তসলিমা নাসরিন
উনত্রিশ জুলাই, শুক্রবার
আমার বিরুদ্ধে জারি করা সরকারি মামলাটির আইনজীবী সরকারি পিপি বলেছেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। মামলার পরবর্তী শুনানির মধ্যে যদি তসলিমা আত্মসমর্পণ না করে তাহলে আমরা আদালতে তার সম্পত্তি ক্রোকের আবেদন করব।
আর কি?
আর হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একশজন শিক্ষক সাংসদদের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ধর্ম নিরপেক্ষতা পুনঃস্থাপন করতে চাইছেন তারা। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে বলছেন। উপাসনালয়ে রাজনীতি চর্চা বন্ধ করতে বলছেন।
আর কি?
সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের ডাকে চট্টগ্রামে গতকাল অর্ধদিবস হরতাল পালন হয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিকে যে কোনও মূল্যে প্রতিহত করার অঙ্গীকার করেছে তারা। ছাত্রদের বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা প্রত্যাহার আর পুলিশ কমিশনারের অপসারণ দাবি করেছে।
আর কি?
৩০ জুলাই পূর্ণ দিবস হরতালের ডাক দিয়েছে ছাত্রঐক্য।
আর কি?
তোমার ফাঁসির দাবিতে আজ লক্ষ লক্ষ লোক সারা দেশ থেকে লং মার্চ করে ঢাকায় আসছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এধরনের ঘটনা প্রথম ঘটছে। শুধু বাংলাদেশই বা বলি কেন, পৃথিবীর ইতিহাসেই ঘটছে প্রথম। আজ ঢাকা আর ঢাকার মত নয়। মোল্লারা দখল করে ফেলবে পুরো ঢাকা।
দেশের সব জায়গা থেকে আর বাসে করে, ট্রাকে করে, ট্রেনে লঞ্চে করে হাজার হাজার মানুষ আসছে ঢাকা শহরে। কাল রাতেই অনেকে এসে গেছে মানিক মিয়া এভিনিউএর মহাসমাবেশে যোগ দিতে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তা আজ আমি করব না, ভেবেই নিয়েছি। যদি মেরে ফেলে আজ, মেরে ফেলুক। ভাববো না। মাথায় আর ভাবনাগুলোকে আমি জায়গা দিতে পারছি না। ঝ আজ বাড়িতে। ঝকে ঘরে বসিয়ে আজ আমি অনেকক্ষণ সময় নিয়ে গোসল করে নিই। গা থেকে অনেকদিনের ধুলি কালি চলে যাওয়ায় হালকা লাগে। বারবারই নিজেকে বলি, আজ যদি মৃত্যু হয় হোক। অন্তত এই ভেবে তুষ্ট হব যে এই দেশের মানুষ আমার মৃত্যু চেয়েছে বলেই আমার মৃত্যু হয়েছে। সক্রেটিস যদি বিষ পান করে মরে যেতে পারেন, আমি কেন পারবো না! নিজের অস্তিত্বটিকে, নিজের বেঁচে থাকাটিকেই এখন প্রায়ই আমার খুব অনাকাঙ্ক্ষিত আর অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়।
কাল রাতে একটি ছবি একেঁছি, চেয়ারে বসে আছে টুপিদাড়িওয়ালা এক লোক, পরনে পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি। লোকটির পেছনে আপাদমস্তক কালো বোরখায় ঢাকা চার বউ। ছবিটি যখন আঁকছিলাম, থেকে থেকে ঝ হাসছিলেন। সকালে শুরু করেছি আরেকটি ছবি, ছবির নাম বেহেসত। বেহেসতের আঙুর গাছের তলে ঝরনার পাশে বসে এক দাড়িওয়ালা লোক মদ খাচ্ছে, তার হাতের গেলাসে মদ ঢেলে দিচ্ছে একটি গোলাপী নগ্ন হুরী, বাকি দশটি আয়তোলোচনা গোলাপী রঙের সুন্দরী হুরী মদ পানরত কুৎসিত দাড়িওয়ালা লোকটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে ঝ বলেছেন, বলে না কয়লা যায় না ধুলে, স্বভাব যায় না মলে! তোমার স্বভাব যাবে না কোনওদিনই। তুমি যেখানেই থাকো, ধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ করবেই।
শুনে হাসতে হাসতে বলেছি, লোকটার মাথার ওপর আল্লাহকে এঁকে দেব নাকি? আল্লাহর আশীর্বাদেই যেহেতু মোল্লাটার এই আরাম হচ্ছে!
ঝ বললেন, আল্লাহর তো আকার নেই, আল্লাহ হচ্ছেন নূর।
ছবিটি দেখতে দেখতে পেছনে সরতে থাকি আর বলতে থাকি, তাহলে একটা নূরই এঁকে দিই। মাথার ওপর সূর্যের মত নূর, সূর্যের চেয়ে তো কয়েক লক্ষ গুণ বেশি হবে সেই নূর।
ঝ বললেন, তাহলে তো তোমার বেহেসত আর বেহেসতের মোল্লারা, হুরীরা সেই নূরে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।
হেসে বলি, ঠিক বলেছো। তাহলে বেচারা আল্লাহকে আর আঁকা গেল না। বেহেসতের চিত্রটিই থাকুক।
–আরও কয়েকটা ন্যাংটো হুরী দিয়ে দাও।
–জায়গা নেই তো, তা না হলে তো সত্তরটাই এঁকে দিতাম। বুকগুলো ডাশা পেয়ারার মত হয়নি? দেখ তো।
–জাম্বুরা করে দাও, জাম্বুরা।
–মোল্লাটার উরুর মাঝখানে যে কিছু দিলাম না! একটা ইরেকটেড পিনাস দিয়ে দেব নাকি?
ঝ জোরে হেসে উঠলেন।
বেহেসতের সুখ আমাদের বেশিক্ষণ সইল না। ঝ গিয়েছিলেন তাঁর স্টুডিও থেকে রং আনতে, সামান্য ক্ষণের জন্য এই যাওয়া বলে এ ঘরের দরজায় বাইরে থেকে আর তালা লাগাননি, ভেতর থেকে আমি দরজা বন্ধ করে রেখেছিলাম। দরজায় টোকা। ঝ এসেছে ভেবে দরজা খুলেই দেখি একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ঝর ছেলে। ভুত দেখার মত চমকে উঠে ছেলেটি দৌড়ে চলে গেল। আমি দরজা বন্ধ করে ধুকপুক বুক নিয়ে দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। এরপর সত্যিকার যখন ঝ ঢোকেন, ঘটনা বর্ণনা করি, কমাদাড়িহীন বর্ণনা। ধপাশ করে বসে পড়েন ঝ,মাথায় হাত। কি করা যায় এখন! ঝর ছেলে এসেছিল ঝকে খুঁজতে। এখন ঝ যদি তাঁর ছেলেকে বলেন যে আমাকে যে সে দেখেছে তা যেন কাউকে না বলে, তবে ছেলের কৌতূহল আরও বাড়বে। আমি বললাম, আমাকে তো আর চেনে না সে। কাউকে যদি বলেই, তবে ক্ষতি কি!
ঝ বড় শ্বাস ফেলে বলেন, চেনার দরকার নেই। কেউ একজন দরজা বন্ধ করে বাড়িতে লুকিয়ে আছে, এই খবরটিই যথেষ্ট। ঝ চকিতে উঠে পড়েন বলতে বলতে— বাড়ি বদলাতে হবে, খামোকা এই ঝুঁকি নেবার দরকার নেই।
ঝ ঙকে জরুরি ভিত্তিতে ফোন করলেন। সংকেতে কথা হল। ছাতাটা সেদিন ফেলে গিয়েছিলেন, আজ এসে ছাতাটা নিয়ে যাবেন কিন্তু, অবশ্য আপনার গাড়ি আনার দরকার নেই, আমিই আপনাকে গাড়ি করে পৌঁছে দিতে পারব।
সংকেতের কথা শুনে আমি বললাম, কি দরকার ছিল, এখন তো বোধহয় পুলিশ আর আমাকে অ্যারেস্ট করার জন্য ওত পেতে নেই।
কি করে জানো! কিছুরই বিশ্বাস নেই। কখন সরকারের মতিগতি পাল্টে যায়, তার কোনও ঠিক নেই। সাবধানে থাকা ভাল। তাছাড়া তুমি কেনই বা ভাবছো, সরকার সত্যি সত্যিই রাজি হয়েছে তোমাকে জামিন দিয়ে দেশ থেকে তাড়াতে। যতদিন না ঘটছে ব্যাপারটি, ততদিন তুমি নিশ্চিত নও।
মধ্যরাতে ঙ গম্ভীর মুখে ঢুকলেন ঘরে। ঝ আর আমি তৈরিই ছিলাম। সব আলো বন্ধ করে ঝ আমাকে নিচে নামিয়ে নিলেন। গাড়িতে উঠে আমার আর পেছনের আসনে শুতে ইচ্ছে করেনি। ঝ আর ঙর অনুরোধ আদেশ কোনওটিকেই আমি মানিনি। মুখখানা ঢাকতে হয় বলে ঢেকেছি। চোখদুটো খোলা। কতদিন শহরটি দেখি না। দুচোখ মেলে রাখি। কোনদিকে যেতে হবে না হবে ঝকে নির্দেশ দিচ্ছেন ঙ। গাড়ি মানিক মিয়া এভিনিউ পার হচ্ছে যখন দেখি রাস্তায় পড়ে থাকা ভাঙা ফেস্টুন, পোস্টার, লাঠি, শত সহস্র দলামোচা কাগজ। কলা কমলার খোসা। মাইলের পর মাইল জুড়ে পড়ে আছে সব। সত্যিকার মহাসমাবেশ ঘটেছে বটে।
কত লোক হয়েছিল? ঙকে জিজ্ঞেস করি।
ঙ গম্ভীর মুখে জবাব দেন, পাঁচ লক্ষ। কেউ কেউ অবশ্য বলছে তিন লক্ষ, কেউ বলছে, চার।
এ তল্লাটে আজ আমি যদি আজ দিনের বেলায় দাঁড়াতাম এসে, কী হত ভাবি। শরীরের একটি কণাও কোথাও খুঁজে পাওয়া যেত না, এমন পিষে মারত আমাকে। একটি একতলা বাড়ির কাছে গাড়ি থামালেন ঙ। বাড়িটির ভেতরে অন্ধকার। দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিলেন একজন। সেই একজনের নাম দিচ্ছি ঠ। ঠর হাতে আমাকে সঁপে দিয়ে ঙ চলে গেলেন। ঠ আমাকে নিয়ে ভেতরে অন্ধকার একটি ঘর পেরিয়ে একটি ছোট ঘরে ঢুকলেন। ছোট ঘরটির দরজা বন্ধ করে দিয়ে আলো জ্বেলে তিনি বসলেন। একটি পুঁটলি হাতে আমার, পুঁটলির মধ্যে শাড়ি আর জামা। ঠকে দেখেই চিনি আমি, আগে কখনও পরিচয় হয়নি যদিও, কিন্তু তিনি একজন সাহিত্যিক,পত্র পত্রিকায় ছবি দেখেছি অনেক। ঠর লেখাও পড়েছি। ঘরটির সামনে বড় বড় জানালা, জানালায় ভারী ভারী পর্দা। ঘরটিতে একটি বিছানা, বিছানার পাশে ছোট ছোট টেবিল, টেবিলে ল্যাম্প। একটি চেস্ট অব ড্রয়ার, একটি লেখাপড়ার টেবিল। কটি চেয়ার। সিলিং ফ্যান। লাগোয়া একটি বাথরুম। ঠ গলা নিচু করে বললেন যে ঙ তাঁকে জানিয়েছেন আমাকে দুদিনের জন্য তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দিতে হবে, এ কথা ঠ ছাড়া বাড়ির আর কোনও প্রাণী যেন না জানে। ঠ ঙকে খুব শ্রদ্ধা করেন, তাঁর কোনও অনুরোধ তিনি ফিরিয়ে দেবেন, এ তিনি ভাবতেই পারেন না। ঠ বলতে চেষ্টা করেছিলেন যে দুদিন পর হলে ভাল হয় কারণ তাঁর বাড়িতে দুজন আত্মীয় এসেছে বেড়াতে, দুদিন পর ওরা চলে যাবে, কিন্তু ঙ বলেছেন, আজই। অগত্যা ঠকে ব্যবস্থা করতেই হল। তাঁর কন্যার ঘরটি আমার জন্য সাজিয়ে দিয়েছেন, যেহেতু এ ঘরটি বাড়ির কোলাহলমুখর ঘরগুলোর কাছাকাছি নয়,বৈঠক ঘরের এক কিনারে আলাদা একটি ঘর। কন্যাকে তিনি বুঝিয়ে সুঝিয়ে অন্য ঘরে ঘুমোতে বলেছেন।
তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। তুমি শুয়ে পড়ো। কিছু লাগবে তোমার?
আমি তো রাতে ঘুমোই না। দুএকটা ভাল বই যদি দিতে পারেন, ভাল হয়। আর কিছু লাগবে না।
ঠ বই এনে দিয়ে বললেন, দরজা বন্ধ করে দিতে, ভেতর থেকে দরজা বন্ধ যেন থাকে সকল সময়, কেবল তিনটে টোকা পড়লে খুলে দিতে হবে, তিনটে টোকা মানে ঠ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন