তসলিমা নাসরিন
পাঁচ জুন, রবিবার
সকালে গ অনেকগুলো পত্রিকা সামনে নিয়ে বসেছিলেন। প্রতিটি পত্রিকায় প্রথম পাতায় আমার ছবি সহ গ্রেফতারি পরোয়ানার খবর। আমি পত্রিকাগুলো দেখতে চাইলে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন যে সকালে তিনি কাজের লোককে দেখেছেন মন দিয়ে পত্রিকা পড়ছে। লোকটি লেখাপড়া জানে, সুতরাং কেবল ছবি দেখেই শেষ করেনি, খবরও পড়েছে। এ বাড়ির অতিথির দিকে কাল রাতে তার চোখ না পড়লেও আজ তো চোখ পড়বে। তাকে, কাজের লোককে হঠাৎ করে তিনি এখন ঘরবন্দি করতে পারেন না। বাইরে পাঠিয়ে দিতেও পারেন না। তাহলে সন্দেহ আরও ঘন হবে।
প্রতিটি পত্রিকায় গ্রেফতারি পরোয়ানার খবর।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আনার অভিযোগ এনে তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি
লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। ঢাকার মতিঝিল থানার ওসি মোঃ নুরুল আলমের দায়েরকৃত মামলার প্রেক্ষিতে গতকাল ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম শহীদউদ্দিন আহমেদ এই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দিয়েছেন। বাদী তার আরজিতে উল্লেখ করেন, তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও সাম্প্রতিককালে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে ইসলাম ধর্ম ও ইসলাম বিদ্বেষী বহু কটূক্তিপূর্ণ মন্তব্য করছেন যা বহুলভাবে প্রচারিত হচ্ছে। বিবাদী সজ্ঞানে ইচ্ছাকৃতভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এইরূপ দুরভিসন্ধিমূলক কাজে লিপ্ত আছেন। বাদী তার আরজিতে বলেন, গত ৯ মে তসলিমা নাসরিন তাঁর দেওয়া কলকাতার ইংরেজি দৈনিক দি স্টেটসম্যান পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেছেন, পবিত্র কোরান শরীফ মানব সৃষ্ট গ্রন্থ। তিনি কোরান শরীফের আমূল পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন চান। ১১ মে উক্ত পত্রিকায় তাঁর লেখা একটি চিঠি বেরিয়েছে, চিঠিতে তসলিমা নাসরিন পবিত্র কোরান শরীফকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে যুগোপযোগী নয় বলে মন্তব্য করেন এবং কোরান অনুযায়ী পরিচালিত না হবার জন্য মতামত প্রকাশ করেন। বাদী আরও উল্লেখ করেন, তসলিমা নাসরিন তাঁর ধর্ম বিরোধী য়েচ্ছ!চারমূলক ও বিকৃত মতামত, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে সকলের ধিককারের পাষনী হিসাবে পরিগণিত হয়েছেন ও বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ২৯৫ (ক) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। উল্লেখ্য, তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার জন্য বাদী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের স্মারক নং ৩৩৮/ বিবিধ ৪৮/৯৪ (আইন) তারিখ ৬.৪.৯৪ ইং মোতাবেক মঞ্জুরিপ্রাপ্ত হয়েই গতকাল আদালতে মামলাটি দায়ের করেন। আদালতে অভিযোগকারীর পক্ষে এপিপি বোরহানউদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। মামলায় ১১ ব্যক্তিকে সাক্ষী করা হয়েছে, তাঁরা হলেন মেজর জেনারেল (অবঃ) আনিস ওয়াইজ, প্রিন্সিপাল বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ; মুফতি মাওলানা ফজলুল হক আমিনী, প্রিন্সিপাল লালবাগ আলিয়া মাদ্রাসা; এডভোকেট এবিএম নূরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার কোরবান আলী, অধ্যাপক আবু আহমেদ চৌধুরী, প্রফেসর এজিএম চৌধুরী, আলহাজ্ব মেজবাউর রহমান চৌধুরী, মাওলানা জুমায়েত আল হাবীব, মাওলানা আবদুল জব্বার, মাওলানা মহীউদ্দিন খান, মাওলানা আবদুল লতিফ। মামলার পরবর্তী তারিখ আগামী ৪ঠা জুলাই। এদিকে তসলিমা নাসরিনকে গ্রেফতার করার জন্য মতিঝিল থানার ২টি স্কোয়াড ছাড়াও গোয়েন্দা পুলিশের একটি বিশেষ স্কোয়াড গতকাল থেকেই তাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। তসলিমা নাসরিন যেন আকাশপথে বা সীমান্তপথে দেশের বাইরে যেতে না পারে সে ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্যে পুলিশের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে বলে পুলিশ সূষেন জানা গেছে।
বাকি খবরগুলো আমার বিরুদ্ধে মিছিলের, বিবৃতির। ১২৯ জন আলেম বিবৃতি দিয়েছেন, (তখনও তাঁরা জানেন না যে আমার বিরুদ্ধে সরকার মামলা করেছে) ইহুদি নাসারাচক্র তসলিমা নাসরিনদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে এই দেশ থেকে ইসলাম মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। সরকারের কাছে বারবার দাবি জানাবার পরও সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। পরন্তু পুলিশি পাহারা বসিয়ে তাদের নাস্তিকতা প্রচারে সহায়তা করছে। অবিলম্বে মুরতাদদের ফাঁসি না দিলে তৌহিদী জনতার হাতেই তাদের চূড়ান্ত ফয়সালা হবে। ইয়ং মুসলিম সোসাইটি বিশাল ব্যানার নিয়ে আমার ফাঁসি চেয়ে শহরে বিক্ষোভ মিছিল করে। মিছিল শেষে সভায় ডাঃ নুরুল ইসলাম বলেন, তসলিমা নাসরিনের মত নির্লজ্জ মহিলা আমার সত্তর বছর বয়সে একজনও দেখিনি। এই মহিলাকে শাস্তি না দিলে দেশবাসী বিএনপি সরকারকে ক্ষমা করবে না।
তসলিমার শাস্তির দাবিতে গোটা জাতি ফুঁসে উঠেছে, এই হল শিরোনাম। জামাতে ইসলামি, জাতীয় যুব কমাণ্ড, খেলাফত আন্দোলন, সচেতন যুব সমাজ, ওলামা কমিটির বিবৃতি, বিক্ষোভের খবর এর তলায়। এছাড়া আরও খুঁটিনাটি, কাল কটার সময় আমি বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। কটা পর্যন্ত বাড়ি ফিরিনি। কি রঙের গাড়িতে করে বেরিয়েছি। গাড়ির নম্বর কি ছিল। উত্তরে গেছি নাকি দক্ষিণে। পুলিশ কবার গেছে আমার বাড়িতে, কটা থেকে কটা পর্যন্ত ছিল। কাকে কাকে জেরা করেছে। কাকে বেঁধেছে, কাকে ছেড়েছে।
গ আজ আমার কারণে আপিস কামাই দিয়েছেন। সকালে এক কাপ চা খাবার তৃষ্ণাটি তাঁকে জানালে তিনি নিজে চা বানিয়ে দেন। কোনও কাজের লোককে আমার আশেপাশে ভিড়তে দিচ্ছেন না। বড় ফটকে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন। কাজের লোকদের কেউ যেন বাড়ির বাইরে যেতেও না পারে। সারা শহরে পুলিশ যাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজছে, তিনি তাকে লুকিয়ে রেখেছেন তাঁর বাড়িতে। গ স্থির হয়ে কোথাও বসতে পারছেন না। আমার দিকে বিরক্ত-চোখে খানিক পর পর তাকাচ্ছেন। আমি যেন এ বাড়িতে এসে একটি মহা অপরাধ করে ফেলেছি। চা এ চিনি দেওয়া হয়নি, চিনি ছাড়াই চায়ে চুমুক দিই, গর কাছে চিনি চেয়ে তাঁকে আর বিরক্ত করতে ইচ্ছে করে না। ঘড়ির কাঁটার দিকে চোখ আমার, নটা বাজতেই উঠি অ্যাণ্ড্রুকে ফোন করতে। তাঁকে নতুন করে কিছু বলতে হয় না আজ, তিনি পত্রিকায় সব খবরই পড়েছেন।
আমাকে আশ্রয় দিন আপনাদের দূতাবাসে। এ শহর বা শহরের বাইরে আমার এমন কেউ নেই যে আমাকে নিরাপদ কোনও আশ্রয় দিতে পারে। দূতাবাস ছাড়া আর কোথাও নিরাপত্তা নেই। দ্রুত বলি, কণ্ঠ আমার কাঁপে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, আশংকা, নিরাপত্তাহীনতায়।
অ্যান্ড্রু বললেন, দূতাবাস হুলিয়া মাথায় নিয়ে ঘোরা কোনও আসামীকে আশ্রয় দিতে পারে না।
অ্যান্ড্রুর ওপর যে বড় ভরসাটি ছিল আমার, মুহূর্তে মুখ থুবড়ে পড়ে।
–আমি শুনেছি দূতাবাসে আশ্রয় চাওয়া যায়। এ সময় আশ্রয় আমাকে দিতেই হবে। আপনি কেন বুঝতে পারছেন না! আমাকে জেলে পোরা হবে, জেলে তো আমাকে মেরে ফেলবে। আপনারা আমার নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করলেন, পাসপোর্ট পাইয়ে দিলেন। এখন আমার জীবন বাঁচাবার জন্য কেন চেষ্টা করবেন না! পাসপোর্টের চেয়ে তো জীবনের মূল্য বেশি! নাকি না!
অ্যাণ্ড্রু নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললেন, আপনি আপনার উকিলের সঙ্গে কথা বলুন। আপনার উকিলকে বলুন জামিনের জন্য চেষ্টা করতে।
–জামিন যদি না হয়! এই মামলায় তো জামিন হয় না। আর জামিন যে কদিন না হবে, ততদিন কি হবে? কে আমাকে আশ্রয় দেবে।
—সে ব্যাপারে আমরা কিছু বলতে পারছি না।
—আপনারা তাহলে কোনও সাহায্যই করবেন না?
—শুনুন তসলিমা, আপনাকে পাসপোর্টের জন্য সাহায্য করেছিলাম। তা আপনি পত্রিকায় লিখে দিয়েছেন। ওটা তো জনগণকে জানানোর ব্যাপার ছিল না। একটা ডিপ্লোমেটিক ব্যাপার এরকম পাবলিক করে দিয়ে খুবই অনুচিত কাজ করেছেন আপনি।
অ্যান্ড্রু আমাকে অবাক করেন। তাঁকে বরং আমি প্রশংসা করছি পাসপোর্ট পাইয়ে দিয়েছেন বলে। প্রশংসা করলে কই খুশী হবে তা নয় ব্যাটা রাগ করছে।
—আমি খুবই দুঃখিত। আমি জানতাম না যে জানানো উচিত নয়। এখন আপনার শরনাপন্ন হলাম এই কারণে যে বিদেশি দূতাবাসের অন্য কাউকে আমি চিনিনা, এক আপনাকে ছাড়া। এখন আমি কি করব বলুন। আমি কি আশ্রয় চাইতে পারি না! শুনেছি রাজনৈতিক আশ্রয় নাকি চাওয়া যায় যখন দেশে বিপদ ঘটে!
–তা নিশ্চয়ই যায়। কিন্তু এভাবে কাজ হবে না। এ দেশের আইনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা দেখাতে হবে তসলিমা। বিশেষ করে হুলিয়া যখন জারি হয়ে গেছে।
রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে হলে আপনাকে এ দেশ থেকে বেরোতে হবে। আপনি ভারতে চলে যান। ভারতে গিয়ে আপনি আশ্রয় চান। এ দেশের আইনে আপনি এখন আসামী। কোনও দূতাবাসই এখন আপনার জন্য কোনও কিছুই করতে পারে না। আপনার বিরুদ্ধে হুলিয়া না থাকলে আমরা হয়ত আপনাকে সাহায্য করতে পারতাম।
–ভারতে যাবো? কি করে যাবো? আমার জন্য সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমার তো এ দেশ থেকে এখন বেরোবার উপায় নেই।
–আমি খুবই দুঃখিত তসলিমা। আপনাকে আমরা কোনও সাহায্য করতে পারছি না এখন। আমি আপনার উকিলের সঙ্গে কথা বলব মামলা নিয়ে। আপনার পরিবারের কাউকে, আপনার কোনও এক ভাইকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবেন। আপনার খবরাখবর নেওয়া যাবে।
— আমি মরে গেলে আমার খবর দিয়ে আর কি করবেন আপনারা?
আমি ফোন রেখে দিই। কণ্ঠের কাছে যে কষ্ট জমাট বেঁধে ছিল, সেটি বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসে। বাচ্চা মেয়ের মত কেঁদে উঠি। আমার জন্য আরেকটি বুক ভাঙা কান্না অপেক্ষা করছিল। আমি জানতাম না যে অপেক্ষা করছিল। না, তা আমার জানার কথা নয়। রাজনৈতিক আশ্রয়ের চেয়ে বড় একটি আশ্রয় আমার আছে, তিনি শামসুর রাহমান। সেই আশ্রয়কে, সেই নিরাপত্তাকে, সেই নির্ভয়কে, ঝড়ে ঝঞ্ঝায় আগুনে রোদ্দুরে যিনি ছাতার মত, তাঁকে আমি ফোন করি। তিনিই ফোন ধরেন।
আমি শুধু বলি, রাহমান ভাই, আমি। ওপাশে এক মুহূর্ত নীরবতা। পরের মুহূর্তেই তাঁর ব্যস্ত কণ্ঠস্বর, শোন, কোনও কথা বলা যাবে না। আমার টেলিফোন ট্যাপড হচ্ছে।
ওপাশে ফোন রেখে দেওয়ার খটাশ শব্দ।
শব্দটি বুকে এসে লাগে। বুকে যেন বজ্রপাত হল। যেন বুকের মাংস ছিদ্র হয়ে ঢুকে গেল তীরের মত কিছু। ফোন তো ট্যাপড হবে আমার, আমার মত অপরাধীর। সমাজের নামী দামী মানুষের ফোন কেন ট্যাপড হবে! এ কি একধরনের বাঁচা যে তুমি মরছ মরো, এখন ভাই তোমাকে জন্য আমাদের কিছু করা সম্ভব নয়। তোমার জন্য আমরা মরব কেন! অতএব আমার ফোন ট্যাপড হচ্ছে। তুমি আর যোগাযোগ করো না।
মনে মনে কি আমি ভাবিনি শামসুর রাহমান বলবেন, কোথায় আছ তুমি? খবরটি শোনার পর অস্থির হয়ে আছি। আমি অনেকের সঙ্গে তোমার বিষয়ে কথা বলেছি। আমরা তোমাকে নিরাপদে কোথাও রাখার জন্য চেষ্টা করছি। আমার বাড়িতে এক্ষুনি চলে এসো। অথবা তুমি কোথায় আছো বলো, আমরা তোমাকে গিয়ে নিয়ে আসবো। আমরা লড়ে যাবো এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। কোনও রকম দুশ্চিন্তা কোরো না।
ভাববো না কেন! শামসুর রাহমান তো ছিলেনই আমার পাশে সবসময়। ব্যক্তিগত, আদর্শগত ঘনিষ্ঠতা আমার সবচেয়ে বেশি ছিল তাঁর সঙ্গেই। তাঁরও তো সেই একই। আমি কি তাঁর খুব কাছের মানুষ ছিলাম না! এই আচমকা বিপদ এলে আমি যদি তাঁর কাছে না যেতে পারি, কার কাছে যাবো!
ক আসেন সকালেই। ককে জানাই যে দূতাবাসে আমার আশ্রয় হবে না। কর মুখটি মুহূর্তে করুণ হয়ে ওঠে।
–তাহলে কি করবেন এখন? কোথায় যাবেন, ঠিক করেছেন কিছু?
–আমার কোথাও যাবার নেই। আত্মসমর্পণ কঞ্চরা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
ক আমার পাশে বসে মৃদুকণ্ঠে বললেন যে তিনি আমার উকিলের সঙ্গে কথা বলেছেন। উকিল আজই জামিন নেবার জন্য আদালতে যাচ্ছেন।
–তাহলে কি জামিন হবে? আমি উদগ্রীব।
–হলে তো আপনি জানতেই পারবেন। কিন্তু আজ রাতে তো কোথাও থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। এখানে তো গ রাজি হচ্ছেন না। গ কে বলেছিলাম যেন আজকের রাতটা এখানে থাকতে দেন।
ক কিছু খবর দ্রুত দিয়ে গেলেন। মিলন তাঁর কাছে সকালেই এসেছিল। কাল রাতে পুলিশ আমার বাড়িতে কয়েকবার গিয়েছে। বাড়ি তছনছ করেছে। রীতিমত সন্ত্রাস যাকে বলে। সবাইকে জেরা করেছে। জেরার নামে চিৎকার চেঁচামেচি অনেক করেছে। মিলনকে জিজ্ঞেস করেছে কোথায় গিয়েছিল সে আমাকে নিয়ে। হাজতে নিয়েও মিলনকে ঘণ্টাখানিক জেরা করেছে, তারা জানে যে সে আমার সঙ্গে বেরিয়েছিল, কোন বাড়িতে আমাকে সে পৌঁছে দিয়েছে সেটি জানার জন্য তাকে ঘামিয়ে কাঁপিয়ে কাঁদিয়ে ছেড়েছে। মিলন তবু বলেনি। সাহাবুদ্দিনকেও গুঁতিয়েছে, কোন বাড়িতে তিনি আমাকে নিয়ে বিকেলে বেরিয়েছিলেন তা জানতে। সাহাবুদ্দিনের পেট থেকে পুলিশ একটি শব্দও বের করতে পারেনি। ক মিলনকে পরামর্শ দিয়েছেন আপাতত বাড়িতে না গিয়ে কোথাও গা ঢাকা দিয়ে থাকতে।
ক চলে গেলেন আজ রাতের জন্য কোথাও কোনও বাড়ি পাওয়া যায় কি না দেখতে। ক র উদভ্রান্ত মুখ দেখে বড় মায়া হয়। ক আমার এমন কোনও ঘনিষ্ঠ বন্ধু নয় যে এত বড় দায়িত্ব তাঁকে আমি দিতে পারি। আমাকে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েই এখন দেখছেন তাঁর ঘাড়ের ওপর বসে আছি আমি। ক বলেছেন এ সময় কোনও বাড়িতে আশ্রয় পাওয়া আর আকাশের চাঁদ হাতের মুঠোয় পাওয়া এক কথা। কেউ আশ্রয় দিতে চাইবে না। ক ভুল বলেননি। পুরো দেশের সবচেয়ে বড় খবর এটিই এখন। মৌলবাদীরা উল্লাসে ফেটে পড়ছে। দেশ এখন আক্ষরিক অর্থেই তাদের দখলে। মৌলবাদীদের ভয়, পুলিশের ভয়। কার এত বড় বুকের পাটা যে বলে যে হ্যাঁ আশ্রয় দেব! ঝুঁকি নেব। যে আমাকে আশ্রয় দেবে সে-ই অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে আইনের চোখে। তার ওপর মৌলবাদীরা পেলে আমাকেই কেবল ছিঁড়ে খাবে না, আশ্রয়দাতা বা দাত্রীকেও কাঁচা খেয়ে ফেলবে।
সারাদিনই গ উৎকণ্ঠায় ছিলেন। ঘরের জানালাগুলো একটিও খোলা হয়নি। দরজাগুলো তালাবন্ধ। বারবারই তিনি ঝিম ধরে বসেছিলেন আর অপেক্ষা করছিলেন রাত হওয়ার। রাত হচ্ছে কিন্তু ক আসছেন না আমাকে নিতে। ক র বাড়িতে ফোন করে ককে আসতে বলবেন সেটিও করছেন না, কারণ কর বাড়ির ফোনে আড়ি পাতা হতে পারে। কঞ্চর বাড়িতে আমি গিয়েছিলাম এই খবরটি জেনে গেলে পুলিশ ককে সন্দেহতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করবে। ক নিজেও বলেছেন তাঁর বাড়িতে যেন ফোন না করা হয়। গ তাঁর স্বামীকে পাঠিয়ে দিলেন ক র বাড়িতে, যেন ক অথবা খ এসে আমাকে এ বাড়ি থেকে নিয়ে যান। আমার বিশ্বাস, ক কোনও বাড়ি খুঁজে পাচ্ছেন না আমাকে রাখার। কিন্তু বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাক বা না যাক আমাকে এ বাড়ি থেকে আজ রাতে বিদায় নিতেই হবে। গ র স্বামী খবর দিয়ে চলে এসেছেন। কিন্তু তারপরও ক র দেখা নেই। গ একবার উঠে দরজার কাছে যান, একবার জানালার কাছে, একবার ফোনের কাছে। কোনওটিই তিনি স্পর্শ করছেন না, কিন্তু করতে চাইছেন স্পর্শ।
যদি ক কোথাও না পেয়ে থাকেন লুকিয়ে থাকার জায়গা! এক চিলতে, এক ফালি জায়গা।
তাহলে কর বাড়িতে থাকবেন বা কিছু।
কিন্তু..
শুনুন, গ বলেন, আপনি কিন্তু ভাববেন না আপনাকে আমি চলে যেতে বলছি আমার নিরাপত্তার জন্য। এটা আপনার নিরাপত্তার জন্য। এখানে থাকলে আপনাকে পুলিশে ধরার আশংকা খুব বেশি।
এক দমে গ কথাগুলো বলেন। মানবাধিকার বিষয়ের আইনজ্ঞ তিনি, তিনি ফালতু কথা বলেন না।
ক রাতে আসেন। মলিন মুখ। কর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বারবারই তিনি হাতের পিঠে ঘাম মুছে নিচ্ছেন। ঘাম আবার জমছে। তাঁর ইশারায় আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। অন্ধকারে রাখা গাড়িটিতে উঠি। ক আমাকে শুয়ে পড়তে বললেন পেছনের আসনে। একটি চাদর বিছিয়ে দিলেন আমার ওপর। চাদরের ওপর কিছু কাপড় চোপড় ব্যাগ ইত্যাদি ডাঁই করে রাখলেন। বাইরে থেকে কারও যদি চোখ যায় ভেতরে, ভেবে নেবে গাট্টি বোঁচকা নিয়ে নিশ্চয়ই যাচ্ছে এরা ঢাকার বাইরে কোথাও। পথের বিপদ আপদ পেরোতে পেরোতে গাড়ি যাচ্ছে। আজ বিশাল মিছিল হয়েছে মৌলবাদীদের। আনন্দে তারা শহরময় নৃত্য করছে। খুব সাবধানে গাড়ি চলছে, সন্দেহের কিছু মাত্র যেন কারও মনে না জাগে। ভেতরে কতগুলো প্রাণ কি অবস্থায় আছে, তা ভেতরের মানুষগুলোই জানে।
গাড়ি থামলে আমাকে নিয়ে দ্রুত একটি অ্যাপার্টমেণ্টে ঢোকানো হল। এই অ্যাপার্টমেণ্টে আমি এসেছি আগে। ধরা যাক এটি যার বাড়ি, তার নাম ঘ। ঘ ঘরের আলো প্রায় নিবিয়ে অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য। ক অনেক চেষ্টা চরিত্র করে এ বাড়িটিই পেয়েছেন যে বাড়িতে আমাকে থাকতে দেওয়ায় কোনও আপত্তি নেই। ঘ আমার লেখালেখি পছন্দ করেন। শান্তিবাগের বাড়িতে তিনি দুবার গিয়েছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। দুবার আমাকে এ বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। চমৎকার মহিলা এই ঘ। নিজেও লেখালেখি করেন। ঘ র স্বামীও বেশ নামী লোক। আমাকে ছোট একটি ঘর দেখিয়ে বললেন, ওটিই আমার ঘর। এ বাড়িতে একটিই অসুবিধে সে হল কাজের লোক। আমি যদি সারাদিন ঘরের বাইরে না বেরোই, তবে কাজের লোক আমার মুখ দেখবে না। ক জিজ্ঞেস করলেন, কয়েকদিনের মামলা কিন্তু। জামিন না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকতে পারবে তো! ঘ বললেন, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। ওর এই বিপদের সময় আমাদের তো কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই ওকে সাহায্য করতে হবে। ঘ বলে চললেন, এই এলাকাটা খুব নিরাপদ। এলাকায় আজে বাজে লোক নেই বললেই চলে। ছোট ঘরটি বাইরে থেকে বন্ধ থাকে। এটি বন্ধ থাকলে কেউ বুঝবেও না যে ঘরে কেউ আছে। আমার মেয়ে যখন বেড়াতে আসে, তখন এ ঘরটিতে থাকে। ওর ইদানীং এখানে আসার কোনও পরিকল্পনা নেই।
ঘ র স্বামী বললেন, কোনও ভয় নেই। ওর যতদিন ইচ্ছা, ততদিন ও এখানে থাকবে।
ক র মুখে হাসি ফোটে। আমার মুখেও। অপ্রত্যাশিত একটি প্রস্তাব। এর চেয়ে স্বস্তিকর আর কী আছে এ সময়!
ঘ আমাকে একটি লম্বা জামা দিলেন শাড়ি পাল্টে ঘরে পরে থাকার জন্য। কিছু বইও দিয়ে গেলেন পড়তে। কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে গেল। দশ ফুট বাই দশ ফুটের ঘরটিতে কেবল একটি চৌকি, চৌকিতে শক্ত তোশকের বিছানা। একটি জানালা আছে, সাঁটা। এমন একটি ঘরকেই আমার রাজপ্রাসাদের মত মনে হয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন