গান্ধী-আরউইন চুক্তির অনুমোদন, দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে কংগ্রেস প্রতিনিধি পাঠানোর সিদ্ধান্ত ছাড়াও, আর একটি কারণে করাচি কংগ্রেসের এক বিশেষ গুরুত্ব আছে। এই কংগ্রেসে ভারতীয় জনগণের মৌলিক অধিকার (Fundamental Rights) রক্ষার জন্যে কংগ্রেস সংগ্রাম করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। ধর্ম-বর্ণের সকল বৈষম্যের অবসান, ‘বেগার’ প্রথার অবলুপ্তি, শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষা, করের ভার হ্রাস এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার রক্ষার সঙ্কল্প করাচি কংগ্রেসের গৃহীত প্রস্তাবগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই সিদ্ধান্তগুলিতে কংগ্রেসের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক প্রগতিশীল চিন্তাধারার শক্তিবৃদ্ধির প্রতিফলন হয়েছিল। করাচি অধিবেশনে গান্ধীজির জনপ্রিয়তার কথা সুভাষচন্দ্র উল্লেখ করেছেন। প্রতিদিন ভোরবেলায় মহাত্মা গান্ধীর প্রার্থনা সভায় যে ভিড় হত তা ছিল অভূতপূর্ব। এর চেয়ে বেশি ফলপ্রসূ প্রচার আর সম্ভব ছিল না বলে সুভাষচন্দ্র মন্তব্য করেছিলেন। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত গান্ধীজি তাঁর প্রার্থনা সভার মাধ্যমে জনগণের কাছে তাঁর কথা ও আবেদন পৌঁছে দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা লাভের পূর্বের কয়েক বছরে জাতীয় কংগ্রেসের সংগঠনে ও নীতিনির্ধারণে পূর্বের তুলনায় গান্ধীজির প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বেশ কিছুটা হ্রাস পেলেও, প্রার্থনা সভাগুলি প্রমাণ করতো তাঁর প্রভাব দেশবাসীর মনে কত গভীর ও ব্যাপক ছিল। এটাই ছিল গান্ধীজির শক্তির প্রধান উৎস। কংগ্রেস ত্যাগ করার পরে ও আজাদ হিন্দ ফৌজ পরিচালনার সময়েও একাধিকবার সুভাষচন্দ্র গান্ধীজির এই অনন্য ক্ষমতার প্রতি সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
১৯৩১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে এক অভিনব উৎসব পালিত হয়েছিল— ‘জাতীয় পতাকা উৎসব’। ওই দিন কলকাতার দেশবন্ধু পার্কে মাদ্রাজের বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা বুলুভাই শম্ভোমূর্তি এই উৎসবের সভাপতি ছিলেন। উৎসবের উদ্যোক্তা ছিল মূলত ছাত্ররা। উৎসাহ ও প্রেরণার উৎস ছিলেন সুভাষচন্দ্র। প্রায় দু’শ ছেলে ও মেয়ে সারিবদ্ধ ভাবে জাতীয় পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে ব্যান্ড ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের সহযোগিতায় একটি দেশাত্মবোধক গান করে যার প্রথম ক’লাইন ছিল:
যারা যুগ যুগ ধরি তুলিয়াছে ভরি, মায়ের পূজার ডালা
অস্থি-সমিধে হোমানল জ্বালি ভোলে কলঙ্ক জ্বালা,
প্রাণ বলি দিতে পূজার বেদীতে যারা সদা আগুয়ান
ত্রিবর্ণ ধ্বজা তাদেরি গর্ব ভারতের সম্মান।
এই গানটি লিখেছিলেন সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় এবং তাতে গানটির সুর দিয়েছিলেন কবি নজরুল ইসলাম। যাঁরা গেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন (সুরসাগর) হিমাংশু দত্ত, অনিল বাগচী, রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়, হরেন চট্টোপাধ্যায়, অনাদি দস্তিদার, আব্বাসউদ্দীন আহম্মদ, সুধীরা দাশগুপ্ত, অঞ্জলি সেন, কমলা ভট্টাচার্য, মাধুরী মুখোপাধ্যায়, হরিদাস গোস্বামী, বিপিনবিহারী বসু প্রমুখ। বিপিন বসু হাওড়া বিবেকানন্দ ইন্সটিটিউশনের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর কণ্ঠে ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীত বড় বড় কংগ্রেস সভার বিশেষ আকর্ষণ ছিল। জেলেতেও তিনি ‘বন্দেমাতরম’ গান গেয়ে রাজবন্দীদের উৎসাহিত করতেন। সুভাষচন্দ্র বিপিনবাবুর কণ্ঠে ‘বন্দেমাতরম’ শোনার জন্যে তাঁকে প্রায়ই অনুরোধ করতেন। ওই স্কুলের আর এক শিক্ষক মৃগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাদলবাবু) বিভিন্ন বড় বড় অধিবেশন ও সভায় গান গাইতে আমন্ত্রিত হতেন। তিনি আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় কাউকে কিছু না বলে ওইসব অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। তিনি সরলা দেবীচৌধুরানী ও দিলীপকুমার রায়ের কাছে গান শিখেছিলেন। মহাজাতি সদনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে, হাওড়া টাউন হলে সীমান্ত গান্ধী ও জওহরলাল নেহরুর সভায় তিনি গান গেয়েছিলেন। দেশাত্মবোধক গানের মাধ্যমে ছাত্র ও যুবকদের অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রে বিপিনবাবু ও বাদলবাবুর অবদান সেকালের বড় বড় নেতাদের প্রশংসা অর্জন করেছিল। জাতীয় পতাকা উৎসবে যে ছাত্র ও তরুণরা গান গেয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই পরে কংগ্রেস সাহিত্য সঙ্ঘ গড়ে তোলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন সাহিত্যিক সুবোধ ঘোষ ও গান্ধীবাদী দেশকর্মী শচীন মিত্র। সভাপতি হন অতুলচন্দ্র গুপ্ত। এই সঙ্ঘ দেশাত্মবোধক সঙ্গীত ও গীতি আলেখ্য প্রচারের কার্যসূচী নিয়েছিল। উদ্যোগী যুবকদের মধ্যে ছিলেন প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র। তিনি নিজে সুগায়ক। সঙ্গীতে সুর দেওয়া ও সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন সুকৃতি সেন।
দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে (১২ সেপ্টেম্বর-১ ডিসেম্বর, ১৯৩১) কংগ্রেসের একমাত্র প্রতিনিধিরূপে গান্ধীজি যোগদান করেন। ভারতীয় নারীদের প্রতিনিধিরূপে আমন্ত্রিত হন সরোজিনী নাইডু। বৈঠকে গান্ধীজি জানান, প্রস্তাবিত ভারতীয় সংবিধানের খুঁটিনাটি আলোচনায় কংগ্রেস আগ্রহী নয়। অযথা সময় নষ্ট না করে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন করতে হবে। ব্রিটিশ নাগরিকদের ও ভারতীয়দের মধ্যে কোনও বৈষম্য চলবে না। উভয়ের সম-অধিকার, সম-মর্যাদা সুনিশ্চিত করতে হবে। কংগ্রেসই একমাত্র সারা ভারতবর্ষের মানুষের প্রকৃত প্রতিনিধি হবার অধিকারী। অন্য সব দলের প্রতিনিধি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা নির্দিষ্ট কোনও সম্প্রদায় বা স্বার্থের মুখপাত্র। কংগ্রেস জাতি, ধর্ম, বর্ণের কোনও ভেদাভেদ বিশ্বাস করে না, প্রশ্রয় দেয় না।
গান্ধীজির সারল্য, আন্তরিকতা, চারিত্রিক মাধুর্য, দৃঢ়তা ও রসবোধ বৈঠকের ভিতরে ও বাইরে রেখাপাত করলে ও প্রশংসিত হলেও বাস্তবে তাঁর দাবিগুলি কোনও গুরুত্ব পায়নি। মূল সমস্যার কোনও সমাধান হয়নি। সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক কার্যত ব্যর্থ হয়। অনুন্নত ও ‘দলিত’ শ্রেণীর প্রতিনিধি ডঃ বি. আর. আমবেদকর, মুসলিম লীগের প্রতিনধি মহম্মদ আলি জিন্না সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচন ও বিশেষ সুযোগ-সুবিধার দাবিতে অটল থাকেন। পূর্ণ হতাশা ও শূন্য হাতে গান্ধীজি দেশে ফিরে আসেন। গান্ধীজি স্বদেশে পৌঁছে (২৮ ডিসেম্বর, ১৯৩১) বিপুল অভ্যর্থনা পেলেও, তা অর্থহীন ছিল। সুভাষচন্দ্রও বোম্বাই গিয়েছিলেন গান্ধীজিকে স্বাগত জানাতে ও তাঁর মুখে সব কিছু শুনতে। সারা দেশে উৎসাহ ও উদ্যমের অভাব প্রকট হয়ে ওঠে। জওহরলাল স্বীকার করেন যে, গোলটেবিল বৈঠকে গান্ধীজির ব্যর্থতা দেশে এক প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি করেছিল।
প্রথম থেকেই সুভাষচন্দ্র গোলটেবিল বৈঠকের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সন্দিহান ছিলেন। তিনি গান্ধীজির সঙ্গে দিল্লিতে দেখা করেছিলেন। গান্ধীজি প্রশ্ন করলে সুভাষচন্দ্র জানিয়ে দেন যে, পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী জাতীয়তাবাদের মূল নীতির বিরোধী। এই নীতির ভিত্তিতে স্বরাজ লাভ অবাঞ্ছনীয়। গোলটেবিল বৈঠকে গান্ধীজিকে একমাত্র কংগ্রেস প্রতিনিধি করে পাঠানোর সিদ্ধান্ত এবং গান্ধীজি তা মেনে নেওয়ায় সুভাষচন্দ্র বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। তাঁর বোধগম্য হয়নি, কী করে এরকম এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত কংগ্রেস কার্যনির্বাহক সমিতি গ্রহণ করলেন। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন গান্ধীজিকে “প্রায় একশ’ জনের একটি সম্মেলনে, যেখানে বিচিত্র সব রকমের লোক, অনুচরবর্গ ও স্ব-নির্বাচিত নেতাগণকে দৃঢ় একটি ব্যুহের মতো (তাঁর) সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হবে। একাকী সেখানে স্বভাবতই তিনি খুবই অসুবিধেয় পড়বেন।” প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগের এবং অন্য সব ঝানু প্রতিনিধিদের সঙ্গে লড়াইতে তাঁকে সাহায্য করার কেউ থাকবে না। বাস্তবে ঠিক তাই-ই ঘটেছিল।
গান্ধীজির স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ক’দিন পূর্বে পুণায় মহারাষ্ট্র যুব সম্মেলনে, গোলটেবিল বৈঠকের ব্যর্থতার উল্লেখ করে সুভাষচন্দ্র বলেন যে, ‘রাজানুগত, সাম্প্রদায়িকতাবাদী, নামগোত্রহীন’ এমন সব ব্যক্তিদেরও ওই বৈঠকে ডাকা হয়েছিল যাঁরা ভারতের স্বাধীনতালাভ ও খাঁটি জাতীয়তাবাদীর পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতেই সচেষ্ট। অথচ, এই বৈঠক হওয়া উচিত ছিল শুধুমাত্র বিবদমান দলগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা। আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতাকামী সিন্ফিন্দের’ও ব্রিটিশ সরকার ঠিক এমনি একটা ‘ফাঁদে ফেলা’র চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সিন্ফিন্ দল ওই ফাঁদ বুঝতে পেরে বিপদ এড়িয়েছিল। কংগ্রেস তা পারেনি। এখন গান্ধীজি দেশে ফিরলেই তাঁকে অনুরোধ জানানো জরুরি যে, গান্ধী-আরউইন চুক্তি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ নিজেরাই ভেঙেছে। ফলে যে চুক্তির ‘কায়া’ বিলুপ্ত হয়েছে তার ‘ছায়া’ আঁকড়ে চেষ্টা অর্থহীন।
দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে আদৌ যোগদান করা ঠিক হয়নি বলে সুভাষচন্দ্র মনে করেছিলেন। আর, যদি করতেই হত, তাহলে ১৯৩০ সালে করলেই ভাল হত। উদারচেতা ভাইসরয় আরউইন বৈঠকের অনেক আগেই কার্যকাল শেষ করে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর পরবর্তী ভাইসরয় লর্ড উইলিংডন ছিলেন অত্যন্ত রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন। ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন হয়েছিল রক্ষণশীল দল। রাজনৈতিক বাতাবরণই পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। গান্ধীজি শুধুমাত্র গোলটেবিল বৈঠকের গুরুত্বপূর্ণ কাজে পূর্ণ সময় ও মন না দিয়ে, ব্রিটেনে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে সহানুভূতি সৃষ্টির জন্যে অনেক সময় ব্যয় করেছিলেন। এটা সমীচীন হয়নি। কংগ্রেসের বিরোধী প্রতিনিধিরা এর সুযোগ নিয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র আরও বলেছিলেন যে, গান্ধীজিকে ইংলন্ডে মাঝে মাঝে দ্বৈত ভূমিকা নিতে হত— ‘রাজনৈতিক নেতার ভূমিকা ও বিশ্বোপদেষ্টার ভূমিকা’। এর ফলে, একজন রাজনৈতিক শত্রুর সঙ্গে যেমন ব্যবহার করা উচিত তা তিনি করতে পারেননি। অহিংসা ও বিশ্বমৈত্রীর বাণীর নতুন প্রচারকের ভূমিকা তিনি নিয়েছিলেন। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের বিচারে, গান্ধীজির “উদারতা, স্পষ্টবাদিতা, বিনীত আচরণ, শত্রুপক্ষের প্রতি তাঁর সুগভীর দরদ, জন্ বুলের (ব্রিটিশ সরকার) ওপর কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি বরং দুর্বলতা হিসাবেই প্রতিভাত হয়েছিল।” গান্ধীজির অতিরিক্ত বিনয়, ব্রিটিশ সরকারের প্রায় অনুকম্পা ভিক্ষার মতো প্রকাশ্য কথাবার্তা ও ভাষণ জাতীয় কংগ্রেস তথা সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলনের মর্যাদা হানি করেছিল। সুভাষচন্দ্র আরও বলেছিলেন যে, গান্ধীজি ইংলণ্ড ছাড়ার পর ইউরোপে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে প্রচার চালিয়ে, রাজনৈতিক জগতের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাতে আলাপ-আলোচনা করে ভারতের প্রতি যে সহানুভূতি এবং সমর্থনের মনোভাব সৃষ্টি করতে পারতেন তা তিনি করেননি। এর একমাত্র উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছিল ভারত ও ভারত-সংস্কৃতির পরম বন্ধু এবং গুণগ্রাহী মনীষী রোমাঁ-রোলাঁর সঙ্গে গান্ধীজির নিকট পরিচয় ও কথাবার্তা। ইতালীতে মুসোলিনীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকারকেও সুভাষচন্দ্র স্বাগত জানিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে ও ইংলন্ডে এবং ইউরোপে গান্ধীজির ভূমিকার যে কঠোর সমালোচনা ও মূল্যায়ন সুভাষচন্দ্র করেছিলেন সে নিয়ে বিতর্কের প্রচুর অবকাশ আছে। গান্ধীজির ইংলন্ডে থাকার ও তারপর কয়েকদিনের ইউরোপ সফরের ফল প্রায় সবটুকুই নেতিবাচক হয়েছিল তা ঠিক নয়। গান্ধীজির ব্যক্তিগত উজ্জ্বল ভাবমূর্তি, অহিংস আদর্শ ও কর্মসূচীর প্রতি অবিচল আস্থা, পরোক্ষভাবে ও পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের মর্যাদা ও ভারতের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধিতে যে সহায়তা করেছিল তা অনস্বীকার্য। কিন্তু তারই সঙ্গে এটাও সত্য যে, গান্ধীজির গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের তাৎক্ষণিক ফল ছিল প্রায় শূন্য। আইন অমান্য আন্দোলন ও গান্ধীজির গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করার ফলে যে উচ্চাশা ও উদ্দীপনা ভারতবর্যে সৃষ্টি হয়েছিল তা ধূলিসাৎ হয়েছিল। এই হতাশা ও তার ফলে রাজনৈতিক আন্দোলনের অনিবার্য গতিহীনতা স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর হয়েছিল। সেই সুযোগে এমন সব সঙ্কীর্ণ ও সাম্প্রদায়িক দাবি আরও বৃদ্ধি পায় যা শেষপর্যন্ত আর নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়নি।
গান্ধীজির প্রত্যাবর্তনের পরের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ সুপরিচিত। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি গান্ধীজিকে ভাইসরয় লর্ড উইলিংডনের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করে বার্তা পাঠাবার সম্মতি জানায়। যদি তাতে উইলিংডন অসম্মত হন তাহলে পুনরায় আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করা হবে বলে স্থির হয়। ইতিমধ্যেই সর্বত্র পুলিশি নির্যাতন ও দমনমূলক ব্যবস্থা শুরু হয়ে গিয়েছিল। উইলিংডন গান্ধীজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পর্যন্ত অস্বীকার করেন। এই পরিস্থিতিতে আইন অমান্য আন্দোলন আবার শুরু হয়। গান্ধীজি, জওহরলাল, সুভাষচন্দ্র ও অন্যান্য কংগ্রেস নেতারা গ্রেপ্তার হন। সরকারি চণ্ডনীতি চরম রূপ নেয়। কংগ্রেস নিষিদ্ধ সংগঠন রূপে ঘোষিত হয়। জাতীয় পত্র-পত্রিকা-সাহিত্য নিষিদ্ধ হয়। আইন অমান্য আন্দোলন পূর্ণোদ্যমে আবার শুরু করার মতো সাংগঠনিক ও মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। এর সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ আক্রমণাত্মক নীতি অব্যাহত রাখে। তা সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জেলায় জেলায় রাজনৈতিক সম্মেলন, বিক্ষোভ, আইন অমান্য কর্মসূচী বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এলাহাবাদে কংগ্রেসের এক শোভাযাত্রার ওপর পুলিশের লাঠি চালনায় মতিলাল নেহরুর বিধবা পত্নী স্বরূপানী গুরুতরভাবে আহত হন। এই অবস্থার মধ্যেও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে দিল্লিতে জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন হয়। খুবই সংক্ষিপ্ত হলেও এই সাহসী অধিবেশনের গুরুত্ব কম ছিল না।
গোলটেবিল বৈঠকে অনুন্নত শ্রেণী, মুসলমান, শিখ প্রভৃতি সম্প্রদায়ের নেতারা পৃথক নির্বাচনী প্রথা ও অন্যান্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধার দাবি তুলেছিলেন। তার সুযোগ নিয়ে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও অনৈক্যের শক্তিকে বৃদ্ধি করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে দুর্বল করার কৌশলী ব্যবস্থা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ সরকার। ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী র্যামসে ম্যাকডোনাল্ড ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ (Communal Award) ঘোষণা করেন। এই সিদ্ধান্ত বা নীতি অনুসারে মুসলমান, শিখ ও ইউরোপীয় ভোটদাতাদের জন্যে ‘পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী’র ব্যবস্থা করা হয়। অনুন্নত শ্রেণীভুক্ত (Depressed Classes) লোকদের হিন্দুদের থেকে পৃথক সম্প্রদায় বলে গণ্য করা হবে বলে স্থির হয়। অতঃপর তারা ‘তফসিলী জাতি’ (Scheduled Caste) নামে পরিচিত হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। কংগ্রেস জাতীয় ঐক্যের প্রতীকরূপে বিবেচিত হিন্দু-মুসলমানদের ‘সংযুক্ত-নিবাচকমণ্ডলী’র দাবি (Joint Electorate) অগ্রাহ্য করে।
গান্ধীজি অস্পৃশ্যতার ঘোর বিরোধী ছিলেন। অনুন্নত শ্রেণী বা ‘হরিজন’দের কল্যাণসাধন ও মর্যাদাদান ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান ব্রত। তিনি তাঁদের ‘তফসিলী জাতি’ রূপে চিহ্নিত করে হিন্দুসমাজের বহির্ভূত পৃথক সম্প্রদায়রূপে গণ্য করার তীব্র বিরোধিতা করেন। এই সিদ্ধান্ত রদ করার দাবিতে তিনি যারবেদা জেলে আমরণ অনশন শুরু করেন (২০ সেপ্টেম্বর)। পাঁচদিন পুণাতে ডঃ আমবেদকর প্রমুখ নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ নীতির কিছুটা সংশোধন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে তিনি অনশন ভঙ্গ করেন। গান্ধীজির সঙ্গে অনুন্নত শ্রেণীর মুখ্য নেতা ডঃ আমবেদকরের এই বোঝাপড়া ‘পুণা চুক্তি’ (Poona Pact) নামে পরিচিত হয়।
‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’কে কেন্দ্র করে বিতর্ক ও গান্ধীজির আমৃত্যু অনশনের সিদ্ধান্ত কংগ্রেসের মধ্যে ও হিন্দু মহাসভা প্রমুখ রাজনৈতিক দলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও তীব্র সমালোচনা সৃষ্টি করে। জওহরলাল ও সুভাষচন্দ্র দু’জনেই তখন কারাগারে ছিলেন। জওহরলাল গান্ধীজির অনশনের কথা শুনে খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল এরকম একটি প্রশ্নে গান্ধীজি নিজের জীবন পর্যন্ত বিপন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে মূল সমস্যা ও দাবিকেই (স্বাধীনতার দাবি ও আন্দোলন) গৌণ করে ফেলেছেন। এর পরিণতি কী হবে? যদি একটা বোঝাপড়া শেষপর্যন্ত হয়ও, তাহলে কী সকলে ভাববে না যে, বেশ বড় রকম যখন কিছু লাভ হয়েছে, এর পর অন্য কোনও দাবির কথা কিছুদিন অন্তত আর না ভোলাই ভাল? তা ছাড়া, আংশিক একটা বোঝাপড়া বা আপসের অর্থ কি হবে না যে, ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’র মূল নীতিটাই মেনে নেওয়া হয়েছে? অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনের এত ত্যাগ, এত নির্ভীক প্রচেষ্টার এই হল পরিণতি? এ তো দাঁড়াল যে, গান্ধীজি শেষপর্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিই হাত শক্ত করলেন। দেশের সব স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মনে এক হতাশা ও অপমানবোধের সৃষ্টি করলেন।
গান্ধীজির একান্ত অনুগত ও গুণমুগ্ধ জওহরলালেরই যদি এইরকম প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে, তাহলে সুভাষচন্দ্রের কী মনে হয়েছিল তা অনুমান করা কঠিন নয় বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র ও কিছুটা জটিল। সুভাষচন্দ্রকে বোম্বাই-এর অনতিদূরে কল্যাণ স্টেশনে ট্রেনেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল (২ জানুয়ারি, ১৯৩২)। সুভাষচন্দ্র লিখেছেন যে, যতদিন গান্ধীজির অনশন চলছিল ততদিন ধীরভাবে কোনও কিছু বিচার, বিবেচনা করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। একমাত্র চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল কী উপায়ে গান্ধীজির জীবন রক্ষা করা যায়। ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ আগাগোড়াই একটি আপত্তিকর দলিল ছিল। সুতরাং তার আংশিক সংশোধনের প্রশ্নে গান্ধীজি নিজের জীবন বিপন্ন করে সমীচীন কাজ করেছিলেন কি না সে নিয়ে মানুষের মনে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু ‘পুণা চুক্তি’র স্থায়ী মূল্য যাই হোক না কেন, একটি মানুষের জন্যে সারা জাতির হৃদয় কেমন অস্থির হয়ে উঠেছিল তা এক অভূতপূর্ব ঘটনা। সুভাষচন্দ্র স্বীকার করেছেন যে, গান্ধীজির অনশনের ফলে অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ আন্দোলনে গভীর প্রাণসঞ্চার হয়েছিল, হিন্দুদের মনে তা নাড়া দিয়েছিল। অনুন্নত শ্রেণীর সমস্যা সম্পর্কে এক গভীর ব্যাপক সহানুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তীকালে সামাজিক অন্যায়-বৈষম্য দূরীকরণের চেতনা ও আন্দোলনের গতি ও শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল। আসলে, অস্পৃশ্যতা, সামাজিক কুসংস্কার ও উচ্চ শ্রেণীর শোষণ-উৎপীড়নের অবলুপ্তির জন্যে সুভাষচন্দ্র নিজেও অধীর ছিলেন। জাতি গঠনের জন্যে, দেশের ভবিষ্যৎ অগ্রগতির জন্যে তিনি এটাকে অপরিহার্য মনে করতেন। তাই গান্ধীজির মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। অনশনের সিদ্ধান্তের প্রতি তাঁর এক নৈতিক সমর্থন ও শ্রদ্ধা ছিল। কিন্তু অন্য দিকে, গান্ধীজির অনশনের ফলে রাজনৈতিক আন্দোলনের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল তাও তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। মূল রাজনৈতিক প্রশ্নটিই ‘অনশনের অন্তরালে চাপা পড়ে গিয়েছিল’। এই বাস্তব দৃষ্টিতে তিনি গান্ধীজির অনশনকে স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর বলে মনে করেছিলেন। বিদেশে ভারতীয়দের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও দাবি সম্পর্কে যে আগ্রহ ও সহানুভূতির সৃষ্টি হচ্ছিল তাও বিঘ্নিত হয়। গান্ধীজির অনশন ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে কিন্তু বৃহত্তর ক্ষেত্র ও লক্ষ্যের বিচারে একটি গৌণ প্রশ্নের মাত্রাতিরিক্ত প্রচার ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে ক্ষতিকর হয়েছিল।
কল্যাণ রেল স্টেশনে গ্রেপ্তার হওয়ার পর সুভাষচন্দ্রকে প্রথমে মধ্যপ্রদেশের সিওনি জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। মাসখানেক পর (৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩২) শরৎচন্দ্র বসুকেও ঝরিয়াতে গ্রেপ্তার করে সুভাষচন্দ্রের সহবন্দীরূপে সিওনি জেলে প্রেরণ করা হয়। কয়েক মাস পরে শরৎচন্দ্র ও সুভাষচন্দ্র উভয়কেই স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্যে জব্বলপুর জেলে পাঠানো হয়। নানান রকমের ব্যাধিতে সুভাষচন্দ্রের স্বাস্থ্যের ক্রমেই অবনতি হচ্ছিল। এর পর অল্পসময়ের ব্যবধানে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসাধীনে রাখার জন্যে সুভাষচন্দ্রকে জব্বলপুর থেকে মাদ্রাজ, সেখান থেকে উত্তর প্রদেশের ভাওয়ালী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, তারপর ভাওয়ালী থেকে লক্ষ্ণৌর বলরামপুর হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু তাঁর স্বাস্থ্যের কোনও উন্নতি হয়নি। শারীরিক অসুস্থতার উপসর্গ বাড়তেই থাকে। শেষপর্যন্ত তাঁকে নিজ ব্যয়ে চিকিৎসার জন্যে ইউরোপে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯৩৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সুভাষচন্দ্র বোম্বাই থেকে এস. এস. গঙ্গে জাহাজে ইউরোপ যাত্রা করেন। ৩ মার্চ তিনি ইতালীর ভেনিস শহরে পৌঁছলে তাঁকে সরকারি অভ্যর্থনা জানানো হয়।
সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে ভারত সরকারের ভীতি কতটা ছিল তা একটি গোপনীয় বার্তা (১৫ ডিসেম্বর, ১৯৩২) থেকে জানা যায়। সুভাষচন্দ্রকে বিদেশে যাবার অনুমতি দিলে কী বিপদ দেখা দিতে পারে সেই সম্বন্ধে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে এই বার্তায় জানানো হয় যে, দীর্ঘদিনের এই চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী (extreme nationalist) সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত, যদিও বিদেশের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের কার্যকলাপের সঙ্গে তিনি যুক্ত নন। ইউরোপে গিয়ে ভগ্নস্বাস্থ্য ভাল হলে তিনি বিপজ্জনক আন্তর্জাতিক বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভারতবর্ষে ফিরে বিপ্লবের চক্রান্ত করার জাল বুনবেন। ইংলন্ডে যদি সুভাষচন্দ্রকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় তাহলে তিনি কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন বাঙালী ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করে গভীর সমস্যার সৃষ্টি করবেন। চিকিৎসার জন্যে একবার দেশ ত্যাগের অনুমতি পেলে তিনি কোনও প্রতিশ্রুতি দেবেন না বা দিলেও তা রক্ষা করবেন না। সুভাষচন্দ্র জাহাজে করে ইউরোপ যাত্রার সংবাদ দিয়ে লণ্ডনের ‘ডেলি হেরাল্ড’ লেখে (২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৩), “গান্ধীর কংগ্রেস আন্দোলনের পিছনে ‘মস্তিষ্ক’ (brain) বলে যাঁকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মনে করে সেই মানুষটি আজ এক ইতালীয় জাহাজে ইউরোপ যাত্রা করেছেন।” অত্যন্ত দুর্বল, যক্ষারোগাক্রান্ত সুভাষচন্দ্রের ক’মাসে ৬৪ পাউন্ড ওজন হ্রাস পেলেও তাঁকে তাঁর মরণাপন্ন মা’কে কলকাতায় দেখতে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়নি। জাহাজে তাঁর সঙ্গে পুলিশ অফিসাররা যান এবং জাহাজ তীর ছেড়ে বেশ কিছু দূর না যাওয়া পর্যন্ত তাঁর হাতে মুক্তির আদেশপত্র দেওয়া হয়নি। সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে ভারত সরকার ও তার পুলিশ বিভাগের এই ভীতি, আতঙ্ক ও তাঁর ‘চক্রান্ত’ করবার ক্ষমতা সম্বন্ধে সতর্কবাণী শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবি’র সব্যসাচীকে মনে করিয়ে দেয়।
মান্দালয়ের মতো সিওনি, জব্বলপুর, মাদ্রাজ প্রভৃতি জেলেও সুভাষচন্দ্র প্রচুর পড়াশোনা করেছিলেন। ‘উত্তরা’ ও ‘পরিচয়’ পত্রিকা পড়ে তাঁর ভাল লেগেছিল। থোরো, টলস্টয়, আলেকজান্ডার হারজেন প্রমুখ লেখকদের বই পাঠাতে আত্মীয় ও বন্ধুদের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। লেনিনের সদ্য প্রকাশিত জীবনী গ্রন্থ ‘দি ম্যান ফ্রম ভল্গা’ বইটির বিজ্ঞাপন দেখে বইটি পড়তে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। নিজের ‘সত্য উপলব্ধি’, সত্য ও আদর্শের জন্যে যে কোনো ‘মূল্য দিতে সঙ্কল্প, আধ্যাত্মিক পুনর্জন্ম’ লাভের জন্যে ব্যাকুলতা প্রকাশ করেছিলেন। ব্যক্ত করেছিলেন বাংলা তথা ভারতের প্রতি ভালবাসার গভীর অনুভূতির কথা। নিঃসঙ্গ কারাজীবনে নিজের মনে গাইতেন— ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।’ এস. এস. গাঙ্গে থেকে বাংলার মানুষের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন মতভেদ, সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে বাংলার গৌরব বৃদ্ধি করতে, দেশকে মহত্তর করতে, স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন “বাংলা বাঁচলে কে মরবে, বাংলা মরলে কে বাঁচবে?”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন