তসলিমা নাসরিন
চার জুলাই, সোমবার
আজ ইনকিলাবের পাতা ভরে লেখা, ৩০ জুনের ঐতিহাসিক গণরায় ব্লাসফেমি আইনের বিকল্প নেই। কেন বিকল্প নেই, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে মাসুদ নিজামী লিখেছেন—
জ্ঞতসলিমা নাসরিন শেষ পর্যন্ত জানালেন যে, তিনি একজন নাস্তিক অর্থাৎ তিনি সৃষ্টিকর্তা বা ধর্মে বিশ্বাস করেন না। ডঃ আহমদ শরীফও নিজেকে নাস্তিক হিসাবে পরিচয় দিয়েছিলেন। একজন লোক আস্তিক নাকি নাস্তিক কিংবা আস্তিক হলেও কোন ধর্মাবলম্বী তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। কথা হচ্ছে পারস্পরিক সহাবস্থানের প্রশ্ন। প্রত্যেকে নিজ মতের সপক্ষে প্রচার করবেন, কথা বলবেন এবং লিখবেন। কিন্তু অন্যকে খোঁচা দিবেন না এবং কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারবেন না। কারণ ধর্ম পালন মানুষের মৌলিক মানবাধিকার। কারো এই অধিকারের ওপর অন্য কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। সকল মতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই কেবল অবাধে নিজের মত প্রকাশের অধিকার ভোগ করা যাবে। এটিই গণতন্ত্রের রীতি এবং মানবাধিকারের বিশ্বজনীন স্বীকৃত নীতি। কিন্তু য়েচ্ছ!য় নাস্তিক ঘোষণাকারী ডঃ আহমদ শরীফ এবং তসলিমা নাসরিন ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু করেন। তারা বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে এবং এ ধর্মের মহাপুরুষদের সম্পর্কে প্রকাশ্যে অনেক আপত্তিকর কথাবার্তা বলেন। ফলে স্বাভাবিক নিয়মে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের পক্ষ হতে প্রতিবাদ উচ্চারিত হল। ডঃ আহমদ শরীফ মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দানের জন্য দুঃখ প্রকাশ না করলেও তিনি আর বেশিদূর না গিয়ে থেমে যান। কিন্তু থামেননি তসলিমা। কথিত নারী অধিকার আন্দোলনের ত্রাণকষর্নী সেজে ধর্ম ও ইসলাম সংক্রান্ত অজ্ঞতা এবং ব্যক্তিগত বিদ্বেষ মিলিয়ে বারবার তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করতে থাকেন। শুধু তাই নয়, তিনি নারীদেরকে উμছৃঙ্খল হবার উস্কানি দিলেন। পবিত্র কোরান মানুষের লেখা এবং আধুনিক সভ্য সমাজে এই অবৈজ্ঞানিক গ্র−ন্থর কোনও প্রয়োজন নেই বলেও মন্তব্য করেন। এসব কারণে তসলিমাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের জন্য আলেম সমাজ ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সরকারের নিকট দাবি জানাতে থাকেন। লক্ষণীয় এই যে, তসলিমার কার্যকলাপের যতই প্রতিবাদ হয় ততই তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তিনি বাংলাদেশের মানচিত্র মুছে ফেলে ভারতের সাথে বাংলাদেশকে একীভূত করার সংকল্পও একাধিকবার ব্যক্ত করেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও ধর্মদ্রোহিতার জন্য তসলিমাকে গ্রেফতার করে শাস্তি দানের জোর দাবি উঠলে ঘাদানিক লাইনে অবস্থানকারীরা তসলিমার পক্ষ অবলম্বন করে বিবৃতি বক্তৃতা দেয়া শুরু করলেন। অতীতে দালালির অভিযোগে অভিযুক্ত কিছু ব্যক্তিও তসলিমাকে সমর্থন দিয়ে প্রগতিশীলতার পরিচয় দানের জন্য উঠে পড়ে লেগে গেলেন। ইতোমধ্যে দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী বিদেশি কতিপয় এনজিওর সমর্থনপুষ্ট সংবাদপত্রও তসলিমার পক্ষ অবলম্বন করল। তসলিমা সমর্থক এসব গোষ্ঠী ধর্মদ্রোহিতার বিচার ও ব্লাসফেমী আইন প্রণয়নের দাবিতে আন্দোলনকারী পক্ষকে ফতোয়াবাজ, ধর্ম ব্যবসায়ী ও রাজাকার আখ্যায়িত করে নিজেরা কোরানের পক্ষ শক্তি হিসাবে প্রকৃত ইসলামের খাদেম হবার চেষ্টায় মেতে উঠলেন। কিন্তু ঠেলায় ধাককায় পড়ে কোরানের পক্ষ শক্তি হিসাবে ইসলামের লেবাস গায়ে দেবার চেষ্টা করলেও এই ভণ্ড বকধার্মিকদের কথা জনগণ গ্রহণ করেনি। জনগণ শত অপপ্রচার সত্ত্বেও আলেম ও ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ কর্তৃক ধর্মদ্রোহিতার বিচার ও ব্লাসফেমী আইন প্রণয়নের দাবিতে ঘোষিত ৩০ জুনের হরতাল পালন করেন। সারাদেশে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল এমনভাবে পালিত হল, যা এ দেশে কোনওদিন হয়নি।
বিরোধীরা প্রথম হরতাল প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়ে সুবিধা করতে না পেরে পরবর্তীতে একই দিনে পাল্টা হরতালের ঘোষণা দেন। কিন্তু হরতালের দিন তোপখানা সড়কে পুলিশের পাহারায় কয়েকজন ঘাদানিপন্থী ছাড়া আর কোথাও তাদের অস্তিত্বের সন্ধান মিলেনি। নজিরবিহীন এই হরতালে প্রমাণিত হল, এ দেশে ধর্ম নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলবে না। ধর্মদ্রোহী এবং তাদের মদদদাতা ও দোসরদের স্থান এ দেশে নেই। দীর্ঘ ১২ ঘন্টা ব্যাপী গোটা বাংলাদেশের জনতার ময়দানে প্রতিফলিত ও প্রতিবিম্বিত হল ঐতিহাসিক গণরায় — মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া চলবে না। ধর্মদ্রোহিতার বিচার করতে হবে এবং ধর্মদ্রোহিতা বন্ধের লক্ষে ব্লাসফেমী আইন প্রবর্তন করতে হবে। হরতাল চলাকালে কিশোরগঞ্জে পুলিশের গুলিতে স্কুলছাত্র আরমান শহীদ হয়। সিলেট অঞ্চলের প্রখ্যাত পীর হযরত মাওলানা আবদুল লতিফ শাহ চৌধুরীর পুত্র ও নাতিসহ কয়েকজনকে পুলিশ বিতর্কিত এনজিওর নালিশের ভিত্তিতে গ্রেফতার করে। অবশ্য এদের পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মামলা তুলে নেওয়া হয়নি। হরতালের দিনই ব্রাহ্মণ্যবাদী ও ইহুদি মিডিয়া হিসাবে সমালোচিত বিবিসি সিগারেট সেবনরত তসলিমাকে দিয়ে কোরানের পাতা উল্টিয়ে আবোল তাবোল বকার দৃশ্য প্রচার করে। দুর্ভাগ্য বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে এ দৃশ্য সম্প্রচারিত হয় এবং তাও হরতালের দিনে। মুসলমানদের দগ্ধ অনুভূতিতে নুনের ছিটা দেওয়ার জন্যই যে বিবিসি তসলিমার এ সাক্ষাৎকার প্রচার করে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইতোমধ্যে জার্মানির ডাস স্পিগেল ম্যাগাজিন ২৭ জুন তারিখে তসলিমার একটি ধর্মদ্রোহিতামূলক সাক্ষাৎকার ছাপায়। অষ্ট্রেলিয়ার দি এজ ম্যাগাজিনেও তার সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। যতদূর জানা যায় তসলিমা এখন ঢাকাস্থ একটি পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূত মহাশয়ের হেফাজতে আছেন, যা আইন অনুযায়ী তারা পারেন না। ইতোমধ্যে নরওয়ে ও সুইডেনের পক্ষ হতেও তসলিমার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ভারতের আনন্দবাজার স্টেটসম্যান পত্রিকা এবং সে দেশের কতিপয় পণ্ডিত আগের মত এখন আর তসলিমাকে নিয়ে মাতামাতি করেন না। পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের মুসলমানরাও তসলিমার কার্যকলাপে ক্ষুব্ধ। এই মুসলমানের ভোট হারানোর ভয়ে সে দেশে আপাতত তসলিমাকে নিয়ে নাচানাচি স্থগিত রয়েছে। যদিও সুযোগ পেলে আবার তালি বাজাতে ভুল হবে না।
বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে খেলার পরিণাম পশ্চিমারা চিন্তা করে না বলেই সে দেশের পত্রিকা লন্ডন টাইমস বাংলাদেশে ধর্মদ্রোহিতার শাস্তি আইন পাস করাতে চাওয়ার জন্য তাদের ভাষায় মৌলবাদীদের সমালোচনা করতে পারে। কিন্তু তাদের যে লোকেরা এখানে আছে, তারা জানে, এহেন স্ববিরোধিতার লুকোচুরি খেলা দ্বারা এদেশবাসীকে বোকা বানানো যাবে না। বাংলাদেশের ক্রিশ্চিয়ান পীস কনফারেন্স বলেছে, পশ্চিমা মিডিয়াগুলো দরিদ্র দেশগুলোর মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দান করে আসছে। ইসলামের বিরুদ্ধে এভাবে আঘাত হানা হলে প্রতিক্রিয়া স্বরূপ খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ইত্যাদি ধর্মের ক্ষেষেনও এমনটি হবার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশে ধর্মদ্রোহিতার বিচারের জন্য ব্লাসফেমী ধরনের আইন হলে লন্ডনের টাইমস পত্রিকার কি ক্ষতি হবে যে তারা এর বিরোধিতা করছে! ওদের দেশেই তো ধর্মকে রক্ষার জন্য ব্লাসফেমী আইন রয়েছে। আসল কথা হচ্ছে, পশ্চিমারা নিজেদের দেশে সেকুলার হলেও মুসলমানদের বেলায় ভীষণ সাম্প্রদায়িক। লন্ডন টাইমস সহ কতিপয় পশ্চিমা দেশের আচরণে তাই প্রমাণিত হচ্ছে। ইউরোপের বলকান অঞ্চলের মুসলিম রাষ্ট্র বসনিয়া, আমেরিকার ধর্মীয় নেতা শেখ ওমর আবদুর রহমান, ইসলামি রাষ্ট্র ইরান, আলজেরিয়ার পুনর্জাগরণ এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র লিবিয়াকে নিয়ে বিশ্ব খ্রিস্টান ইহুদি চক্র যে খেলা খেলছে, তা সবার জানা। পৃথিবীর সর্বত্র মুসলিম জাগরণকে খ্রিস্টান ইহুদি চক্র মৌলবাদ আখ্যায়িত করে সন্ত্রাসবাদের তালিকাভুক্ত করে ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। বাংলাদেশের ইসলামি জাগরণও পাশ্চাত্য ও প্রতিবেশী ব্রাহ্মণ্যবাদী গোষ্ঠীকে দুঃশ্চিন্তায় ফেলেছে। এ জন্য তারা এ দেশের ইসলামী লাইনের লোকদেরকে মৌলবাদী আখ্যায়িত করে তাদের জনসমক্ষে নিন্দিত ও ধিকৃত হিসাবে চিহ্নিত করতে চায়। পক্ষান্তরে ইসলামের শত্রুতায় কাউকে লিপ্ত হতে দেখলে তাকে নানাভাবে উৎসাহিত করে, যা তাদের এ দেশীয় সেবাদাস এবং দোসররাও করে থাকে। বাংলাদেশ মূলত আন্তর্জাতিক ও ভূমণ্ডলীয় ষড়যন্ত্রের কারণে এ পরিস্থিতির শিকারে পরিণত হয়েছে। এটা এদেশ বাসী বোঝেন বলেই ষড়যন্ত্রকারীরা সমস্যায় পড়েছে। কারণ তাঁরা বোঝেন যে, সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের সেবাদাসরা চান্স পেলেই দেশ ও জাতির স্বার্থ বিরুদ্ধ লাইনে অবস্থান নেয়। ভারত কর্তৃক ফারাককা সহ ৫৪টি বাঁধ নির্মাণ, তালপট্টি ও মুহুরির চর দখলসহ অনবরত বাংলাদেশের সর্বনাশ করলেও যেসব মহল ভারতের নিন্দা করে না, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্তি সৃষ্টিকারী খুনী শান্তিবাহিনীর পক্ষ নিয়ে কথা বলে, যারা সব সময় দেশের কৃষ্টি ঐতিহ্যের বিরোধী পক্ষে দাঁড়িয়ে বিবৃতি দেয়, সেসব মুখচেনা মহলগুলোই তসলিমার পক্ষে তাদের বিদেশী প্রভুদের সেবা করতে শুরু করল। যে তসলিমা পবিত্র কোরানকে অবৈজ্ঞানিক আখ্যায়িত করে আধুনিক সভ্য সমাজে এরপ্রয়োজন নেই বলে ঘোষণা করলেন, তার পক্ষে দাঁড়িয়ে এসব লোক যখন নিজেদের কোরানের পক্ষ শক্তি হিসাবে জাহির করার চেষ্টা করেন তখন কি সচেতন দেশবাসীর চিনতে কষ্ট হয় এরা কারা এবং কি চায়? আশার কথা জনগণের এ উপলব্ধিই এ দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং ধর্ম ও কৃষ্টি কালচারের রক্ষাকবচ। ৩০ জুন তারিখে সূচিত ঐতিহাসিক গণরায় বাস্তবায়নের দায়িত্ব এখন সরকারের ওপর বর্তিয়েছে। ধর্মদ্রোহিতার বিচার দেশকে অশান্তির বিস্তার থেকে রক্ষার স্বার্থেই করা প্রয়োজন। ব্লাসফেমী আইন হলে তা সকল ধর্মের জন্যই রক্ষাকবচ হতে পারে। সকল ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানের জন্য এ আইন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
লেখাটি পড়ে অনেকক্ষণ চুপ হয়ে বসে থাকি আমি। নিঃসন্দেহে এটি বুদ্ধিমান লোকের লেখা। কে এই মাসুদ নিজামী আমি জানি না। নামটি আগে কখনও শুনেছি বলে মনে হয় না। এটি কারও সত্যিকারের নাম নাকি ছদ্মনাম, তাও জানি না। একটি প্রশ্ন আমার মনে বাসা বাঁধে, মৌলবাদীরা ব্লাসফেমী আইনের দাবি করছে কেন, তারা তো ইচ্ছে করলেই আল্লাহর আইনের দাবি করতে পারে, যে আইনে অবিশ্বাসীদের হত্যা করার বিধান আছে। কেন তারা মুরতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য খ্রিস্টানদের তৈরি ব্লাসফেমী আইন চাইছে? কেন আল্লাহর আইনটির, যে আইনে অবিশ্বাসীদের হত্যা করতে হয়, ডান হাত এবং বাঁ পা, বাঁ পা আর ডান হাত প্রথম ঘচাং ঘচাং করে কেটে ফেলতে হয় পেছন থেকে, তার দাবি করছে না! আল্লাহর আইনের চেয়ে খ্রিস্টানের তৈরি আইনে তাদের কেন বেশি আস্থা? কী কারণ এর পেছনে, ভেবে দেখতে গিয়ে আমার মনে হয়, ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনে যুগের পর যুগ বাস করে এখনও মাথা নোয়ানো প্রভু প্রেমটি যায়নি। সাদা চামড়া দেখলেই ভক্তি ধরে এদের, আল্লাহর চেয়ে বেশি ভক্তি।
প্রচার মাধ্যমের এমনই এক গুণ যে কোনও মন্দ খবরই আগুনের মত সাঁ সাঁ করে দৌড়ে যায়, বাতাসের আগে আগে যায়। একজন কেউ যদি কোথাও একটি মিথ্যে কথা লিখে ফেলে, তাহলে সেই মিথ্যেটি এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। পত্রিকায় লিখে দিল যে কোরান পড়তে পড়তে সিগারেট খেয়েছি। ব্যাস, এ কথাই এখন ধ্রুব সত্যের মত দাঁড়িয়ে গেছে। যেমন লজ্জা লিখে আমি ৪৫ বা ৪৮ লক্ষ টাকা পেয়েছি বিজেপির কাছ থেকে। এটি লেখা হয়েছিল ইনকিলাবে। যে মানুষেরা ইনকিলাবের কোনও খবর বিশ্বাস করে না, তারা কিন্তু এই টাকার খবরটি বেশ সুন্দরভাবে বিশ্বাস করে বসে আছে। আমি যে এই মিথ্যেটির প্রতিবাদ করেছি, সেটি কেউ গ্রাহ্য করছে না। লক্ষ করেছি, আমার সম্পর্কে নেতিবাচক খবরগুলো মানুষের মনে খুব ধরে। যেমন আমি কোরান সংশোধনের কথা বলেছি, আমি যে প্রতিবাদ করেছি এর, বলেছি যে না আমি এ কথা বলিনি, মানুষ শুনেও এটি শুনছে না। আরেকটি জিনিস লক্ষ্য করার বিষয় তা হল, মৌলবাদীরা বলছে যে তাদের বিপক্ষ শক্তি তসলিমার পক্ষের লোক। কিন্তু মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনে আমার নামটি কিন্তু উচ্চারণ করা হয় না, তারা যে আমার পক্ষের কেউ নয়, তারা যে আমাকে মোটেও পছন্দ করে না, তা বেশ বুঝিয়ে দিচ্ছে। তারপরও মৌলবাদীরা অমৌলবাদীদের দোষ দেবার জন্য তসলিমার সমর্থক বলে গাল দিচ্ছে। তসলিমাকে সমর্থন করা এ দেশে দোষের বিষয়। তসলিমা একটি ঘৃণ্য নাম। এই নামটি একটি কালো কুচ্ছিত নাম। এই নামের কালিমা মেখে কেউ অμছুত হতে চাইছে না।
আজ পোলাও মাংস খাওয়ালেন ঞর স্ত্রী। পাশে দাঁড়িয়ে পাতে তুলে দিলেন খাবার। যেন আমি এ বাড়ির সম্মানিত কোনও অতিথি। আরও খাও, আরও নাও বললেন অনেকবার। অনেকটা মার মত। জানি না মা কেমন আছেন। মা কি খাচ্ছেন দাচ্ছেন কিছু! মনে হয় না। নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছেন না মা। নিশ্চয়ই দিন রাত কাঁদছেন। মাকে সান্ত্বনা দেবার মত কেউ কি আছে পাশে! জানি না কিছুই। ঞর স্ত্রী আমাকে বলেছেন এই বাড়িটি আমার বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়। এত কাছে বসে আছি, অথচ আমার সাধ্য নেই আমার বাড়িটিতে যাওয়ার। আমার বাড়ির কেউ কি জানে যে আমি কত কাছে এখন তাদের! মার চেয়ে বেশি বাবার কথা মনে হয়। বাবা কখনও কাঁদার মানুষ নন। তিনি শক্ত মানুষ। তিনি যুক্তির মানুষ। বাবাকে আমি এখন বেশ কল্পনা করতে পারি, দুশ্চিন্তায় তিনি মাথার চুল খামচে ধরে বসে আছেন, তাঁর রক্তচাপ বাড়ছে। তিনি মুড়ির মত ওষুধ খাচ্ছেন রক্তচাপ কমাতে, কিন্তু কিছুতেই কমছে না। তিনি ভাবছেন তাঁর দুর্ভাগা কন্যাটির কথা। বাবার রক্তচাপ বেড়ে বেড়ে হঠাৎ যদি হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে যায়! তবে তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ি তো আমিই হব। নিজেকে কোনওদিনই ক্ষমা করতে পারবো না আমি। বাবাকে একবার আমি দেখতে পাবো তো আমার বা তাঁর মৃত্যুর আগে! একবার কি দেখা হবে না আমাদের! ইচ্ছে করে আবার কৈশোরে ফিরে যেতে। বাবা মা ভাই বোন নিয়ে চমৎকার নির্ঝঞ্ঝাট জীবন যাপন করতে ইচ্ছে করে। লেখালেখি করব না। ডাক্তারি করব। বাবা যেমন আমাকে বড় ডাক্তার বানাতে চেয়েছিলেন, তেমন বড় ডাক্তার হব। শহরে একটি ক্লিনিক দেব, দেখে তিনি ভীষণ আনন্দ পাবেন। তাঁর কোনও একটি ছেলেমেয়ে ডাক্তার হয়নি আমি ছাড়া। আমাকে দেখে তিনি নিজের জীবনকে সার্থক মনে করবেন। –স্বপ্নটি নিয়ে আমি শুতে যাই, রাতে ঘুম হয় আমার।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন