কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন মতিলাল নেহরু। জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে ইতিপূর্বে এত লোকসমাগম, এত বিশাল আয়োজনও হয়নি ও এমন উদ্দীপনা কখনও দেখা যায়নি। আর একটি কারণে কলকাতা অধিবেশন ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। সেটি হল সুভাষচন্দ্রের পরিকল্পনা, পরিচালনা ও নেতৃত্বে কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন ও ওই বাহিনীর ভূমিকা। সুভাষচন্দ্র নিজে ছিলেন বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জি. ও. সি)। আধা-সামরিক কায়দায় বাহিনীর স্বেচ্ছাসেবকদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা হয়। সংগঠনের বৈশিষ্ট্য ছিল সামরিক নিয়মশৃঙ্খলা বাহিনীতে বাইসাইকেল ডিভিশন, মোটর সাইকেল ডিভিশন, অশ্বারোহী ডিভিশন, সামরিক বাদ্য (Band) ডিভিশন, সাঙ্কেতিক বার্তা (Code Messages) ডিভিশন ছিল। পৃথক নারী বাহিনী ছিল। সকলেই আধা-সামরিক ইউনিফর্ম পরতেন। সুভাষচন্দ্র নিজে সামরিক পোষাকে একটি বাদামী রঙের ঘোড়ার পিঠে চেপে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করতেন। কংগ্রেস অধিবেশনের সভাপতি মতিলাল নেহরুকে হাওড়া স্টেশন থেকে একটি ঘোড়ার গাড়িতে বসিয়ে শোভাযাত্রা করে আনা হয়। গাড়িটি ২৮টি সাদা ঘোড়া টেনেছিল। বাহিনীর অফিসাররা সামরিক রীতিতে ‘ক্যাপ্টেন’ ‘মেজর’ প্রভৃতি পদমর্যাদায় পরিচিত ছিলেন, স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনীর ‘ক্যাপ্টেন’ ছিলেন লতিকা ঘোষ। অধিবেশনে যোগদানকারী প্রতিটি মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ও অভ্যর্থনা করার দায়িত্বভার ছিল সুভাষচন্দ্রের নিজের, তিনি তাঁর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সহযোগিতায় সব কিছু দেখাশোনা করেন। তাঁর কর্তব্যজ্ঞান ও নিয়মনিষ্ঠা সম্পর্কে বহু কাহিনী শোনা যায়। যেমন, বিভাবতী বসু প্রবেশপত্র না আনায় তাঁকেও প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। সুভাষচন্দ্রকে এটা জানানোর পরেও প্রবেশপত্র না আনা পর্যন্ত তাঁর মেজবৌদি প্রবেশ করতে পারেননি।
১৯২৮ সালের কংগ্রেস অধিবেশনে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের এক গভীর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ছিল। যে কোনও জাতির স্বাধীনতা অর্জন ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে সামরিক শক্তির গুরুত্ব কতখানি তা সুভাষচন্দ্র মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর পূর্ণ ভারতীয়করণ (Indianization) ছিল তাঁর স্বপ্ন। শুধুই স্বপ্ন নয়— রাজনৈতিক লক্ষ্য। কিন্তু বিদেশী শাসকরা তা কখনই চায়নি। সামরিক বাহিনীর নিচুস্তরে ভারতীয়দের নেওয়া ছাড়া, উচ্চপদে যোগ্যতা থাকলেও ভারতীয়রা উন্নীত ও নিযুক্ত হত না। এই রকম কোনও প্রস্তাব বা দাবি সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এই নিয়ে ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও সুভাষচন্দ্রই প্রথম এই বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন, প্রতিকারের জন্যে কার্যকরী উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও তার সর্বাধিনায়ক (G.O.C) সুভাষচন্দ্র বসুর ভূমিকা অদূর ভবিষ্যতের আজাদ হিন্দ বাহিনী ও ‘নেতাজির’ জন্ম এবং ঐতিহাসিক সংগ্রামী কার্যকলাপের পূর্বাভাস ছিল। কংগ্রেস অধিবেশনে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিপক্ষে এবং পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে প্রদত্ত সুভাষচন্দ্রের ভাষণে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত ছিল। তিনি বলেছিলেন যে, আর একটি বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন। এই পরিস্থিতিতে “ভারতবর্ষকে সতর্ক অবস্থায় থাকতে হলে অবশ্যই এক নতুন মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে, এমন এক মানসিকতা যা বলবে যে, আমরা পূর্ণ স্বাধীনতা চাই।” কিন্তু যে মানসিক প্রস্তুতির কথা তিনি বলেছিলেন তা কংগ্রেসের প্রবীণ নেতাদের কাছে আদৌ গ্রহণযোগ্য ছিল না। অহিংস শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের আদর্শে বিশ্বাসী গান্ধীজি ও তাঁর অনুগামীদের কাছে সুভাষচন্দ্রের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, তার সংগঠন, ভূমিকা কংগ্রেস আদর্শ ও নীতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়েছিল। গান্ধীজি নাকি সুভাষের অধিনায়কত্বে গঠিত ও পরিচালিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী দেখে মৃদুহাস্যে ‘সেলার্স সার্কাস’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ছিলেন যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত। কংগ্রেস অধিবেশন উপলক্ষে একটি প্রদর্শনীও হয়েছিল। প্রদর্শনীর সভাপতি ছিলেন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় ও সম্পাদক ছিলেন নলিনীরঞ্জন সরকার।
কলকাতা কংগ্রেসে প্রবীণ ও নবীনদের মধ্যে প্রত্যাশিত বিরোধ দেখা দিয়েছিল। সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের ভেতরের ঐ বিরোধকে ‘অপেক্ষাকৃত প্রবীণ’ ও ‘বামপন্থীদের দল’-এর মধ্যে আদর্শগত মতভেদ বলে বর্ণনা করেছেন। গান্ধীজির প্রস্তাবে বলা হয় যে, ১৯২৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে যদি নেহরু কমিটি রচিত শাসনতন্ত্রকে ব্রিটিশ পালামেন্ট পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করে ভারতকে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন দেয় তাহলে কংগ্রেস তা মেনে নেবে। তা না হলে কর দেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্যে এবং ঐ ধরণের আর যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে সেইমত দেশবাসীকে নির্দেশ দিয়ে কংগ্রেস অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তুলবে। গান্ধীজির প্রস্তাবের বিরোধিতা করে সুভাষচন্দ্র একটি সংশোধনী প্রস্তাব আনেন। তিনি প্রথমেই সুস্পষ্টভাবে বলেন যে, সংশোধনী প্রস্তাবটি আনতে হচ্ছে বলে তিনি দুঃখিত। কিন্তু “এই ঘটনা এক মতভেদের স্পষ্ট লক্ষণ, কংগ্রেসের ভেতরে প্রাচীন এবং নবীন চিন্তাধারার মধ্যে মৌলিক মতভেদ।” জোরাল ভাষায় তিনি বলেন যে, নবীনরা চান প্রবীণরা ‘সময়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলুন’। তিনি প্রশ্ন করেন, “আপনারা কি বুকে হাত রেখে বলতে পারেন যে, এই সময়ের মধ্যে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন লাভের যুক্তিসঙ্গত কোনও সম্ভাবনা আছে? পণ্ডিত মতিলাল তাঁর ভাষণে স্পষ্টই বলে দিয়েছেন যে, এমন বিশ্বাস তাঁর নেই। তবে কেন আমরা এই বারো মাসের জন্য পতাকা (স্বাধীনতার) অবনমিত করব?…দাসমনোবৃত্তিকে জয় করতে হলে আমাদের স্বদেশবাসীদের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে অটল থাকতে উৎসাহিত করেই তা হবে।” সংশোধনী প্রস্তাবটিকে সমর্থনের আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, “নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রীতি, প্রশংসা এবং ভক্তি এক জিনিস, আর নীতির প্রতি শ্রদ্ধা অন্য জিনিস। আমার প্রস্তাব গ্রহণ করুন এবং তরুণ সমাজকে নতুন চেতনায় অনুপ্রাণিত করুন।” তার প্রত্যুত্তরে গান্ধীজি বলেন, নবীন বাংলা (Young Bengal) এক মস্তবড় ভুল করছে কারণ, পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তোলা এক অন্তঃসারশূন্য বাগ্বৈশিষ্ট্য মাত্র! “আমি আপনাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি এক বছরের মধ্যে স্বরাজ আসবে।” এই প্রতিশ্রুতি তিনি ১৯২০ সালে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার সময়েও দিয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্রের সংশোধনী প্রস্তাবটি ৯৭৩-১৩৫০ ভোটে পরাজিত হয়। ভোটের জয়-পরাজয়ে কিন্তু মূল সমস্যার সমাধান হয়নি। প্রবীণ-নবীনের মতাদর্শের সংঘাত তীব্রতর হয়েছিল মাত্র। প্রখর রাজনৈতিক বুদ্ধিসম্পন্ন গান্ধীজির তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি।
গান্ধীজি সুভাষচন্দ্রের অদম্য শক্তি, উৎসাহ, সাংগঠনিক ক্ষমতা, তরুণদের উদ্দীপ্ত করার মতো আকর্ষণী ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা করতেন। তাঁকে স্নেহ করতেন। কিন্তু তারই সঙ্গে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন সুভাষকে সম্পূর্ণ অনুগত রাখার কোনও সম্ভাবনা নেই। সুভাষ নিজের মত ও পথ স্থির করেছেন। তিনি তাঁর নিজের পথেই চলবেন। কিন্তু গান্ধীজির অনুযোগ ছিল, সুভাষ (এবং সেই সময়ে জওহরলালও) গঠনমূলক কাজ ও চিন্তার পরিবর্তে যুব সমাজকে শুধুমাত্র বক্তৃতা, মিছিল ও চমকপ্রদ প্রদর্শনীতে মুগ্ধ করছেন। গান্ধীজির এই সমালোচনা সঠিক ও তথ্যভিত্তিক ছিল না। বাস্তব চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ১৯২৮-১৯২৯ সালে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস রাজনীতির মূলস্রোতের বাইরে এতরকম কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন, তাঁর চিন্তা ও কর্মক্ষেত্র কত বহুমুখী ছিল তা জানলে বিস্মিত হতে হয়। সুভাষচন্দ্রের ধ্যান-ধারণায় রাজনীতি ও সামাজিক পুনর্গঠন অভিন্ন ও অবিচ্ছেদ্য ছিল। স্বাধীনতার আকাঙক্ষা সমগ্র জাতির মধ্যে জাগ্রত করার জন্যে নারী-পুরুষ, ছাত্র-যুবক শ্রমিক, কৃষক— সর্বস্তরের, সকল মানুষের কল্যাণ, অন্যায়-বৈষম্যের দূরীকরণ, সাম্প্রদায়িক সংহতি ও সহযোগিতা একান্তভাবে প্রয়োজন। সামঞ্জস্য ও সমন্বয়ই দেশ ও জাতিকে গড়ে তুলতে পারে, প্রকৃত মানুষ তৈরি করতে পারে। সুভাষচন্দ্রের জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের এই আদর্শ ও লক্ষ্য স্বামী বিবেকানন্দ ও শ্রীঅরবিন্দের ভাবধারায় সিঞ্চিত ছিল।
কলকাতা কংগ্রেসের পূর্বে ও পরে সুভাষচন্দ্র শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক আন্দোলন, যুব-ছাত্র আন্দোলন, নারী জাগরণ ও নারীদের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদানের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। ১৯২৬-১৯২৮ সালে ভারতে শ্রমিক অসন্তোষ ক্রমেই বাড়তে থাকে। বহু শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে ওঠে। সমাজবাদী মনোভাব জনগণের মধ্যে বৃদ্ধি পায়। জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীরা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে সাম্যবাদী গণ-আন্দোলনের শক্তি উপলব্ধি করতে থাকেন। ১৯২৭ সালে খড়গপুরে রেলওয়ে ধর্মঘটের পরের বছর লিলুয়া রেলওয়ে ওয়ার্কশপের কর্মীরা ধর্মঘট করে। চেঙ্গাইল ও বাউড়িয়া পাটকলে শ্রমিকরা ধর্মঘট করে। শ্রমিক অসন্তোষ ও বিপ্লবী তৎপরতার বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন হয়ে সরকার ১৯২৮ সালে জাতীয় নিরাপত্তা আইন (Public Safety Bill) পাস করে। ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে সারা দেশে ব্যাপকভাবে শিল্পে শ্রমিক ধর্মঘট দেখা দেয়। বহু বামপন্থী নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এঁদের মধ্যে ছিলেন মুজফ্ফর আহমেদ, পি. সি. জোশী, এস. এ. ডাঙ্গে, মিরাজকার প্রমুখ ভারতীয় এবং জন ব্রাডলে ও ফিলিপ স্প্র্যাট নামে দু’জন ব্রিটিশ কমিউনিস্ট। এঁদের মীরাট জেলে রাখা হয়। এঁদের বিচার মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা (Meerut Conspiracy Case) নামে পরিচিতি লাভ করে। পশ্চিম ভারতে বোম্বাই ও দক্ষিণ মহারাষ্ট্রের গিরনি কামগর ইউনিয়নগুলির (Girmi Kaingarh Union—Red Flag) উদ্যোগে ১৯২৯ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে ওই অঞ্চলে সাধারণ ধর্মঘট হয়। জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশের পাটকলগুলিতে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। ওই সময়ে আরও অনেক শিল্প ধর্মঘট হয়। ধর্মঘট ডাকার বিরুদ্ধে নানা রকম বাধানিষেধ আরোপ করে ‘ট্রেড ডিস্পিউটস অ্যাক্ট’ (Trade Disputes Act) নামে একটি আইন পাস করা হয়। ১৯৩৩ সালের মধ্যে শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব বৃদ্ধি পায়। কমিউনিস্ট পার্টির নীতি ছিল, শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের মাধ্যমে সাধারণ ধর্মঘট করতে হবে। সেনাবাহিনী ও পুলিশের মধ্যে বৈপ্লবিক ভাবধারা প্রচার করতে হবে। পূর্ণ স্বাধীনতার জন্যে দেশব্যাপী গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ১৯৩৪ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে বে-আইনী ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে কমিউনিস্ট বেশি সংখ্যায় কংগ্রেসে যোগ দেবার চেষ্টা করতে থাকে। এর উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় আন্দোলনের বৃহত্তর পটভূমিতে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের পূর্ণ স্বাধীনতার আন্দোলনের শামিল হয়ে দলের শক্তি ও প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হওয়া।
সুভাষচন্দ্র শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। জামশেদপুরে টাটা আয়রন এন্ড স্টিল ওয়ার্কসে শ্রমিক ধর্মঘট কয়েক মাস ধরে চলেছিল। এই ধর্মঘট যখন প্রায় ব্যর্থ হতে চলেছে তখন শ্রমিকদের চাপে তিনি এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এর ফলে ধর্মঘটী শ্রমিকদের মনোবল বৃদ্ধি পায় ও শেষপর্যন্ত একটি সম্মানজনক মীমাংসা হয়। শ্রমিক আন্দোলনে এটা ছিল সুভাষচন্দ্রের প্রথম প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। জামশেদপুরের আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, পুঁজিপতিরা পছন্দ করুন আর নাই করুন শ্রমিক আন্দোলন দ্রুত শক্তি অর্জন করছে। তাকে আর তুচ্ছজ্ঞান করা চলবে না। জামশেদপুরের ইস্পাত কারখানা মানুষের শুভেচ্ছা পেয়েছে তার কারণ, ‘ভারতীয়করণ’। কিন্তু কোম্পানীকেও যথার্থ জাতীয় মনোভাবের পরিচয় দিতে হবে। লিলুয়ার রেল শ্রমিকদের ধর্মঘটেও সুভাষচন্দ্র জনসাধারণের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন ধর্মঘটরত শ্রমিকদের সাহায্য করতে। ‘ফরওয়ার্ড’-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে (১ মে, ১৯২৮) তিনি বলেন যে, জাতীয় উদ্দেশ্য পরিপূরণের জন্যে শ্রমিক ও কৃষক সংগঠন গড়ে তোলা প্রয়োজন। শ্রমিক আন্দোলন ও ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেসের অভিন্ন সম্পর্ক থাকা দরকার। কলকাতার মেথরদের বেতনবৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘট পুলিশের সাহায্যে কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ ভেঙে দেওয়ার তিনি তীব্র নিন্দা করেছিলেন। মেথরদের ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতিকার না হওয়ার জন্যেই এই ধর্মঘট হয়েছিল বলে তিনি বিবৃতি দিয়েছিলেন।
শিল্পের উন্নয়ন, বিকাশ এবং শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের চিন্তার প্রতিফলন হয়েছিল ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ অফ ইন্ডিয়া’র বাংলা শাখার ইস্তাহারে (২ অক্টোবর, ১৯২৬)। এতে অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে আর্থিক বৈষম্য দূরীকরণ, সম্পত্তির সমবণ্টন, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং সকলের জন্যে সমান সুযোগের ওপর জোর দেওয়া হয়। সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাবিত শিল্প-নীতির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল: বৃহদাকার উৎপাদন ব্যবস্থা ও সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্র শিল্পকে উৎসাহ দান; মূল শিল্পগুলির জাতীয়করণ: শিল্পের পরিচালনা, কর্মচারী নিয়োগ ও ছাঁটাইয়ের বিষয়ে শ্রমিকদের মতামতকে গুরুত্বদান; শিল্পে বিবাদ ও ধর্মঘট, লক-আউট প্রভৃতি যাতে না হয় তার জন্যে নিরপেক্ষ সালিশী বোর্ড গঠন; কারখানার শ্রমিকদের জন্যে আট ঘণ্টার কর্মদিবস নির্দিষ্ট করা; রাষ্ট্র-বেকার ভাতা ও বার্ধক্যভাতার ব্যবস্থা করা; শ্রমিকদের জন্যে অসুস্থতা ও দুর্ঘটনা বীমা; প্রসূতি কল্যাণ; শিশুদের জন্যে ক্রেশ; শ্রমিকদের বাসগৃহ, পর্যাপ্ত ছুটি ইত্যাদির ব্যবস্থা করা। ইস্তাহারে কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি ও কৃষকদের স্বার্থরক্ষার জন্যে একই রকম ভূমিপ্রথা, সমহারে কর ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ও ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে কৃষি ঋণ বাতিল করা এবং ক্ষতিপূরণের সাহায্যে জমিদারি প্রথার বিলোপের প্রস্তাব করা হয়।
সুভাষচন্দ্রের অর্থনৈতিক চিন্তা ও কর্মসূচী, শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা, শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর সহানুভূতি ও সক্রিয় সমর্থন একদিকে যেমন কংগ্রেসের প্রবীণ রক্ষণশীল নেতাদের মনোমত হয়নি, তেমনি কমিউনিস্টদেরও সমর্থন পায়নি। গান্ধীপন্থীরা মনে করতেন রাজনীতির সঙ্গে শ্রমিকদের বেতন, চাকরির সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির সমস্যা এক করে ফেললে শ্রমিকদের ক্ষতিই হবে। কিন্তু সুভাষচন্দ্র ও তাঁর সহযোগীরা মনে করতেন যে, শ্রমিকদের জাতীয় আন্দোলনের মূল স্রোতে আনতে হবে। তাঁরা শ্রেণী সংগ্রামে বিশ্বাস করতেন না। শ্রমিক, মালিক ও পরিচালকদের মধ্যে সহযোগিতা ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত মীমাংসার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু চরমপন্থী কমিউনিস্টরা শ্রেণী সংগ্রাম, শিল্প শ্রমিকদের শক্তিশালী সংগঠন ও দীর্ঘ ধর্মঘটের মাধ্যমে দাবি-দাওয়া আদায় করায় বিশ্বাস করতেন। গান্ধীপন্থী ও সুভাষপন্থী—উভয় পক্ষকেই উগ্র বামপন্থী কমিউনিস্টরা পছন্দ করতেন না। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা সুভাষচন্দ্র ও স্বরাজ্যপন্থীদের আরও বেশি বিরোধী ছিলেন। এই প্রসঙ্গে কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য অমলেন্দু ঘোষের ‘ভারতে কম্যুনিজম (১৯২০-১৯৮৬)’ গ্রন্থে আছে। মুজফ্ফর আহমেদের মাধ্যমে মানবেন্দ্রনাথ রায় নাকি সুভাষচন্দ্রকে একটি গোপন পত্র পাঠিয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর পরিচয় না থাকায় মুজফ্ফর আহমেদ ওই চিঠি সুভাষের সহপাঠী বিপ্লবী ভূপেন্দ্রকুমার দত্তের হাতে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ওই পত্র সুভাষচন্দ্র গ্রহণ না করায় মুজফ্ফর আহমেদ নিজেই তাঁর কাছে যান। সুভাষ তখন তাঁকে বলেন, যাঁরা তাঁকে চিঠি লিখতে চান তাঁরা যেন সোজাসুজি লেখেন।
সাইমন কমিশন-বিরোধী আন্দোলনে ও জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে কমিউনিস্টরা প্রবেশ করলেও মস্কোতে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ষষ্ঠ বিশ্ব সম্মেলনে ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদী সংস্কারপন্থী বুজোয়াদের (যেমন স্বরাজ্যপন্থীদের) বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেওয়া হয়। ‘শ্রমজীবীদের শত্রু ‘সংস্কারবাদী’ গান্ধীপন্থী ও স্বরাজ্যপন্থীদের ‘মুখোশ খুলে দেবার’ জন্যে কমিউনিস্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়। ‘Draft Plan of Action of the Communist Party of India’ (ডিসেম্বর, ১৯৩০) নামে ‘ডকুমেন্টে’ (Document) সোজাসুজি বলা হয় যে, ভারতবর্ষে বিপ্লবের সবচেয়ে বড় শত্রু হল, কংগ্রেস সম্বন্ধে ভারতীয় জনসাধারণের এক বৃহৎ অংশের ‘মোহ’। বিশেষ করে, কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থীরা গণ-সংগ্রামকে নিয়ন্ত্রণ বা দমিয়ে রাখার সর্বপ্রকার চেষ্টা করেছে ও করছে। ভারতবর্ষে বিপ্লবের পথে সবচেয়ে ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক (The most harmful and dangerous obstacle to victoty of the Indian revolution) হল কংগ্রেসের মধ্যে জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ বামপন্থীরা। এঁদের ‘মুখোস খোলাই’ হবে কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান কাজ। এই ‘বামপন্থী’ জাতীয়তাবাদী সংস্কারপন্থীদের বিরুদ্ধে ‘নির্মম’ (ruthless) যুদ্ধ চালিয়ে বিচ্ছিন্ন করে শ্রমিক ও কৃষকদের কমিউনিস্ট পার্টির পতাকাতলে আনতে হবে। কমিউনিস্ট পার্টির এই নীতি ও মনোভাবের ফলে ভারতবর্ষে শ্রমিক আন্দোলন দ্বিধা-বিভক্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ে। অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসে এর প্রতিফলন হয়। সুভাষচন্দ্র এর জন্যে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও বেদনাহত হন। AITUC-র কলকাতা অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে (৪ জুলাই, ১৯৩১) শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে অনৈক্য ও বিবাদ সম্পর্কে তিনি সোজাসুজি বলেন, বিদেশী কোনও সংস্থা বা “মস্কোর হুকুমের কাছে আমাদের আত্মসমর্পণ করা উচিত নয়। ভারতকে উদ্ভাবন করতে হবে তার নিজস্ব পদ্ধতির, তার নিজের পরিবেশ, নিজের প্রয়োজনের মতো করে তৈরি করতে হবে নিজেকে।” রেলকর্মী, চা-বাগানের শ্রমিক, পাটশিল্প ও বস্ত্রশিল্পের কর্মীদের জীবনধারণের উপযোগী মজুরির দাবি তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন করেন। এর জন্যে শক্তিশালী আন্দোলনের প্রয়োজনের কথা বলেন। পরস্পর-বিরোধী চিন্তাধারা শ্রমজীবীদের বিভ্রান্ত করে তুলছে বলে তিনি ‘দক্ষিণপন্থী সংস্কারবাদী’ ও কমিউনিস্টদের তীব্র সমালোচনা করেন। এই দুই দলের মাঝে তিনি নিজেকে তৃতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেন। তিনি বলেন যে, এই দল পুরোদস্তুর সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা! এই সমাজতন্ত্র হবে ভারতের নিজস্ব ধরণের— “তার মধ্যে এমন নতুন কিছু অভিনব কিছু থাকবে, সারা বিশ্ব যার দ্বারা লাভবান হবে।” এর এক সপ্তাহ পরে শ্রমিক সংগঠনে ‘মস্কোজাত বিপদের সম্ভাবনা’ সম্পর্কে এক বিবৃতিতে তিনি খোলাখুলি বলেন, “মস্কোর আঁচল ধরে চলতে” ভারতীয় শ্রমিকরা রাজি নন।” কমিউনিস্টরা নিরন্তরভাবে জাতীয় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, শ্রমিক ইউনিয়নে যাঁরা তাঁদের দলভুক্ত নন তাঁদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। “মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরা ভারতে সুস্থ শ্রমিক ইউনিয়নের বিকাশের পথে গুরুতর বিপদস্বরূপ।” তিনি অভিযোগ করেন যে, এস. ভি. দেশপাণ্ডের মতো কমিউনিস্ট শ্রমিক নেতারা চান যে ‘জাতীয় কংগ্রেস নিপাত যাক’, ‘গান্ধী নিপাত যাক’ এই আওয়াজে তাঁরাও (সুভাষচন্দ্ররা) গলা মেলান। তিনি কমিউনিস্টদের সোজাসুজি সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, তা হবে না। “আমাদের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই নিজেদের প্রকৃত আনুগত্য গোপন করার, ছদ্ম-পরিচয়ে নিজেদের জাহির করার।…আমরা যারা কংগ্রেসকর্মী তারা কংগ্রেসকর্মীই থাকব।” শেষপর্যন্ত যাতে কংগ্রেস ও সারা ভারত শ্রমিক ইউনিয়নের সুসম্পর্ক থাকে তার জন্যে তাঁরা চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। বলা বাহুল্য, সুভাষচন্দ্রের এত খোলাখুলি বিবৃতি ও ‘মস্কোর আঁচল ধরে না চলা’র ঘোষণা কমিউনিস্টদের আরও বেশি জাতীয় কংগ্রেস ও সুভাষবিরোধী করে তুলেছিল। এর ফলে কমিউনিস্ট আন্দোলনের যে ক্ষতি হয়েছিল, কমিউনিস্টরা যে জাতীয় আন্দোলনের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জনসাধারণ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন তা অনেক পরে তাঁরা স্বীকার করেছিলেন। সুভাষচন্দ্রকে জানতে ও বুঝতে কমিউনিস্টরা বড় ভুল করেছিলেন। সে ইতিহাস কয়েক বছর পরের ঘটনা।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন