৩. অতলে অন্তরীণ – ০৬

তসলিমা নাসরিন

নয় জুন, বৃহস্পতিবার

ঢাকা শহরের এমন কোনও রাস্তা নেই যেখানে মৌলবাদীদের জমায়েত হচ্ছে না বা মিছিল হচ্ছে না। গতকাল দেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে জামাতে ইসলামির জনসভায় হাজার হাজার লোক জমেছিল। জামাতে ইসলামির মহাসচিব, জাতীয় সংসদ সদস্য মতিউর রহমান নিজামী জনসভায় বলেন, তসলিমা বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্ম, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। স্বাধীনতার চেতনার দাবিদার যে সমস্ত নেতা ও দল ওই লেখিকাকে সমর্থন করছেন তাঁরাও মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিপক্ষে থেকে যাচ্ছেন। বাইবেল বা যীশু-খ্রীস্টের বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্য বা কটূক্তি করলে বৃটেনসহ পশ্চিমাদেশগুলোতে যে শাস্তির বিধান রয়েছে, কোরান শরিফ সম্পর্কে দুঃসাহসিক বক্তব্যের কারণে তসলিমারও একই শাস্তি প্রাপ্য। বিজেপি, আনন্দবাজার পত্রিকা, পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা যারা তসলিমাকে ইন্ধন যোগাচ্ছে, তারা ইসলাম ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সুগভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ইত্যাদি ইত্যাদি এবং ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আইনের দাবি।

জামাতে ইসলামির মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাইদী বক্তা হিসেবে জনপ্রিয় বেশ। তাঁর বক্তৃতার ক্যাসেট হাটে ঘাটে মাঠে ঝালমুড়ির মত বিক্রি হয়। তিনি অগুনতি জনতার সামনে বলেছেন, সমাজতন্ত্রের ধ্বস নামার পর নাস্তিক মুশরিক ও ইহুদিবাদীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এখন ইসলামকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। দেশ আজ তৌহিদী জনতা ও মুরতাদ এই দুই ভাগে বিভক্ত। মুরতাদ দলের নেষনী হচ্ছে তসলিমা। সুতরাং তসলিমাকে ফাঁসি দেওয়া হলে দেশ মুরতাদ মুক্ত হবে।

শায়খুল হাদিসও তাঁর বাহিনী নিয়ে পথে নেমেছেন। আর অনেকের মত তিনিও এখন সরকারকে দোষ দিচ্ছেন, আমাকে এখনও গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না বলে। বলেছেন, জনতার রুদ্ররোষ থেকে বাঁচাবার জন্য সরকার তসলিমাকে অন্যত্র সরিয়ে রেখেছে। ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা মাওলানা ওবায়দুল হক তাঁর সভায় বলেছেন, জনমতের চাপে সরকার তসলিমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেও এখন পর্যন্ত তাকে গ্রেফতার করতে না পারায় সরকারের প্রকৃত চেহারা উন্মোচিত হয়ে পড়েছে।

আজ সব পত্রিকায় স্পীকারের কাছে লেখা আমার চিঠিটি ছাপা হয়েছে। ভাল কথা। খুব ভাল কথা। যে কথা আগেই জানিয়েছিলাম, সে কথা আবার জানালাম যে আমি কোরান সংশোধনের কথা বলিনি। এতে কী উপকার হবে আমার? এখন কি মৌলবাদীরা বলবে, যে, দুঃখিত আমাদের ভুল হয়ে গিয়েছিল, তসলিমার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, কারণ ও তো বলেনি কোরান সংশোধনের কথা–সুতরাং আমরা সরে দাঁড়াচ্ছি ওর ফাঁসি চাওয়া থেকে! সরকার কি বলবে, ইসরে কি মিথ্যে মামলা ঠুকে দিয়েছি। এখন ক্ষমা চেয়ে মামলা তুলে নিই! কেউ বলবে না। বলবে না কারণ সংশোধনের কথাটির জন্য মৌলবাদীরা আমার ওপর ক্ষিপ্ত নয়, কোরান সংশোধনের কথা শুনে সরকারের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতও লাগেনি। মৌলবাদীদের ইচ্ছে কোনও একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মাঠে নামা, নিজেদের তেজ দেখানো, রাগ দেখানো আর লোকদের ভয় দেখানো। ইচ্ছে, শক্তিমান হওয়া। এ তো মৌলবাদীদের ইচ্ছে। সরকারের ইচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। মাঝখান থেকে কে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে? আমি। ক্ষমতাসীন জাতীয়তাবাদী দল বা বিরোধী দল আওয়ামী লীগ (এই দুটো দলই আকারে আকৃতিতে প্রতিশ্রুতিতে সন্ত্রাসে সবার ওপরে) কারও বুকের পাটা নেই মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে শক্ত শক্ত কথা বলে, কারণ দুই বড় দলেরই সময় সময় এই মৌলবাদী দলের সঙ্গে আঁতাত করতে হয়। সম্ভবত সরকারি দলের ধারণা ছিল না, উসকে দিলে মৌলবাদীরা এত বিকট শক্তি ধারণ করতে পারে। অথবা ধারণা ছিল, সরকারের অন্তঃস্থলে যথেষ্টই ধর্মান্ধ বিরাজ করে।

আজ সব পত্রিকায় বিবৃতি বেরিয়েছে। বিবৃতি দিয়েছেন দেশের সমস্ত বুদ্ধিজীবীগণ। দেশের যত রাজনৈতিক দল আছে ( বিএনপি এবং মৌলবাদী দল ছাড়া), দেশের যত প্রগতিশীল সংগঠন, সংস্থা, সমিতি, পরিষদ আছে, খুব বড়, বড়, মাঝারি, ছোট, সবার, দেশের যত নারী সংগঠন আছে, যত সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী আছে, লেখকদের, কবিদের, নাট্যকারদের, শিল্পীদের, সাংবাদিকদের যত রকম সংস্থা আছে সবার, আবৃত্তির দলের, গানের দলের, নাচের দলের, খেলার দলের, হ্যাঁ সবারই বিবৃতি আজকের পত্রিকায়, প্রতিবাদে মুখর আজ দেশ, প্রতিবাদ–জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদ। দাবিতে মুখর আজ দেশ, জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের দাবি। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সবার ওপরে আছেন শামসুর রাহমান। বিবৃতিটি কে লিখেছেন? নিশ্চয়ই শামসুর রাহমান। শওকত ওসমান, কে এম সোবহান, বেলাল চৌধুরী, বশীর আল হেলাল, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, মুস্তফা নুরউল ইসলাম. . .। বিবৃতির পর বিবৃতি। বাক স্বাধীনতার পক্ষে বিবৃতি, কিন্তু আমার বাক স্বাধীনতার পক্ষে নয়। সুফিয়া কামাল, মালেকা বেগম আছেন, ওদিকে হুমায়ূন আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক, ইমদাদুল হক মিলন, আসাদ চৌধুরী…. শত শত নাম। নামী দামী মানুষ। বিশেষজ্ঞ। পণ্ডিত। সমাজের মাথা। তাত্ত্বিক থেকে সাংবাদিক, শিক্ষক থেকে চিকিৎসক, বামপন্থী ডানপন্থী মধ্যপন্থী, পন্থীহীন, নাস্তিক আস্তিক, সকলেই বিবৃতি দিয়েছেন। দেশের প্রগতিশীল মুক্তবুদ্ধি যুক্তিবাদী একটি প্রাণীও নিশ্চুপ নন। তন্ন তন্ন করে একটি, অন্তত একটি বিবৃতির মধ্যে আমার নামটি খুঁজি, জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের সঙ্গে এই সামান্য নামটি, মাত্র চার অক্ষরের নামটি খুঁজি, কোথাও কোনও শব্দের আড়ালে আছে কি না নামটি, যেহেতু একই ২৯৫ (ক) ধারায় মামলা জারি হয়েছে আমার বিরুদ্ধেও, যেহেতু অন্যায় ভাবে আমার বিরুদ্ধেও, যেহেতু ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার অভিযোগ আমার বিরুদ্ধেও, নামটি খুঁজি, ভুলেও যদি কেউ উল্লেখ করে থাকেন নামটি, খুঁজি। নেই। কোথাও নেই। কোনও বিবৃতিতে নেই। কোনও প্রতিবাদে নেই। তবে কি এই সত্য যে আমার বিরুদ্ধে মামলা করা সরকারের উচিত হয়েছে, এবং জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা উচিত হয়নি? বিবৃতির কোথাও আমি নেই, তবে আমার নামটি আছে, আছে পত্রিকার বাকি অংশ জুড়ে–মৌলবাদীদের সভায়, সম্মেলনে, মিছিলে, ব্যানারে, কেবল আমার নামটিই আছে, আর কারও নাম নেই।

জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের মামলা প্রত্যাহার করার জন্য সরকারের কাছে দাবি করছে, তাদের গ্রেফতারি পরোয়ানার প্রত্যাহারের দাবি করছে, তাদের বিরুদ্ধে জারি করা মামলা প্রত্যাহার করার দাবি করছে তোমার সব প্রগতিশীল বন্ধুরা। তারা কেউ তোমার বিরুদ্ধে জারি করা মামলার কথা কিছু বলছে না। তোমার প্রগতিশীল বন্ধুরা কেউই তোমার গ্রেফতারি পরোয়ানার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করছে না।

আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি না। বারবার পড়ি। আমি কি ঠিক দেখছি, ঠিক পড়ছি? হ্যাঁ তুমি ঠিক দেখছ, ঠিক পড়ছ। এটা ঘটেছে। বিস্মিত হচ্ছে!? হ্যাঁ বিস্মিত হচ্ছি। বিস্ময় আমার হৃদয়ে, বিস্ময় আমার সর্বাঙ্গে। আমি বিস্ময়ের ঘোর থেকে একতিল নড়তে পাচ্ছি না। না ডানে, না বামে। বিস্ময় আমাকে একটি মূর্তির মত বসিয়ে রেখেছে সেই সকাল থেকে, সকাল পেরিয়ে গেছে, দুপুর গেছে, বিকেল গেছে। বিস্ময় কি কেটেছে তোমার? না কাটেনি।

আমার হৃদপিণ্ড কি চলছে? জানি না। আমার রক্ত চলাচল কি বন্ধ হয়ে গেছে, জানি না। বিস্ময় আমাকে মুক্তি দিচ্ছে না। মূর্তির চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। জল গড়াক। মূর্তির হাত জল মুছে ফেলতে সেই জলের দিকে এগোচ্ছে না। গড়াক। জল গড়াতে গড়াতে মূর্তিটি স্নান করে ফেলুক। তার আজ পাঁচদিন স্নান হয়নি। স্নানের প্রয়োজন ছিল তার।

সকল অধ্যায়

১. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০১
২. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০২
৩. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৩
৪. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৪
৫. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৫
৬. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৬
৭. ২. তাণ্ডব – ০১
৮. ২. তাণ্ডব – ০২
৯. ২. তাণ্ডব – ০৩
১০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০১
১১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০২
১২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৩
১৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৪
১৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৫
১৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৬
১৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৭
১৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৮
১৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৯
১৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১০
২০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১১
২১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১২
২২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৩
২৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৪
২৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৫
২৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৬
২৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৭
২৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৮
২৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৯
২৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২০
৩০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২১
৩১. ৪. দেশান্তর – ১
৩২. ৪. দেশান্তর – ২
৩৩. ৪. দেশান্তর – ৩
৩৪. ৪. দেশান্তর – ৪ (শেষ)
৩৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২২
৩৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৩
৩৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৪
৩৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৫
৩৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৬
৪০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৭
৪১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৮
৪২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৯
৪৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩০
৪৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩১
৪৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩২
৪৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৩
৪৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৪
৪৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৫
৪৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৬
৫০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৭
৫১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৮
৫২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৯
৫৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪০
৫৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪১
৫৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪২
৫৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৩
৫৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৪
৫৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৫
৫৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৬
৬০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৭
৬১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৮
৬২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৯
৬৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫০
৬৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫১
৬৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫২
৬৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৩
৬৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৪
৬৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৫
৬৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৬
৭০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৭
৭১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৮
৭২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৯
৭৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬০
৭৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬১
৭৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬২

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন