দেশনায়ক – ১৪

গান্ধীজি ও সুভাষচন্দ্রের মধ্যে মতানৈক্য, ক্রমে তা প্রকাশ্য বিরোধ ও সংঘাতে পরিণত হয়ে সুভাষচন্দ্রের ফরওয়ার্ড ব্লক দল গঠন, তিন বছরের জন্যে ‘শৃঙ্খলাভঙ্গের’ অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে কংগ্রেসের কার্যনির্বাহক কমিটির শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ইত্যাদির সম্বন্ধে এক প্রচলিত ধারণা হল যে, ওই ঘটনা প্রবাহের সূচনা হয়েছিল তিরিশের দশকের শেষের দিকে। প্রকৃত ঘটনা কিন্তু তা নয়। গান্ধীজির প্রতি ক্ষোভ, তাঁর কর্মপদ্ধতি ও নেতৃত্ব সম্বন্ধে সংশয় সুভাষচন্দ্রের মনে দেখা দিয়েছিল অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের সময় থেকেই। তারপর থেকেই সুভাষচন্দ্রের মনে গান্ধীজির মত, পথ, নেতৃত্ব সম্পর্কে সন্দেহ ও অনাস্থা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে।

গান্ধীজির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারই সুভাষচন্দ্রের পক্ষে খুব আশাব্যঞ্জক হয়নি। গান্ধীজির পরিকল্পনার মধ্যে তিনি স্পষ্টতার ‘শোচনীয় অভাব’ লক্ষ্য করেছিলেন। কেমন করে ধাপে ধাপে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করবে সে বিষয়ে গান্ধীজির নিজেরই কোনও স্পষ্ট ধারণা আছে বলে সুভাষের মনে হয়নি। তিনি খুবই নিরুৎসাহ ও হতাশ হয়েছিলেন গান্ধীজির কথাবার্তায়। যিনি ইতিমধ্যেই কংগ্রেস তথা জাতীয় আন্দোলনের সর্বময় নেতা রূপে স্বীকৃত, তাঁর সম্বন্ধে প্রথমেই এরকম মনে হওয়া উভয়ের সম্পর্কের পক্ষে শুভ ইঙ্গিত ছিল না। সুভাষচন্দ্রের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি কোনও কিছুই বা কাউকেই বিচার-বিশ্লেষণ না করে গ্রহণ করতেন না। নিজের পিতা, মাতা, সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় মেজদাদা শরৎচন্দ্রকেও নয়। তাঁর মানসিকতাই ছিল বিদ্রোহীর। এর একমাত্র ব্যতিক্রম ঘটেছিল দেশবন্ধুর প্রতি আনুগত্যের ক্ষেত্রে। কিন্তু তাঁর কথারও প্রতিবাদ করতে সুভাষ ছাড়তেন না। দেশবন্ধুর অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তর্ক-বিতর্কের পর নিজের সিদ্ধান্তে অন্যদের সম্মত করানোতে। অন্যদিকে গান্ধীজিও নিজের মত ও বিশ্বাসে অটল থাকতেন। আলাপ-আলোচনা করলেও তিনি সহকর্মী ও অনুগামীদের পূর্ণ আনুগত্য প্রত্যাশা করতেন। অন্যথা হলে বেশ অপ্রসন্ন হতেন! এইরকম দুই চরিত্র ও মানসিকতার ব্যক্তির পক্ষে একসঙ্গে কাজ করা বেশ দুরূহ ছিল। গান্ধী-সুভাষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিল। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও স্নেহের যে একটা বন্ধন গড়ে ওঠেনি তা নয়, কিন্তু শেষপর্যন্ত মৌলিক নীতি আদর্শ ও কর্মসূচীকে কেন্দ্র করে যে মতপার্থক্য উভয়ের মধ্যে দেখা দেয় তা ওই বন্ধনকে শিথিল করে তোলে।

চৌরিচৌরার ঘটনার পর গান্ধীজি হঠাৎ অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত রাখায় দেশের সর্বত্র এক গভীর হতাশা নেমে আসে। আন্দোলন যখন তুঙ্গে উঠে ব্রিটিশ সরকারকে সত্যিই বিচলিত ও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে ঠিক সেই সময় এই সিদ্ধান্ত সুভাষচন্দ্রের কাছে ‘বিনা মেঘে বজ্রাঘাত’ বলে মনে হয়েছিল। তাঁর মনে হয়েছিল গান্ধীজি দেশব্যাপী আন্দেলানকে ‘গলা টিপে হত্যা’ করেছেন। মতিলাল নেহরু, লালা লাজপৎ রায়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন থেকে শুরু করে কংগ্রেসের হাজার হাজার কর্মী গান্ধীজির সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হন। সুভাষচন্দ্র তখন দেশবন্ধুর সঙ্গে কারাগারে। গান্ধীজির সিদ্ধান্তের কথা জেনে দেশবন্ধু রাগে ও দুঃখে আত্মহারা হয়ে যান। সেই সময় অনেকেই সন্দেহ করেছিলেন যে, গান্ধীজি গোপন সূত্রে কিছু তথ্য পেয়ে নিজেও আঁচ করেছিলেন যে বারদৌলিতে কর-বন্ধ আন্দোলন সফল হবে না। আর, সে ক্ষেত্রে তাঁর পক্ষে অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। তাই চৌরিচৌরার ঘটনাটিকে আন্দোলন প্রত্যাহারের অজুহাত রূপে তিনি ব্যবহার করেছিলেন। সুভাষচন্দ্রের লেখা পড়ে মনে হয় তিনি নিজেও এরকম সন্দেহ করেছিলেন। একমাত্র ‘মহাত্মার গোঁড়া ভক্তের দল’ ছাড়া সকলেই মহাত্মার সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন বলে সুভাষচন্দ্র উল্লেখ করেছেন। কথাটি খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ। গান্ধীজি যে কংগ্রেসের ‘একচ্ছত্র অধিনায়ক’ হয়ে উঠেছিলেন তা সুভাষচন্দ্র পছন্দ করেননি। প্রথম থেকেই তাঁর আপসমূলক নীতি তিনি সমর্থন করতে পারেননি। জাতিভেদ, জমিদার-কৃষক সম্পর্ক, পুঁজিবাদ-শ্রমিক স্বার্থ, রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের নীতি প্রভৃতি মৌলিক প্রশ্নে সুভাষচন্দ্রের সমর্থন ছিল কংগ্রেসের মধ্যে যাঁরা আমূল সংস্কারের পক্ষপাতী তাঁদের দিকে।

অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচী, নীতি ও শেষপর্যন্ত গান্ধীজির প্রতিশ্রুতি—‘এক বছরের মধ্যেই স্বরাজ’ প্রতিষ্ঠিত হবে, কতটা ও কীভাবে সফল হবে এই সন্দেহ সুভাষচন্দ্রের প্রথম থেকেই ছিল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনেরও গান্ধীজির নীতি ও কর্মসূচী পছন্দ হয়নি। কিন্তু শেষপর্যন্ত গান্ধীজি কৌশলে পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে আনতে সক্ষম হন। চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে তাঁর এক বোঝাপড়া সম্ভব হয়। তাঁর বিপুল প্রভাব ও জনপ্রিয়তার দ্বারা দেশবন্ধু কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থীদেরও নিরস্ত করতে সফল হন। এরপর অসহযোগ আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। জনসমর্থন ও উদ্দীপনা বাড়তে থাকে।

সুভাষচন্দ্র তখন পর্যন্ত কংগ্রেসে কোনও পরিচিত বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব নন। নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে তাঁর কোনও ভূমিকাই ছিল না। কিন্তু দেশবন্ধু ও সুভাষচন্দ্রের মতো কিছু সহকর্মীর অক্লান্ত প্রচেষ্টা, জনসংযোগ, সংগঠনের ক্ষমতা ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত সর্বত্র অভূতপূর্ব উৎসাহ সৃষ্টি করে। যে দু’টি প্রশ্নে গান্ধীজি আন্দোলন শুরু করেছিলেন তার একটি সম্পর্কে অন্য অনেকের মতো সুভাষচন্দ্রেরও সংশয় ছিল। ওই প্রশ্নটি ছিল, তুরস্কের সম্রাট (যিনি একাধারে ছিলেন ‘সুলতান ও খলিফা’) তাঁকে স্বস্থানে ও স্বমর্যাদায় পুনঃ প্রতিষ্ঠার দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল (খিলাফৎ আন্দোলন) তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে ওই বিষয়টিকে অসহযোগ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য রূপে ঘোষণা করা। এই সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের চিন্তায় কিছুটা স্ববিরোধ ছিল। তাঁর ‘ভারতের মুক্তি সংগ্রাম’ (The Indian Struggle 1920-1942) গ্রন্থে এটি লক্ষ্য করা যায়। তাঁর মতে জাতীয় প্রশ্নগুলির সঙ্গে খিলাফৎ প্রশ্নকে যুক্ত করার মধ্যে ‘কোনও প্রকৃত ভুল নিহিত ছিল না’। আসল ভুল হয়েছিল জাতীয় কংগ্রেস থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র স্বাধীন একটি সংগঠন রূপে দেশব্যাপী খিলাফৎ কমিটি গঠন করতে দেওয়া। যদি তা না করতে দিয়ে খিলাফৎপন্থী মুসলমানদের কংগ্রেসে যোগ দিতে বলা হত, তাহলে তুরস্কে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও খলিফা পদের অবলুপ্তির ফলে যখন খিলাফৎ প্রশ্ন অর্থহীন হয়ে পড়ল, তখন কংগ্রেস তাদের দলভুক্ত করে নিতে পারত। খিলাফৎপন্থী মুসলমানদের অনেকেই সাম্প্রদায়িক, প্রতিক্রিয়াশীল এবং ব্রিটিশ-ঘেঁষা মুসলমান দলে যোগ দিতেন না। অন্যত্র সুভাষচন্দ্র বলেছেন, “ভারতীয় রাজনীতিতে খিলাফং প্রশ্নকে স্থান দেওয়া দুর্ভাগ্যজনক হয়েছিল।” একই সঙ্গে তিনি পুনরাবৃত্তি করেছেন যে খিলাফৎপন্থী মুসলমানরা একটি পৃথক দল গঠন না করে কংগ্রেসে যোগদান করলে এরকম ‘অবাঞ্ছিত পরিণাম’ হত না। খিলাফৎপন্থী মুসলমানেরা জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে মিশে যেতেন।

সুভাষচন্দ্রের এই বিশ্লেষণ ও অভিমত ছিল অতি সরলীকরণের এক দৃষ্টান্ত। বাস্তবে খিলাফৎপন্থীদের অধিকাংশই ধর্মীয় আবেগের দ্বারা তাড়িত ও পরিচালিত ছিলেন। ভারতবর্ষে স্বরাজ প্রতিষ্ঠার দাবি তাঁদের কাছে গৌণ ছিল। ব্যতিক্রম মানুষ যে ছিলেন না তা নয়। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা ছিল কম। জাতীয় কংগ্রেস বহু পূর্ব থেকেই ধর্মনিরপেক্ষতার ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আদর্শ গ্রহণ করেছিল। কংগ্রেসের স্বরাজ প্রতিষ্ঠার দাবির সঙ্গে তুরস্কের সম্রাটকে ‘সুলতান’ ও ‘খলিফা’ রূপে পুনঃ প্রতিষ্ঠার দাবির মধ্যে নীতিগত মিল কমই ছিল। গান্ধীজি ও খিলাফৎ নেতারা যে সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার পিছনে ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের (political expediency) লক্ষ্য। জাতীয় কংগ্রেস যদি সত্যিই সিদ্ধান্ত নিতেন যে, খিলাফৎপন্থীরা পৃথক কোনও দল গঠন করতে পারবেন না, তাঁদের সকলকে কংগ্রেসে যোগদান করতে হবে, তাহলে খিলাফৎপন্থীরা সম্মত হতেন কিনা সন্দেহ আছে। সুভাষচন্দ্র রাজনৈতিক সুবিধাবাদ বা প্রয়োজনমত রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করাটা তেমন ভাল বুঝতেন না। তিনি বড় হয়েছিলেন এক উদার পরিবেশে। কোনওরকম সাম্প্রদায়িক বিতর্ক, বিরোধ বা বিদ্বেষ, প্রাদেশিকতা ও জাতপাতের ক্ষুদ্রতা তাঁকে স্পর্শ করেনি। তিনি এইসব প্রশ্নে এমন এক মানসলোকে বাস করতেন, এমন দৃষ্টিতে সমস্যাগুলি দেখতেন, সহজ সমাধানের কথা ভাবতেন, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয় হলেও সব সময়ে বাস্তবনিষ্ঠ ছিল না। দুর্ভাগ্যক্রমে নানা ঐতিহাসিক কারণে ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার ও জাতিবর্ণ এবং সামাজিক বৈষম্যতার বিষ ইতিমধ্যেই প্রবেশ করতে শুরু করেছিল। কঠোর আদর্শবাদী সুভাষচন্দ্রের চিন্তা ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে বাস্তববুদ্ধির অভাব মাঝে মাঝেই লক্ষ্য করা যেত। তাঁর জীবনের এই দিকটি পরে আরও সুস্পষ্ট হয়।

গান্ধীজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচীতে সমস্ত রাজকীয় খেতাব ও সম্মানজনক পদ বর্জন, স্থানীয় সংস্থাগুলি থেকে সরকার মনোনীত সদস্যপদ ত্যাগ, সরকারি অনুষ্ঠান পরিহার, সরকার নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পুত্র-কন্যাদের নাম প্রত্যাহার, জাতীয় শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা, আইন-আদালত, আইনসভা ইত্যাদি বর্জন অন্তর্ভুক্ত ছিল। স্বদেশী দ্রব্য উৎপাদন ও ক্রয়, হাতে সুতা কাটা ও বুনন, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ ও মাদকতা বর্জনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। ‘চরকা’ ও ‘খাদি’ নবজাগ্রত জাতীয়তাবাদের প্রতীকের মর্যাদালাভ করে। ‘খাদি’ ও ‘চরকা’কে গান্ধীজি যতটা ও যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং সংগ্রামের অন্যতম প্রধান অস্ত্ররূপে ব্যবহার করা অবশ্য প্রয়োজনীয় বলে মনে করেছিলেন সে বিষয়ে বহু লোকের, বিশেষ করে বাংলার বুদ্ধিজীবী বিপ্লবী ও চরমপন্থীদের মনে গভীর সংশয় ছিল। গান্ধীজিকে শ্রদ্ধা ও তাঁর কর্মসূচীকে সামগ্রিকভাবে সমর্থন করলেও রবীন্দ্রনাথেরও মনে হয়েছিল যে, আরও গঠনমূলক কার্যসূচী গ্রহণ করা প্রয়োজন। তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্জনের পক্ষে ছিলেন না। তাঁর আশঙ্কা ছিল এর ফলে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান, সভ্যতা সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। চরকা ও খাদির ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ—এর মাধ্যমেই দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হবে, অর্থনৈতিক স্ব-নির্ভরতা আসেব তা তিনি মনে করতেন না। ইংলন্ড থেকে একই জাহাজে স্বদেশে ফেরার সময় এইসব বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তিনি কবির সঙ্গে একমত ছিলেন। দেশে ফেরার পর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গান্ধীজির গভীর পারস্পরিক প্রীতি ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গান্ধীজির কর্মসূচী ও নীতির প্রতি রবীন্দ্রনাথের মনোভাবের অনেকটা পরিবর্তন ঘটে।

‘খাদি’ ও ‘চরকা’র ওপর যে গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয় তাকে কিন্তু সুভাষচন্দ্র স্বাগত জানিয়েছিলেন। চরকার ব্যবহার পূর্বেও ছিল। তার পুনরায় প্রচলন প্রচেষ্টাকে তিনি ‘অভিনব ও দুঃসাহসিক’ বলে মনে করেছিলেন। গান্ধীজির প্রচেষ্টায় অল্প কিছুদিনের মধ্যে সারা দেশের সুদূরতম গ্রামগুলিতেও সুতো-কাটতে শিক্ষা দেবার জন্যে হাজার-হাজার নারী পুরুষকে পাঠানো হয়। অল্প দিনের মধ্যেই ‘খাদি’ বা ‘খদ্দর’ ভারতের সব কংগ্রেস কর্মীর পোশাক হয়ে ওঠে। সুভাষচন্দ্র নিজে এই উদ্যোগে উৎসাহ বোধ করেছিলেন। গান্ধীজির সঙ্গে বোম্বাইয়ে দেখা করে কলকাতায় ফিরে তিনি খদ্দর পরতে শুরু করেন। কলকাতায় তথা বাংলাদেশে কিন্তু চরকা ও খাদি সম্বন্ধে একটা প্রচ্ছন্ন বিরূপতার ভাব ছিল। চরকা কেটে আর খাদি পরে দেশ থেকে ইংরাজ শাসনের উচ্ছেদ করে স্বরাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে বুদ্ধিজীবী বাঙালিদের অনেকেই বিশ্বাস করতেন না। এই নিয়ে প্রায়ই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিতর্ক হত। কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গান্ধীজির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ও জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হলেও তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মাঝে মাঝে রসিকতা করতেন। খদ্দরের ধুতি জলে ভেজাবার পর তোলা যায় না বলে খদ্দর পরার অসুবিধার কথা তিনি রসিয়ে বলতেন। সুভাষচন্দ্র তখন সবে খদ্দর পরা শুরু করেছেন। একদিন শরৎচন্দ্র সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়কে খদ্দরের পাঞ্জাবি কিন্তু মিলের ধুতি পরা দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “সাবিত্রী, খদ্দর পরনি? পরো, ওর Educative Value আছে।” সুভাষচন্দ্র তখন উপস্থিত ছিলেন। কিছু পরে সাবিত্রীপ্রসন্ন ও সুভাষচন্দ্র বেরলেন। ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছে সুভাষচন্দ্র সাবিত্রীপ্রসন্নকে জিজ্ঞাসা করলেন, “খদ্দর কিনতে যাবেন না?” সাবিত্রীপ্রসন্ন বললেন যে, খদ্দর কিনতে হবে, পরতেও হবে। কিন্তু ‘Congressman’ হওয়ার জন্যেই যদি চরকা কাটার পরীক্ষা দিতে হয় তাহলেই মুশকিল! চরকা কাটার সার্থকতা তিনি মানেন। এটা ‘পরাধীনতার স্মারক’—একটা ‘Symbol’ বলে যদি ধরা হয়। তারপর তিনি সুভাষচন্দ্রকে বললেন, “আপনি দেখেছেন খদ্দরকে ‘মিটিংকা কাপড়া’ বলে কাগজে ঠাট্টা করেছে?” সুভাষ চুপ করে রইলেন। সাবিত্রীপ্রসন্ন বুঝলেন কথাবার্তায় সুভাষ খুব খুশি হননি। তাঁর মনোগত ভাবটা বুঝে সাবিত্রীপ্রসন্ন ওয়েলিংটন স্ট্রিটের (এখন নির্মলচন্দ্র চন্দ্র স্ট্রিট) নির্মলচন্দ্র চন্দ্রের বাড়ির নীচের ঘরের খদ্দরের দোকান থেকে খদ্দরের ধুতি, চাদর ও পাঞ্জাবি কিনলেন। কিছু খুচরো টাকা কম পড়তে সুভাষ তা নিজের পকেট থেকে দিয়ে দিলেন। ওই ধার শোধ করার কোনও সুযোগ সাবিত্রীপ্রসন্নকে সুভাষচন্দ্র আর দেননি। ফেরার পথে আবার খদ্দর প্রসঙ্গে সাবিত্রপ্রসন্ন বলেন, “শুনেছি শরৎবাবু চরকা কাটেন। আমার কিন্তু বিশ্বাস হয় না।’ কথাটা এড়িয়ে গিয়ে সুভাষচন্দ্র বললেন, “ ‘কিন্তু সুতাকাটা কংগ্রেস’ বলে যারা ব্যঙ্গ করে—তারাও হয় ভুল বোঝে, নয়তো ‘নেতি নেতি’ ভাবকে প্রশ্রয় দিয়ে জড়ত্বকে আশ্রয় করে।”

দেশবন্ধু, সুভাষচন্দ্র, বহু একনিষ্ঠ কর্মী ও শত শত উৎসাহী ছাত্রদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাংলাদেশে চরকা ও খাদি সম্বন্ধে যে উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছিল এবং যে পরিমাণ খাদির উৎপাদন হয়েছিল তা গান্ধীজিকে হতাশ করেছিল। তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে মন্তব্য করেছিলেন, “যদি বাংলায় যথেষ্ট সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক না মেলে, তাহলে বাংলাদেশকে বঙ্গোপসাগরে ঝাঁট দিয়ে ফেলে দিয়ে আরও উপযুক্ত নারী ও পুরুষের জন্যে স্থান করে দেওয়া উচিত।” তিনি অবশ্য আশা প্রকাশ করেন যে একবার সম্পূর্ণ জাগলে বাংলা আর পিছিয়ে থাকবে না। গান্ধীজির এই ক্ষুব্ধ মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে সরকার-ঘেঁষা ও গান্ধী-দেশবন্ধু বিরোধী ‘স্টেটসম্যান’ লেখে, “বুদ্ধিজীবী বাঙালিরা ‘চরকা’ প্রত্যাখান করেছে বলেই গান্ধীজির এত রাগ! গান্ধীজির এখনও বুঝতে বাকি আছে যে বাঙালি এই বিষয়ে পিছিয়ে আছে, কেননা বাংলা সম্পূর্ণ সজাগ।” ‘স্টেটসম্যানে’র সমালোচনার পিছনে প্রকৃত কারণ ছিল গান্ধীজি ও অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি বীতরাগ। বাঙালিদের প্রতি কোনও প্রকৃত অনুরাগ নয়। কিন্তু গান্ধীজিও যে বাংলার স্বদেশপ্রেমিক অসংখ্য মানুষের মন ও চিন্তাধারা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

সকল অধ্যায়

১. দেশনায়ক – ১
২. দেশনায়ক – ২
৩. দেশনায়ক – ৩
৪. দেশনায়ক – ৪
৫. দেশনায়ক – ৫
৬. দেশনায়ক – ৬
৭. দেশনায়ক – ৭
৮. দেশনায়ক – ৮
৯. দেশনায়ক – ৯
১০. দেশনায়ক – ১০
১১. দেশনায়ক – ১১
১২. দেশনায়ক – ১২
১৩. দেশনায়ক – ১৩
১৪. দেশনায়ক – ১৪
১৫. দেশনায়ক – ১৫
১৬. দেশনায়ক – ১৬
১৭. দেশনায়ক – ১৭
১৮. দেশনায়ক – ১৮
১৯. দেশনায়ক – ১৯
২০. দেশনায়ক – ২০
২১. দেশনায়ক – ২১
২২. দেশনায়ক – ২২
২৩. দেশনায়ক – ২৩
২৪. দেশনায়ক – ২৪
২৫. দেশনায়ক – ২৫
২৬. দেশনায়ক – ২৬
২৭. দেশনায়ক – ২৭
২৮. দেশনায়ক – ২৮
২৯. দেশনায়ক – ২৯
৩০. দেশনায়ক – ৩০
৩১. দেশনায়ক – ৩১
৩২. দেশনায়ক – ৩২
৩৩. দেশনায়ক – ৩৩
৩৪. দেশনায়ক – ৩৪
৩৫. দেশনায়ক – ৩৫
৩৬. দেশনায়ক – ৩৬
৩৭. দেশনায়ক – ৩৭
৩৮. দেশনায়ক – ৩৮
৩৯. দেশনায়ক – ৩৯
৪০. দেশনায়ক – ৪০
৪১. দেশনায়ক – ৪১
৪২. দেশনায়ক – ৪২
৪৩. দেশনায়ক – ৪৩
৪৪. দেশনায়ক – ৪৪
৪৫. দেশনায়ক – ৪৫
৪৬. দেশনায়ক – ৪৬
৪৭. দেশনায়ক – ৪৭
৪৮. দেশনায়ক – ৪৮
৪৯. দেশনায়ক – ৪৯
৫০. দেশনায়ক – ৫০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন