৩. অতলে অন্তরীণ – ১৮

তসলিমা নাসরিন

একুশ জুন, মঙ্গলবার

ঙর সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছে একজনের। ঙ গিয়েছিলেন একটি অনুষ্ঠানে যেখানে শিল্পীরা মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন। জ নিজে একজন শিল্পী। শিল্পীর চোখ বোঝে ঙর চোখ দুটোয় উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, শঙ্কা। ঙর চোখ যেন কিছু খুঁজছেও, কাউকে খুঁজছে। জ ও তাকিয়ে থাকেন ঙ র দিকে। ঙর চোখ দুটো চারদিকে ঘুরে ঘুরে জ র চোখে গিয়ে স্থির হয়। আবার দুজনের চোখ চারদিকে ঘুরে এসে স্থির হয় দুজনের চোখে। সেই চারচোখে একটি ভাষা আছে। ভাষাগুলো দুজনই পড়তে চেষ্টা করেন। পড়তে পড়তে দুজন এগোতে থাকেন পরস্পরের দিকে। কাছে এসে খুব হালকা দুএকটি কথা শুরু হয় এভাবে।

–কেমন আছেন?

–এখন কি আর ভাল থাকার কোনও অবস্থা আছে!

–ভাবাও যায় না এইসব হচ্ছে দেশে। প্রতিরোধ ছাড়া আর উপায় নেই।

–নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।

জ বোঝেন ঙর ঠিক মন নেই এই প্রতিরোধের আন্দোলনে। ঙ কিছু নিয়ে গভীর চিন্তা করছেন।

জ হঠাৎ বলেন, আমি কি কোনও রকম সাহায্য করতে পারি আপনাকে?

ঙ চমকে ওঠেন, জিজ্ঞেস করেন, কি রকম সাহায্য?

–যে কোনও সাহায্যই। আমি পারব করতে। জ ধীরে গম্ভীর কণ্ঠে ইতি উতি তাকিয়ে বলেন।

–কি পারবেন?

–আপনার যে সাহায্যটা এখন দরকার সেটা আমি করতে পারব।

–আমার যে কোনও সাহায্য দরকার তা কি করে বুঝলেন?

–আমি অনুমান করছি।

–কি রকম শুনি।

ঙ আর জ এগিয়ে যেতে থাকেন মানুষের ভিড় থেকে দূরে..

–আপনার কি কোনও নিরাপদ কোনও জায়গা দরকার?

–নিরাপদ জায়গা?

–হ্যাঁ নিরাপদ জায়গা। যদি দরকার হয় তাহলে আমাকে জানাবেন। আর একটি কথা, আমাকে বিশ্বাস করবেন।

জ ঙর হাতে তাঁর টেলিফোন নম্বর লেখা একটি কাগজ দিয়ে ভিড়ে মিশে যান।

আশ্চর্য এই জ। জ আমার চেনা। ঙ আমার চেনা। কিন্তু জর সঙ্গে কোনওদিন ঙকে নিয়ে, অথবা ঙর সঙ্গে জ কে নিয়ে কোনও কথা আমার কোনওদিন হয়নি। জ এবং ঙ কারও জানার কথা নয় যে দুজনই আমার চেনা বা পরিচিত।

ঙ এরপর জর সঙ্গে কথা বলে নিরাপদ জায়গাটির সন্ধান পান। এরপর গভীর রাতে, হঠাৎ, এমন কী আমাকেও বলা হয় না সেটি যে আজ রাতেই, আমার মুখ মাথা, গা হাত পা ঢেকে গাড়িতে উঠতে হয়, গাড়িতে ওঠার সময় কারও যদি চোখ পড়ে আমার দিকে, ভেবে নেবে এবাড়ির কোনও পর্দানসীন বৃদ্ধা (ঙর মা ) কে বুঝি হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে অথবা বৃদ্ধা তাঁর কন্যার বাড়িতে নাতনির অসুখ দেখতে যাচ্ছেন। গাড়ির পেছনে আমাকে শুয়ে পড়তে হয় কুকুর কুণ্ডুলি হয়ে, আমার শরীরখানা ঢেকে রাখা হয় হাবিজাবি জিনিস দিয়ে। গাড়ি কোথায় যাচ্ছে, কোন দিকে — আমার সাধ্য নেই অনুমান করি। যখন থামে, আমাকে দ্রুত নেমে আসতে হয়। ক আর ঙ আমার দু পাশে এমন ভাবে হাঁটেন যেন আমি আড়ালে পড়ে থাকি। কেউ নেই সামনে আমাদের দিকে নজর দেওয়ার। সামনে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন ঝ। এটি ঝর বাড়ি। ঝ আমাদের অপেক্ষায় বাড়ির সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমরা ঢুকে যেতেই তিনি দরজায় বড় একটি তালা লাগিয়ে দিলেন। এখন ঝ কে নিঃশব্দে অনুসরণ করছেন ক, ককে আমি, আমাকে ঙ। ঝ যে পথটি দিয়ে আমাদের তাঁর ঘরের ভেতর নিয়ে গেলেন, সেটি বাড়ির পেছন দিকের পথ। আড়াইতলায় একটি ঘরে আমাদের নিয়ে ঢুকলেন ঝ। ছোট্ট একটি ঘর। ঘরের মেঝেয় একদিকে একটি তোশক পাতা, অন্যদিকে দুটো চেয়ার। মাঝখানে কাঠের তৈরি একটি ভাস্কর্য। একটি দাড়িঅলা দৈত্যের মুখ, এক হাত লম্বা জিভ বেরিয়ে এসেছে মুখ থেকে।

ঝ আমার আগে থেকে চেনা। চেনা কাউকে দেখলে মানুষের মুখে হাসি ফোটে। সম্ভাষণ জানায়। অথচ ঝ র মুখ থমথমে। আমার মুখ ফ্যাকাসে। কেউ আমরা পরস্পরকে জিজ্ঞেস করছি না কেমন আছেন বা কেমন আছো। আমরা জানি আমরা কেমন আছি। আমাদের জিজ্ঞেস করার কোনও প্রয়োজন হয় না। ক আর ঙর সঙ্গে খুব নিচু স্বরে কথা বললেন ঝ। বললেন এ বাড়িতে অনেক মানুষ আছে, আট বছর বয়সী ঝর একটি পুত্রসন্তান আছে, আর আছে তিনজন কাজের মানুষ, একজন দারোয়ান। সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমাকে এ ঘরে বাস করতে হবে। ঘরের সঙ্গেই লাগানো ছোট একটি গোসলখানা, এটি ব্যবহার করতে হবে যথাসম্ভব নিঃশব্দে, যেন কোনও শব্দ নিচ তলায় না পৌঁছোয়। এ ঘর বাইরে থেকে তালা বন্ধ থাকবে। বাড়ির লোকেরা জানবে এ ঘরে কোনও প্রাণী নেই। এ ঘরের প্রাণীকে তাই অগাধ নৈঃশব্দ্য আর অন্ধকারের মধ্যে জীবন কাটাতে হবে। তৃষ্ণা মেটাতে হলে গোসলখানার জলই যথেষ্ট, ক্ষুধা মেটাতে ঝ বাড়ির লোকদের চোখ এড়িয়ে খাবার দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। এই হল নিয়মাবলী। কতদিন আমি এখানে থাকতে পারব, এই প্রশ্ন করা হলে ঝ বলেন, যতদিন আমার প্রয়োজন। ঝর এই উদারতায় চোখে জল চলে আসে আমার। জল আড়াল করি হঠাৎ ঘরের পাশে বারান্দাটি দেখতে জানালায় উঁকি দিয়ে। ক আর ঙ চলে যান। কবে তাঁরা আসবেন, কবে আমি জানব জামিনের খবর, তা কিছুই জানি না। তাঁরাও আমাকে জানান না কিছু।

রাতে ঝ আমাকে ঘরে রেখে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দরজায় চলে যান। যাবার আগে কাঠের জিভঅলা দৈত্যের মুখটি দেখিয়ে কেবল জিজ্ঞেস করেছেন, চিনতে পারছো এই মুখটি কার? আমি উত্তর দেবার আগেই ঝ বললেন, গোলাম আযম। সারারাত আমার পার হয় অন্ধকারের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে। কাঠের মত বসে থাকি, পাশে কাঠের গোলাম আযম।

সকল অধ্যায়

১. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০১
২. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০২
৩. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৩
৪. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৪
৫. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৫
৬. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৬
৭. ২. তাণ্ডব – ০১
৮. ২. তাণ্ডব – ০২
৯. ২. তাণ্ডব – ০৩
১০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০১
১১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০২
১২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৩
১৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৪
১৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৫
১৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৬
১৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৭
১৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৮
১৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৯
১৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১০
২০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১১
২১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১২
২২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৩
২৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৪
২৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৫
২৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৬
২৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৭
২৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৮
২৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৯
২৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২০
৩০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২১
৩১. ৪. দেশান্তর – ১
৩২. ৪. দেশান্তর – ২
৩৩. ৪. দেশান্তর – ৩
৩৪. ৪. দেশান্তর – ৪ (শেষ)
৩৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২২
৩৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৩
৩৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৪
৩৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৫
৩৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৬
৪০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৭
৪১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৮
৪২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৯
৪৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩০
৪৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩১
৪৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩২
৪৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৩
৪৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৪
৪৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৫
৪৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৬
৫০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৭
৫১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৮
৫২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৯
৫৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪০
৫৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪১
৫৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪২
৫৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৩
৫৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৪
৫৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৫
৫৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৬
৬০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৭
৬১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৮
৬২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৯
৬৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫০
৬৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫১
৬৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫২
৬৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৩
৬৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৪
৬৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৫
৬৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৬
৭০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৭
৭১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৮
৭২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৯
৭৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬০
৭৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬১
৭৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬২

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন