বুদ্ধিমান ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ বুঝেছিলেন কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও বোঝাপড়ায় আসতে হলে সবচেয়ে বড় ভরসা হল গান্ধীজি, কেননা, তাঁদের মতে “ভারতের ইংরাজদের প্রহরীদের মধ্যে গান্ধী ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ” (‘…the best policeman the Britisher had in India’)। এই অভিমত প্রথমে ব্যক্ত করেছিলেন এলেন উইলকিনসন (Ellen Wilkinson)। তিনি ইন্ডিয়া লীগের প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য হিসেবে ভারত ভ্রমণে এসে (১৯৩২) ওই মন্তব্য করেছিলেন। সাম্প্রতিক কালে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক মাইকেল এডওয়ার্ডস (Michael Edwardes) তাঁর ‘Last Years of British India’ গ্রন্থে লিখেছেন, গান্ধীজির উদ্দেশ্য ছিল হিংসাকে নিয়ন্ত্রণ করা। গান্ধীজিকে তিনি ‘a neutralizer of rebellion’ বলে অভিহিত করেছেন। গান্ধীজি সম্বন্ধে এই অভিমত প্রশংসাসূচকই ছিল। তিনি যে প্রকৃতই অহিংসার আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের মধ্যেও শান্তি অব্যাহত রাখার প্রয়াসী ছিলেন, কখনই সশস্ত্র অভ্যুত্থানের কথা ভাবেননি এটা তাঁদের কাছে গান্ধীজির মহত্বের এক বৈশিষ্ট্য ছিল। দেশে-বিদেশে বহু ঐতিহাসিক ও বিদগ্ধ মানুষ তাঁর সম্বন্ধে অনুরূপ ধারণা পোষণ করেন। কিন্তু সমকালীন পটভূমি ও পরিস্থিতিতে, যখন ইংরাজ শাসনের উচ্ছেদের জন্যে সংগ্রাম তুঙ্গে উঠেছে, তখন জনসাধারণের কাছে ও সুভাষচন্দ্রের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামীর কাছে গান্ধীজির ওই ভূমিকা সমর্থন করা এবং মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল। সুভাষচন্দ্র ও তাঁর মতো ‘বামপন্থী’দের (কথাটি বর্তমান যুগের পরিপ্রেক্ষিতে অনুপযুক্ত ও অপপ্রয়োগ মনে হতে পারে) দৃষ্টিতে গান্ধীজির ওই ভূমিকা আন্দোলনের পক্ষে ক্ষতিকর বলে মনে হয়েছিল। জওহরলালের মতো আরো অনেকেই গান্ধীজির সিদ্ধান্তে অখুশি হয়েছিলেন। কিন্তু তা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করার সাহস তাঁদের ছিল না। সুভাষচন্দ্রের ছিল।
গান্ধী-আরউইন চুক্তির কয়েকদিন পরেই করাচিতে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে (মার্চ, ১৯৩১) এই চুক্তি অনুমোদিত হয়। সুভাষচন্দ্র বাস্তব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বুঝেছিলেন, করাচি কংগ্রেসে বিরোধিতা করে কোনও লাভ হবে না। ওই চুক্তির অনুমোন অবধারিত। সুতরাং অধিবেশনে মতভেদ সৃষ্টি করা সমীচীন হবে না। তাঁর এই সিদ্ধান্তের পিছনে আর একটি কারণ ছিল। সুভাষচন্দ্র কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র হবার পরও বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর বক্তৃতা-সফর অব্যাহত রেখেছিলেন। এই রকম এক সফরে মালদায় প্রবেশ করার সময় তাঁকে স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষ জানায় যে তাঁর মালদায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই আদেশ অমান্য করার চেষ্টা করলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিচারে তাঁর এক সপ্তাহের কারাদণ্ড হয়। মুক্তিলাভ করার পরই তিনি জানতে পারেন যে, আসন্ন স্বাধীনতা দিবস (২৬ জানুয়ারি, ১৯৩১) পালন উপলক্ষে কলকাতার ময়দানে কংগ্রেসের পরিকল্পিত একটি শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই আদেশ মেনে নেবার পাত্র সুভাষচন্দ্র ছিলেন না। নির্দিষ্ট দিনটিতে কলকাতার মেয়ররূপে সুভাষচন্দ্র কর্পোরেশর কার্যালয় থেকে ময়দানের মনুমেন্ট (বর্তমানে শহীদ মিনার) অভিমুখে এক শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেন। শোভাযাত্রার ওপর পুলিশের লাঠিচার্জে তিনি গুরুতরভাবে আহত হন। আক্রমণে ঘোড়সওয়ার পুলিশও যোগ দিয়েছিল। উন্মত্ত প্রতিহিংসাপরায়ণ পুলিশ আহত মেয়রকে লালবাজার লক-আপে বিনা চিকিৎসা, বিনা আহারে রেখে দেয়। পরের দিন আদালতে বে-আইনী সমাবেশে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও জননিরাপত্তা বিঘ্ন করার অপরাধে তাঁর ছ’মাসের কারাদণ্ড হয়। সুভাষচন্দ্র ওই বিচারের প্রহসনে কোনও অংশ নেননি। তিনি শুধু বলেন, লালবাজারের অবস্থা যে কোনও সভ্য সরকারের পক্ষে এক কলঙ্ক। লালবাজার লক-আপে, অন্যান্য জেলে ও মান্দালয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার ফলে সুভাষচন্দ্র বন্দীদের প্রতি অমানবিক ব্যবহারের অবসান এবং জেলগুলির শোচনীয় অবস্থার জরুরি সংস্কার সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করেছিলেন। তিনি স্থির করেছিলেন সুযোগ পেলেই এই বিষয়ে উদ্যোগী হবেন। সে সুযোগ তিনি কখনও পাননি। আজও সেই জঘন্য মানসিকতা ও পরিবেশের উল্লেখযোগ্য কোনও পরিবর্তন হয়নি।
গান্ধী-আরউইন চুক্তির শর্তানুসারে অহিংস আন্দোলনের জন্যে কারারুদ্ধ সব রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া হয়। সুভাষচন্দ্র মুক্তিলাভ (৮ই মার্চ) করেই বোম্বাই গিয়ে গান্ধীজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সমগ্র পরিস্থিতি ও আসন্ন করাচি অধিবেশন সম্বন্ধে আলোচনা করা সঙ্গত মনে করেন। বোম্বাই যাত্রার পূর্বে তিনি ঘোষণা করেন, “জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্বাধীনতা লাভের কথা বলব, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ বা দ্বিধা নেই।” গান্ধীজির সঙ্গে কথা বলার পর তিনি ঠিক করবেন দেশের প্রকৃত মঙ্গলসাধনের জন্যে কী পন্থা গ্রহণ করা উচিত। তাঁর সঙ্গে গান্ধীজির দীর্ঘ আলোচনা হয়। সুভাষচন্দ্র খোলাখুলি জানান যে, যতদিন গান্ধীজি স্বাধীনতার পক্ষে থাকবেন ততদিন তাঁরা তাঁকে সমর্থন জানাবেন। কিন্তু যখনই তিনি ওই লক্ষ্য থেকে সরে যাবেন তখনই তাঁর বিরুদ্ধে লড়াই করা তাঁদের কর্তব্য হবে। আলোচনার পর গান্ধীজি আশ্বাস দেন যে, আসন্ন দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে কংগ্রেস প্রতিনিধিদলের ক্ষমতা সীমিত করার জন্যে তিনি করাচি কংগ্রেসে প্রস্তাব করবেন; লাহোর কংগ্রেসে স্বাধীনতার অর্থ সম্বন্ধে যে ব্যাখ্যা করা ইতিপূর্বেই হয়েছে তার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনও নির্দেশই প্রতিনিধিদলের প্রতি থাকবে না; গান্ধী-আরউইন চুক্তিতে যেসব রাজবন্দীর মুক্তির কথা বাদ পড়েছে তাঁদের মুক্তির জন্যে তিনি যথাসাধ্য উদ্যোগ নেবেন।
সুভাষচন্দ্র গান্ধীজির আশ্বাসে মোটামুটি সন্তুষ্ট হন। এর পর বোম্বাই থেকে গান্ধীজি দিল্লি রওনা হলে একই ট্রেনে সুভাষচন্দ্র তাঁর সঙ্গে যান। যাত্রাপথে গান্ধীজি যে রকম সংবর্ধনা পান তা দেখে সুভাষচন্দ্র উপলব্ধি করেন যে, গান্ধীজির জনপ্রিয়তা সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে। অসহযোগ আন্দোলনের সময়ও তিনি এত স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দন, শ্রদ্ধা পাননি।
গান্ধী-আরউইন চুক্তির পর সকলেরই ধারণা হয়েছিল লাহোর যড়যন্ত্র মামলার ভগৎ সিং ও তাঁর সঙ্গীদের ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হবে না। কিন্তু দিল্লিতে পৌঁছেই তাঁরা শুনলেন, সরকার অভিযুক্তদের ফাঁসি দেবে বলে স্থির করেছে। গান্ধীজিকে আবার অনুরোধ করা হল তিনি যেন এই তিন বিপ্লবীর প্রাণ রক্ষার জন্যে ভাইসরয়ের উপর চাপ সৃষ্টি করেন। সুভাষচন্দ্র অনুরোধ করেন, গান্ধীজি যেন বলেন যে প্রয়োজন হলে তিনি তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা ভেঙ্গে দেবেন। গান্ধীজি কিন্তু বিপ্লবী বন্দীদের জন্যে এতদূর যেতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তবুও সুভাষচন্দ্র স্বীকার করেছেন, মহাত্মাজি তাঁর ‘যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন’। আরউইনও কোনও প্রতিশ্রুতি না দিলেও ফাঁসি স্থগিত রেখে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবেন বলেছিলেন। এর ফলে এই আশা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, ফাঁসির দণ্ডাদেশ শেষপর্যন্ত মকুব হয়ে যাবে। অন্যান্য মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত বিপ্লবীদেরও ফাঁসি হবে না। কিন্তু সব আশা নস্যাৎ করে কলকাতা থেকে করাচি যাবার পথে সুভাষচন্দ্র ও অন্যরা চরম দুঃসংবাদ পেলেন— ভগৎ সিং ও তাঁর সহবিপ্লবীদের ২৩ মার্চ ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। এই সংবাদ সারা দেশে গভীর শোক, বেদনা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে। অল্প কয়েক মাস পূর্বেই যতীন দাস শহীদ হয়েছিলেন। তার প্রতিক্রিয়া তখনও দেশের সর্বত্র প্রবল ছিল। করাচিতেই নিখিল ভারত নওজোয়ান সভায় (২৮ মার্চ, ১৯৩১) সুভাষচন্দ্র মর্মস্পর্শী ভাষায় যতীন্দ্রনাথ দাসের শবানুগমন কেমন করে ‘বিজয় অভিযানের রূপ নিয়েছিল’, তা স্মরণ করে বলেন, ভগৎ সিং, রাজগুরু ও শুকদেবের জন্যে শোকের কারণ নেই। “মুক্তিলাভের পূর্বে ভারতকে আরও অনেক সন্তানহারা হতে হবে।” দুঃখের বিষয় হল আমাদের শ্রেষ্ঠ বীরদের জীবন রক্ষা করতে আমরা ব্যর্থ।
এক নিদারুণ শোকাবহ পরিবেশে করাচিতে কংগ্রেস অধিবেশন শুরু হয়। গান্ধীজি করাচিতে পৌঁছলে তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানো হয়েছিল। বহু যুবকের মনে হয়েছিল গান্ধীজি ‘বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন’। এই সন্দেহ যে অমূলক তা সুভাষচন্দ্রও স্বীকার করেছেন। কিন্তু আলোচনা ভেঙ্গে দেওয়ার এবং গোলটেবিল বৈঠক বর্জন করার ভয় না দেখানোয়, ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ধরেই নিয়েছিলেন ফাঁসির আদেশ কার্যকর হলেও তেমন কোনও সঙ্কট দেখা দেবে না।
করাচি কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। কংগ্রেস কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা ছিল, ভগৎ সিং-এর ফাঁসিকে কেন্দ্র করে অধিবেশনে ঝড় উঠতে পারে; গান্ধী-আরউইন চুক্তির প্রবল বিরোধিতা হতে পারে। কিন্তু ওই রকম প্রকাশ্য বিরোধিতার (যা প্রায় বিদ্রোহের মতো হত এবং কংগ্রেসকে দ্বিধা-বিভক্ত করত) নেতৃত্ব দেবার সাহস ও শক্তি এবং সমস্ত বিরোধীদের একত্র করে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সমর্থন লাভের ক্ষমতা একমাত্র সুভাষচন্দ্রেরই ছিল। কিন্তু তিনি সব দিক ধীর মস্তিষ্কে বিচার-বিবেচনা করে বুঝেছিলেন ওই রকম পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে না। কংগ্রেস অধিবেশনের প্রতিনিধিদের যা রাজনৈতিক চরিত্র এবং গান্ধীজির প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ছিল তাতে বিরোধীদের প্রস্তাব পাস হওয়ার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। নতুন করে দেশজুড়ে গণ-আন্দোলন করার মতো সংগঠন, জনসমর্থন, লোকবল, অর্থবল ইত্যাদিও ছিল না। গান্ধীজির ভাবমূর্তি কতটা উজ্জ্বল, কী বিপুল তাঁর প্রভাব, সুভাষচন্দ্র তা ট্রেন-যাত্রার সময় নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সুতরাং চুক্তি অনুমোদনের বিরোধিতার ফল হবে কংগ্রেস তথা স্বাধীনতা আন্দোলনে বিভেদ সৃষ্টি করে কংগ্রেসের দুর্বলতার লক্ষণ প্রকাশ করা। এতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষেরই সুবিধে হত। তাই সুভাষচন্দ্র ও তাঁর সহকর্মীরা প্রকাশ্য বিরোধিতা করেননি। তবে কংগ্রেসের বামপন্থী দল একটি বিবৃতিতে গান্ধী-আরউইন চুক্তির প্রতি তাঁদের বিরোধিতার উল্লেখ করে জানান যে, অনৈক্য সৃষ্টি না করার জন্যে তাঁর এই প্রস্তাব অধিবেশনে উত্থাপন করবেন না। কংগ্রেসের বিষয়-নির্বাচনী কমিটিতে এই বিবৃতি সুভাষচন্দ্র দিলে চুক্তির সমর্থকরা দারুণ উল্লাস প্রকাশ করেন। তেমনি, সুভাষচন্দ্রের ‘অত্যুৎসাহী’ সমর্থকরা হতাশ হন।
করাচি অধিবেশনে গান্ধীজির মনোভাব অনেকটা নরম ছিল। তবুও সম্ভাব্য বিক্ষোভ-প্রতিবাদের আশঙ্কায় কংগ্রেস কর্মকর্তারা (বর্তমান পরিভাষায় ‘হাই কমান্ডֹ’) এক চমকপ্রদ কৌশলের আশ্রয় নেন। শহীদ ভগৎ সিং-এর পিতা সর্দার কিষেণ সিং-কে অধিবেশনে আমন্ত্রণ করে কংগ্রেস নেতাদের সমর্থনে বক্তৃতা দেবার ব্যবস্থা করেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন