১৯৩৬ সালের ২৪ মার্চ ডঃ থিয়েরফেলডার-কে সুভাষচন্দ্র লেখেন যে, তিনি যখন প্রথম জার্মানীতে আসেন (১৯৩৩) তখন তাঁর আশা ছিল, নিজস্ব জাতীয় শক্তি ও আত্মসম্মান বোধে নবজাগ্রত জার্মানীর একই লক্ষ্যে সংগ্রামরত অন্যান্য জাতির প্রতি গভীর সহানুভূতি থাকবে। কিন্তু এখন তিনি দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন যে, জার্মানীর নতুন জাতীয়তাবাদ সঙ্কীর্ণ, স্বার্থপর এবং উদ্ধত। হের হিটলারের সাম্প্রতিক বক্তৃতায় তাই প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। জার্মানীর নতুন জাতীয়তাবাদ শুধুমাত্র স্বার্থপরতা এবং জাতিগত ঔদ্ধত্যকেই উৎসাহিত করছে। জার্মানীর বর্তমান পরিবেশ ভারতীয়দের পক্ষে খুবই হতাশাব্যঞ্জক। জার্মান অ্যাকাডেমি এবং ডঃ থিয়েরফেলডারের মতো অল্প কিছু ভারত-হিতৈষী মানুষ যেভাবে এই মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করানোর চেষ্টা করে চলেছেন তার জন্যে সুভাষচন্দ্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। কিন্তু তাঁদের ওই শুভ প্রচেষ্টার সুফলের কোনও লক্ষণ নেই। সুভাষচন্দ্র অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে, আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে জানান যে, এখনও তিনি ভারত ও জার্মানীর মধ্যে এক সমঝোতা গড়ে তোলার জন্যে চেষ্টা করে যেতে প্রস্তুত আছেন। কিন্তু ভারতের আত্মসম্মানের সঙ্গে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া চাই। সগর্বে সুভাষচন্দ্র লেখেন, “আমরা যখন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যের সঙ্গে লড়াই করছি আমাদের স্বাধীনতা আর অধিকারের জন্য, যখন আমরা আমাদের চূড়ান্ত সাফল্যের ব্যাপারে নিশ্চিত, তখন আমরা কিছুতেই অপর কোনও জাতির কাছ থেকে অপমান কিংবা আমাদের জাতি ও সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ সহ্য করতে পারি না।”
নাৎসী জার্মানীতে বসে হিটলারের এরকম কঠোর সমালোচনা ও তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ কেউ করতে পারেন তা অচিন্তনীয় ছিল। শুধু এই চিঠিই নয়, হিটলারের বক্তৃতার তীব্র সমালোচনা করে তিনি ভারতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্যে একটি বিবৃতি পাঠিয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্রের এটি প্রথম প্রতিবাদ ছিল না। জার্মানীর মনোভাবে এবং জার্মানীতে ভারতীয় ছাত্রদের প্রতি দুর্ব্যবহার, অপমানকর বৈষম্যমূলক আচরণে তিনি এত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে ইতিপূর্বে, ১৯৩৫ সালে, তিনি ভারতে জার্মান দ্রব্য বর্জন সম্পর্কে চিন্তা করতে শুরু করেছিলেন। ‘অ্যাডভান্স’-এ একটি প্রবন্ধে (২৫ আগস্ট, ১৯৩৫) জার্মানীতে ভারতীয় ছাত্র এবং শিক্ষানবীশদের ওপর বিধিনিষেধের প্রতিকারের জন্যে ভারতীয় রাজনৈতিক মহল এবং বাণিজ্যিক গোষ্ঠীকে প্রতিবাদ জানাতে বলেছিলেন। এর ফলে ‘ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান চেম্বার্স অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজ’ তাঁদের বার্লিনের প্রতিনিধির মাধ্যমে ‘রাইখ চেম্বার্স অফ কমার্স’-এর কাছে সুভাষচন্দ্রের অভিযোগ সম্পর্কে খোঁজ-খবর করেন। উত্তরে, ওই জার্মান ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আশ্বাস দেন যে, ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে জার্মানরা ইচ্ছুক। ভারতীয় ছাত্র ও শিক্ষানবীশদের কোনও রকম অসুবিধা সৃষ্টি করা তাঁদের উদ্দেশ্য নয়।
সুভাষচন্দ্রের তেজস্বিতা, সাহস ও দৃঢ়তার কোনও তুলনা ছিল না। ভালটার লাইফার, জে. এইচ. ফোক্ত প্রমুখ জার্মান লেখকরা সুভাষচন্দ্রের দৃঢ়তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ভালটার লাইফার লিখেছেন, সুভাষচন্দ্র ছিলেন “এক অসাধারণ গুণী ভারতবাসী⋯যেমন দৃঢ়চেতা ও তেজস্বী, তেমনই তীক্ষ্ণ ধীশক্তিসম্পন্ন ও স্পষ্টভাষী। স্বৈরাচারী শাসকদের মুখোমুখি দাঁড়াতে সত্যিই তাঁর জুড়ি ছিল না।” ফোক্ত লিখেছেন যে, ভারতে জার্মানীর বাণিজ্যিক স্বার্থ বিঘ্নিত হবার আশঙ্কায় নাৎসীরা বাধ্য হয়ে তাদের মনোভাব এবং নীতি পুনর্বিবেচনা করা শুরু করে। এমনকি হিটলারও ‘হিন্দুস্থান টাইমস’-এর সংবাদদাতা ডঃ এ. এল. সিম্হাকে একটি সাক্ষাৎকার দেবার প্রয়োজন অনুভব করেন।
সুভাষচন্দ্রের প্রচেষ্টার স্থায়ী কোনও সুফল কিন্তু হয়নি। হিটলার ও নাৎসী জার্মানীর ভারতবর্ষ এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি বিরূপ মনোভাবের কোনও পরিবর্তন দেখা দেয়নি। যতদিন না ব্রিটেনের সঙ্গে জার্মানীর যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ততদিন হিটলার ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ও ব্রিটিশ শাসনের অনুরাগীই ছিলেন। সুভাষচন্দ্র কিন্তু তাঁর মূল বিশ্বাস ও প্রচেষ্টা ত্যাগ করেননি। তিনি স্থির নিশ্চিত ছিলেন যে এক বিরাট আন্তর্জাতিক সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ব্রিটিশ শক্তি তাতে জড়িয়ে পড়বেই ও গভীর সঙ্কটের মধ্যে পড়বে। তার পূর্ণ সুযোগ ভারতবর্ষকে গ্রহণ করতে হবে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্ভাব্য শক্তিশালী শত্রুপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে উপযুক্ত সময়ে ব্রিটিশ শক্তির ওপর প্রচণ্ড আঘাত হেনে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে জয়যুক্ত করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী যে ক’বছর সুভাষচন্দ্র ইউরোপে ছিলেন, সেই সময় তাঁর সব চিন্তা, কর্মতৎপরতা, বিভিন্ন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করার পিছনে ছিল এই একটিই উদ্দেশ্য। ১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাসে মহানিক্রমণের পরে জার্মানীতে যাওয়া এবং হিটলারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের মূলেও ছিল একই উদ্দেশ্যসিদ্ধির পরিকল্পনা।
ইউরোপে ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৬ সালের মধ্যে তাঁর কার্যকলাপ সম্বন্ধে সুভাষচন্দ্র নিজেই লিখেছেন যে, তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন ইউরোপের অবস্থা প্রত্যক্ষরূপে পর্যালোচনা করা। কয়েকবার তিনি জার্মানী ও ইতালী গিয়েছিলেন। রোমে মুসোলিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। মুসোলিনী তাঁকে ভালভাবে অভ্যর্থনা করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভার্সাই চুক্তির ভিত্তিতে যে শান্তি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা যে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ছে এটা সুভাষচন্দ্র বুঝেছিলেন। লীগ অফ নেশনস (League of Nations) বা ‘রাষ্ট্রসঙ্ঘ’ যে ইউরোপীয় বৃহৎ শক্তিগুলির দ্বারা এবং তাদের স্বার্থে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তা তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল, যার ফলে এক বিরাট সংঘর্ষ আসন্ন হয়ে পড়েছিল তা আরও নিকট থেকে, গভীরভাবে দেখা এবং বিচারের জন্যে তিনি অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, চেকোস্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, বলকান রাজ্যগুলি ও অন্যান্য দেশে গিয়েছিলেন। আয়ারল্যান্ডে প্রেসিডেন্ট ডি, ভ্যালেরা ও তাঁর বিশিষ্ট মন্ত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। বহু উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের সঙ্গে ইউরোপে তাঁর দেখা ও কথাবার্তা হয়েছিল। এঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন রোমাঁ রোলাঁ।
সুভাষচন্দ্র যাতে না সহজে বিভিন্ন দেশে প্রবেশ করার অনুমতি পান, অবাধে ভ্রমণ করতে পারেন, প্রধান প্রধান ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন তার জন্যে ব্রিটিশ সরকার সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছিলেন। ইউরোপে যখন যেখানে সুভাষচন্দ্র গিয়েছিলেন, ব্রিটিশ গুপ্তচররা তাঁর গতিবিধির ওপর শ্যেন দৃষ্টি রেখেছিল, ছায়ার মতো তাঁকে অনুসরণ করতো। প্রতিটি দেশের ব্রিটিশ দূতাবাস থেকে লন্ডনে গোপন রিপোর্ট পাঠানো হত সুভাষচন্দ্র কী করছেন, কী বলেছেন, কার সঙ্গে দেখা করেছেন সব কিছু সম্পর্কে। যেমন, বার্লিন থেকে জানানো হয় (১৮ এপ্রিল, ১৯৩৪) যে, সুভাষচন্দ্র জার্মানীর ড্রেসডেন শহরে সফরকালে ‘ড্রেসডেনার এ্যনজাইজার’-এর সংবাদদাতার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, ‘ভারতের অগ্রগতির প্রাথমিক শর্ত হল রাজনৈতিক কর্তৃত্বের স্থান থেকে ইংরেজদের হটিয়ে দেওয়া।’ বসুর সাক্ষাৎকারটি ওই কাগজে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। ভিয়েনা থেকে রিপোর্ট যায় (২০ এপ্রিল, ১৯৩৪) যে, ভিয়েনার ‘হিন্দুস্থান অ্যাকাডেমিকাল অ্যাসোসিয়েশন’ কলকাতার প্রাক্তন মেয়র সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে রয়েছে। ইনি ‘আজ জীবিত সর্বাধিক ব্রিটিশ বিরোধীদের অন্যতম।’ বসু এখন ‘ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টস’-এর প্রধান দফতরটি লন্ডন থেকে ভিয়েনায় স্থানান্তরিত করার চেষ্টা করছেন। তাঁর এইসব কাজকর্ম ‘যথাসম্ভব সংযত করা বিশেষভাব্যে কাম্য।’ বুদাপেস্ট শহরের ‘পেস্টার লয়েড’-এ প্রকাশিত (৯ মে, ১৯৩৪) সুভাষচন্দ্রের একটি সাক্ষাৎকার ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর বিশদ রিপোর্ট গোপনে লন্ডনে পাঠান হয়। এই সাক্ষাৎকারে সুভাষচন্দ্র জাতীয় কংগ্রেস ও দেশের পরিস্থিতি সম্বন্ধে যে বিশ্লেষণ ও ব্যক্তিগত অভিমত ব্যক্ত করেন তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।
গান্ধীজির ভূমিকা প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র বলেন, গান্ধীজির প্রভাবের দু’টি দিক আছে। একদিকে তিনি নিজে এক জীবন্ত উদাহরণ। অন্যদিকে আছে তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ। তাঁর সততা ও মহিমময় চরিত্র জনগণের কাছে সর্বদাই এক দৃষ্টান্তস্বরূপ। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক মত ও দৃষ্টিভঙ্গি অনেকেই মনে করেন আরও বৈপ্লবিক ও আপসহীন হওয়া প্রয়োজন। ইংরাজরা তাঁর অহিংসনীতি, মহান চরিত্র ও সততাকে শুধুমাত্র নিজেদের উদ্দেশ্যসাধনে ব্যবহার করেছে। স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে বৈপ্লবিক উপায়ও গ্রহণ করা ন্যায্য হবে কি না, এই প্রশ্নের উত্তরে সুভাষচন্দ্র বলেন, “হ্যাঁ, ইংরেজের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যে সব উপায়ই ন্যায্য, এমনকি বিপ্লব এবং হিংসাও।” সুভাষচন্দ্র জানান, অস্পৃশ্যতা ও জাতপাতের বিভেদ দূর করার প্রশ্নে তিনি গান্ধীজির সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। হিন্দু-মুসলমান অনৈক্যের প্রশ্নে তিনি বলেন যে, এই সমস্যা ইংরাজরা নিজেদের স্বার্থে কৃত্রিম উপায়ে বৃদ্ধি করেছে। ভারত স্বাধীন হলে এই সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হবে। কমিউনিস্টরা গান্ধীজির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন যে, তাঁর রাজনৈতিক বন্ধুরা ‘মোটা পুঁজিবাদী ভিন্ন আর কিছু নন এবং তাঁরা চাইছেন ভারতীয় সর্বহারাদের শোষণ করতে’—এই সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের মত জানতে চাইলে তিনি বলেন, কংগ্রেস জনগণের দল। এই দলের নেতারা পুঁজিবাদী নন। নিজেদের জন্যে সম্পদ জমিয়ে তোলার কোনও ইচ্ছাও তাঁদের নেই। দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নতি এবং অগ্রগতির জন্যে কংগ্রেস নেতারা পরিকল্পিত অর্থনীতির কথা ভাবছেন—“তা সে ইউরোপীয় কিংবা মার্কিনী যাই হোক না কেন। তাঁরা অবশ্য কমিউনিজম চান না, কারণ তা ভারতীয় জনগণের চরিত্র এবং স্বভাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।” পরিশেষে সুভাষচন্দ্র হাঙ্গেরির বিভিন্ন সংগ্রামের প্রতি ভারতীয়দের সহানুভূতি ও সমর্থন জানান।
প্রাগ থেকে জানানো হয় (১৫ মে, ১৯৩৪) সুভাষচন্দ্র চেকোস্লোভাকিয়া এবং ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের জন্যে গঠিত ‘ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউট’-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি ডঃ লেসনীর উদ্বোধনী ভাষণের প্রত্যুত্তরে ভাষণ দেন। লেসনী সম্পর্কে ব্রিটিশ দূতাবাসের ওই গোপন রিপোর্টে যে রুচিহীন জঘন্য মন্তব্য করা হয়েছিল তা অবিশ্বাস্য হলেও অর্থবহ ছিল। অধ্যাপক ভিনসেন লেসনী (Vincene Lesny) ছিলেন প্রখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ। রবীন্দ্রানুরাগী লেসনি কবির আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনে এসে অধ্যাপনাও করেছিলেন। এইরকম একজন মানুষ সম্পর্কে ব্রিটিশ দূতাবাসের এক অফিসার কটুক্তি ও ব্যঙ্গ করে লেখেন, “লেসনী একজন ভয়ঙ্কর ব্রিটিশ বিরোধী (এবং একজন গাধা—অবশ্য দু’টি সর্বদাই মিশ খায়)।” এই মন্তব্য শুধুমাত্র লেসনি সম্পর্কেই নয়, পরোক্ষভাবে সুভাষচন্দ্র সম্পর্কেও ছিল। লেসনীর মতো ভারত-হিতৈষীদের সঙ্গে যোগাযোগ, নতুন সংগঠন প্রতিষ্ঠা, ভারত সম্পর্কে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নামকরা বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র-পত্রিকায় সুভাষচন্দ্রের সাক্ষাৎকার দেওয়া এবং তা গুরুত্ব পাওয়ায় ব্রিটিশ দূতাবাসগুলি এবং লন্ডনের কর্তৃপক্ষ মহল কতটা বিচলিত এবং উদ্বিগ্ন বোধ করছিল আলোচ্য রিপোর্টটিতে তা ফুটে উঠেছিল।
রুমানিয়ার ‘ডিমিনিয়েৎসা’ পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সুভাষচন্দ্র বলেন যে, এই মুহূর্তে পার্লামেন্টারী কাজকর্মের মধ্য দিয়ে উন্নতি অর্জনের চেষ্টা করলেও ভারতকে মুক্ত করার জন্যে তিনি প্রতিটি পদ্ধতিই, এমনকি শক্তিপ্রয়োগও ভাল বলে মনে করেন। বিভিন্ন রাজ্যে সুভাষচন্দ্রের ভ্রমণ, সাক্ষাৎকার, আলাপ-আলোচনার প্রভাব লক্ষ্য করে ব্রিটিশ দূতাবাসগুলি এতই বিচলিত হয়ে পড়ছিল যে, বেলগ্রেডের ব্রিটিশ দূতাবাস থেকে যুগোশ্লাভিয়ার সরকারকে অনুরোধ জানায় (৯ জুন, ১৯৩৪), সংবাদপত্রগুলিকে নির্দেশ দিতে যাতে বেলগ্রেডে সুভাষচন্দ্রের উপস্থিতির সংবাদটুকু ছাড়া তাঁর সম্বন্ধে অন্য কোনও সংবাদ ছাপা না হয়। এই সরকারী নির্দেশে কাজ হয়েছিল। সুভাষচন্দ্র নাকি ‘তিক্ত হতাশা’ নিয়ে যুগোশ্লাভিয়া ত্যাগ করেন।
সোফিয়া (বুলগেরিয়া) থেকে ব্রিটিশ দূতাবাসের সি. এইচ. বেনটিঙ্ক সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে এক চিঠিতে (১০ জুন, ১৯৩৪) কিছু অদ্ভুত সংবাদ লন্ডনকে জানান। ওই গোপন ‘তথ্য’ ব্রিটিশ দূতাবাসের এক কর্মী সোফিয়ার অশ্বারোহী পুলিশের প্রধানের সঙ্গে একটি সন্ধ্যা অতিবাহিত করে সংগ্রহ করেছিলেন। তথ্যগুলি হল: সুভাষচন্দ্র বসু স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কিছুটা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি দু’টি স্থানে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিনি ‘সংরক্ষিত’ (কথাটির অর্থ দুর্বোধ্য) পাঁচ হাজার অফিসার সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছিলেন, যারা লড়াই করেছে এবং এখন ‘বৈপ্লবিক কৌশল’ অনুসরণ করতে প্রস্তুত। তিনি বুলগেরিয়ান, ফরাসি এবং জার্মান ভাষায় রচিত ‘মার্কসবাদী সাহিত্য বাক্সবন্দী করে নিয়ে গেছেন’। তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন যে গান্ধীর শীঘ্রই মৃত্যু হবে এবং তিনিই তাঁর স্থান দখল করবেন⋯ভারত একটি বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত,⋯তবে সম্ভবত দু’ একটি বছর কেটে যেতে পারে⋯ভারতে চল্লিশ কোটি মানুষ রয়েছেন, তার পনেরো কোটিকে ব্রিটিশ শাসনের কবল থেকে ভারতের মুক্তির জন্যে লড়াইয়ে জীবন বলিদান করতে হতে পারে। সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে এই তথ্য এবং সুভাষচন্দ্রের বক্তব্যের উদ্ধৃতি কতখানি নির্ভরযোগ্য আর কতখানি ব্রিটিশ গুপ্তচরের মস্তিষ্ক প্রসূত, সান্ধ্য মজলিশের পানীয়ের প্রভাব বা ইংরাজি ভাষার অজ্ঞতার জন্যে সুভাষচন্দ্রের বক্তৃতার সঠিক মর্ম উদ্ধারের ব্যর্থতার ফল ছিল, তা নির্ণয় করা অসম্ভব। তবে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, অদূর ভবিষ্যতে ভারতের বুকে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদের জন্যে দৃঢ়সঙ্কল্প হয়ে সুভাষচন্দ্র ইউরোপের পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ ও বিচার করে ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে শুরু করেছিলেন।
সুভাষচন্দ্রের গতিবিধির ওপর প্রখর দৃষ্টি রাখার ব্যাপারে এক মুহূর্তের জন্যেও যেন শৈথিল্য না ঘটে সে বিষয়ে ব্রিটিশ দূতাবাসগুলির ওপর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কতটা কঠোর নির্দেশ ছিল সে সম্বন্ধে একটি কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনার উল্লেখ আছে ভিয়েনা থেকে পাঠানো এক গোপন রিপোর্টে (২৫ এপ্রিল, ১৯৩৬)। সুভাষচন্দ্র তাঁর পিছনে সব সময় গোয়েন্দা লাগিয়ে নজরদারি করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ভিয়েনার পুলিশের বড়কর্তকে একটি কড়া চিঠি লিখেছিলেন। সুভাষচন্দ্র শ্লেষাত্মক ভাষায় লেখেন যে, তাঁর জানা ছিল না অস্ট্রিয়া এখনও একটি ব্রিটিশ উপনিবেশ! তিনি সতর্ক করে দেন যে, যদি তিনি তাঁর চিঠির কোনও সুদত্তর না পান তাহলে তিনি তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার কথা ফাঁস করে দিয়ে ভারতীয়দের অস্ট্রিয়া পর্যটন করতে আসার বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেবেন। পুলিশের বড়কর্তা কোনও উত্তর দেননি, কেননা তাঁর বলার মতো মুখ ছিল না। সুভাষচন্দ্র তাঁর পিছনে লেগে থাকা গোয়েন্দাদের প্রায় হাতে-নাতে ধরে ফেলেছিলেন। তাঁকে অনুসরণ করা হচ্ছে এই সন্দেহ নিশ্চিত করার জন্যে তিনি ভিয়েনার শহরতলিতে এক বরফ-ঢাকা প্রান্তরের ওপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করেন। তখন অনন্যোপায় হয়ে দুই গোয়েন্দাপ্রবরকেও তাই করতে হয়। বেচারাদের ওপর নির্দেশ ছিল কোনওমতেই সুভাষচন্দ্রকে এক নিমেষের জন্যেও চোখের আড়াল করলে চলবে না! সুভাষচন্দ্র মহাপরাক্রমশালী ব্রিটিশ সরকারের কতখানি উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিলেন তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে বাংলার সরকার ও পুলিশ বিভাগ, ভারত সরকার, লন্ডনে ব্রিটিশ সরকারের উচ্চতম মহল এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ব্রিটিশ দূতাবাসগুলির দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। অনির্দিষ্টকাল বিনা বিচারে তাঁকে কারারুদ্ধ করে রাখা সহজ ছিল না। সারা দেশজুড়ে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভের আশঙ্কা ছাড়াও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বেশ কিছু সদস্য এই নিয়ে প্রশ্ন করে সরকারকে নাজেহাল করে তুলতেন। ভারতে কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্যরাও ওই সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলতেন। অন্যদিকে ভারতবর্ষে সুভাষের উপস্থিতি ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে বিপজ্জনক ছিল। ইংলন্ডেও তাঁকে প্রবেশের অনুমতি দিতে তাঁদের সাহস হয়নি। আশঙ্কা ছিল, ইংলন্ডের ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্য-বিরোধী মনোভাব তীব্রতর করে তাদের সংগঠিত করে বড় রকমের সমস্যা সৃষ্টি করবেন। আবার ইউরোপেও বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে, বড় বড় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং ভারত-হিতৈষী সংগঠন গড়ে তুলে তিনি ক্রমেই ব্রিটিশ সরকারের দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছিলেন। সুভাষ-আতঙ্ক এমনই হয়ে পড়ছিল যে, ১৯৩৪ সালের নভেম্বরের শেষে ‘পিতা জানকীনাথ মৃত্যুশয্যায়’ এই তারবার্তা পেয়ে তিনি বিমানে করে স্বদেশযাত্রা করলে বাংলার সরকার ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কলকাতায় পৌঁছবার আগের দিন তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। বিমানবন্দরে সুভাষচন্দ্রকে এক পুলিশবাহিনী অভ্যর্থনা করে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এলগিন রোডে পিতৃগৃহে তাঁকে অন্তরীণ করে রাখা হয়। ১৯৩৫ সালের জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে চিকিৎসার জন্যে তিনি আবার ইউরোপে ফিরে যান। যে স্বল্প সময় তিনি কলকাতায় ছিলেন তার মধ্যে একদিনের জন্যেও তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়নি।
১৯৩৬ সালের এপ্রিল মাসে কংগ্রেসের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে যোগদানের জন্যে সুভাষচন্দ্র আবার ভারতে ফেরার সিদ্ধান্ত করেন। ওই কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু। তাঁর অভিপ্রায়ের কথা জেনে ভিয়েনার ব্রিটিশ দূতাবাসের মাধ্যমে লিখিতভাবে সুভাষচন্দ্রকে সতর্ক করে দেওয়া হয় যে, স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। সুভাষচন্দ্র জওহরলালকে তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সঙ্কল্পের কথা জানিয়ে তাঁর অভিমত জানতে চান। উত্তরে জওহরলাল জানান যে, যদিও এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা চিরকাল মেনে নেওয়া যায় না, তবু বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি সুভাষচন্দ্রের স্বদেশ ফেরার সিদ্ধান্ত সমর্থন করতে পারছেন না। কিন্তু সুভাষচন্দ্র অবিচল থাকেন। তিনি রোমাঁ রোলাঁকে এক চিঠিতে জানান যে, যদিও নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠদিনগুলি কারাগারে কাটাবার আশঙ্কা আছে, তবুও তিনি সরকারী হুকুমে ভীত নন। ১৯৩৬ সালের ৮ এপ্রিল বোম্বাই-এ জাহাজ থেকে নামামাত্র তিনি গ্রেপ্তার হন। কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল, বিশিষ্ট জাতীয় নেতারা, সংবাদপত্র-পত্রিকা এই গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাল। ১০ মে সারা দেশে তাঁর মুক্তির দাবিতে ‘সুভাষ দিবস’ পালন করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাবস্থাপক সভায়, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সুভাষচন্দ্রের মুক্তির প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা হওয়ার ফলে তাঁকে কার্শিয়াঙে শরৎচন্দ্র বসুর বাড়িতে বন্দী করে রাখা হয়। সেখান থেকে ১৭ ডিসেম্বর তাঁকে চিকিৎসার জন্যে কলকাতার মেডিকেল কলেজে আনা হয়। শেষপর্যন্ত ১৯৩৭ সালের ১৭ মার্চ তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তিদানের সিদ্ধান্তের প্রধান কারণ ছিল তাঁর স্বাস্থ্যের আশঙ্কাজনক অবনতি। কয়েকমাস পরে সুভাষচন্দ্র আবার ইউরোপ যাত্রা করেন (১৮ নভেম্বর, ১৯৩৭)।
সুভাষচন্দ্রকে পুলিশের গোপন রিপোর্টে ‘ভারতের ব্রিটিশ শাসনের এক নির্দয় শত্রু’ বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। পর্লামেন্টে সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে আটকে রাখার কারণ ব্যাখ্যা করে বলা হয় যে, “বসু একজন সন্ত্রাসবাদী এবং অন্যতম প্রধান সন্ত্রাসবাদী দলের নেতা। তিনি সহিংস বিপ্লবের পক্ষে প্রচার চালান। এই বিষয়টি প্রচারের জন্য এবং তা কার্যে পরিণত করার জন্য জনগণকে সংগঠিত করার ব্যাপারে তাঁকে স্বাধীনতা দেওয়া হলে জননিরাপত্তার পক্ষে তা ক্ষতিকর হবে।” সরকারী বিবৃতিটি সত্য ও মিথ্যার এক সমন্বয় ছিল। সুভাষচন্দ্র সন্ত্রাসবাদী এবং সন্ত্রাসবাদী দলের নেতা, এই বক্তব্য ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। কিন্তু স্বাধীন সুভাষচন্দ্র যে জনগণকে সংগঠিত করে ‘জন নিরাপত্তা’ অর্থাৎ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের নিরাপত্তার পক্ষে বিরাট আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠবেন, এই বক্তব্য মিথ্যা ছিল না। কে তাদের সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বিপজ্জনক শত্রু তা বুঝতে ব্রিটিশ সরকারের ভুল হয়নি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন