৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৭

তসলিমা নাসরিন

দশ জুলাই, রবিবার

ছাত্র ইউনিয়নের সেমিনার হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিষয়, ফতোয়াঃ রাষ্ট্র, ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতির প্রেক্ষাপটে। কে এম সোবহান বলেছেন, সত্তর দশকে পুঁজিবাদী বিশ্ব আবিষ্কার করে সমাজতন্ত্র ঠেকানোর জন্য মৌলবাদের চেয়ে অব্যর্থ অস্ত্র আর নেই। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, বিএনপি জন্মের পর থেকেই মৌলবাদীদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়ে আসছে। এটা ছিল বিএনপির বিরুদ্ধে আমাদের প্রধান অভিযোগ। কিন্তু দুঃখ এই যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি দল রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণের নামে জামাতের সঙ্গে বসে আলোচনা করছে। ফতোয়াবাজির উদ্ভবের পেছনে রাষ্ট্রীয় মদদ ও সরকারি রাজনীতি, গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর পরিবর্তন, উপমহাদেশের সাম্প্রতিক মৌলবাদী রাজনীতি, সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা, ধর্মান্ধতা, বাম রাজনীতির ব্যর্থতা, ইংরেজদের ডিভাইড এণ্ড রুল নীতির কারণে পাকিস্তান নামের মৌলবাদী রাষ্ট্রের উত্থান প্রভৃতি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে।

এছাড়া গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য আজ দেশব্যাপী ফতোয়াবাজ প্রতিরোধ পালন করা ঘোষণা দিয়েছে। এ তো গেল ঘরের ঘটনা। ঘরে বসে ঘোষণা দেওয়ার ঘটনা। ঘরের বাইরে কি ঘটছে? রাস্তায় কি ঘটছে? বড় বড় মাঠে ময়দানে ঘটছে কি?

সিলেটে ২৯ জুলাইএর লং মার্চ সফল করার লক্ষ্যে ঐতিহাসিক রেজিস্ট্রারী ময়দানে ভাষণ দেন ইসলাম ও রাষ্ট্রদোহী প্রতিরোধ মোর্চার মহাসচিব মাওলানা ফজলুল হক আমিনী। বিশাল ময়দান, বিশাল জমায়েত, বিশাল ভাষণ। সিলেট ঘুরে এসে বিবৃতি দিয়েছেন, সিলেটসহ সারা দেশে যে গণজাগরণ দেখে এসেছি তাতে প্রতীয়মান হয় যে আগামী ২৯ জুলাই পবিত্র কোরান দিবসে ঢাকায় তৌহিদী জনতার ঢল নামবে। সারা দেশ থেকে লাখ লাখ জনতা লং মার্চ করে ঢাকায় আসার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। তৌহিদী জনতার ঈমানের জোয়ারে সেদিন নাস্তিক মুরতাদ চক্রের দাফন করা হবে। ৩০ জুন সফল হরতাল পালিত হওয়ার পর প্রায় ৯ দিন অতিবাহিত হয়ে গেল, অথচ সরকার আমাদের একটি দাবিও পূরণ করেনি। এনজিওদের পক্ষে সরকারের কোন কোন মন্ত্রীর সমর্থন এবং আলেম উলেমাদের ঢালাওভাবে ফতোয়াবাজ আখ্যা দানে জনমনে আরও পরম ক্ষোভ পরিলক্ষিত হচ্ছে। সরকারের এহেন ভূমিকা দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি ডেকে আনবে। আমরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী। কিন্তু আমাদের নিয়মতান্ত্রিকতাকে দুর্বলতা ভাবলে ভুল হবে।

চট্টগ্রামে নেছারিয়া আলিয়া মাদ্রাসার উদ্যোগে শাহাদাতে কারবালা বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন যে আজকে এক শ্রেণীর মুরতাদ নাস্তিক ধর্মদ্রোহী দেশ হতে ঈমানী আওয়াজকে বন্ধ করার জন্য এবং দেশকে একটি নাস্তিক্যবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য নানাভাবে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। তারা তসলিমার মত বেহায়া, নাস্তিক মহিলাকে এ কাজে লেলিয়ে দিয়ে কোরান হাদিস এবং দ্বীনি ধ্যান ধারণার ওপর নির্লজ্জ হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় শাহাদাতে কারবালার দীপ্ত শপথ নিয়ে সকল ধর্মদ্রোহী মুরতাদদের প্রতিহত করার আহবান জানিয়ে বক্তারা বলেন, ১২ কোটি ইসলামপ্রিয় মানুষ দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ ভাবে সকল ইসলামদ্রোহীদের বিষদাঁত ভেঙে দেবেই।

আরও খবর। ঢাকা ভার্সিটির ২৬৫ জন ছাত্র ছাত্রীর বিবৃতি। তসলিমা নাসরিনকে অবিলম্বে গ্রেফতার করুন। আগ্রাসন প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির ছাত্র শাখার পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৬৫ জন ছাত্র ছাত্রী এক বিবৃতিতে স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও জাতীয় উজ্জীবন নিশ্চিত করার জন্য দেশে বিদেশে নিন্দিত, চরম সাম্প্রদায়িক, আমাদের এই রাষ্ট্র ও তার স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের শত্রু, ভারতের বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বিজেপি, আনন্দবাজারীদের সেবাদাসী তসলিমা নাসরিনকে ধর্ম এবং রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে অবিলম্বে গ্রেফতার ও বিচার করার দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা বলেন এ লেখিকা দেশে বিদেশে মুদ্রিত তার লেখায়, সাক্ষাতকারে আলাপ আলোচনায় যে আন্তর্জাতিক সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির চেষ্টা করছে, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। বিবৃতিতে তিন দিনের মধ্যে তসলিমাকে গ্রেফতার ও তার সমর্থক পত্রিকাগুলোকেও নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে বলা হয়, আমরা অবিলম্বে উক্ত লেখিকার সমস্ত রচনার মুদ্রণ, পুনঃমুদ্রণ ও অনুবাদ দেশে বিদেশে নিষিদ্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি। তসলিমার মত রাষ্ট্রদ্রোহী, সমাজদ্রোহী, ধর্ম ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বদ্রোহীকে প্রতিহত করে স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও জাতীয় উজ্জীবন অব্যাহত রাখার সংগ্রামে এগিয়ে আসতে সচেতন ও দেশপ্রেমিক সকল ছাত্রছাত্রী ভাই বোনসহ সমগ্র জাতির প্রতিও আহবান জানাচ্ছি। বিবৃতি প্রদানকারীদের মধ্যে আছেন, মোঃ মনিরুজ্জামান, মোঃ আবদুল লতিফ, মোঃ ইউছুফ আলী, মোঃ ছফিউল্লাহ, মোঃ মাহবুবুর রহমান, মোঃ সেলিম রেজা, মোঃ ফজলুর রহমান, নার্গিস আখতার প্রমুখ।

ঢাকায় যুব কমাণ্ডের বিশাল সভায় বলা হয়েছে, ৩০ জুনের গণরায়কে পাশ কাটানোর পদক্ষেপ দেশবাসী মানবে না। ওদিকে দিনাজপুরে মুরতাদদের ফাঁসির দাবিতে জামাতে ইসলামীর ডাকে বিক্ষোভ দিবস পালন হয়। পবিত্র কোরান অবমাননাকারী ধর্মদ্রোহী মুরতাদদের গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবিতে জামাতে ইসলামী বাংলাদেশ এই বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। সকালে প্ল্যাকার্ড ফেস্টুন নিয়ে একটি বিক্ষোভ মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে, পরে জেলা প্রশাসককে ৮ দফা দাবির একটি স্মারকলিপি দেয় জামাতিরা।

এ সময় কী ঘটছে আমার জীবনে, কী হচ্ছে দেশে, তা পত্রিকার সংবাদগুলোই দেখিয়ে যাচ্ছে। আমি তো সারাদিন অন্ধকার ঘরে গা ঢেকে মাথা ঢেকে বসেই আছি। বসে থাকতে থাকতে পিঠে খিল ধরে যায়, পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে। আমার তো আর বিশেষ কোনও খবর নেই। হঠাৎ হঠাৎ আমার বসে থাকার স্থবিরতায় কেউ কেউ তরঙ্গ তুলে উদয় হন। জ উদয় হলেন দুপুরবেলা। দেশের অবস্থা সম্পর্কে জর সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা হওয়ার পর যখন চুপচাপ বসে আছি দুজনই একটি হতাশার দিকে তাকিয়ে, জ চুলের কথা তোলেন। ঙই নাকি জকে দিয়ে চুল কিনিয়েছেন। চুল! এই চুলটি কিছুতেই আসলে আমাকে স্বস্তি দিচ্ছে না। ভূত হয়ে দিনরাতই ভয় দেখাচ্ছে। গভীর রাতে আচমকা ঘুম ভেঙে যায় চুলের ভয়ে। চুলের প্রসঙ্গ আমাকে এত অস্বস্তি দিতে থাকে যে আমি প্রসঙ্গ পাল্টে দেশে কি হচ্ছে না হচ্ছের দিকে নজর দিই। দেশের কথা বলতে বলতেই সুফিয়া কামালের প্রসঙ্গ ওঠে। জ সুফিয়া কামালের প্রশংসা করছেন কারণ এই এত বয়স হওয়ার পরও তিনি সভায় যাচ্ছেন, মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে যুব সমাজকে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য আহবান জানাচ্ছেন। সুফিয়া কামালকে তিনি খালাম্মা বলে স−ম্বাধন করেন। শুধু জ নন, সুফিয়া কামালের বয়সে ছোট সবাই তাঁকে খালাম্মা বলে, তিনি হয়ে গেছেন জাতীয় খালাম্মা। জাহানারা ইমামকে ডাকা হয় আম্মা বলে। আম্মা আর খালাম্মা ডাক আমার মুখ দিয়ে কখনও বেরোয়নি। আমি পারি না হঠাৎ কাউকে আম্মা বলে ডাকতে। ওসব ডাকলেই যে সম্মান দেখানো হয়, না ডাকলে হয় না, তা আমি মানি না। সুফিয়া কামালকে সুফিয়া কামাল ডেকেই আমি যথেষ্ট সম্মান করতে পারি। তিনি জাতীয় সমন্বয় কমিটির এক সভায় মানুষকে বলেছেন, আল্লাহর নাম নিয়ে জেগে উঠুন, মৌলবাদীর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করুন। সুফিয়া কামাল নিজে খুব ধর্মবিশ্বাসী মানুষ, তিনি তাঁর বিশ্বাস থেকেই মানুষকে আল্লাহর নাম নিয়ে জেগে উঠতে বলেছেন। আল্লাহর নাম নিয়ে মৌলবাদীরা জাগে, এখন আল্লাহর নাম নিয়ে অমৌলবাদীদেরও জাগতে হবে! সাম্যবাদের নাম নিয়েও তো জাগা যায়, অসাম্প্রদায়িকতার নাম নিয়েও তো যায়, মানবতার নাম নিয়েও তো যায়। কেন আল্লাহর নাম নিয়ে জাগতে হবে! আল্লাহ কি কোনও অসাম্প্রদায়িক কথা কোনওকালে বলে গেছেন কোথাও?

জ বললেন যে সুফিয়া কামালের সঙ্গে তাঁর একদিন কথা হচ্ছিল, আমার প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি, সুফিয়া কামাল, খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, তসলিমা মেয়েটি খুব বেয়াদব। ওকে আমি এত খবর দিলাম ও যেন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। মেয়ে এল না!

অবাক হই শুনে। তিনি আমার শান্তিবাগের বাড়িতে একবার লোক পাঠিয়েছিলেন খবর দিতে তাঁর সঙ্গে যেন দেখা করতে যাই। আমি গিয়েছিলাম পরদিনই। তিনি আমার সঙ্গে হেসে কথা বলেছেন, মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেছেন। জকে বলি সে কথা। জ বললেন আমার সেই দেখা করার খবর তিনি জানেন। সুফিয়া কামাল নাকি আমাকে আরেকদিন ডেকেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয়বারের ডাকার খবর আমি পাইনি। খবরটি যাকে দিয়ে পাঠিয়েছিলেন সে আমার কাছে আসেনি। কিন্তু সে কথা কি জানেন সুফিয়া কামাল যে তার দূত আমাকে তাঁর কোনও খবর আদৌ পৌঁছে দেয়নি!

জ মাথা নাড়লেন, জানেন না তিনি।

সুফিয়া কামালের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে ছাড়াও আরেকবার আমার দেখা হয়েছিল, দেখাটি হয়েছিল পূরবী বসুর একটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে। সুফিয়া কামাল ছিলেন প্রধান অতিথি, আমি ছিলাম বিশেষ অতিথি। পূরবী বসুর বই সম্পর্কে আমাদের বক্তৃতা দেওয়ার কথা। আমি যেহেতু বক্তৃতায় পারদর্শী নই, অল্প কথায় পূরবী বসুর লেখার প্রশংসা করে বসে যাই। সুফিয়া কামাল অনেকক্ষণ ধরে বলেছিলেন। তিনি কেবল পূরবী বসুকে নিয়ে বলেননি, আমাকে নিয়েও বলেছিলেন। আমার লেখালেখি নিয়ে। তাঁর বক্তব্য শুনে আমি বিস্ময়বোধ করেছিলাম, তিনি বলেছিলেন যে নারীবাদী লেখা লিখছি সে ভাল কথা, তবে তা উগ্র যেন না হয়। হ্যাঁ মেয়েরা হল মায়ের জাত, মেয়েদের সহনশীল হতে হবে, পুরুষেরা যদি ভুল করে, রাগারাগি করে তবে ঘর সামলানোর জন্য মেয়েদেরই নরম হতে হয়। পুরুষ স্বভাবতই গরম, নারীও যদি গরম হয়,তবে সংসার চলবে কি করে! মায়ের জাতের দায়িত্ব অনেক। মায়ের জাতের দায়িত্ব হল পুরুষকে আদর দিয়ে ভালবাসা দিয়ে কাছে টানা, তাদের বুঝতে শেখা, তারা ভুল করলে ক্ষমা করে দেওয়া। মায়ের জাতের দায়িত্ব সন্তানকে সুষ্ঠুভাবে লালন পালন করা। ইত্যাদি। মেয়েদের রাগ করা, চিৎকার চেঁচামেচি করা, পুরুষদের ডিঙিয়ে যেতে চাওয়া, পুরুষের বিরুদ্ধে বলা, উগ্রতা দেখানো কিছুই উচিত নয়। এতে মেয়েদের কমণীয়তা নষ্ট হয়।–দেশের সবচেয়ে বড় নারী সংগঠনের সভানেত্রীর মুখে এসব শুনে বড় বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ বসে থেকেছি। পরে পূরবী বসুর কানে কানে বলেছিলাম, আমি তো জানতাম না এমন অদ্ভুত চিন্তাভাবনা তাঁর!

পূরবী বসু বললেন, পুরোনো মানুষেরা ওভাবেই ভাবেন।

তা ঠিক। পুরোনো মানুষরাও হয়ত ওভাবেই ভাবেন। আমার নানিও হয়ত এভাবেই ভাবেন। নাহ, নানি কিন্তু এভাবে ভাবেন না। মনে আছে রুদ্রকে ছেড়ে আসছি ছেড়ে আসছি করছি যখন, নানি বলেছিলেন, লাত্থি দিয়া আইয়া পড়তে পারস না! অত দোনামনার কি আছে! তর আবার চিন্তা কি? নিজে ডাক্তার হইছস। ডাক্তারি করবি, আর নিজের পছন্দ মত থাকবি! ব্যাডইনগর শয়তানি সহ্য করার কি ঠ্যাকা পড়ছে তর? তবু নানি তো নানিই, নানির কথার কি মূল্য আছে জগতে! পাড়াপড়শি আর আত্মীয়কুল ছাড়া নানিকে কেউ চেনেই না। নানি তো আর সুফিয়া কামালের মত অত লেখাপড়া করেননি, তাঁর মত শুদ্ধ ভাষায় কথাও বলতে পারেন না। সুফিয়া কামালকে সকলে চেনেন। ইশকুলের পাঠ্য বইয়ে তাঁর সাঁঝের মায়া কবিতাটি আমাদের বয়সী সকলেই পড়েছি। সেই সুফিয়া কামাল চোখের সামনে বসে আছেন। নানির মত অমন না হলেও এই বয়সেও তিনি যে সভা সমিতি করছেন, বলছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, এই তো অনেক। আমরা যখন বুড়ো হব, আমাদের অনেক কথাই হয়ত নতুন প্রজন্মের লেখকদের কাছে বড় পুরোনো ঠেকবে।

আমার তন্ময়তা ভেঙে যায় জর কণ্ঠস্বরে, একটা ব্যাপার কি তুমি বেশ অনেকদিন থেকে খেয়াল করছ তসলিমা যে তোমাকে কাউণ্টার দেবার জন্য হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই বেগম রোকেয়াকে আমদানি করা হয়েছিল?

মানে? আমি অবাক তাকাই।

যখনই তুমি নারীবাদী লেখা লিখে বিখ্যাত হয়ে গেলে, অমনি একদল মানুষ ভুলে যাওয়া বেগম রোকেয়াকে কবর থেকে টেনে হিঁচড়ে তুলে আনল, ১০০ বছর আগের সেই রোকেয়াকে। তিরিশ বছর আগে রোকেয়ার কথা ইশকুলের বইয়ে পড়েছিলাম, দ্যাটস অল। এতকাল রোকেয়াকে নিয়ে কোনওদিন কোনও লেখালেখি বা কোনও সভা হতে দেখিনি। শত খুঁজেও তাঁর কোনও বইও পাইনি কোনওদিন পড়ার। হঠাৎ এই দুতিন বছর ধরে শুরু হল রোকেয়া নিয়ে উৎসব। বেগম রোকেয়া। বেগম রোকেয়া! চারদিকে লেখালেখি, তসলিমার অনেক আগেই বেগম রোকেয়া লিখে গেছেন নারীবাদ নিয়ে, তসলিমা আবার কিসের নারীবাদী! নারীবাদী ছিলেন রোকেয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। রোকেয়ার বই নতুন করে বেরোনো শুরু হল। যেন রোকেয়াই এখন এই সমাজে নারীমুক্তি ঘটাবে। এ সবই হল তোমাকে আড়াল করার জন্য। মৃতকে জীবিত বানিয়ে জীবিতকে কবর দেওয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য। হিংসে হিংসে, তোমার খ্যাতি দেখে হিংসেয় লোকে মরে।

আমি হেসে বলি, আমি নিজেই তো বেগম রোকেয়াকে নিয়ে লিখেছি।

তা লিখেছো। তোমার লেখা আর তাদের রোকেয়া-পাগলামোতে পার্থক্য আছে। তুমি শ্রদ্ধা নিয়ে লিখেছো, তারা যা করছে কুমতলব নিয়ে করছে। রোকেয়া বেঁচে নেই বলেই করতে পারছে। বেঁচে থাকলে ওঁকেও হিংসে করত।

আমি ম্লান হাসি।

জ বলেন, তোমাকেও কিন্তু কোনও এক সময় কবর থেকে তুলে আনা হবে তসলিমা! বুক ধ্বক করে ওঠে। কবরের কথা উঠছে কেন!

কবরের কথা উঠছে এই জন্য যে, জ বললেন, মানুষ তো মরবেই, আমিও মরব একদিন, তুমিও মরবে। ভবিষ্যতের বাংলাদেশে যদি কোনওদিন কোনও মেয়ে প্রচণ্ড নারীবাদী লেখা লিখতে শুরু করে, নারীর অধিকারের কথা খুব জোরে সোরে বলে বা লেখে, তখন তাকে অবজ্ঞা করার জন্য তোমাকে কবর থেকে তুলে আনবেই আমাদের বুদ্ধিজীবী ওরফে কুচক্রীজীবীরা। তারা চিরকালই ছিল, থাকবে।

আমার খানিকটা অস্বস্তি হয় এসব শুনে।

তোমার ফতোয়ার বিরুদ্ধে, জ বললেন, খেয়াল করেছো যে মহিলা পরিষদ কোনও রকম প্রতিবাদ করেনি! সুফিয়া কামাল জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের মামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, তোমার মামলার কথা কিছু বলেননি!

আমি মাথা নাড়ি, জানি।

জ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আমি গোপন করি।

জ বললেন, তোমাকে যারা চেনে না, তারা তোমাকে খুব ভুল বোঝে।

হেসে বলি, যারা আমাকে চেনে, তারাও কিন্তু আমাকে ভুল বোঝে।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলি, হয়ত ভুল বোঝে না, ঠিকই বোঝে, আমার আচার আচরণ, স্বভাব চরিত্র, আমার চিন্তা ভাবনা তাদের ভাল লাগে না।

সকল অধ্যায়

১. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০১
২. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০২
৩. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৩
৪. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৪
৫. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৫
৬. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৬
৭. ২. তাণ্ডব – ০১
৮. ২. তাণ্ডব – ০২
৯. ২. তাণ্ডব – ০৩
১০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০১
১১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০২
১২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৩
১৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৪
১৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৫
১৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৬
১৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৭
১৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৮
১৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৯
১৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১০
২০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১১
২১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১২
২২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৩
২৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৪
২৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৫
২৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৬
২৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৭
২৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৮
২৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৯
২৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২০
৩০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২১
৩১. ৪. দেশান্তর – ১
৩২. ৪. দেশান্তর – ২
৩৩. ৪. দেশান্তর – ৩
৩৪. ৪. দেশান্তর – ৪ (শেষ)
৩৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২২
৩৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৩
৩৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৪
৩৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৫
৩৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৬
৪০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৭
৪১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৮
৪২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৯
৪৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩০
৪৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩১
৪৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩২
৪৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৩
৪৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৪
৪৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৫
৪৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৬
৫০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৭
৫১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৮
৫২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৯
৫৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪০
৫৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪১
৫৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪২
৫৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৩
৫৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৪
৫৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৫
৫৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৬
৬০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৭
৬১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৮
৬২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৯
৬৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫০
৬৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫১
৬৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫২
৬৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৩
৬৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৪
৬৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৫
৬৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৬
৭০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৭
৭১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৮
৭২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৯
৭৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬০
৭৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬১
৭৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬২

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন