তসলিমা নাসরিন
সাত জুন, মঙ্গলবার গতকাল জামাতে ইসলামী আমার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল বের করেছে। হাজার হাজার মানুষ ছিল সে মিছিলে। মিছিলের সামনে যে ব্যানারটি নিয়ে তারা হেঁটেছে, ওতে তসলিমা নাসরিনের ফাঁসি চাই লেখা নয়, লেখা ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক আইন চাই। বিপদের ঘন্টাধ্বনি বাজছে। শুনতে পাচ্ছে! কেউ, শুনতে পাচ্ছে!! জামাতে ইসলামি কেবল তসলিমার ফাঁসি দিয়ে তুষ্ট হতে চাইছে না। সংসদে ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে শাস্তির আইনের জন্য বিল পাস করার দাবি করছে। জামাতের সভায় বলা হচ্ছে, খোমিনীর ফতোয়ার ভয়ে রুশদি পালিয়ে বেড়াচ্ছে, তসলিমারও তাই অবস্থা। তসলিমাদের খুঁটির জোর আধিপত্যবাদী ভারত, সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা এবং খ্রিস্টীয় সাম্রাজ্যবাদীদের ঐক্যবদ্ধ জেহাদের মাধ্যমে মোকাবেলা করতে হবে। গোলাম আযমের প্রতিটি দিনই এখন স্বর্ণালী দিন। তিনি এখন দিন রাত ব্যস্ত। সরকারকে চাপ দিয়ে অনেক কিছু তো করানো হল, এটি হয়ে গেলে রাজ্যজয় হবে গোলাম আযমের জামাতের। মুসলিম লীগও নেমেছে আন্দোলনে, ইসলাম বিষয়ে তসলিমার অমার্জনীয় ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তির বিরুদ্ধে বিবৃতির ঝড় বইছে পত্রিকায়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ১০১ জন ছাত্রও বিবৃতি দিয়েছে, তারাও তসলিমার ফাঁসি চায়। ফাঁসি চায় জাতীয় ইসলামিক দল। তাহাফফুজে হারমাইন কমিটি। ইসলামি ছাত্র মজলিশ। একশ রকম দল। কেবল ঢাকায় নয়। সারা দেশে। এত যে ইসলামি দল আছে দেশে, আমার জানা ছিল না। প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীর অনেকে বলতেন, মৌলবাদীরা খুবই ক্ষুদ্র একটি শক্তি, এদের নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করার কোনও মানে নেই। এরা লাফায় বেশি কিন্তু ভোট তো পায় না। ঠিক, এরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসতে পারেনি। কিন্তু আগে পেত তিনটে আসন, এখন পায় বারোটি আসন। কিন্তু যত কম আসনই পাক, এরা যা দাবি করছে, সরকার তো তার সবই মেনে নিচ্ছে। এরা আজ যে ধর্মদ্রোহিতার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আইনএর জন্য দাবি তুলছে, সরকার যদি এক সময় এটিও মেনে নেয়! এরা ক্ষুদ্র দল, তা জানি। কিন্তু ক্ষুদ্র দল সবসময় ক্ষুদ্রই থাকে না। ক্ষুদ্র দল অলক্ষ্যে দানবের মত বড় হতে থাকে। বিশেষ করে এদের যদি শুরু থেকেই প্রতিহত না করা যায়। ক্ষুদ্র বলে তুচ্ছ করে অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকে অনেকে, অনেক মৌলবাদ বিরোধী প্রগতিশীল মানুষ। মৌলবাদীদের ভিন্ন ভিন্ন দল থাকতে পারে কিন্তু এরা সঙ্ঘবদ্ধ। প্রগতিশীলদের দলে বিরোধ লাগে, কোন্দল হয়, দল শত টুকরো হয়, মতের অমিল হলে জন্মের শষনু বনে যায়। মৌলবাদীদের মধ্যে তা হয় না। তারা বৃহৎ স্বার্থে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে। বৃহৎ স্বার্থটি, দেশে ইসলামি শাসনতন্ত্র কায়েম করা — দেশটির আগপাশতলা ইসলামে মোড়ানো — দেশটির বুকে ইসলামের পেরেক গাঁথা। ইসলাম এখন আর কোনও ধর্ম নয়, ইসলাম এখন রাজনীতি। এই রাজনীতি জনপ্রিয় হওয়ার দিন আসছে। ঢেউ উঠছে ইসলামি জিগিরের। আশংকাটি এখন আর আঁচড় কাটে না, এখন ধারালো দাঁতে কামড়াতে থাকে। আর কতদিন ভেবে সুখ পাবে মানুষ যে মৌলবাদী দলটি একটি ক্ষুদ্র দল! ক্ষুদ্র দল ভেবে যে এদের মাঠে ছেড়ে দিয়েছো, ভেবেছো তোমার আঙিনায় এরা দখল বসাবে না, আহা তোমার দেখা হয়নি গায়ে গতরে কেমন বেড়েছে এ, কেমন ধারালো হয়েছে এর দাঁত নখ! কেবল তোমার আঙিনায় নয়, দরজা ভেঙে তোমার ঘরে ঢুকে পড়েছে! ধর্মের দৈত্যটি দেখ কেমন তোমার ঘাড়ের ওপর চড়ে বসেছে, এখন দেখ কেমন তোমার গলা টিপে ধরেছে। শ্বাস নিতে এখন কেমন লাগছে, বল তো!
পুলিশ আমাকে খুঁজে পাচ্ছে না। সারা দেশে খোঁজা হচ্ছে আমাকে। ময়মনসিংহের বাড়িতে, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব চেনা পরিচিতদের যত বাড়ি আছে, খোঁজা হচ্ছে। শান্তিনগরের বাড়িতে নাস্তানাবুদ হচ্ছে একেকজন। মোতালেবকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। আমি কোথায় আছি, বাড়ির কেউ জানে না, কিন্তু পুলিশের ধারণা, জানে। তাদের পেট থেকে আমার খোঁজ খবর বের করার সব রকম চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ। আমার আত্মীয়রা আমার উকিলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছেন। আমি আজ যাবো কাল যাবো উμচ আদালতে বা নিম্ন আদালতে, এরকম খবর প্রতিদিনই ছড়িয়ে পড়ছে, ছড়িয়ে পড়ছে আর ভিড় বেড়ে যাচ্ছে আদালত প্রাঙ্গনে। কিন্তু বৃথাই ভিড়, আমার টিকিটি কোথাও দেখা যায়নি। আরেকটি খবর পিলে চমকে দেয়, আমি যেহেতু ধরা দিচ্ছি না, আমার সম্পত্তি ক্রোক করার কথা ভাবছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়।
খবরঃ ধর্মদ্রোহীদের শাস্তি দিতে সংসদে আইন পাস করার দাবি নিয়ে জামাতে ইসলামি বায়তুল মোকাররম মসজিদের প্রাঙ্গণে এক বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। জামাতে ইসলামি বাংলাদেশের নায়েবে আমীর মাওলানা আবুল কালাম মুহম্মদ ইউসুফ বলেছেন, তসলিমা নাসরিনসহ ধর্মদ্রোহীদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেষনীকে স্পষ্ট বক্তব্য দিতে হবে। দেশবাসীকে জানাতে হবে খালেদা হাসিনা কি ধর্মদ্রোহী তসলিমার পক্ষে, না সাধারণ জনগণের পক্ষে। তসলিমা পবিত্র কোরান উল্টে দিতে চায় অথচ খালেদা হাসিনা একটা কথাও বলেন না। তসলিমার লাগামহীন বক্তব্য ও ঔদ্ধত্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক ইসলাম বিরোধী চক্রের সাথে তার কর্মকাণ্ড বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে সে বলছে। কলকাতার সল্ট লেকে তাকে বাড়ি বানিয়ে দিচ্ছে বিজেপি। তসলিমা নিজেকে বেশ্যা বানিয়েছে, এখন আরও মহিলাকে সে বেশ্যা বানাতে চাচ্ছে। আগামী শুক্রবার জুম্মাহর নামাজের পর খুৎবায় তসলিমা সম্পর্কে বক্তব্য রাখার জন্য তিনি মসজিদের ইমামদের আহবান করেছেন। বক্তাদের মধ্যে জামাতে ইসলামির বড় নেতারা ছিলেন, সংসদ সদস্যও ছিলেন। তাঁরা বলেছেন, এবারের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে শুধু রাজপথের আন্দোলনে সীমাবদ্ধ না রেখে একটা পরিণতিতে নিয়ে যাওয়া হবে যাতে বাংলাদেশে আর কেউ ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলতে না পারে। ভণ্ডামির একটা সীমা আছে, তসলিমাকে পুলিশ পাহারা দেবে আর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, এটা কেমন কথা!
খবরঃ সারাদেশে তসলিমার ফাঁসির দাবি তুঙ্গে উঠেছে। পবিত্র কোরান সম্পর্কে ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তির জন্য কুখ্যাত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের ফাঁসি এবং দৈনিক জনকণ্ঠ নিষিদ্ধ করার দাবিতে সারাদেশে প্রতিবাদ সভা, মিছিল ও বিবৃতি অব্যাহত রয়েছে এবং তসলিমার প্রতি ঘৃণা ও ধিককারের জোয়ার প্রবলতর হচ্ছে। ঢাকা তো আছেই, এ ছাড়াও খুলনা, চট্টগ্রাম রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন সভা সমিতি সংগঠন থেকে দাবি উঠেছে, নাস্তিকতাবাদের নেষনী লজ্জার কুখ্যাত লেখিকা নির্লজ্জ তসলিমার বিরুদ্ধে কেবল গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে চলবে না, ফাঁসি দিতে হবে। জনকণ্ঠ পত্রিকায় সুরা ত্বীন এর অপব্যাখ্যা করা হয়েছে, জনকণ্ঠ নিষিদ্ধ করতে হবে। হাদিস ফাউণ্ডেশনের পরিচালক ডঃ মুহম্মদ আসাদুল্লাহ আল গালিব বিবৃতিতে বলেন, আট হাজার পাশ্চাত্য লেখক ও ছয় হাজার তিনশ পাশ্চাত্য সংগঠন যে তসলিমার পক্ষে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছে, নিশ্চয়ই সে ইহুদি নাছারাদের এ দেশীয় এজেন্ট, এতে কোনও সন্দেহ নেই। আর সে কারণেই সরকার এই কুখ্যাত মেয়েটি ও তার লেখনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভয় পায়। সম্প্রতি তাকে গ্রেফতারের এক চমৎকার নাটক দেখিয়ে বর্তমান সরকার তার ভোটারদের আশ্বস্ত করতে চেয়েছিল। কিন্তু সে চালাকি বুঝতে কারো কষ্ট হয়নি।
গ্রেফতারি পরোয়ানার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ( কোনওদিন নাম শুনিনি), লেখক শিল্পী সংসদের ২৫ জন তরুণ লেখক লেখিকা ( মৃগাঙ্ক সিংহ ছাড়া কোনও নাম আগে শুনিনি)। ব্যক্তিগত বিবৃতি দিয়েছেন বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম (নাম শুনেছি)। বলেছেন যে তিনি অবাক হচ্ছেন আমার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির বিরুদ্ধে কেউ কোনও প্রতিবাদ করছেন না দেখে।
ঘ আজ সকালে আমার জন্য নাস্তা নিয়ে এসে চোখ টিপে বলেছেন আজ তিনি কাজের মহিলাকে সকাল সকাল বিদেয় করে দেবেন। তখন আমি এ ঘর ছেড়ে বেরোতে পারব, আমি এমনকী চাইলে সোফায় গিয়ে বসতে পারব। এই প্রস্তাব নিঃসন্দেহে চমৎকার। এই ঘরটি যদি প্রাসাদ হয়, তবে পাশের ঘরের সোফা তো রাজদরবারের মত। রীতিমত মসনদে গিয়ে বসা। পত্রিকার ওপর আমার এমন ঝুঁকে থাকা দেখে ঘ বলেন, এত কী পড়? বাদ দাও পড়া। আজ না হয় কাল তুমি জামিন পেয়ে যাবে। হৈ চৈ আর থাকবে না। দেখো তুমি!
জামিন যদি না হয়! আমার মলিন স্বর।
এও একটা কথা। জামিন যদি না হয়। এই সরকার যদি তোমাকে জেলে পাঠাতে চায়, যে করেই হোক পাঠাবে। এ দেশের জুডিশিয়াল সিসটেম তো ইনডিপেনডেন্ট না, সরকারি ইনফ্লুয়েন্সেই সব চলে। লোয়ার কোর্ট সরকারের ডাইরেক্ট আণ্ডারে। হাইকোর্ট অফিসিয়ালি ডাইরেক্ট না হলেও ইনডাইরেক্টলি আন্ডারে। তা না হলে হাইকোর্ট কিভাবে গোলাম আযমকে নির্দোষ প্রমাণ করে, বল! এই সরকার গোলাম আযমকে মুক্তি দিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন হাইকোর্টকে সরকারের আদেশ শুনতে হবে। তাছাড়া জাজরা তো আবার এক একটা পার্টির লোক।
হয়ত জেলই আছে কপালে। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলি।
ঘ বললেন, ‘জেলে তো আর পলিটিক্যাল প্রিজনারদের সঙ্গে তোমাকে রাখবে না। রাখবে ক্রিমিনালদের সঙ্গে। খুনী বদমাশদের সঙ্গে। তোমার বিরুদ্ধে যে কেইস, সেটা তো ক্রিমিনাল কেইস। তোমাকে ক্রিমিনাল হিসেবে ট্রিট করা হবে। জেলে তুমি থাকবে কি করে! অসম্ভব। আমি দেখেছি জেলের ভেতরটা। ক্রিমিনালদের যেখানে রাখা হয়, সেখানে খুবই জঘন্য অবস্থা। ফ্লোরে শুতে হয়, কোনও বেড দেওয়া হয় না। গাদাগাদি করে শোয় সব। ঘরে কোনও ফ্যান নেই। দুর্গন্ধ। আন-হাইজিনিক আন- হেলদি পরিবেশ। পেচ্ছ!ব পায়খানার অবস্থা কল্পনা করা যায় না। যেখানে ঘুমোয়, সেখানেই পেচ্ছ!বপায়খানা করে। জঘন্য খাবার দেওয়া হয়। দুর্গন্ধ, বাসি পচা। মোটা মোটা লোহার মত শক্ত রুটি। উফ!’ ক্ষণে ক্ষণে শিউরে ওঠার কাঁপুনি ঘএর গায়ে, জ্ঞএসব তো আছেই, গার্ডরা মহিলা প্রিজনারদের রেপ করছে যখন তখন। না না, জেলের নাম নিও না। আমি ভাবতেই পারি না. ..’
দুপুরবেলা। চনমনে ঘ হঠাৎ তিতিবিরক্ত। বললেন, মালেকা বেগম ফোন করেছিলেন। দেশের অবস্থার কথা উঠল। এখন তো দেশের অবস্থার কথা ওঠা মানে তোমার কথা ওঠা। তা উনি কি বললেন জানো?
–নাহ। তা তো জানি না কি বললেন!
–আচ্ছ!, তোমার সাথে কি মালেকা বেগমের কোনও গণ্ডগোল হয়েছে নাকি?
–না তো!
–আমি জিজ্ঞেস করলাম মহিলা পরিষদ থেকে কোনও প্রতিবাদ করা হচ্ছে কি না। বললেন, প্রশ্নই ওঠে না। এ কেমন নারীবাদী গো! ছি ছি ছি।
আমি চুপ হয়ে বসে থাকি। তিনিও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, তোমার খুব নিন্দা করছিলেন মালেকা বেগম। আমার ভাল লাগেনি, যেভাবে তিনি কথা বলছিলেন।
–কিরকম নিন্দা? জিজ্ঞেস করি।
–বললেন, যা হয়েছে ভাল হয়েছে। শিক্ষা হয়েছে। বিজেপির টাকা নিয়ে লজ্জা লিখেছে বেশ হয়েছে। ধর্ম নিয়ে বাজে কথা বলেছে, শাস্তি হবে না কেন? ফ্রান্সে গিয়েছিল টাকা আনতে, ওর ফাঁসি হওয়াই উচিত।
–মালেকা বেগম এসব কথা বলেছেন? আমি অবিশ্বাস্য চোখে তাকাই ঘ র মুখে।
–হ্যাঁ, বলেছেন। কেন, তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?
না বোধক মাথা নাড়তে গিয়ে নাড়ি না। কী জানি, হবে হয়ত। আজকাল কত কিছুই তো উদ্ভট ঘটছে। যাদের বন্ধু বলে ভাবি, দেখা যায় তারা আসলে সত্যিকার বন্ধু নয়। ঘ যদিও বলছেন, তিনি মালেকা বেগমের মন্তব্য পছন্দ করেননি। কিন্তু একটি জিনিস টের পাই, ওই মন্তব্য তাঁর সঙ্গে আঠার মত সেঁটে আছে।
এর পর মালেকা বেগম নয়, অন্য কিছু নিয়ে কথা হয়। বিকেলের চা নিয়ে, গরম পড়া নিয়ে, বিছানার চাদর-বালিশ নিয়ে।
একসময় ঘ বলেন, কপালে অনেকগুলো এলোমেলো ভাঁজ, আচ্ছ!, তুমি এত চমৎকার নির্বাচিত কলাম লিখলে! এত সুন্দর কবিতা লেখো তুমি। আমি তোমার সবগুলো কবিতার বই পড়েছি। কিছু কিছু কবিতা মুখস্তও হয়ে গেছে পড়তে পড়তে। মেয়েদের কথা তুমি যেভাবে লিখতে পারো, আর কেউ পারে না সেভাবে লিখতে! তুমি মেয়েদের মনের কথাগুলো প্রকাশ করছিলে, যে কথা মেয়েরা প্রকাশ করতে জানে না। তুমি তো কেবল মেয়েদের মনের কথাই কেবল বলোনি, তাদের তুমি অনেক প্রেরণা দিচ্ছ, সাহস দিচ্ছ। অনেক মেয়েই আমাকে বলেছে, তোমার লেখা পড়ে তাদের জীবন এখন পাল্টে গেছে, তারা এখন নতুন করে নিজেদের চিনতে পারছে, তারা এখন নিজেদের মূল্য দিতে শিখছে। তারা মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাইছে। এ কত বড় কাজ, তুমি বোঝো! যেভাবে লিখছিলে, সুন্দর লিখছিলে। সব কিছু তো ভালই ছিল। কিন্তু, তুমি হঠাৎ কেন লজ্জা লিখতে গেলে?
বড় একটি চমক আমার জন্য। ঘ এবং তাঁর স্বামী মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আর এই ঘ কি না বলছেন আমি কেন লজ্জা লিখতে গেলাম!
তোমার মাথা টাথা কি খারাপ হয়েছিল?
এর উত্তর কি দেব আমি তা না বুঝতে পেরে অপরাধীর মত নখ খুঁটি। নখ থেকে চোখ তুললেই দেখি ঘ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন আমার উত্তরের জন্য।
মৃদু কণ্ঠে বলি, এখানে হিন্দুদের ওপর অন্যায় অত্যাচার হয়েছে। এগুলোর প্রতিবাদ করেছি। করাটা কর্তব্য মনে হয়েছে।
–শোন, তুমি নারীবাদী লেখক, তুমি নারীবাদী লেখা লিখবে। হিন্দু মুসলমান সমস্যা নিয়ে লেখার জন্য তো অনেকেই আছেন। এসব পলিটিক্যাল লেখা। তুমি তো আর পলিটিক্স কর না। তোমার একটা ফিল্ড আছে, সেই ফিল্ডে তুমি নাম করেছিলে। তুমি নারীবাদ নিয়েই ফিক্সড থাকতে পারতে! খামোকা কেন তুমি ডিরেইল্ড হলে? তোমার লজ্জা লেখাটা উচিত হয়নি।
–লজ্জা লিখেছি বলে আমি যে মেয়েদের সম্পর্কে লেখা বন্ধ করে দিয়েছি, তা তো নয়। আমি তো লিখছিই।
–লিখছ কিন্তু লজ্জা লেখার জন্য অনেকে এখন তোমার নারীবাদী লেখাগুলোও আর ভাল ভাবে নিচ্ছে না। মালেকা বেগম বললেন তুমি বিজেপির কাছ থেকে টাকা নিয়ে লিখেছো লজ্জা, এ কথা তো শুধু তো মালেকা বেগমই বলেন না, এ কথা অনেকেই বলে। এই লজ্জা লিখে নিজের অনেক ক্ষতি করেছো তুমি তসলিমা।
এ সময় কানদুটো যদি বধির হয়ে যেতো! যদি সত্যিই বধির হত কান, আমার স্বস্তি হত।
–তুমি কি জানো না ভারতে মুসলমানদের কি করে মারছে? জ্বলন্ত উনুনে ওদের ফোটাচ্ছে, জানো না?
উনুনে ফোটানোর কথা বলতে গিয়ে ঘ র শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠল। জ্যান্ত মানুষগুলো যেন তাঁর চোখের সামনে উনুনে ফুটছে।
–এরকম শুনিনি তো! জ্বলন্ত উনুনে ..
ঘ উত্তেজিত।
–তাহলে তুমি জানো না! একটা বিষয় যদি না জানো, তবে বিষয়টি নিয়ে লিখতে যাও কেন! তোমার তো জানতে হবে ওখানে কী হচ্ছে।
আমি অসহায় বসে থাকি। মাথা নত।
ঘ র গলার স্বর উঁচু থেকে খাদে নেমে আসে। তিনি ধীরে, প্রায় গলা চেপে, প্রায় কানে কানে বলেন, এখানেও হিন্দুদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে তা ঠিক। কিন্তু তা বলতে যাবে কেন? ওরা কি মুসলমানদের ওপর ওখানে যে অত্যাচার হচ্ছে সেগুলো বলে? এসব বলতে হয় না। তুমি খুব ভুল করেছো লজ্জা লিখে।
ইচ্ছে হয় প্রতিবাদ করি। বলি যে না, আমি ভুল করিনি। ওখানে কি হচ্ছে, তা আমি দেখিনি, তা আমি জানি না। এখানে যা হচ্ছে, এখানে যা আমি দেখেছি, তা লিখেছি। ঘ আমার নীরবতার কিছু একটা অনুবাদ করে নিয়ে বললেন, এটা একটা সেনসিটিভ ইস্যু। এটা দুদেশের পলিটিক্যাল ব্যাপার। এটা নিয়ে তুমি ডীল করতে পারো না। কারণ তোমার কাছে ইনফরমেশন নেই দুদিকের। তাছাড়া তুমি তো আর পলিটিক্স বুঝবে না। পলিটিক্স করলে পলিটিক্স বুঝতে।
এর উত্তরে আমি কিছু বলি না, শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আমি জানি ঘ এখন যা বলছেন, তা এদেশের অধিকাংশ লোক বলছেন। নাহ, প্রতিবাদ এখন আর আমি করছি না। আমার মানসিক শারীরিক সব শক্তি আমি হারিয়ে বসে আছি।
ঘ বিশ্রাম নিতে তাঁর নিজের ঘরে চলে যান। বাইরে থেকে আমার ঘরের দরজাটি বন্ধ। অন্ধকার জানালায় মুখ করে শুয়ে ছিলাম। যদিও রাজদরবারে গিয়ে মসনদে বসার কথা ছিল আমার, বসা হয়নি। মসনদের জন্য আমার কোনও আগ্রহ জন্মে না, এই ঘরে শুয়ে বসে অপেক্ষার এক একটি মুহূর্ত তো নয়, যুগ পার করছি জামিনের খবর শোনার জন্য। কেবল ক র আসার অপেক্ষা। ক আমার জন্য জামিন হওয়ার একটি সুসংবাদ নিয়ে দেবদূতের মত উদয় হবেন। তাঁর উদয়ের পথে আমি উদগ্রীব প্রাণ নিয়ে তাকিয়ে আছি। এসময় হঠাৎ ঘরে ঢোকেন ঘ। ক র কথা জিজ্ঞেস করেন। ক কোথায় আছে তা আমি জানি কি না জানতে এসেছেন।
না আমি জানি না।
ঘ বললেন ককে তাঁর খুব দরকার। ককে কেন দরকার তাঁর, তা আমি জিজ্ঞেস করি না। কিন্তু তিনি নিজেই বলেন, কর আজ আসা দরকার আমাকে নিয়ে যাবার জন্য।
কান তুমি বধির হও।
কান বধির হয় না।
–আপনি তো বলেছিলেন, আমি এখানে যতদিন দরকার হয়. ততদিন থাকতে পারব! নিজের স্বরে নিজেই চমকে উঠি, স্বরটি কান্নার মত শোনাচ্ছে।
–বলেছিলাম। তখন বুঝতে পারিনি এ যে কত বড় ঝুুঁকির ব্যাপার। ক কোথায় আছে এখন, তুমি জানো না?
মাথা নাড়ি। গলায় আর স্বর ফুটছে না।
আবারও অস্ফুট কণ্ঠ আমার, কাল আমার জামিন হয়ে যাবে হয়ত। আজকের রাতটা অন্তত থাকি..
ঘ বললেন, দেখ, একটা রাত কেন, অনেকগুলো রাতই তুমি থাকতে পারতে। কিন্তু আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে। পাশের ফ্ল্যাটের মহিলা আমার বাসায় দুবার কড়া নেড়েছে। দুবারই আমি তাকে দেখেছি দরজায় বাইরে থেকে ভেতরে উঁকি দিচ্ছে। কখনও সে এমন করে না। নিশ্চয়ই সে সন্দেহ করছে..
–ক এখন আমাকে নিয়ে কোথায় যাবেন? ক র তো কোনও জায়গা নেই আমাকে রাখার!
–সে ক জানবে।
স্বরটি থেকে লু ছুটে আমার চোখ মুখ পুড়িয়ে দিতে চায়।
অবিরল অশ্রুধারা পোড়া থেকে বাঁচায় আমাকে।
ঘ অন্য ঘরে চলে যান। ঘ র কণ্ঠস্বর ভেসে আসে অন্য ঘর থেকে। জ্ঞআমার বাসায় তুমি একটা কলম রেখে গেছিলে, কলমটা নিয়ে যেও আজ। আজই কিন্তু নিতে হবে, কারণ আমি কাল সকালেই ঢাকার বাইরে চলে যাচ্ছি। তুমি না আসতে পারলে অন্য কাউকে পাঠিয়ে দিও নিয়ে যেতে। উহ, যে গরম পড়েছে এ সময় জার্নি করাও মুশকিল…’
মধ্যরাতে ক আর খ আসেন। দুজনের মুখেই দুশ্চিন্তার কালো দাগ। আমি যে কত বড় বোঝা এখন, আমি যে কত বড় ঝুঁকি এখন তাঁদের কাছে, দাগটি দেখেই বুঝি। হাড়ে মজ্জায় টের পাই। ক কে আকুল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করি, কিছু হল জামিনের? ক মাথা নাড়েন। না বোধক। ঘ একবার ক কে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় এখন নিয়ে যাচ্ছ? ক উত্তর দেন নি। ঘ আমার মাথার ওপর তাঁর নিজের একটি চাদর ফেলে বললেন যেন এটি দিয়ে মুখ মাথা সব ঢেকে ফেলি। ঢেকে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নামতে হয়। যেন কেউ কোনও বাড়ির দরজা খুলে এ সময় বেরিয়ে আমাকে দেখে ফেলার সুযোগ না পায়। মুখ মাথা ঢেকে বসে থাকতে হয় পাথরের মূর্তির মত গাড়িতে। কেউ কোনও কথা বলছে না। গাড়ি কোথায় কোনদিকে যাচ্ছে, কিছুই আমার বোধে আসে না। গাড়ি হঠাৎ একসময় থেমে যায়, হঠাৎই অন্ধকার থেকে লাফিয়ে কেউ একজন গাড়িতে ওঠেন। গাড়িতে যিনি ওঠেন, তাঁর নাম ধরছি ঙ। ক, খ এবং ঙর মধ্যে কোনও কথা হচ্ছে না। ঙ কেবল গাড়ির চালককে বামে, ডানে, সামনে শব্দগুলো বলছেন। গাড়ি যখন এক গলিতে ঢুকলো, গলির ভেতরে একটি ট্রাক আমাদের উল্টো দিক থেকে এসে পথরোধ করে দাঁড়ালো, কারও পাশ কেটে যাওয়ার কোনও অবস্থা নেই। ট্রাকের পেছনে দুটো গাড়ি এসে থামল, আমাদের গাড়ির পেছনে একটি গাড়ি, পাশে চারটে রিক্সাও থামল। ট্রাক চালক নেমে এল যানভিড় হালকা করার জন্য। আমাদের গাড়ির চালককে পেছনে যাবার নির্দেশ দিচ্ছে। গাড়িগুলো ভেঁপু বাজাচ্ছে, কিছু পথচারী থেমে আছে জটলার মধ্যে। গাড়ির আলো এসে পড়ছে মুখে। উপুড় হয়ে বস্তার মত পড়ে থাকব ভেতরে, সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। পথচারির চোখে পড়তে পারে বস্তা হওয়ার দৃশ্য। মুখ বেশি ঢাকা যাচ্ছে না, বেশি করে মুখ ঢাকলে সন্দেহ হবে, এমনিতে গরমকালে শীতের চাদরে মাথা ঢাকাটাই উদ্ভট। আমি শাড়ির আঁচল দিয়ে নাক ঢেকে রাখি, যেন নাক ঢাকছি ধুলো বালি এড়াতে। নাক ঢাকতে গিয়ে চিবুক ঢাকা হয়ে যাচ্ছে, ঠোঁট ঢাকা হচ্ছে, গাল হচ্ছে। চাদর মাথার ওপরে বেশি টেনে দেওয়ার ফলে কপালের খানিকটা ঢাকা হয়েছে। বাকি আছে চোখদুটো। চোখদুটোতে আশংকা, এ্ই আশংকাই কারও নজরে পড়লে সংশয় জাগাবে। কিন্তু আশংকাকে কোথায় লুকোই আমি! আশংকা নিয়ে চোখদুটো নত হয়ে থাকে। কিন্তু রাস্তায় যান বাহন জট পাকাচ্ছে, আমি তো আর আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা নই, আমি কেন চোখ তুলে দেখছি না কি হচ্ছে না হচ্ছে! গাড়ির ভেতর এক চালক ছাড়া আমরা সব শ্বাস বন্ধ করে রাখছি। আমার মাথাটি আলতো করে ধরে খ তাঁর নিজের কাঁধে রাখেন। এবার আমি মনে মনে বুঝি, আমাকে কি করতে হবে, আমাকে চোখ বুজে থাকতে হবে, আমি যে অসুস্থ এক মহিলা, গাড়ি করে কোনও হাসপাতালের দিকে যাচ্ছি, অথবা হাসপাতাল থেকে এসেছি, তা যেন অনুমান করে নেয় যে কেউ, যারই চোখ আমার মুখে পড়ে। গাড়ির জট খুলে রাস্তা পরিষ্কার হতে বারো মিনিট সময় নেয়, এই বারো মিনিট আমার কাছে বারো বছরের মত দীর্ঘ। যেন বারো বছর ধরে আমার সশস্ত্র আততায়ীটির চোখের সামনে নিরস্ত্র বসে আছি। গাড়ি থামলে আমাকে আর সবার সঙ্গে নেমে পড়তে হয়। মুখ মাথা ঢাকা আমি, কেবল চোখদুটো খোলা। দোতলা একটি বাড়ির দোতলায় উঠি মুখ মাথা খোলাদের সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে। ঘর অন্ধকার করে ভেতরে যে মেয়েটি বসেছিলেন, তার নাম চ। ঘরের আধো আধো আলোয় আমি ঙ কে চিনতে পারি, ঙ দেশের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। বড় মাপের একজন বুদ্ধিজীবী। ঙ র বাড়িতে আমি আগে দুবার গিয়েছি, একবার কজন সাহিত্যিককে ডেকেছিলেন একটি ঘরোয়া আলোচনায়, আর একবার ঙ এবং ঙর স্ত্রী আমাকে এবং আরও কজনকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন, সে নিমন্ত্রণে গিয়েছিলাম। ঙর মত এত বড় একজন মানুষ আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন, এটি আমাকে নিরাশার গাঢ় অন্ধকার থেকে টেনে আলোতে ওঠায়। কি করে ক র সঙ্গে ঙ র যোগাযোগ হল, কিছু আমি জানি না। যে বাড়িতে ঙ আমাদের নিয়ে এলেন, এটি তাঁর কন্যার বাড়ি। চ নামের মেয়েটি তাঁর কন্যা।
আধাঁর আঁধার ঘরটিতে ক, খ, ঙ, চ এবং আমি। আমাদের মধ্যে খুব নিচু গলায় কথা হয়। ক বলেন যে তিনি আমার উকিলের কাছে গিয়েছিলেন, উকিল এখনও আদালতে যাননি আমার জামিনের জন্য। ডঃ কামাল হোসেন দেশে ছিলেন না, তিনি ফিরে এসে অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করছেন। ক আরও বললেন যে যেহেতু এই মামলায় জামিন হয় না, সুতরাং জামিনের জন্য যদি উকিল লড়তে চান, তবে দেশের জনগণ যে আমার বিরুদ্ধে জারি হওয়া মামলা আর গ্রেফতারি পরোয়ানার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, তা বলতে হবে, তার প্রমাণ দেখাতে হবে। তাই আমার পক্ষে এখন জনমত দরকার, পত্রিকায় আমার পক্ষে বিবৃতি দরকার। এটিই এখন সরচেয়ে জরুরি। ক নিজে বিবৃতি যোগাড় করার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, কিন্তু কেউ, কোনও বুদ্ধিজীবী, লেখক, রাজনীতিক বিবৃতি দিতে চাইছেন না। কে দিতে চাইছেন না, তা আমার জিজ্ঞেস করার সাহস হয় না। আমি বলি, কিছু বিবৃতি তো গেছে। কর মুখে দুশ্চিন্তার দাগটি আরও ঘন কালো দেখায় যখন বলেন, ও কটা বিবৃতিতে কিμছু কাজ হবে না।
খ বললেন, তোমার জন্য এ দেশের লোকের সাপোর্ট আছে, তোমার পক্ষে দাঁড়াবার জন্য এটিই একমাত্র বেইস।
ঙ বললেন, বিদেশি কিছু ইম্পর্টেন্ট অরগানাইজেশন তো প্রতিবাদ করেছে।
ক বললেন, হ্যাঁ বিদেশি অরগানাইজেশনের সাপোর্ট আছে। কিন্তু দেশি সাপোর্ট লাগবে। দেশি সাপোর্টএর মূল্য এখন বেশি।
সারা হোসেনের সঙ্গে কথা হয়েছে আপনার? ক কে জিজ্ঞেস করি।
ক বললেন, আপনার ভাগ্য খুব ভাল যে আপনি ডক্টর কামাল হোসেনের মত উকিল পেয়েছেন। তাঁর মেয়ে সারা হোসেন আপনার জামিনের ব্যাপার নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। কোর্টে আপনার অনুপস্থিতিতে জামিন নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ কোর্টে যাওয়া তো আপনার জন্য রিস্কি। যতদূর মনে হচ্ছে জামিন পাওয়া মোটেও সহজ নয়। এ দেশে কজন উকিল এধরনের কেইস করার ঝুঁকি নিতে পারে? চারদিকে খবর হয়ে গেছে যে কামাল হোসেন আপনার উকিল। পাবলিক সেন্টিমেণ্টের ব্যাপার। কখন বোমা মেরে উড়িয়ে দেয় উকিলের অফিস কে জানে! কামাল হোসেন একটা পলিটিক্যাল পার্টির লিডার। আপনার পক্ষ নিলে তাঁরও ক্ষতি হবে।
দীর্ঘ একটি শ্বাস গোপন করি।
খ বললেন, ঙ যে কত উপকার করলেন আজ। ঙর সঙ্গে যদি আজ দেখা না হত তবে তোমাকে কোনও বাড়িতে আশ্রয় দেয়ার ক্ষমতা ছিল না। ঘ যখন জানিয়ে দিলেন যে তোমাকে তিনি আর রাখতে চাইছেন না, মোট সাতজনের সঙ্গে আমি গোপনে কথা বলেছি, কেউ তোমাকে রাখার ঝুঁকি নিতে চান না। একমাত্র ঙ রাজি হয়েছেন।
ক হঠাৎ অপ্রাসিঙ্গকভাবে লজ্জার কথা তুললেন। বললেন, আপনার উচিত ছিল লজ্জা বইটাতে একটা ব্যালেন্স রাখা। ভারতের মুসলমানের ওপর কি হয়েছে, সেটা আপনি পুরো এড়িয়ে গেছেন। সত্যি কথা বলতে কি, এ দেশের মানুষ আগে যেমন আপনাকে পছন্দ করত, এখন আর তেমন করে না।
দীর্ঘশ্বাস জানে কতটা দীর্ঘ তার পথ।
ক হঠাৎই উঠে পড়েন, উঠে বিরক্ত গলায় বলেন, আপনি এত দীর্ঘদিন থেকে নারীবাদী লেখা লিখছেন। আপনার কেন কোনও মহিলা সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না! কেন করেননি যোগাযোগ? দেশে এত সংগঠন, আপনি কোনও সংগঠনের সদস্য নন। আজ যদি আপনি কোনও একটা মহিলা সংগঠনের সদস্য হতেন, আপনার এই অসুবিধা হত না।
যাবার আগে ক চকে বললেন দরজা তো বটেই, জানালাগুলোও সব সময় বন্ধ রাখার জন্য, যেন বাইরে থেকে কেউ আমাকে দেখার সুযোগ না পায়। টেলিফোন তালাবন্ধ রাখার জন্য যেন কোনওভাবেই আমার হাতের নাগালে টেলিফোন না আসে কারণ ভুল করে আমি এমন কাউকে ফোন করে ফেলতে পারি যার বাড়ির ফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে, পুলিশ তখন জেনে যাবে কোন বাড়িতে আমি আছি, তখন কেবল আমার সর্বনাশ হবে না, চ র ও হবে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন