৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৩

তসলিমা নাসরিন

ছয় জুলাই, বুধবার

সকালে ট বাইরে থেকে পাউরুটি আর ডিম কিনে এনে রুটি গরম করে আর ডিম ভেজে আমাকে ডাকলেন খেতে। খাবার ঘরটির চারদিকে জানালা, পর্দাহীন জানালা। আমি দাঁড়াতেই এক ঝাঁক আলো আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিল। অনেকদিন আলো দেখে অভ্যস্ত নই আমি। ট হঠাৎ লক্ষ করলেন জানালায় পর্দা নেই। আশেপাশের বাড়ি থেকে কেউ তাকালেই আমাকে দেখে ফেলতে পারে। রান্নাঘরে যাবার আমার কোনও উপায় নেই, ও ঘরের জানালাতেও কোনও পর্দা নেই। ট মুশকিলে পড়লেন। অগত্যা আমাকে নাস্তা খেতে হল বৈঠক ঘরে বসে।

আমি যে ঘরে শুয়েছি সে ঘরে বিছানার কাছে একটি টেলিফোন রাখা। টেলিফোনটি তালা দেওয়া। টকে বলেছিলাম যে আমি একটি ফোন করব, খুব জরুরি ফোন, চাবিটি যেন তিনি দেন আমাকে। ট নিরস মুখে বললেন, চাবি ছিল তার কাছে, এখন হারিয়ে গেছে। আমি ঠিক বুঝি, এটি কঞ্চর শিখিয়ে দেওয়া। আমি যেন কোথাও কোনও ফোন করতে না পারি, সে ব্যবস্থা আমি এ বাড়িতে আসার আগেই তিনি করে রেখেছেন।

ট বেরিয়ে গেলেন। আমার কাছে দরজার চাবি দিয়ে গেছেন। বলে গেছেন, ক বা কর পাঠানো কেউ যদি আসে তবে যেন দরজার তল দিয়ে চাবিটি দিই তাকে। দরজায় ছিদ্র আছে বাইরে দাঁড়ানো মানুষকে দেখার। সে ছিদ্র দিয়ে আগে যেন দেখে নিই কে এসেছে।

ট অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর বাড়িটিতে একা আমি। কি রকম যেন ভয় ভয় লাগে। কেউ যদি জানে যে এ বাড়িতে আমি আছি। মিছিল করে এসে যদি মৌলবাদীর দল দরজা ভেঙে ঢোকে! দুর্ভাবনা থেকে মন ফেরাতে টর বৈঠকঘরের বইগুলো দেখতে থাকি। সবই ইংরেজি বই। বড় বড় বিদেশী সাহিত্যিকদের লেখা বই। সালমান রুশদির দ্য স্যাটানিক ভার্সেস বইটি তুলে নিই তাক থেকে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বইটির অনেকগুলো পৃষ্ঠা পড়ে ফেলি। পড়ে ফেলি, কিন্তু বুঝেছি কি! না কিছুই বুঝিনি। অনেক শব্দের অর্থই জানি না। পাশে ইংরেজি থেকে বাংলা অভিধান নিয়ে না বসলে ্‌এই বই পড়ে কিছুই বোঝা আমার হবে না। বইটি রেখে দিই যেখানে ছিল,সেখানে। বাড়িটিতে কোনও দামি আসবাব নেই। কিন্তু বাড়িভর্তি দামি বই। সত্যিকার শিল্পীর বাড়ি এটি। অগোছালো, উদাসীন। দেয়ালের ছবিগুলো বড় বড় শিল্পীর। দুস্প্রাপ্য কিছু শিল্পকর্ম এখানে ওখানে। টর বান্ধবীর একটি ছবিও চোখে পড়ে। জানি না বান্ধবী কি না, তবে অনুমান করি বান্ধবীই। টর ছবিও পাশে। ট আর টর বান্ধবী দুজনই খুব সুন্দর।

দুপুরে জ আসেন খাবার নিয়ে। জকে দেখে খুশি লাগে খুব। ট গিয়ে তাঁকে আজ সকালে খবর দিয়েছেন এখানে আসার জন্য। ইঙ্গিতে কথা হয়েছে তাঁদের। জ-কে, আমি জানি না কেন, আমার খুব আপন মনে হয়। যতক্ষণ তিনি থাকেন আমার কাছে, মনে হয় নিজের বাড়িতে বুঝি আছি আমি। জর অসম্ভব ক্ষমতা আছে মানুষকে আপন করে নেওয়ার। এত সহজ সরল উদার এবং মুক্ত মনের মানুষ সংসারে খুব একটা নেই। জকে নিয়ে আমি একটি গল্প লিখেছিলাম, ছাপাও হয়েছে সে গল্প আমার একটি বইয়ে। জর চোখে জল চলে এসেছিল সে গল্পটি পড়ে। জ-কে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখতে ইচ্ছে হয় আমার। তাঁর জীবন আসলেই দীর্ঘ একটি রোমহর্ষক উপন্যাসের মত। কিন্তু লেখার সময় কোথায় পাবো আমি! আমি কি বেঁচে থাকতে পারবো! যাকে শক্ত করে আলিঙ্গন করে আছে মৃত্যু তার আবার লেখালেখির স্বপ্ন! হা স্বপ্ন।

জ চান আমি যেন বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করি। তিনিও দেশ থেকে আমার পালিয়ে যাওয়াটিকে একমাত্র বাঁচার পথ বলে মনে করছেন। জকে বলি আমার মনের কথা যে কিছুতেই আমি পালাতে চাই না। আমার মনের কথা, কিন্তু জ আমাকে ভালোবাসলেও আমার মনের কথাকে মোটেও মেনে নেন না। অনেকক্ষণ আমাকে সঙ্গ দিয়ে যাবার আগে তিনি বলেন কাল তাঁর কন্যাকে পাঠিয়ে দেবেন আমাকে সঙ্গ দিতে।

ক রাতে আসেন খাবার নিয়ে। ভাত, শাক, চিংড়ি মাছ। আমার প্রিয় খাবার। ক-র মা খ এগুলো রান্না করেছেন। খুব ভাল লাগে খেতে। খাওয়ার পর ক আমাকে তাড়া দেন ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে কটি ছড়া লিখে দিতে। ক কে বসিয়ে রেখেই লিখে দিই দ্রুত। নিয়ে ক চলে যান, বলে যান রুমানা নামের এক মেয়ে আসবে কাল দুপুরে। দুপুর দেড়টার সময় নীল শাড়ি পরা একটি মেয়ে দরজার টোকা দেবে, সেই মেয়েটিই রুমানা, যেন দরজা খুলে দিই। ক একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়েছেন আমাকে। ব্যাগের ভেতর আমার দুটি শাড়ি, দুটি ব্লাউজ, একটি তোয়ালে।

ক চলে গেলে ট বলেন, মৌলবাদ বিরোধী শক্তি এখন সত্যিই মাঠে নেমেছে। কি করছে তারা ট বলেন এক এক করে। বলার চেয়ে বলা ভাল পত্রিকা থেকে পড়ে শোনান। এলিফেন্ট রোডে গণফোরামের সভায় কাল ডঃ কামাল হোসেন বলেছেন, একাত্তরে জামাতের ভূমিকা কোনও বিতর্কিত বিষয় নয়। অথচ আজ সুবিধাবাদী রাজনীতির ফাঁক গলে তারা আবার জায়গা করে নিচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যদি আমরা হারাই তবে জাতি হিসেবে আমাদের কিছুই থাকবে না। স্বাধীনতার চেতনাকে অর্থবহ করতে হলে দালালদের রাজনীতিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উচ্ছেদ করতে হবে।

নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী সারোয়ারী রহমান বলেছেন ফতোয়াবাজরা নারী প্রগতির অন্তরায়। ধর্মকে ব্যবহার করে কেউ নারীদের প্রতি অন্যায়, অমানবিক আচরণ করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রাম জোরদার করতে জাতীয় কনভেনশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী ১৫ অথবা ১৬ জুলাই এই কনভেনশন অনুষ্ঠিত হবে। গণফোরাম, ন্যাপ, গণতন্ত্রী পার্টি, পিপলস পার্টিসহ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সব দল ও ছাত্র, যুব, কৃষক, খেতমজুর, আইনজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক, নাট্য সাংস্কৃতিক কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার বিভিন্ন সংগঠনকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। এই কনভেনশনে আওয়ামী লীগের যোগ দেওয়ার একটি সম্ভাবনা আছে।

টকে বলি, এখনও উদ্যোগের কথাই বলা হচ্ছে। কাজের কাজ কিছু হচ্ছে কি? এখনও কি সময় হয়নি সব দল একত্র হওয়ার? মৌলবাদীদের মধ্যে মতের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও তো তারা একসঙ্গে পথে নেমেছে! শুনেছিলাম সেদিন আওয়ামী লীগ নাকি যোগ দিয়েছে আন্দোলনে।

টর মুখটি মলিন দেখায়। তিনি মাথা নেড়ে বললেন যে আওয়ামী লীগ মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়নি।

ওদিকে মৌলবাদীরা কতদূর এগিয়েছে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, গ্রামে গঞ্জে নজিরবিহীন হরতাল পালন হয়েছে। কিশোরগঞ্জের আরমান ছাড়াও এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেলাল নামে একটি ছেলেকে নাকি মিছিলে গুলি করে মারা হয়েছে, দুটো মৃত্যুই এখন তারা রাজনীতিতে ব্যবহার করছে। আরও জোর গলায় বলছে, বাংলার মাটিতে মুরতাদ নাস্তিক চক্রের ঠাঁই নেই।

ট তাঁর হাতের পত্রিকা থেকে মৌলবাদীদের পরবর্তী কর্মসূচী পড়ে শোনান। ২৯শে জুলাই তারিখে ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা প্রতিরোধ মোর্চা কোরান দিবস পালন করবে। সারা দেশ থেকে মানুষ ঢাকায় লংমার্চ করে আসবে। দেশের ৪০ জন বিশিষ্ট আলেম এই লং মার্চ কর্মসূচীর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, জ্ঞকোরানের ইজ্জত রক্ষায় এই লং মার্চ সফল করা প্রতিটি মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব। কোরানকে নিয়ে তসলিমা ও জনকণ্ঠ গংরা যে হেলাফেলা শুরু করেছে তার প্রতিবাদে সোচ্চার না হলে আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। নেমে আসবে আমাদের ওপর খোদায়ী গজব।’ হরতালের দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্রেফতারকৃতদের বিনাশর্তে মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়ে বলেন, অন্যথায় সারা দেশে এর প্রতিবাদে আগুন জ্বলে উঠবে। সরকারের ঘটবে পতন।

টকে আর এগোতে না দিয়ে জিজ্ঞেস করি, এই একটি দলই কি লং মার্চ করছে?

ট পত্রিকাটি রেখে বললেন, আরও অনেক দল আছে সঙ্গে। জাতীয় নাস্তিক নির্মূল কমিটি..

–জাতীয় নাস্তিক নির্মূল কমিটি! তার মানে কেবল আস্তিকদের বাঁচার অধিকার আছে, নাস্তিকদের নেই।

ট হাসেন। ট যখন আমার দিকে তাকান হাসতে হাসতে, তাঁর চোখ থেকে টুপটুপ করে করুণা ঝরে পড়ে। এ সময় এমন একটা সময়, কেউ করুণ চোখে তাকালে নিজের ওপরই করুণা জন্মে। নিজেকে সবার চেয়ে আলাদা মনে হয়। আমি আর সবার মত নই, আমি পাপী তাপী, আমি নষ্ট ভ্রষ্ট। কেউ কি আমার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ভাবতে পারবে কেমন লাগছে আমার! আসলে মরতে হলে, মরছি যে তা না জেনে মরাই ভাল। হুট করে যারা মরে যায়, তারা সত্যিই ভাগ্যবান। দীর্ঘদিন যদি নিজেকে জানতে হয় বুঝতে হয় যে মরছি মরছি, এই মুহূর্তে মরছি, পর মুহূর্তে মরছি। তবে প্রতিটি মুহূর্তই এক একটি মৃত্যুর মত দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। কে চায় এত অসংখ্য মৃত্যু!

সকল অধ্যায়

১. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০১
২. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০২
৩. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৩
৪. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৪
৫. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৫
৬. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৬
৭. ২. তাণ্ডব – ০১
৮. ২. তাণ্ডব – ০২
৯. ২. তাণ্ডব – ০৩
১০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০১
১১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০২
১২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৩
১৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৪
১৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৫
১৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৬
১৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৭
১৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৮
১৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৯
১৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১০
২০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১১
২১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১২
২২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৩
২৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৪
২৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৫
২৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৬
২৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৭
২৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৮
২৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৯
২৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২০
৩০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২১
৩১. ৪. দেশান্তর – ১
৩২. ৪. দেশান্তর – ২
৩৩. ৪. দেশান্তর – ৩
৩৪. ৪. দেশান্তর – ৪ (শেষ)
৩৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২২
৩৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৩
৩৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৪
৩৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৫
৩৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৬
৪০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৭
৪১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৮
৪২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৯
৪৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩০
৪৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩১
৪৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩২
৪৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৩
৪৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৪
৪৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৫
৪৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৬
৫০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৭
৫১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৮
৫২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৯
৫৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪০
৫৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪১
৫৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪২
৫৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৩
৫৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৪
৫৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৫
৫৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৬
৬০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৭
৬১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৮
৬২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৯
৬৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫০
৬৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫১
৬৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫২
৬৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৩
৬৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৪
৬৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৫
৬৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৬
৭০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৭
৭১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৮
৭২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৯
৭৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬০
৭৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬১
৭৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬২

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন