দেশনায়ক – ৩৩

ইউরোপ প্রবাসকালে সুভাষচন্দ্র ইউরোপের বহু দেশে গিয়েছিলেন, রাষ্ট্রনেতা, রাজনীতিবিদ্, উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, আলোচনা করেছিলেন। তাঁর একটিই উদ্দেশ্য ছিল: ভারতবর্ষ ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্বন্ধে প্রচার ও জনসমর্থন সৃষ্টি করা। ভারতবর্ষ সম্পর্কে ইচ্ছাকৃত, উদ্দেশ্যমূলক এবং অজ্ঞানতাপ্রসূত ভ্রান্ত ধারণা এবং অপপ্রচারের প্রতিবাদ ও তা অপসারণের জন্যে চেষ্টা করা। তাঁর ইচ্ছা ছিল সোভিয়েত রাশিয়া পরিভ্রমণ করা। কিন্তু তিনি সোভিয়েত দেশে প্রবেশের অনুমতি পাননি। অনুমতি লাভের জন্যে তিনি খুব বেশি চেষ্টা করেননি প্রধানত দুটি কারণে। প্রথমত, তাঁর সম্পর্কে এমনিই অভিযোগ এবং সন্দেহ ছিল যে, তিনি একজন ভয়ঙ্কর বিপ্লবী। কমিউনিস্ট বিপ্লবীর সঙ্গে তাঁর গোপন যোগাযোগ আছে। এখন যদি তিনি রাশিয়ায় যাবার জন্যে বেশি জেদাজেদি করতেন তাহলে ওই সন্দেহ আরও ঘনীভূত হত। তাঁর পক্ষে অন্যান্য দেশে যাওয়াও অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ত। তাতে তাঁর ইউরোপ প্রবাসের বৃহত্তর উদ্দেশ্য সিদ্ধির (চিকিৎসা ছাড়া) অন্তরায় হত। দ্বিতীয়ত, সোভিয়েত রাশিয়ায় বলশেভিক দলের কার্যকলাপ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যা ও পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের প্রকৃত মনোভাব কী, সে বিষয়ে সুভাষচন্দ্রের মনে কিছুটা সংশয় ও হতাশা দেখা দিয়েছিল। নিজের মনোভাব ব্যক্ত করে তিনি বলেছিলেন, “আজ কম্যুনিস্ট মতবাদ কোনও ধরনের জাতীয়তাবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়। অথচ ভারতের আন্দোলন এক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন—ভারতীয় জনগণের জাতীয় মুক্তির এক আন্দোলন…রাশিয়া এখন নিজ আত্মরক্ষায় ব্যস্ত এবং এখনও বিপ্লবী চেহারা বজায় রাখার চেষ্টা করলেও কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিকের মাধ্যমে বিশ্ববিপ্লব জাগিয়ে রাখার আর আগ্রহ নেই।” সুভাষচন্দ্র বুঝেছিলেন, নিজের অর্থনৈতিক সমস্যা ও পুনর্গঠন, জাপান-ভীতি ও বৃহৎ শক্তিগুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষায় রাশিয়া এত উদ্বিগ্ন ও ব্যস্ত যে, ভারতবর্ষের মতো দেশের সমস্যা নিয়ে আগ্রহ দেখাবার বিশেষ ইচ্ছে তার নেই। তাই তিনি রাশিয়ার কাছে তেমন কিছু আশা করেননি।

আর একটি কথাও মনে রাখতে হবে যা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। তা হল, কংগ্রেস আন্দোলন, স্বরাজ্যপন্থীদের নেতাদের মধ্যে গান্ধীজি ও সুভাষচন্দ্রের প্রতি রুশ কমিউনিস্ট ও ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’-এর মনোভাব খুবই বিরূপ ছিল। “রাশিয়ার আঁচল” ধরে চলার নীতির কঠোর সমালোচনা করেছিলেন সুভাষচন্দ্র। গান্ধীজির সঙ্গে কর্মসূচী ও নীতির প্রশ্নে তীব্র মতপার্থক্য থাকলেও, ‘গান্ধী নিপাত যাক’—এই রকমের কোনও রাজনৈতিক লক্ষ্য সুভাষচন্দ্রের কাছে গ্রহণযোগ্য তো ছিলই না—অবাঞ্ছনীয় ছিল। সুতরাং রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে কখনও কখনও, (বিশেষ করে ১৯৩৮-১৯৩৯ সালে হরিপুরা এবং ত্রিপুরী কংগ্রেসের সময়) ভারতীয় কমিউনিস্টরা সুভাষচন্দ্রকে সমর্থন জানালেও, মূলত তাঁরা আগাগোড়া সুভাষ-বিরোধী ছিলেন। সুভাষচন্দ্র ১৯৩৪ সালে তাঁর ‘The Indian Struggle’ গ্রন্থের শেষে ‘ভবিষ্যতের ইঙ্গিত’ প্রসঙ্গে লেখেন, “নির্ভয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা যেতে পারে যে ভারতে সোভিয়েট রাশিয়ার নতুন একটি সংস্করণ হয়ে উঠবে না।” আর একটি কথা তিনি বলেছিলেন যা আজকের ভারতবর্ষের পক্ষেও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, “রাশিয়ার ইতিহাসে গির্জা ও রাষ্ট্রের নিবিড় সম্পর্ক ও একটি ধর্মীয় সংগঠন থাকার জন্য কম্যুনিজম সেখানে ধর্ম-বিরোধী ও নাস্তিকতামূলক হয়ে উঠেছে। অপরপক্ষে, ভারতবাসীদের মধ্যে কোনও ধর্মীয় সংগঠন না থাকায় এবং ধর্মীয় সংগঠন ও রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের অভাবে ধর্মের বিরুদ্ধে এরূপ কোনও ভাব ভারতে নেই।…উপরন্তু, ভারতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্মসংস্কার ও সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জাতীয় জাগরণের সূচনা ঘটেছে।” এ ছাড়া, কম্যুনিজমের প্রধান বিষয়বস্তু—ইতিহাসের বস্তুতান্ত্রিক ব্যাখ্যা—ভারতে গ্রহণযোগ্য হবে না। এমনকি যাঁরা কম্যুনিজমের অর্থনৈতিক দিকটি গ্রহণ করেন, তাঁরাও ইতিহাসের বস্তুতান্ত্রিক ব্যাখ্যা বিনা দ্বিধায় মেনে নেবেন না। বলা বাহুল্য, সোভিয়েত রাশিয়া এবং ভারতবর্ষে কম্যুনিজমের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের এই মূল্যয়ান ও ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ কমিউনিস্টদের খুবই ক্ষুব্ধ করেছিল। তাঁর সম্বন্ধে ভারতীয় কমিউনিস্টদের বিরূপ মনোভাব আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল।

ভবিষ্যতে কম্যুনিজম ও ফ্যাসিবাদের মধ্যে একটি সমন্বয় হবে এবং ‘তা ভারতবর্ষেই’ হতে পারে, ‘অধিকাংশ ism বা মতবাদের ভেতর অল্পাধিক সত্য আছে’—সুভাষচন্দ্রের এরকম উত্তি অন্ধ রুশভক্ত কমিউনিস্টদের কাছে ‘ঈশ্বরনিন্দা’র (Blasphemy) মতো অমার্জনীয় গর্হিত অপরাধ বলে গণ্য হয়েছিল। মতাদর্শের প্রতি অন্ধভক্তি বিচারশক্তিকে কীভাবে আচ্ছন্ন করতে পারে তার এক দৃষ্টান্ত হল ‘সুভাষচন্দ্র, ভারত ও অক্ষশক্তি’ গ্রন্থে সুধী প্রধানের মন্তব্য। তাঁর সুচিন্তিত গবেষণাধর্মী এই সাম্প্রতিক গ্রন্থে প্রবীণ মার্ক্সবাদী লেখক সুধী প্রধান অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করেছেন, ‘সুভাষচন্দ্রের তীব্র দেশপ্রেম, দেশের স্বাধীনতার জন্য মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও দুঃসাহসিক বিদেশ অভিযান কেবল ভারতবর্ষ নয় সারা পৃথিবীর মানুষের দ্বারা অভিনন্দিত হয়েছে।” তিনি তাঁর গ্রন্থের উৎসর্গ পৃষ্ঠায় নেতাজি সুভাষকে ‘দেশগৌরব’ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু মার্ক্সবাদ ও সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের বক্তব্যের সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, “এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে মার্ক্সবাদ সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের পড়াশুনা যথেষ্ট ছিল না।” এমনকি সুধী প্রধান এও লিখেছেন, “আজকের দিনে আশ্চর্য লাগে ভাবতে যে তাঁর মত একজন শিক্ষিত লোক মার্ক্সবাদী কম্যুনিজমের সাধারণ সূত্রগুলির সঙ্গেও পরিচিত ছিলেন না…দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা, শ্রেণী সংঘর্ষের ভিত্তিতে সামন্ততন্ত্রের পতনের পর ধনতন্ত্রের উত্থান, ধনতন্ত্রের বিরোধিতায় শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রণী ভূমিকা এবং রাষ্ট্রের অবলোপ সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের অজ্ঞতা দেখে বিস্মিত হতে হয়।”

সুভাষচন্দ্রের পড়াশোনার পরিধি ও গভীরতা সম্বন্ধে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। সমাজতন্ত্র, ফ্যাসিজম, বলশেভিজম ইত্যাদি বিষয়ে সুভাষচন্দ্রের পড়াশোনার কিছু পরিচয় সুধী প্রধানের গ্রন্থেই রয়েছে। সুভাষচন্দ্রের বিশ্লেষণ ও মার্ক্সিজম সম্বন্ধে তাঁর ‘অজ্ঞতার’ আলোচনা অপ্রয়োজন হলেও, এইটুকু স্মরণ করা প্রাসঙ্গিক যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পঞ্চাশ বছরের মধ্যে কমিউনিজম ও সোস্যালিজমের সঙ্গে ‘পুঁজিবাদ’, ‘ভোগবাদ’, ‘সাম্রাজ্যবাদ’, ‘মৌলবাদ’ ইত্যাদির যে রকম বিচিত্র সমন্বয় ও সহাবস্থান পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটেছে, তারপরে কমিউনিজম ও ফ্যাসিজমের মধ্যে যে সম্ভাব্য সমন্বয়ের কথা সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন তা সম্পূর্ণ অবাস্তব ছিল বলে মনে করার কোনও কারণ নেই। সুধী প্রধানের বক্তব্যের কিছুটা দীর্ঘ উদ্ধৃতি এবং উল্লেখের মূল্য উদ্দেশ্য হল, ছ’ দশক পরে কমিউনিজম তথা বিশ্বের ইতিহাসে এত অচিন্তনীয় যুগান্তকারী পরিবর্তনের পরেও, যদি কমিউনিজম সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গি ও বক্তব্যের এত তীক্ষ্ণ সমালোচনা হয়, তাহলে তিরিশের দশকে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ও অব্যবহিত পরে তাঁর প্রতি কমিউনিস্টদের মনোভাব কতটা বিরূপ ছিল তা উপলব্ধি করতে অসুবিধা হয় না।

ভিয়েনার চিকিৎসকদের সুপারিশের ফলে সুভাষচন্দ্র জার্মানীতে যাবার অনুমতি পান। ১৯৩৩ সালের জুলাই মাসে তিনি বার্লিনে পৌঁছন। জার্মানীতে সুভাষচন্দ্রের কর্মসূচী ও তৎপরতা, জার্মানদের চোখে সুভাষচন্দ্র, নাৎসী সরকারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ, হিটলার ও নাৎসী জার্মানী সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব, সুভাষচন্দ্রের প্রচেষ্টার প্রতিক্রিয়া ও সুদূরপ্রসারী ফলাফল, সুভাষচন্দ্রের জীবনের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। জার্মান মহাফেজখানায় ও বিভিন্ন সূত্রে যে মূল্যবান তথ্য এই বিষয়ে পাওয়া গেছে তা সঙ্কলিত করে প্রকাশ করেছেন নন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁর কয়েকটি গ্রন্থে ও রচনায়। এইগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল ‘সুভাষচন্দ্র ও নাৎসী সরকার’ এবং ব্রিটিশ ও জার্মানদের চোখে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু’ গ্রন্থ দুটি। সুধী প্রধানের ‘সুভাষচন্দ্র, ভারত ও অক্ষশক্তি’ গ্রন্থটিও তথ্যসমৃদ্ধ।

বার্লিনে ভারত-জার্মান সোসাইটির Lothar Frank-এর সাহায্যে সুভাষচন্দ্র নাৎসী সরকারের উচ্চপদস্থ নেতাদের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেন। জার্মান বৈদেশিক দপ্তর তাঁকে বার্লিনে স্বাগত জানালেও তৎকালীন নাৎসী জার্মানীর পরিবেশ ভারতীয়দের পক্ষে খুব অনুকূল ছিল না। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নাৎসী সরকার ইহুদি এবং ভারতীয়-সহ সব অশ্বেতাঙ্গদের প্রতি তাচ্ছিল্য ও অশ্রদ্ধার মনোভাব প্রদর্শন এবং ঘৃণ্য প্রচারে উদ্যোগী হয়েছিল। এর মূলে ছিল হিটলারের নিজস্ব বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি। হিটলার তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘মেইন ক্যাম্ফ’-এ (Mein Kampf) তথাকথিত ‘অনার্য’ জাতিগুলির প্রতি তাঁর ঘৃণা ও অবজ্ঞা ব্যক্ত করেছিলেন। ভারত-সমেত ওই সব জাতিকে তিনি নিকৃষ্ট শ্রেণীর মানুষ বলে অভিহিত করেন। তাঁর জাতি-বৈরিতা ও বিদ্বেষ ছিল উদগ্র। ভারতীয় স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারকদের তিনি অল্প কিছু এশীয় ‘সঙ’ বা ‘ভেলকিবাজ’ বলে বিদ্রূপ করেছিলেন। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উগ্র সমর্থক ছিলেন হিটলার। তিনি বলেছিলেন, “জাতি হিসেবে ইংলন্ডের গর্ব করার কারণ আছে।” এক বিন্দু রক্ত থাকতে ইংরেজরা কোনওদিন ভারতের ওপর তাদের অধিকার ছেড়ে দেবে এ চিন্তা পর্যন্ত তাঁর কাছে ছিল বাতুলতা মাত্র। শোষিত জাতিসমূহের কোনও সংগঠনকে তিনি ‘অক্ষমদের জোট’ বলে তুচ্ছজ্ঞান করতেন। তিনি বলেছিলেন, “মানব সমাজের জাতিগত মূল্যে বিশ্বাসী আমার মতো একজন জাতীয়তাবাদীর কাছে তথাকথিত ‘শোষিত রাষ্ট্রসমূহের’ জাতিগত হীনতা একান্তই স্বীকৃত।” হিটলারের আশা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি ব্রিটেনের শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব জার্মানী ও ব্রিটেনের মধ্যে মৈত্রী স্থাপনে সহায়তা করবে। বলশেভিক মতবাদকে হিটলার ‘মানবতা-বিরোধী এক জঘন্য অপরাধ’ বলে মনে করতেন। ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে তিনি ‘নিকৃষ্ট’ হিন্দুজাতির ‘উন্নততর’ অ্যাংলো-নর্ডিক জাতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। এক বক্তৃতায় (২৭ জানুয়ারি, ১৯৩২) তিনি ভারতকে ‘সভ্য’ করা ‘শ্বেত মানুষের বোঝা’ (Whiteman’s burden) বলে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি এও লিখেছিলেন, “জার্মান হিসাবে আমি ভারতকে অন্য জাতের চেয়ে ব্রিটিশদের অধীনস্থই বরং দেখতে চাই।” হিটলারের এই ভারত-বিদ্বেষী মনোভাব, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্বন্ধে অবজ্ঞা ও অজ্ঞতা নাৎসী সরকারের বহু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং জার্মান লেখকদের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করেছিল।

জার্মানী যাবার পূর্বে সুভাষচন্দ্র যে স্বয়ং হিটলার ও নাৎসী সরকারের এই চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভারত-বিদ্বেষী মনোভাবের কথা জানতেন না তা নয়। কিন্তু এর প্রকৃত রূপ ও গভীরতা কতখানি তা তিনি অনুমান করতে পারেননি। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, উপযুক্ত প্রচারের ও সঠিক তথ্যের অভাবে জার্মান সরকারের এই রকম মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে। তা ছাড়া ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এবং কিছু জার্মান লেখক ও বুদ্ধিজীবী নিয়মিত কুৎসা ও অপপ্রচার করে হিটলার ও নাত্সী সরকারকে বিভ্রান্ত করছে। যদি ঠিকভাবে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা যায়, সাক্ষাৎ-আলোচনায় বোঝান যায় তাহলে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটান সম্ভব হবে। সংখ্যায় কম হলেও জার্মান সরকারী মহলে ও লেখক-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ভারতবর্ষের প্রতি সহানুভূতিশীল, ভারতের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলায় আগ্রহী মানুষও আছেন। সরাসরি হিটলারের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেলে তাঁকেও তাঁর মত এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা বোঝান অসম্ভব নয়। শুধু সুভাষচন্দ্রই নন, হিটলারের ভারত-বিদ্বেষী মনোভাব এবং তাঁর উগ্ৰ বৰ্ণশ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসের কথা জানা সত্ত্বেও বিশিষ্ট বাঙালী শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই প্রথম মহাযুদ্ধের পর পরাজিত বিধ্বস্ত জার্মানীকে অল্পসময়ের মধ্যে এক সুসংহত শক্তিশালী দেশে পরিণত করায় হিটলারের গুণমুগ্ধ হয়েছিলেন। প্রখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বিনয়কুমার সরকারের পরামর্শে কলকাতায় অবস্থিত জার্মান কনসাল জার্মান বৈদেশিক দপ্তরকে জানান (১৭ মে, ১৯৩৪) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে হিটলারের ‘মেইন ক্যাম্ফ’ পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে যদি ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কীয় বিরূপ মন্তব্যগুলি বইটি থেকে বাদ দেওয়া হয়। হিটলার এই প্রস্তাবে সম্মত হননি।

বার্লিনে পৌঁছে সুভাষচন্দ্র জার্মান বৈদেশিক দপ্তরের মাধ্যমে ও অন্যান্য সূত্রে হিটলারের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রচেষ্টা সফল হয়নি। জামনীর খ্যাতনামা দৈনিক পত্রিকা ‘ফ্যোকিখার বেয়োবাখটার’ (Volkischer Beobachter) লেখে, “ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জার্মানদের কোনও কৌতূহলই নেই।” ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৬ সালের মধ্যে সুভাষচন্দ্র বেশ কয়েকবার জার্মানী ও ইতালীতে গিয়েছিলেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও তিনি ওই সময়ে যান। তিনি কার্যত ভারতবর্ষের, বিশেষ করে ভারতের মুক্তি সংগ্রামের, বে-সরকারী রাষ্ট্রদূতের ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল ভারতীয় রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং ভারতীয় সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও আত্মিক সম্পদ এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে নিরলস প্রচার চালিয়ে আন্তজাতিক যোগসূত্র স্থাপন করা। এই উদ্দেশ্যে সাধনের জন্যে তিনি জার্মানী এবং ইতালীর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

জার্মানীতে সুভাষচন্দ্রের অভিজ্ঞতা সুখপ্রদ হয়নি। কিন্তু তাতেও তিনি হতোদ্যম হননি। তাঁর আত্মবিশ্বাস ছিল যে, কঠিন হলেও, ভারতবর্ষের প্রতি জার্মান সরকারের মনোভাব ও নীতির সংশোধন এবং পরিবর্তন ঘটান সম্ভব হবে। এই প্রচেষ্টায় তিনি কিছু কিছু বিশিষ্ট জার্মানদের সমর্থন ও সহযোগিতা লাভ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন জার্মান অ্যাকাডেমির ভারতীয় কমিটির প্রধান ডঃ ক্রানজ থিয়েরফেলডার ও তাঁর বন্ধুরা। জার্মান বৈদেশিক দপ্তরের মিঃ ভাইয়েকহফ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ডঃ স্মিডট প্রমুখ কয়েকজন অফিসার সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছিলেন। তাঁরা হিটলার ও নাৎসী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

হিটলার ও নাৎসী সরকারের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের যোগাযোগ স্থাপনের এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে নাৎসী জার্মানীর সহানুভূতি-সহযোগিতা লাভের প্রচেষ্টার যৌক্তিকতা নিয়ে বহু প্রশ্ন উঠেছিল। আজও সেই প্রশ্ন অনেকের মনেই জাগে। বার্লিনে থাকার সময়ে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে অ্যালেক্স কুরটি ও তাঁর স্ত্রী কিটি কুরটির (Alex and Kitty Kurti) বন্ধুত্ব হয়েছিল। তাঁরা ছিলেন ইহুদি। হিটলারের ইহুদি-বিদ্বেষ, নির্যাতন ও শেষপর্যন্ত নৃশংসতম গণহত্যা (Holocaust) আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে এক বীভৎস দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে আছে। কিটি কুরটি একবার সুভাষচন্দ্রকে প্রশ্ন করেছিলেন, কী করে তিনি নাৎসীদের মতো ঘৃণ্য চরিত্রের মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা করেন। উত্তরে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, বিপজ্জনক ঠিকই, কিন্তু উপায় নেই। যে-কোনও মূল্যে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা পেতে হবে। ইউরোপের পচন ধরেছে। তাতে কিছু যায় আসে না। ইংলন্ডে এবং জার্মানীতে যাঁরা ভালো মানুষ আছেন তাঁদের তিনি শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু তাঁর পথ তিনি স্থির করেছেন। তারপর সুভাষচন্দ্র শ্রীমতী কুরটিকে প্রশ্ন করেন, “আপনাদের ধারণা আছে, কী অসীম দুঃখ-দুর্দশা, হতাশা ও অবমাননায় ভারত নিমজ্জিত রয়েছে? কী যন্ত্রণায় ও ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধের মধ্যে ভারতবর্ষকে চলতে হচ্ছে? তা কী আপনারা কল্পনা করতে পারেন?” শ্রীমতী কুরটি তাঁর স্মৃতিচারণে এ কথাও জানিয়েছেন যে, সুভাষচন্দ্র নাৎসীদের ঘৃণা করতেন। কুরটি-রা পরামর্শ দিয়েছিলেন, নাজী এলাকা ছেড়ে নিরাপত্তার জন্যে অন্যত্র চলে যেতে। সুভাষচন্দ্রের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান ছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আঘাত হানা, সেই উদ্দেশ্যসাধনের জন্যে সম্ভাব্য সকল সূত্রের সন্ধান করা ও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে তা পরীক্ষা করা। সুভাষচন্দ্রের এই নীতি ও প্রচেষ্টার সাফল্য-ব্যর্থতা এবং যৌক্তিকতা বিচার করার সময় একটি মূল কথা বিস্মৃত হলে চলবে না। সুভাষচন্দ্র কখনও, কোথাও, কারও কাছে দেশের ও নিজের সম্মান ও আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেননি। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। হিটলার ও নাৎসী সরকারের কাছেও নয়, জাপানের কাছেও নয়, দেশে-বিদেশে কোনও প্রবল শক্তি বা প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছেও নয়। জার্মানীতে অবস্থানকালে সুভাষচন্দ্রের চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল হয়েছিল।

সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে এক জার্মান কূটনীতিবিদ লিখেছিলেন, “তিনি ছিলেন যেমন দৃঢ়চেতা ও তেজস্বী, তেমনই তীক্ষ্ণ ধীশক্তিসম্পন্ন ও স্পষ্টভাষী। স্বৈরাচারী শাসকদের মুখোমুখি দাঁড়াতে সত্যিই তাঁর জুড়ি ছিল না।” কলকাতায় অবস্থিত জার্মান কনসাল বার্লিনে জানিয়েছিলেন (৫ মে, ১৯৩৩), “বিপ্লবী মানসিকতার সর্বাধিক সম্মানিত অন্যতম কংগ্রেস নেতা” চিকিৎসার জন্যে জার্মানী যাচ্ছেন। জার্মানীতে ভারতীয়দের প্রতি দুর্ব্যবহার, জাতি-বিদ্বেষ, বৈষম্যমূলক আচরণ দেখে তিনি গভীর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কিছু কিছু জার্মান লেখকদের ভারত-বিরোধী গ্রন্থ ও রচনার তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এই রকম অপপ্রচার ও মর্যাদাহানিকর লেখা অবিলম্বে বন্ধ করার জন্যে তিনি তৎপর হয়েছিলেন। জার্মান সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। এই ধরনের কার্যকলাপ ও ভারত-বিরোধী মনোভাব সংযত ও সংশোধন করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও কার্যত জার্মান সরকার কিছুই করেননি। বরং ১৯৩৬ সালের ২৬ জানুয়ারি মিউনিখে জাতীয় সমাজতন্ত্রী ছাত্র সংগঠনের বার্ষিক উৎসবে তাঁর ভাষণে হিটলার সুস্পষ্ট করে দেন যে, আত্মজীবনীতে এবং অন্যান্য ভাষণে ও কথাবার্তায় তিনি ইতিপূর্বে যা কিছু বলেছেন তার কোনও পরিবর্তন হয়নি। হিটলার ‘শ্বেতকায় জাতির’ উপনিবেশ স্থাপনের ‘অধিকার’ এবং বিশ্বশাসনের দায়িত্বের কথা সদম্ভে পুনর্ব্যক্ত করেন। ভারতবর্ষের ব্রিটিশ নির্ভরতার প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, ইংরেজরাই ভারতীয়দের আজ্ঞাপালন করতে শিখিয়েছে। হিটলারের এই মনোভাবে সুভাষচন্দ্র কতখানি আহত ও ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন তা প্রকাশ পেয়েছিল ডঃ থিয়েরফেলডার (Thierfelder)-কে লেখা একটি চিঠিতে।

সকল অধ্যায়

১. দেশনায়ক – ১
২. দেশনায়ক – ২
৩. দেশনায়ক – ৩
৪. দেশনায়ক – ৪
৫. দেশনায়ক – ৫
৬. দেশনায়ক – ৬
৭. দেশনায়ক – ৭
৮. দেশনায়ক – ৮
৯. দেশনায়ক – ৯
১০. দেশনায়ক – ১০
১১. দেশনায়ক – ১১
১২. দেশনায়ক – ১২
১৩. দেশনায়ক – ১৩
১৪. দেশনায়ক – ১৪
১৫. দেশনায়ক – ১৫
১৬. দেশনায়ক – ১৬
১৭. দেশনায়ক – ১৭
১৮. দেশনায়ক – ১৮
১৯. দেশনায়ক – ১৯
২০. দেশনায়ক – ২০
২১. দেশনায়ক – ২১
২২. দেশনায়ক – ২২
২৩. দেশনায়ক – ২৩
২৪. দেশনায়ক – ২৪
২৫. দেশনায়ক – ২৫
২৬. দেশনায়ক – ২৬
২৭. দেশনায়ক – ২৭
২৮. দেশনায়ক – ২৮
২৯. দেশনায়ক – ২৯
৩০. দেশনায়ক – ৩০
৩১. দেশনায়ক – ৩১
৩২. দেশনায়ক – ৩২
৩৩. দেশনায়ক – ৩৩
৩৪. দেশনায়ক – ৩৪
৩৫. দেশনায়ক – ৩৫
৩৬. দেশনায়ক – ৩৬
৩৭. দেশনায়ক – ৩৭
৩৮. দেশনায়ক – ৩৮
৩৯. দেশনায়ক – ৩৯
৪০. দেশনায়ক – ৪০
৪১. দেশনায়ক – ৪১
৪২. দেশনায়ক – ৪২
৪৩. দেশনায়ক – ৪৩
৪৪. দেশনায়ক – ৪৪
৪৫. দেশনায়ক – ৪৫
৪৬. দেশনায়ক – ৪৬
৪৭. দেশনায়ক – ৪৭
৪৮. দেশনায়ক – ৪৮
৪৯. দেশনায়ক – ৪৯
৫০. দেশনায়ক – ৫০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন