কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনের (১৯২৮) অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল বাংলার ছাত্র যুব সমাজে গান্ধীজির জনপ্রিয়তা হ্রাস। তাঁর সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের আদর্শগত বিরোধ প্রকাশ্যেই দেখা দিয়েছিল। কিন্তু সাইমন কমিশন-বিরোধী আন্দোলন, বিদেশী দ্রব্য ও বস্ত্র-বয়কট এবং বস্ত্রযজ্ঞ (অর্থাৎ বিদেশী কাপড় পোড়ানো) অব্যাহত ছিল। সুভাষচন্দ্র এই আন্দোলনের সাফল্যের জন্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। কংগ্রেস তথা জাতীয় আন্দোলনে গান্ধীজির নেতৃত্ব ছিল অবিসংবাদী। সুভাষচন্দ্র তাঁর কর্মসূচী ও সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন তুললেও গান্ধীজির নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার চিন্তাও করেননি। তা সত্ত্বেও কলকাতার অত্যুৎসাহী ছাত্র-যুব সমাজ গান্ধীজির উপর বিশেষ ক্ষুব্ধ হয়েছিল। ১৯২৯ সালের ৪ মার্চ শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কে এক জনসভায় গান্ধীজি বক্তৃতা দিতে আসেন। সুভাষচন্দ্রের আশঙ্কা ছিল সভায় গান্ধীজির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হতে পারে, তাই সভার শুরুতেই তিনি আবেদন জানান, সকলে যেন গান্ধীজির মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখেন। অনেকদিন পরে তিনি এসেছেন। তাঁর কাছ থেকে সকলে শুনতে চান। বিদেশী বস্ত্ৰযজ্ঞের পবিত্র বহ্নিশিখা গান্ধীজি আজ প্রজ্বলিত করছেন। তার গুরুত্ব বাঙালি যেন উপলব্ধি করে। এই সভায় ও সভার পরে পুলিশি হামলা হয়েছিল। কিন্তু গান্ধীজি, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ও সুভাষচন্দ্রের প্রচেষ্টায় জনসাধারণ শান্ত থাকায় বড়রকমের দুর্ঘটনা ঘটেনি। এর পর বস্ত্র বয়কট ও বস্ত্রযজ্ঞ অব্যাহত থাকে। সরকারি দমন নীতি, ক্রমবর্ধমান শ্রমিক অসন্তোষ ও আন্দোলন, ছাত্র-যুব-নারী জাগরণ স্বাধীনতার স্পৃহা ও জাতীয় আন্দোলনকে তীব্রতর করে তোলে। ভারতীয় শ্রমিক মহলকে শান্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে মিঃ হুইটলিকে চেয়ারম্যান করে শ্রমিকদের অবস্থা ও তার উন্নতির সম্ভাব্য ধারা সম্পর্কে রিপোর্ট দেবার জন্যে একটি কমিশন গঠন করা হয় (Whitley Commission on Indian Labour)। সাইমন কমিশনের মতো উদ্দেশ্যমূলক এই কমিশন বয়কট করার জন্যে সুভাষচন্দ্র আহ্বান জানান।
সাইমন কমিশন-বিরোধী আন্দোলন পূর্ণোদ্যমে অব্যাহত রাখতে সুভাষচন্দ্র নিরলসভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। ‘ব্রিটিশ বস্ত্র বর্জন’ ও ‘বস্ত্রযজ্ঞ’ তাঁর কাছে ইংরাজ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক ছিল। তাঁর মনে আশঙ্কা দেখা দিচ্ছিল যে, ব্রিটিশ সরকার সুকৌশলে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রগতিকে স্তিমিত করার উদ্যোগ নিচ্ছে। ব্রিটিশ কূটবুদ্ধির ফলে জাতীয় আন্দোলনের নেতাদের মনেও আপস-মীমাংসার একটি প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। ছাত্র-যুবক সমাজকে, বিশেষ করে বাংলার যুবশক্তিকে, তিনি বিরামহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্যে উদ্বুদ্ধ করতে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর প্রতিটি ভাষণে এই সুরটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। সুভাষচন্দ্রের ডাকে ছাত্র-যুবক সমাজে যে প্রচণ্ড উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হচ্ছিল তাতে রক্ষণশীল কংগ্রেস নেতাদের অনেকেই বিচলিত বোধ করছিলেন। যৌবনের স্বভাবোচিত উচ্ছ্বাসের প্রকাশও ঘটেছিল কোনও কোনও ক্ষেত্রে। তার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ছাত্ররা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠেছে বলে, “আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করা হচ্ছে। শৃঙ্খলা ও আইন-কানুন অবশ্যই মেনে চলতে হবে। কিন্তু প্রচলিত অর্থে আইন-শৃঙ্খলা মানার কথা বলা হলে আমি তাতে কর্ণপাত করব না। তরুণ সমাজের অ্যাডভেঞ্চার প্রবণতা স্বাস্থ্যের লক্ষণ।”
মান্দালয় থেকে ফিরে রাজনৈতিক আন্দোলনে পুনঃপ্রবেশের পর থেকেই সুভাষচন্দ্রের মনের মধ্যে এক ঝড় উঠতে শুরু করেছিল। ক্রমেই তাঁর মন অসহিষ্ণু, বিক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী হয়ে উঠছিল। তাঁর মনে হচ্ছিল মুক্তি সংগ্রাম যত দুর্বার ও আপসহীন হওয়া দরকার তা ঠিক হয়ে উঠছে না। যে সক্রিয় মানসিকতা, গতিশীল কর্মসূচী দেশের অগ্রগতি, আমূল পরিবর্তন ও স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে প্রয়োজন তার অভাব লক্ষ্য করে তিনি বিচলিত বোধ করছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ-স্বামী বিবেকানন্দের ভাবধারা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু রামকৃষ্ণ মিশন স্বামীজির ভারতের সার্বিক পুরুজ্জীবন ও জাতি গঠনের আদর্শ রূপায়ণের পথ থেকে সরে গেছে বলে তাঁর অভিমতের উল্লেখ পূর্বেই করেছি। নিজের জীবনে শ্রীঅরবিন্দের অসীম প্রভাব সত্ত্বেও তিনি ‘পণ্ডিচেরীর চিন্তাধারা’র সমালোচনা করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। তেমনি, গান্ধীজির ‘সবরমতী চিন্তাধারা’ও তিনি দেশের সার্বিক প্রগতির পথে অন্তরায় বলে মনে করেছিলেন। ১৯১৫ সালে আমেদাবাদে সবরমতী নদীর তীরে গান্ধীজি এক আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই আশ্রমে স্বদেশপ্রেমিক ভারতীয়দের সত্যাগ্রহের আদর্শ ও পদ্ধতি সম্বন্ধে শিক্ষাদান করা হত। আশ্রম জীবনে গান্ধীজির অর্থনৈতিক চিন্তাধারাও প্রতিফলিত হত। সুভাষচন্দ্র সবরমতী আশ্রমের উল্লেখ করে বলেন, “সবরমতী হতে উদ্ভূত চিন্তাধারার আন্দোলনের বাস্তবিক উদ্দেশ্য দেশের মধ্যে এইরূপ মনোভাবের সৃষ্টি করা যে, আধুনিক যা-কিছু সব মন্দ। অধিক পরিমাণ কিছু উৎপাদন অত্যন্ত অশুভজনক। অভাব ও জীবিকা নির্বাহের মান বাড়ানো উচিত নয়, আমাদের আবার গো-যানের যুগে ফিরে যেতে হবে এবং আধ্যত্মিক উন্নতির জন্য ব্যায়ামচর্চা ও সামরিক শিক্ষার প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করতে হবে।” সুভাষচন্দ্রের এই সমালোচনা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করে যে, গান্ধীজির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মতই শুধু নয় তাঁর জীবনদর্শনের সঙ্গেও তাঁর (সুভাষের) দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক মতপার্থক্য আছে। এই পার্থক্য ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে তিরিশের দশকের শেষের দিকে গান্ধী-সুভাষ ঐতিহাসিক বিতর্ক ও বিরোধের রূপ নিয়েছিল।
শ্রীঅরবিন্দের পণ্ডিচেরী আশ্রম সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের মুখ্য অভিযোগ ছিল ওই আশ্রমের চিন্তাধারা দেশের মধ্যে এই মনোভাবের সৃষ্টি করছে যে, “শান্তভাবে সাধনা অপেক্ষা আর কিছু মহৎ নেই, যোগের অর্থ প্রাণায়াম ও ধ্যান, অনেক সংঘর্ষ থাকলেও ঐরূপ যোগ করা সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।” সুভাষচন্দ্র তাঁর নিজের বিশ্বাস ব্যক্ত করে বলেন, “এই আন্দোলনের ফলে অনেকে ভুলে গেছে যে, নিঃস্বার্থ ও একনিষ্ঠ কার্য দ্বারাই মাত্র বর্তমান অবস্থায় আধ্যাত্মিক উন্নতি সম্ভব⋯চারদিক হতে আমরা যে-রূপ ভাবে বিপদ জালে জড়িত, তাতে সাধনার আশ্রয় গ্রহণ করা একটা দুর্বলতা মাত্র। এই চিন্তাধারার নিষ্ক্রিয়তারই আমি প্রতিবাদ করছি।” সুভাষচন্দ্র নিজে কৈশোর কাল থেকেই সাধু-সন্তদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এক সময়ে গুরুর সন্ধান করেছিলেন। দেশপ্রেম, সমাজকল্যাণ ও অধ্যাত্মচিন্তার সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর জীবনে। ভারতের যোগী-ঋষিদের সাধনা, তাঁদের আশ্রমপ্রতিষ্ঠা ও আশ্রমজীবন তিনি গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু তাঁর জীবনের ধ্যান, জ্ঞান, আদর্শ ও লক্ষ্য ছিল—একটিই। পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত ভারতবর্ষ। তার জন্যে জীবনপণ সংগ্রাম। অর্জুনের লক্ষ্যভেদের পাখিটির মতো, তাঁর একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উচ্ছেদ। এর জন্যে চাই কর্মযোগ, নিরন্তর সংগ্রাম। অন্তরের এই গভীর উপলব্ধি, নিজের অটল বিশ্বাসের কথা ঘোষণা করতে তাঁর কোনও দ্বিধা, সঙ্কোচ ছিল না। তাই তিনি বলতে পেরেছিলেন, ভারতকে স্বাধীন, শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হলে যোগী-ঋষিদের পন্থায় চললে হবে না। “এই সত্য কথা বলতে গিয়ে যদি আপনাদের মনে আমি কোনোরূপে আঘাত করে থাকি তাহলে আমাকে মার্জনা করবেন।” তিনি বলেন, সবরমতী বা পণ্ডিচেরীর চিন্তাধারার মূলে যে দার্শনিক ভিত্তি আছে তার সমালোচনা তিনি করছেন না। উভয় চিন্তাধারার বাস্তবতার দিক থেকেই তিনি সমালোচনা করছেন। “আমরা এখন ভারতবর্ষে চাই প্রবল কর্মবাদ⋯আমাদের একদিকে যেমন ‘বৈদিক যুগে ফিরে যাও’ চিৎকারে বাধা দিতে হবে, তেমনি অপর দিকে আধুনিক ইউরোপের অনুকরণে অর্থশূন্য পরিবর্তনের বিরোধিতাও করতে হবে।” এই বিশ্বাস ও লক্ষ্যই সুভাষচন্দ্র বসুকে স্বামী বিবেকানন্দের ভাবাদর্শের অনেক কাছে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।
একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা কিন্তু স্মরণ রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। তা না হলে সুভাষচন্দ্রকে সঠিকভাবে বুঝতে ভুল হবার আশঙ্কা আছে। সুভাষচন্দ্র যাঁদের গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন, যাঁদের আদর্শ ও কর্মের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, যাঁদের জীবন, সাধনা ও অবদানকে মহৎ বলে স্বীকার করতেন, তাঁদেরই তিনি সম্ভবত বেশি সমালোচকের দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। নিজের পিতা-মাতা থেকে শুরু করে কালক্রমে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, মহাত্মা গান্ধী, শ্রীঅরবিন্দ, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি সকলের ক্ষেত্রেই এই কথাটি কমবেশি প্রযোজ্য। রবীন্দ্রনাথকে তিনি অসীম শ্রদ্ধা করতেন। রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহধন্য ছিলেন তিনি। রবীন্দ্র সাহিত্য ও রবীন্দ্র সঙ্গীত ছিল তাঁর জীবনের শক্তি ও অনুপ্রেরণার অন্যতম প্রধান উৎস। তাঁর জীবনের সঙ্কটকালে, গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তাঁর মনে আসত রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা। এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। কিন্তু সেই রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্যের কিছু কিছু দিক সম্বন্ধে বিরূপ মন্তব্য প্রকাশে তিনি দ্বিধা করেননি। যেমন, মান্দালয় জেল থেকে শরৎচন্দ্র বসুকে একটি চিঠিতে (১ আগস্ট, ১৯২৫) ‘নারায়ণ’ পত্রিকায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের বাংলার প্রাচীন ও জাতীয় সংস্কৃতির পুনরুত্থান সম্পর্কীয় বক্তব্যের প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথের ও রবীন্দ্রানুসারীদের জীবনে ও সাহিত্যে যে শূন্যগর্ভ, অগভীর আন্তর্জাতিকতাবাদের স্ফূরণ দেখা যায়, এবং যে আন্তর্জাতিকতাবাদ ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদের মূল সত্যটি অনুধাবন করতে অক্ষম, চিত্তরঞ্জন সঙ্গে সঙ্গে তাকেও অনাবৃত করে দেখাতে চেয়েছিলেন।” সুভাষচন্দ্রের এই রবীন্দ্র-বিচারে ভুল হয়েছিল এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিকতাবাদের সঙ্গে তাঁর জাতীয়তাবাদ বা বোধের কোনও বিরোধ ছিল না। কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদ—যা মানুষে-মানুষে দেশে-দেশে বিভেদ সৃষ্টি করে, মনকে সঙ্কীর্ণ করে তোলে তার বিরোধী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জাতীয় সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনে রবীন্দ্রনাথ কম সচেষ্ট ছিলেন না। কিন্তু তরুণ সুভাষের মনে তখন দেশের স্বাধীনতা লাভের জন্যে ‘Nationalism’-ই একমাত্র গ্রহণযোগ্য ছিল। Internationalism (আন্তর্জাতিকতাবাদ) তাঁর কাছে গৌণ ছিল। পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিকবাদ সম্পর্কেও সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথকে তিনি আরও গভীরভাবে বুঝেছিলেন। কিন্তু মান্দালয় জেলের পরিবেশে ও তৎকালীন রাজনৈতিক পরিবেশে তাঁর যা অনুভূতি হয়েছিল সে কথা সুভাষচন্দ্র অকপটে প্রকাশ করেছিলেন। বক্তব্যের দৃঢ়তা, স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতা সুভাষচন্দ্রের জীবনের এক বৈশিষ্ট্য ছিল। অনেক সময়ই এর জন্যে তাঁকে লোকে ভুল বুঝেছিলেন।
কলকাতার সিটি কলেজ ছাত্রদের সরস্বতী পুজো করার দাবি নিয়ে যে বিতর্ক দেখা দিয়েছিল সেই প্রশ্নেও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের প্রকাশ্য মতভেদ দেখা দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সিটি কলেজে হিন্দু ছাত্রদের সরস্বতী পুজো করার দাবি সমর্থন করেননি। তিনি মনে করেছিলেন এই রকম দাবি সাম্প্রদায়িক বিরোধ সৃষ্টি করে ধর্মসমন্বয়ের আদর্শ বিঘ্নিত করবে। সুভাষচন্দ্র মনে করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের পক্ষে এই বিতর্কে না জড়িয়ে নিরপেক্ষ থাকাই শ্রেয় ছিল। সহিষ্ণুতার প্রশ্ন ওঠায় সুভাষচন্দ্র বলেন, “সহিষ্ণুতার অর্থ এই নয় যে, নিজধর্ম পরিত্যাগ করতে হবে। আমার মতে ছাত্রদের পুজো করতে না দিয়ে ব্রাহ্মরাই বেশি অসহিষ্ণুতা দেখিয়েছেন।” এই বিতর্ক সেদিন কলকাতায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। রবীন্দ্রনাথের এরকম প্রকাশ্য সমালোচনায় অনেকেই বিস্মিত এবং দুঃখিত হয়েছিলেন। কালক্রমে ঐ বিতর্কের কথা লোকে বিস্মৃত হয়ে গেছে। কিন্তু যা স্মরণীয় হয়ে আছে তা হল রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্র দু’জনেই পারস্পরিক গভীর শ্রদ্ধা ও স্নেহের সম্পর্কে আবদ্ধ হলেও, নিজের অভিমত ব্যক্ত করতে সঙ্কোচ বোধ করেননি। ওই বিতর্ক তাঁদের সম্পর্কে কোনও ছায়াপাত করেনি। সিটি কলেজের ঘটনা যখন চরমে উঠেছে, কলেজের সামনে সত্যাগ্রহী ছাত্ররা গ্রেপ্তার হয়েছে, তখন সুভাষচন্দ্র প্রকাশ্য বিবৃতিতে তার নিন্দা করেছেন (২০ জুলাই, ১৯২৮)। আবার তারপরের দিনই আর একটি ভাষণে তিনি বলছেন, “রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতায় জীবনের অফুরন্ত কর্মশক্তি ও ব্যক্তির জীবনে সেই শক্তির প্রসার ভাষা পেয়েছে।” অন্যত্র রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশচন্দ্র বসুর মতো মানুষ যে দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন সেই দেশের স্বাধীনতা লাভের যোগ্যতাকে প্রশ্ন করার অসারতার কথা বলেছেন। পঞ্জাবে ছাত্র সম্মেলনে সগর্বে উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ কেমন ভাবে পঞ্জাবের ইতিহাস থেকে পঞ্জাবের বীরদের কাহিনী ভিত্তি করে, মহান সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে তা বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। মহত্ত্বের অকুণ্ঠ স্বীকার, প্রবীণদের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা অটুট রেখেও নীতি ও কর্তব্যের প্রয়োজনে প্রকাশ্য বিরোধিতা বা ভিন্নমত ব্যক্ত করার নৈতিক সাহস এবং শক্তি সুভাষচন্দ্রের ছিল। এমন চরিত্রবল প্রকৃতই বিরল।
শ্রীঅরবিন্দের দৃষ্টিভঙ্গি ও তাঁর অবদানের মূল্যায়ন প্রসঙ্গেও সুভাষচন্দ্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের এই দিকটি ফুটে উঠেছিল। সুভাষচন্দ্রের জীবনে শ্রীঅরবিন্দের প্রভাব ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। পণ্ডিচেরীর চিন্তাধারার ‘নিষ্ক্রিয়তা’র সমালোচনার অল্প কিছু কাল পূর্বেই তিনি তিলকের মৃত্যুতিথি উপলক্ষে এক ভাষণে বলেছিলেন, তিলক ও অরবিন্দ উভয়েই জাতীয়ভাবের প্রতীক। দু’জনেই আমাদের নমস্য। কিন্তু বিপ্লবী অরবিন্দকে সুভাষচন্দ্র যত সহজে বুঝেছিলেন ঋষি, মহাযোগী শ্রীঅরবিন্দ তাঁর কাছে তুলনামূলকভাবে দুর্জ্ঞেয় ছিলেন। এই নিয়ে সুভাষচন্দ্র ও দিলীপকুমার রায়ের মধ্যে অনেক চিঠিপত্র বিনিময় ও আলোচনা হয়েছিল। শ্রীঅরবিন্দ সুভাষচন্দ্রকে গভীর স্নেহ করতেন। তাঁর অসাধারণ চরিত্র ও দেশপ্রেমে মুগ্ধ হয়েছিলেন। দিলীপকুমার সুভাষের লেখা চিঠিগুলি তাঁকে পড়ে শোনাতেন। অরবিন্দ গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনতেন। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর অভিমতও ব্যক্ত করতেন। পণ্ডিচেরী আশ্রম সম্বন্ধে সুভাষের মন্তব্যে তিনি অখুশি হয়েছিলেন। একমাত্র যুক্তিবাদ ও কর্মবাদের ওপর সুভাষচন্দ্রের বিশ্বাস প্রসঙ্গে অরবিন্দ দিলীপকুমারকে বলেছিলেন, “তোমার হতাশ বন্ধুটি চান সবাই তাঁর মত ও পথ অনুসরণ করে চলুক। কেন তা হবে? রাজনীতিকের এই স্বপ্ন কখনই তো সার্থক হয় না⋯তিনি তোমাকে তিরস্কার করেছেন অন্ধ-বিশ্বাসের কাছে যুক্তিবিচারকে জলাঞ্জলি দিয়েছ বলে। কিন্তু যুক্তিসহ বিশ্বাস ছাড়া তাঁর মতবাদই বা কী? তোমার বিশ্বাস অনুযায়ী তুমি চল, তাঁর বিশ্বাসমত তিনি চলেন এ তো স্বাভাবিকই, কিন্তু তাঁর মত যে তোমার মতের চেয়ে তাড়াতাড়ি সত্যে পৌঁছতে পারবে তার কোনো সম্ভাবনা নেই⋯কোন্ যুক্তি, কোন্ বিচার বলে দেবে কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা?⋯রহস্যময় এই পৃথিবীর আপাতবিরোধের মাঝখানে বিশ্বাসটাকে উড়িয়ে দেবার কোনো কারণ নেই।”
বিশ্বাস-যুক্তি, যোগবল-আত্মশক্তি, জীবনের রহস্য সম্বন্ধে এইসব তত্ত্ব নিয়ে মতপার্থক্যের মধ্যে যে মাধুর্যময় বৈশিষ্ট্য ছিল তা হল সুভাষচন্দ্রের প্রতি অরবিন্দের গভীর স্নেহাশিস ও শুভ-কামনা। আর তেমনি, অকৃত্রিম অরবিন্দের প্রতি সুভাষের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও তাঁর শুভাশিস পাওয়ার আকুলতা। সুভাষচন্দ্র গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে অরবিন্দ তাঁর কল্যাণকামনায় নিজর যোগশক্তি ব্যবহার করেছিলেন, দিলীপকুমার তাঁর বন্ধু সুভাষকে শ্রীঅরবিন্দের একটি আশীর্বাদী ফুল পাঠিয়েছিলেন। এই ফুল ও অরবিন্দের আশীর্বাদ পেয়ে সুভাষচন্দ্র আনন্দে ও কৃতজ্ঞতায় অভিভূত হয়ে লিখেছিলেন, “আমি জানি না তোমার (দিলীপকুমারের) যোগবল গ্রহণ করার মতো সরলতা আমার কাছে কি না—হয়তো তা নেই। কিন্তু তা না থাকলেও আমার মনে হয়, যাঁরা আধ্যাত্মিক তত্ত্বে বিশ্বাসী নন, বা মনের অসীম শক্তিতে যাঁদের আস্থা নেই তাঁরাও তো ‘উইলফোর্স’-এর কথা অস্বীকার করতে পারেন না। এই যে মানসিক শক্তি—তার যে নামই দেওয়া হোক না কেন—তারা কাজ করবেই, গ্রহীতা যদি যোগ্য পাত্র না-ও হয় তবু ঐ ইচ্ছা ব্যর্থ হবে না। শ্রীঅরবিন্দের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ—তাঁকে আমার প্রণাম জানিও।”
দিলীপকুমার রায়কে এই চিঠি (১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২) সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন মাদ্রাজের ‘পেনিটেনশ্যারি’ (চিকিৎসার জন্যে কারাগার-বিশেষ) থেকে। তাঁর পণ্ডিচেরী আশ্রমে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল বহুদিনের। কিন্তু এত কাছে এসেও তা সম্ভব না হওয়ায় তিনি দুঃখ করে লিখেছিলেন, “সত্যি মাদ্রাজ পণ্ডিচেরীর কত কাছে—কিন্তু মধ্যিখানের দেয়ালগুলিই বাধা—পৃথিবীর নানা ব্যবধান এই কারণেই।” যুক্তি ও বিশ্বাস প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্রের আর একটি চিঠির উল্লেখ করি। কয়েক মাস পরে (৫ মার্চ, ১৯৩৩) দিলীপকুমারকে তিনি লিখেছিলেন, “তুমি জান সম্প্রতি (প্রায় ৪/৫ বছর যাবৎ) আমি মন্ত্রশক্তিতে বিশ্বাস করি। এর আগে সাধারণ বিচারবাদী যুক্তিতে আমি মনে করতাম মন্ত্র একটা প্রতীক মাত্র, শুধু মনঃসংযোগে সহায়তা করে। কিন্তু তান্ত্রিক দর্শন পড়ে আমার বিশ্বাস হয়েছে যে কতকগুলি মন্ত্রের সত্যই শক্তি আছে—এক এক মানসিক অবস্থার পক্ষে এক একটা বিশেষ মন্ত্রের প্রয়োজন। তারপর থেকে আমি বুঝতে চেষ্টা করেছি আমার মানসিক অবস্থাটা ঠিক কি রকম, কোন ধরনের মন্ত্র আমার পক্ষে কার্যকর হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা পেরে উঠিনি, কারণ আমার মানসিক অবস্থা অনবরত পাল্টায়—কখনও আমি শৈব, কখনও শাক্ত, আবার কখনও বা বৈষ্ণব। আমার মনে হয় এই কারণেই গুরুর প্রয়োজন—কারণ যিনি যোগ্য গুরু তিনি আমাদের সম্বন্ধে, আমাদে, নিজেদের চেয়েও বেশি বুঝতে পারেন। তিনি হয়তো তৎক্ষণাৎ বলে দিতে পারেন কার পক্ষে কোন মন্ত্র উপযোগী, কার পক্ষে কোন পন্থা শ্রেষ্ঠ।”
কঠোর যুক্তিবাদী সুভাষচন্দ্রও যুক্তি ও বিশ্বাসের চিরন্তর দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত থাকতে পারেননি। এই দুয়ের মধ্যে কোনও দুর্ভেদ্য দেয়াল তিনি পাননি, যেমন পাননি আরও অনেক যুক্তিবাদী মানুষ। নিজের মানসিক অবস্থা অনবরত পাল্টায়—এই স্বীকারোক্তি সুভাষচন্দ্রের জীবন ও চিন্তাধারার এক বড় দিক উন্মোচন করে। তাঁর অন্তর ও বহির্জীবন উভয়ই নিস্তরঙ্গ দিঘির মতো ছিল না। মহাসমুদ্রের মতো তরঙ্গময় ছিল তাঁর জীবন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন