৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৩

তসলিমা নাসরিন

ছাব্বিশ জুলাই, মঙ্গলবার

কি ছিল তসলিমার লেখায়, আর কেনই বা ক্ষেপলো মৌলবাদীরা?

আজকের কাগজ এই শিরোনাম দিয়ে ভূমিকা লিখে আমার কলামগুলো ছাপার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেখে অবাক হই, যেখানে নাম উল্লেখটিই হত না, সেখানে নাম উল্লেখ তো বটেই, একেবারে কলাম ছাপার সিদ্ধান্ত। আসলে একটি কথা মনে হয়ে বুঝে গেছে যে তসলিমার নামটিই যেহেতু মৌলবাদীরা উচ্চারণ করছে, সুতরাং এই নামটি উল্লেখ না করে অন্য নাম উল্লেখ করে বেশিদিন কাজ চলে না। জনকণ্ঠের সাংবাদিকরা বহু আগেই ছাড়া পেয়ে গেছে, তাদের নাম উল্লেখ করার আর দরকার পড়ছে না। বুদ্ধিজীবীদের ফতোয়া দিচ্ছে এই অভিযোগ করে বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকাও দিতে পারছে না, অতএব, শেষ পর্যন্ত তসলিমা নামটি না চাইলেও উচ্চারণ করতেই হল। ভূমিকাটি এরকম, ‘নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিন নারী স্বাধীনতা, ধর্মের কুসংস্কার, গোঁড়ামি, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীদের দুর্ভোগ ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন সময় সাপ্তাহিক খবরের কাগজ, আজকের কাগজসহ প্রগতিশীল পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন। তাঁর এই রচনাগুলো কুসংস্কারাচ্ছত মৌলবাদীদের ভাল লাগেনি। তারা প্রথম প্রথম এ ব্যাপারে হালকাভাবে তসলিমার লেখার প্রতিবাদ করেছিল। কয়েকটি মৌলবাদী পত্রিকার সহযোগিতায় তাদের সেই ক্ষোভ রোষ উস্কে ওঠে এবং এভাবেই বর্তমান অবস্থায় পৌঁছোয়। নারী শিক্ষা, নারী মুক্তি, নারী প্রগতি এবং মেয়েরা যখন সমাজের বন্দী অবস্থা ছিন্ন করে কর্মজীবনে প্রবেশ করছিল তখনই ধর্মান্ধ মোল্লারা শুরু করেছে নাসরিন বিরোধী প্রচারণা। আজ মৌলবাদীরা কেবল নাসরিনের বিরুদ্ধেই ফাঁসির দাবি জানাচ্ছে না, প্রকৃতপক্ষে নারীমুক্তির বিরুদ্ধেই তারা সোচ্চার হতে চাইছে। সরকারও যখন নারীদের শিক্ষা ও দারিদ্র মুক্তির কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে তখনই মৌলবাদীরা মাঠে নেমেছে কোমর বেঁধে। আমরা আজকের কাগজের পাঠকদের জন্য সেই প্রগতিবাদী কলামগুলো থেকে উল্লেখযোগ্য অংশবিশেষ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছি। আজ তার প্রথম অংশ প্রকাশ করা হল।’

আগেও যে কথা ভাবছিলাম যে আজকের কাগজসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল পত্রিকা এখন মিশন হিসেবেই নিয়েছে মৌলবাদবিরোধী সব খবর প্রকাশ করার, কলাম ছাপার, সম্পাদকীয় লেখার। মৌলবাদীদের কোনও খবরই এসব পত্রিকায় ছাপা হয় না। ওদের বিশাল বিশাল মিছিলের ছবি ছাপা হয় না। একইরকম মৌলবাদীদের পত্রিকায় তাদের খবরগুলোকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। কেবল একদলের পত্রিকা পড়লে দেশের প্রকৃত অবস্থা বোঝার উপায় নেই, বুঝতে হলে দুদলের পত্রিকা পড়তে হয়।

 

ইনকিলাব পত্রিকায় লং মার্চের জন্য বিরাট বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে, সারাদেশ থেকে ঢাকা অভিমুখে লং মার্চ। লং মার্চের পর মহাসমাবেশ। বিজ্ঞাপনে তসলিমা নাসরিনের ফাঁসির দাবির কথা বলা হয়েছে, যেটি নাকি ৩০শে জুনের হরতালের গণরায়। এখন ঝর প্রশ্ন, ২৮ জুন তারিখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে বলা হল যে কোনও ব্যক্তির জীবন নাশের হুমকি প্রদান করা আইনের চোখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এখন এই বিজ্ঞাপনকে কিভাবে নেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়? কী ব্যবস্থা নিচ্ছে প্রতিদিনের মিছিলগুলোয়, সভাগুলোয় ফাঁসির জন্য চিৎকার করা মোল্লাগুলোর বিরুদ্ধে? ঝর প্রশ্নের কোনও উত্তর আমার কাছে নেই। আমার একটি প্রশ্ন, এ সময় আওয়ামী লীগ কী করছে? ঝ বললেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি আর জামাতের সঙ্গে আঁতাত করেছে, এখন আওয়ামী লীগের কাছে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করাই মূল বিষয়। জামাতের বিপক্ষে গেলে জামাত আওয়ামী লীগের দাবিকে সমর্থন জানাবে না, না জানালে আওয়ামী লীগের সম্ভব হবে না আন্দোলন জোরদার করার। সুতরাং আওয়ামী লীগ এখন মরে গেলেও জামাতের বিপক্ষে একটি শব্দও উচ্চারণ করবে না। যে দুচারজন বলছে জামাতের বিপক্ষে তারা নিজ দায়িত্বে বলছে, দল থেকে নয়। মূলত ছাত্ররাই যা করার করছে। তারা দলের সিদ্ধান্তের পরোয়া করছে না। বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট আজ সাম্প্রদায়িকতা, ফতোয়াবাজ ও মৌলবাদ বিরোধী জাতীয় কনভেনশন করবে বলে মতবিনিময় করেছে বিভিন্ন দল ও সংগঠনের সঙ্গে। দলগুলো গণফোরাম, গণতন্ত্রী পার্টি, গণআজাদী লীগ, জাতীয় সমন্বয় কমিটি, পাট সুতা বস্ত্র ও চিনিকল শ্রমিক ফেডারেশন, শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ছাত্র সমাজ, আইনজীবী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, প্রজন্ম ৭১। কিন্তু আওয়ামী লীগ কোথায়! আওয়ামী লীগের বন্ধু এখন জামাতে ইসলামি। বাম ফ্রণ্টের নেতারা আওয়ামী লীগের এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে এসে মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কথা বলছেন, আশা করছেন আওয়ামী লীগ ফিরে আসবে।

কিন্তু আসবে কি?

ঝ বললেন, ওরা না এলেই ভাল। আওয়ামী লীগের চরিত্র বুঝুক সবাই। ভেবেছে ধর্মের কথা বললে ধর্মান্ধদের ভোট পাওয়া যাবে, তা তারা জীবনেও পাবে না। এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যে মানুষগুলো আওয়ামী লীগকে সমর্থন করত, তারা আর আওয়ামী লীগকে ভোটই দেবে না। দলটি তার বাঁধা ভোটগুলো নষ্ট করছে। এত আদর্শচ্যুতি কজন সহ্য করবে!

 

চট্টগ্রামে গোলাম আযম যাচ্ছেন বক্তৃতা করতে! লালদীঘির ময়দানে তিনি জনসভা করবেন, ভাবা যায়! জামাতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তিনি আর বসে থাকছেন না। কিন্তু ছাত্রঐক্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামাতের জনসভা পণ্ড করে ছাত্রঐক্য সমাবেশ করবে লালদীঘি ময়দানে। সিদ্ধান্তটি সাহসী বটে, কিন্তু সংঘর্ষ ঠেকাবে কে! একটি হিম হিম ভয় আমাকে তির তির করে কাঁপায়। এর মধ্যেই গোলাম আযমের উপস্থিতির প্রতিবাদে ছাত্রঐক্যের সঙ্গে জামাত শিবির ও পুলিশের সংঘর্ষে চট্টগ্রামে গতকাল পঞ্চাশজন আহত হয়েছে। ছাত্রঐক্য আর জামাত শিবিরের মধ্যে ২০/২৫ রাউণ্ড গুলি −ছাঁড়াছুঁড়ি হয়, শতাধিক বোমা, ককটেল বিস্ফোরিত হয়। ছাত্রঐক্য মিছিল করছে, গোলাম আযমের ফাঁসি আর জামাত শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি নিয়ে। কিন্তু জামাত শিবিরের লোকেরা দখল করে নিয়েছে লালদীঘির ময়দান। পুলিশ প্রশাসনও লালদীঘির ঘাট দখল করে রেখেছে গোলাম আযমের জনসভার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। সশস্ত্র শিবিরকর্মীদের পুলিশ গ্রেফতার করছে না, গ্রেফতার করছে ছাত্রঐক্যের ছেলেদের। জামাত শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের মিছিলে হামলা করেছে, লালদীঘির ময়দানের নিয়ন্ত্রণ দখল করে নিয়েছে পুরোপুরি।

মৌলবাদী জোটের সমাবেশ বায়তুল মোকাররমের সামনের রাস্তায়। তসলিমার ফাঁসির জন্য জনগণের সমর্থনের নিদর্শন ৩০ জুনের হরতাল যদি বড় কিছু উদাহরণ না হয়ে থাকে তবে ২৯ জুলাইএর লং মার্চ আর মহাসমাবেশ বুঝিয়ে দেবে ফাঁসির দাবি কি জিনিস। সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের নেতারা বললেন, ২৯ জুলাই বাধা দিলে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হবে। শুরু যে হবে এ বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই। কারও আছে বলেও মনে হয় না। সরকার কি ফেঁসে গেল মোল্লাদের উত্তেজিত করে! বক্তারা জোর দিয়ে বলছেন রক্তের বিনিময়ে হলেও জীবনের বিনিময়ে হলেও মহাসমাবেশ সফল করতেই হবে। সরকারকে দোষ দেওয়া শুরু হয়ে গেছে, সরকার তসলিমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে লোককে ধোকা দেবার জন্য, এখন পর্যন্ত তাকে গ্রেফতার করতে পারছে না, এটা কোনও কথা হল! সরকার তসলিমাকে খুঁজে পায় না, আর তসলিমা সাক্ষাৎকার দিয়ে চলছে, বাহ! বাহ বটে, কিন্তু মোল্লাদের ঘটে এইটুকু বুদ্ধি হয় না যে সাক্ষাৎকার আজ প্রচার হওয়া মানে এই নয় যে আমি আজ সাক্ষাৎকার দিয়েছি. টেলিভিশনগুলো পুরোনো সাক্ষাৎকার প্রচার করছে। বিবিসি অন্য দেশের টেলিভিশন থেকে কিনে সেই সাক্ষাৎকার প্রচার করছে।

সরকার কি একটু চিন্তায় পড়েছে! ২৯ জুলাই সার্ক দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন হওয়ার কথা ঢাকায়। আর এই তারিখেই মৌলবাদীরা সারা দেশ থেকে লং মার্চ করে ঢাকায় আসছে মহাসমাবেশে যোগ দিতে। সম্মেলন পণ্ড হয়ে যায় কি না কে জানে। সমাবেশ করো তবে হোটেল শেরাটন থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত রাস্তাটা বাদ দিয়ে কর। কানে কানে বলে দেওয়া হয়েছে মৌলবাদী নেতাদের।

এদিকে সরকার থেকে তসলিমা নাসরিন ইস্যু নিয়ে বিদেশে নেতিবাচক প্রচারের আচ্ছ!মত জবাব দেবার জন্য বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, সরকার থেকে তসলিমা নাসরিন ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে একটি নোট পাঠানো হয়েছে বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোয়। ঢাকায় বিদেশি সাংবাদিকদেরও সেই নোট পাঠানো হয়েছে। ২৯৫ (ক) ধারাটি কি এবং কাহাকে বলে তার ব্যাখ্যা করে দিয়েছে সরকার। ইহা যে কোনও উগ্র ইসলামি আইন নয়, ইহা যে ধর্মনিরপেক্ষ আইন, কারণ ইহা ব্রিটিশের তৈরি করা আইন, তার ব্যাখ্যা। কবে তৈরি করেছিল ব্রিটিশ আইন? ঔপনিবেশিক আমলে। প্রায় দুশ বছর আগে অথবা দেড়শ বছর আগে। ব্রিটিশ তৈরি করলেই আইন বুঝি খুব আধুনিক হয়ে যায়! ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে যায়! সেটা কথা নয়, কথা হল, বাংলাদেশ দূতাবাস এখন মোক্ষম জবাব দিতে ব্যস্ত। ব্যস্ততার মধ্যে পাশের কলকাতায় বাংলাদেশ দূতাবাসের ডেপুটি হাইকমিশনার জাহাঙ্গীর সাদাত জানিয়েছেন ভারতীয় পত্র পত্রিকায় তসলিমা ইস্যু সঠিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে না। তার মানে বেঠিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। বলেছেন,বাংলাদেশকে হেয় করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে অত্যন্ত আবেগপূর্ণ এবং অপ্রাসঙ্গিক ইস্যুগুলোকে যা ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, তা ভারতীয় পত্রপত্রিকা ফলাও করে প্রচার করছে। জাহাঙ্গীর সাদাত সরকারি আদেশে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা, যুগান্তর, আজকাল এসব পত্রিকায় চিঠি পাঠিয়েছেন, লিখেছেন, তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ২৯৫(ক) ধারায় একটি ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত হেনে প্রকাশ্যে বিদ্বেষপূর্ণ বিবৃতি প্রদানের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে এই মামলা করা হয়। তসলিমা আইনের প্রক্রিয়া এড়িয়ে চলছেন। তিনি যদি কোনও অপরাধ করে না থাকেন তাহলে তাকে আদালতেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে। বহু পশ্চিমা দেশের মত বাংলাদেশে ব্লাসফেমি আইন নেই। কিন্তু তসলিমার বিরুদ্ধে যে আইনে মামলা হয়েছে সেটি সকল ধর্মের অনুসারীদের নিরাপত্তা প্রদানকারী একটি ধর্ম নিরপেক্ষ আইন। তার প্রকাশ্য বিবৃতিসমূহ সাধারণ আইনের আওতায় তদন্তাধীন রয়েছে। এক শ্রেণীর ভারতীয় পত্রপত্রিকা এমন একটি ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা করছে যে তসলিমাকে নির্যাতন করা হচ্ছে। এইসব পত্রিকা ইচ্ছাকৃতভাবে আইনগত ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক নির্যাতনের পরিষ্কার ধারণার মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। ভারতীয় পত্রিকা ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যম বাংলাদেশ সরকার জনগণের মৌলিক অধিকার ও বাক স্বাধীনতা রক্ষা করছে না, এমন একটি মিথ্যা ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার তসলিমা নাসরিনকে প্রকাশ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে বিবৃতিদানের মামলায় ন্যায় বিচার পাওয়ার জন্য আইনের নিরাপত্তা দিচ্ছে। একমাত্র আদালতই তাকে বিশাল জনরোষ থেকে রক্ষা করতে পারে। তবে তসলিমা নিজেই ্‌আইনগত প্রক্রিয়ায় নিরাপত্তা গ্রহণ করেননি। বাংলাদেশ সরকার মৌলবাদী চাপের কাছে হার মানছে বলে যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা মোটেও সত্য নয়। বরং সরকার দেশের ধর্মনিরপেক্ষ আইন অনুসারেই কাজ করছে। দেশের আইনের অধীনেই তসলিমার বিচার হচ্ছে। যেহেতু তসলিমা আত্মগোপন করে আছেন এবং আইনের হাত থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাই তিনি আইনগত নিরাপত্তার দাবি করতে পারেন না। যেহেতু বাংলাদেশের আদালত স্বাধীন, মুক্ত ও নিরপেক্ষ তাই তসলিমা ন্যায় বিচার পাবেন। তসলিমার বিরুদ্ধে কোনও ব্যক্তি বা গ্রুপের হত্যার হুমকি দেওয়ার কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আছে কি না তা আদালতই সিদ্ধান্ত নেবে। বাংলাদেশ সরকার হত্যার হুমকি প্রদানের বিরুদ্ধে যে কোনও ব্যক্তি বা সংগঠনকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। বাংলাদেশে এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সরকার বিষয়টিকে আদালতে অর্পণ করে তসলিমাকে শুধু আইনী নিরাপত্তাই দেয়নি, দেশের আইনকে সমুন্নত রাখা ও তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার জন্য রাজনৈতিক ও ধর্মীয় শক্তিকে সাফল্যজনকভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। এই হল সরকারি জবানবন্দি। কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থন কেন করতে হচ্ছে সরকারকে! বিদেশে ছাপানো খবরগুলো সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলছে বুঝি!

আরেকটি জরুরি খবর।

তসলিমা নাসরিন ইস্যু কভারের উদ্দেশ্যে কোনও বিদেশি সাংবাদিককে বাংলাদেশে আসার ব্যাপারে ভিসা না দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় নির্দেশ দিয়েছে।

২৯ জুলাইএর লং মার্চ সফল করার জন্য মৌলবাদী নেতারা দেশের এক শহর থেকে আরেক শহরে দৌড়োচ্ছেন, জনসভায় বক্তৃতা করছেন। আনোয়ার জাহিদ খুলনার জনসভায় বলেছেন, সত্য কথা বললে যদি মৌলবাদী হতে হয়, তবে আমি গর্ব করে বলছি আমি মৌলবাদী।

ঝ আজ আপিসে যাননি, দীর্ঘ সময় কাটাচ্ছেন আমার সঙ্গে। বিভিন্ন খবর নিজে তিনি পড়ছেন, শোনাচ্ছেন।

জামাতে ইসলামী ২৯ জুলাই বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে সমাবেশ করবে বলছে। প্রশ্ন মনে উদয় হয়, ঝকে জিজ্ঞেস করি, জামাতে ইসলামী সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে লং মার্চ আর মহাসমাবেশ করছে না, কারণটি কি?

ঝও ব্যাপারটি বুঝতে পারছেন না। জামাত হঠাৎ আলাদা হয়ে গেল কেন? জামাত ছাড়া আর সব মৌলবাদী দল তো সব একসঙ্গে আছে। মৌলবাদী জোটে জামাত নেই কেন?

আগের একটি খবরের কথা মনে করে ঝ বললেন, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব। জামাতে ইসলামী মনে করে তাদের নেতারা অন্য ইসলামী দলের চেয়ে বড় নেতা, সুতরাং জামাত হয়ত পুরো জোটের নেতৃত্ব দিতে চায়। কিন্তু ওদিকে আমিনী, শায়খুল হাদিস এরা নাম করে ফেলেছে যথেষ্ট, এরা এখন নিজামীদের ওপর নাপতানি করতে চাইছে। সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের তো গোপন মিটিংও হয়ে গেছে জামাতকে তারা দলে নেবে কি নেবে না এ নিয়ে। কেউ বলছে জামাত থাকুক, কেউ বলছে না দরকার নেই। সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ এখন জামাতের চেয়েও বেশি শক্তিশালী, জামাত এখন সঙ্গে না থাকলেও তাদের কোনও কিছু যায় আসে না।

এদের মধ্যে একটা ব্যাপার দেখেছো? আমি বলি, জামাতে ইসলামী আর ইসলামী ঐক্যজোট বা সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও তারা কিন্তু মঞ্চে উঠে এক দল আরেক দলকে গালাগাল করছে না। কিন্তু এখানে বিএনপি আর আওয়ামী লীগ হলে চুলোচুলি লেগে যেত।

এদেশে মৌলবাদীদেরই মনে হয় ভবিষ্যৎ ভাল। তাদের মধ্যে একতা আছে। আজ জামাতে ইসলামীর প্রতি থানায় পথসভা আছে ও মিছিল আছে। কাল বাদ আছর বায়তুল মোকাররম থেকে মিছিল বের করবে, কেবল তাই নয়, প্রতিটি থানা, ওয়ার্ড আর মহল্লা থেকে জামাতের মিছিল বেরোবে, আর ২৯শে জুলাই বিকেল ৩টায় বায়তুল মোকাররমের সামনে জনসভা। মোল্লারা ২৪ ঘণ্টা ব্যস্ত। দিনে মিছিল করছে, রাতে মশাল মিছিল করছে। রাতে যে ব্যাটারা একটু ঘুমোবে তাও না, এমনই উত্তেজিত।

আমি বলি, এই যে জনসভাগুলো করছে, সবই তো রাস্তা বন্ধ করে। মঞ্চ করছে রাস্তার ওপর। সাধারণ মানুষকে কি কম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে!

ঝর কণ্ঠে নির্লিপ্তি, তাতো হচ্ছেই। তা আর কে কেয়ার করে! জনগণ নিয়ে এ দেশের কোনও রাজনৈতিক দল ভাবে না। জামাতে ইসলামী কার কাছ থেকে শিখেছে রাস্তা বন্ধ করে জনসভা করা? বিএনপি আওয়ামী লীগের কাছ থেকেই তো!

–এ দেশে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি,কোনওদিনই একটি সুস্থ নেতৃত্বের দেখা পাবো না, যারা সত্যিকার দেশের মানুষের মঙ্গল কামনা করে!

–তা তো আছেই। গণফোরাম আছে। বাম দলগুলো দুএকটা আছে। কিন্তু তাদের কোনও জনপ্রিয়তা নেই। আর ক্ষমতায় গেলে সব লোকই যখন করাপ্ট হয়ে যায়, তখন কারও ওপর আর আস্থা নেই।

–কামাল হোসেন আমার লইয়ার বলে বলছি না। তাঁর দলটিই মনে হয় সত্যিকার একটি দল যে দলটি ক্ষমতায় গেলে দেশের সত্যিকার উন্নতি হতে পারে।

ঝ জোরে হেসে বলেন, একই বু−র্জায়া দল। একই একই। আওয়ামী বিএনপির চেয়ে আলটিমেটলি কোনও পার্থক্য নেই। ক্যাপিটালিস্ট। তবে অনেস্ট ক্যাপিটালিস্ট। এখন যেরকম দুর্নীতি চলে, তেমন হয়তো চলবে না। কিন্তু গরিব গরিবই থেকে যাবে। যাই হোক, কারা ভোট দেবে কামাল হোসেনকে?

ঝ একটু থেমে, একটু ভেবে বলেন, দেশের কিছু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষের ভোট পেয়ে আর যাই হোক নির্বাচনে জেতা হয় না। ভোট পাওয়ার জন্য যেমন অসৎ হতে হয়, তেমন অসৎ কামাল হোসেন হতে পারবেন না, তাই তিনি ভোট পাবেন না। গণফোরাম বাংলাদেশের সংজ্ঞায় কোনও রাজনৈতিক দল না হয়ে হয়ে গেছে রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীদের ক্লাব। সাধারণ মানুষ গণফোরাম চিনতে চিনতে আরও কয়েক যুগ নেবে।

ঝ আর আমি মুখোমুখি আধশোয়া হয়ে এসব নিয়ে কথা বলি। একটি খবর দেখে আমি চমকে উঠি, উঠে বসি, শেষ পর্যন্ত ..

শেষ পর্যন্ত কি?

শেষ পর্যন্ত সরকারকে বলতে হল..

কি বলতে হল বলই না! ঝ টান দিয়ে কাগজটি আমার হাত থেকে নিয়ে নিলেন।

পড়ে, হেসে, তিনি বললেন, তথ্যমন্ত্রী বলেছে মৌলবাদীদের আস্কারা দেওয়া যাবে না। বলেছে বাংলাদেশে মৌলবাদীদের কোনও স্থান নেই।

আমি বলি, কেমন বেসুরো লাগছে শুনতে যে বিএনপি সরকার এ কথা বলছে। ঝ বললেন, বলেছে বিদেশে এ দেশটা মৌলবাদী দেশ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে বলে। তা না হলে মৌলবাদীরা যে দীর্ঘদিন থেকে সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কোনও কথাই তো আগে বলেনি। বলেনি আগে। এই সরকার নিজেকে গণতান্ত্রিক সরকার বলে। তা বটে, গভরমেন্ট অব দ্য ফান্ডামেন্টালিস্টস, বাই দ্য ফান্ডামেন্টালিস্টস, ফর দ্য ফান্ডামেন্টালিস্টস হঠাৎ করে গণতন্ত্রের কথা বলছে।

ঝ যখন নিচে চলে যান কিছু জরুরি ফোন করতে, তখন পত্রিকার বড় একটি খবরে হঠাৎ চোখ পড়ে।

 

তসলিমা নাসরিনকে হত্যার জন্যে ইসলামী জেহাদ বিশেষ স্কোয়াড গঠন করেছে। আনুষ্ঠুষ্ঠানিক ঘোষণা ২৯ জুলুলাই।

তসলিমা নাসরিনকে হত্যা করার জন্য ইসলামি জেহাদ নামে একটি সংগঠন বিশেষ স্কোয়াড গঠন করেছে। আগামি ২৯ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে এই স্কোয়াডের নাম ঘোষণা করা হবে। ইসলামী জেহাদের আহবায়ক মাওলানা বরকতউল্লাহ নিউজ এণ্ড ফিচার সার্ভিসকে বলেছেন, শুধু তসলিমা নাসরিন নয়, ইসলাম এবং কোরআন বিরোধী সকল মুরতাদের বিরুদ্ধে স্কোয়াড সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তিনি বলেন, যে সব পত্রপত্রিকা কোরআনের অবমাননা করেছে, সেইসব পত্রপত্রিকার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ইসলামী জেহাদ নামের এই সংগঠনটির ঠিকানা বলা হয়েছে নয়ারহাট, সাভার। তবে এর আহবায়ক জানান, বর্তমানে ঢাকার নয়াটোলা, মগবাজারে তাদের অস্থায়ী কার্যালয় রয়েছে। ২৯ জুলাই লং মার্চের প্রতি ঐ সংগঠন সমর্থন জানিয়েছে। সংগঠনে সহস্রাধিক সাচ্চা মুজাহিদ রয়েছে বলে মাওলানা বরকত উল্লাহ জানান। যারা ইসলাম এবং কোরআন রক্ষার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। ইসলামী জেহাদ মনে করে তসলিমা নাসরিনসহ দেশের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী মুরতাদ। তাদের ফাঁসি হওয়া উচিত। তবে, এজন্যে তারা প্রথমে সরকারের কাছে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাবে। পরবর্তী পর্যায়ে সরকার ব্যর্থ হলে তারা নিজেরাই ইসলাম রক্ষার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে তারা জানিয়েছে। এই সংগঠনের সঙ্গে জামাতের কোনও সম্পর্ক আছে কী না এ ব্যাপারে পরিষ্কার কিছু বলেননি। তবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর ৭৫ পর্যন্ত বরকত উল্লাহ কারাগারে ছিলেন। এখন অবশ্য তার চলাফেরা প্রকাশ্যে। বরকত উল্লাহ বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পেরেছে, ইসলাম ছাড়া এই দেশ চলতে পারে না।

ইসলামি দলের সূষেন জানা গেছে জামাতের পৃষ্ঠপোষকতায় এই সংগঠনের ব্যানারে অন্তত একশ জন সশস্ত্র ক্যাডার রয়েছে। এদের অনেকেই যুব কমাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এদের লক্ষ্য তথাকথিত মুরতাদদের চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া। দু বছর আগে যুব কমাণ্ড ভারতীয় দালাল হিসেবে প্রগতিশীল রাজনীতিবিদদের নাম ঘোষণা করে তাদের হত্যার হুমকি দিয়েছিল। এই ঘটনার পর পর খুলনায় রতন সেন নিহত হন। ঢাকায় রাশেদ খান মেনন গুলিবিদ্ধ হন। এখন ইসলামী জেহাদ ইসলাম রক্ষার নামে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিয়ে পরিস্থিতিকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাবার পাঁয়তারা করছে। সংগঠনের সূষেন জানা গেছে, ২৯ জুলাই লং মার্চের পরেই তারা স্কোয়াডের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবে। ইসলামী জেহাদের কর্মীরা মনে করে সরকারের মধ্যে অনেক মুরতাদ রয়েছে। যাদের কারণে তসলিমা নাসরিনকে গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না। সংগঠনের এক প্রচারপষেন বলা হয়েছে একে একে তারা প্রত্যেক মুরতাদের বিরুদ্ধে গণআদালত গঠন করবে। যদিও সরকার বারবার বলেছে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ধরনের সংগঠনের বিরুদ্ধে কোনও রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

এই খবরটি পড়ে আমি অনেকক্ষণ স্থবির বসে থাকি। সাদা কাগজের ওপর পেন্সিলে আঁকতে থাকি আমার ছবি, ছবিটির গলায় দড়ি, বুকে ছুরি, মাথায় গুলি। লিখতে থাকি মৃত্যু মৃত্যুমৃত্যু। মৃত্যু, মৃত্যু, মৃত্যু।ছোট মৃত্যু, বড় মৃত্যু। কেমন লাগে মরে গেলে! কিছু কি বোঝা যায় যে মরে যাচ্ছি আমি। বুকে কি খুব যন্ত্রণা হয়! এমন কাউকে পাইনি যে মরেছে, এবং বর্ণনা করেছে মৃত্যু হলে কেমন লাগে। যে যায়, সে যায়। কোনওদিন ফিরে এসে কাউকে বোঝাতে পারে না মৃত্যুর রংরূপগন্ধ। আমি মরে গেলে কেউ কি কাঁদবে এই জগতে! আমার মা কাঁদবেন, বাবা কাঁদবেন, ভাই বোনেরা কাঁদবে জানি। এদের বাইরে যারা আমাকে ভালবাসে, তারা দুঃখ করবে। কিন্তু কদিন আর! কটা দিন গেলে সবাই ভুলে যাবে। আগের মত যে যার জীবন যাপন করবে। সারাদিন আমি আর মৃত্যু বসে থাকি পাশাপাশি। সাদা কাগজটিতে মৃত্যুর ছবি আঁকতে আঁকতে লিখি।

মৃত্যুর সঙ্গে এখন আমার রোজ দুবেলা দেখা হয়, আমরা পরস্পরকে গাঢ় চুম্বন করি, পাশাপাশি বসি, ধুম আড্ডা দিই। মৃত্যুর শরীরে চমৎকার সুগন্ধ, হাঁটুতে থুতনি রেখে জীবনের গল্প যখন করি, থই থই নদী, নদীতে ডুবে ভেসে কৈশোর যাপন, ধুলো খেলা–যখন গল্প করি ফিতে বাঁধা বেণী উড়িয়ে গোল্লাছুট, গোলাপ পদ্ম, হাডুডু আর ভোকাট্টা ঘুড়ির পেছনে দৌড়ে দৌড়ে ভর সন্ধেয় মাঠ পেরিয়ে, খাল পেরিয়ে রাত্তিরে পুকুর পাড়ে বসে সারা গায়ে জ্যোৎস্না মাখানো.. জলের ওপর শুয়ে থাকা রুপোলি মাছ দেখে সেই মাছের দিকে হাত বাড়ালে হাতের মুঠোয় আসে মাছ নয়, টুকরো টুকরো চাঁদ। যখন গল্প করি ঘাসের বিছানা থেকে ফ্রক ভরে শিউলি তুলে পড়শির দেয়াল ডিঙিয়ে দে দৌড় দে দৌড় দিনের কথা, মৃত্যুর চোখেও তখন অল্প অল্প শিশির জমে, তারও কণ্ঠ বুজে আসে, বলে, যাই। মৃত্যুর সঙ্গে রোজ দুবেলা দেখা হয় আমার, দেখা হলে পরস্পরকে গাঢ় চুম্বন করি আর যখন গল্প করি কৈশোর পেরোতেই গহন অরণ্যে এক পাল বুনো মোষের মুখে আমাকে ছেড়ে দিল কারা যেন, কারা যেন একটি ডোবায় ঠেসে ধরল আমার মুখ, মাথা, কারা যেন আমার পায়ে হাতে শেকল পরালো, কারা যেন পাথর ছুঁড়তে ছুঁড়তে আমার কপাল, মাথার খুলি…. মৃত্যুর চোখেও তখন গভীর কুয়াশা নামে, বলে — যাই। মৃত্যুর সঙ্গে রোজ দুবেলা দেখা হয় আমার। আমার চুলে পিঠে হাত বুলিয়ে সে কথা দিয়েছে আবার আসবে সে, এবার আর ঘোর অন্ধকারে আমাকে একলা বসিয়ে কোথাও যাবে না, তার বাড়ি আছে একটি আলোয় ঝলমল, ওখানে নেবেই আমাকে।

ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে কাগজটিতে। পড়ুক। পড়তে দিই। গোঙানোর শব্দ শুরু হলে বালিশে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে পড়ে থাকি। শব্দটিকে সজোরে চেপে রাখি যেন কোথাও না যায় ঘরটি থেকে। হাত পা গুলো গুটোতে গুটোতে সঙ্কুচিত হতে হতে আমি এই এতটুকু হয়ে যেতে থাকি, অস্তিত্ব যদি অস্বস্তি হয়ে দাঁড়ায়, এভাবেই বুঝি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে হয়। এভাবেই পড়েছিলাম যখন ঝ এলেন। ভেতর থেকে বন্ধ ছিল না দরজা। ঝ ঢুকে পিঠে হাত রাখতেই চমকে পেছন ফিরি।

—হয়েছে কি?

—কিছু না।

—কিছু তো নিশ্চয়ই।

আমাকে টেনে তুলে বসিয়ে দেন তিনি। মুখ দেখেই বোঝেন আমি আবার ডুবেছি মৃত্যুচিন্তায়। সিগারেট বাড়িয়ে দেন। দুজন চুপচাপ বসে সিগারেট খেতে থাকি। ঝ একসময় বলেন —আজ তোমার ভাই আসবে।

—সত্যি? সত্যি আসবে? কখন আসবে?

—রাতে।

—কটায়?

—জানিনা কটায়।

—কি করে জানো যে আসবে?

—কথা হয়েছে।

একটি উত্তেজনা আমার দিকে চিতার মত দৌড়ে আসতে থাকে। এতদিন পর আমি আমার ঘনিষ্ঠ কাউকে দেখব। মনে হচ্ছে কয়েক লক্ষ বছর পর বুঝি দেখা হবে! ঝকে দেখলে বোঝা যায় না যে ভেতরে ভেতরে তিনি এত নরম। নিশ্চয়ই তিনি বুঝতে পারেন কী ভীষণ চাইছি আমি আত্মীয়দের কাউকে দেখতে। হয়ত কোনওদিনই আর আমাদের দেখা হবে না ভেবে ঝ এখন এই শেষ দেখার ব্যবস্থাটি করে দিলেন।

সারাদেশে আন্দোলন হচ্ছে। প্রতিটি নগরে, বন্দরে। প্রতিটি শহরে, উপশহরে, প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি গঞ্জে। আমাকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য মানুষ উন্মাদ হয়ে উঠেছে। আমার বাবার গ্রামে, যে গ্রামে আমার বাবা জন্মেছেন, যে গ্রামের মানুষদের তিনি আজ তিরিশ বছর বিনে পয়সায় চিকিৎসা করছেন, সেই গ্রামের মানুষও আমাকে ফাঁসি দেবে। যে ইশকুলে বাবা লেখাপড়া করেছেন, সেই চণ্ডিপাশা ইশকুলের মাঠেও বিরাট জনসভা। চল্লিশ হাজার লিফলেট বিলি হয়েছে নান্দাইলে। জেহাদের ডাক পড়েছে।

____________________________________________

জেহাদের ডাক
আল্লাহু আকবর

মুরতাদ বিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করার প্রত্যয়ে
মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতিকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে
ইসলামী তাহজীব ও তমদ্দুনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে
আঞ্জুমুমান এত্তেহাদে মুসুসলেমীন এর উদ্যোগে
তৌহিদী জনতার ঐতিহাসিক মহাসমাবেশ
স্থান চণ্ডিপাশা হাইস্কুলুল মাঠ, নান্দাইল, ময়মনসিংহ
তাং- ২৬ শে জুলাই, ১৯৯৪ইং, মোতাবেক ১০ই শ্রাবণ ১৮০১ সাল (বাং)
রোজ মঙ্গলবার, সময় বেলা ২ ঘটিকা।

সভাপতি-হযরত মাওলানা আমিরউদ্দিন সাহেব
আহবায়ক — আঞ্জুমানে এত্তেহাদে মুসলেমীন
প্রধান অতিথি-মাননীয় জনাব আনওয়ারুল হোসেন খান চৌধুরী এম.পি
প্রধান পৃষ্ঠপোষক– আঞ্জুমানে এত্তেহাদে মুসলেমীন

বক্তব্য প্রদান করিবেন ঃ
১. হযরত মাওলানা আবদুল মান্নান হারুন নগরী সাহেব,
২. হযরত মাওলানা আলী হোসেন রাঘেবী সাহেব
৩. হযরত মাওলানা মজিবর রহমান খান সাহেব, অধ্যক্ষ, ঘোষপাড়া সিনিয়র মাদ্রাসা
৪. হযরত মাওলানা সায়েদুর রাহমান সাহেব, নান্দাইল
৫. হযরত মাওলানা আবদুল মালেক সাহেব, নাজেম, বারুই গ্রাম মাদ্রাসা
৬. হযরত মাওলানা রিয়াজ উদ্দিন সাহেব, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, আশরাফ চৌধুরী আলীয়া মাদ্রাসা
৭. হযরত মাওলানা মাহতাব উদ্দিন খাকী সাহেব, আচারগাঁও
৮. হযরত মাওলানা রুহুল আমিন রাজী সাহেব, ঈশ্বরগঞ্জ
৯. হযরত মাওলানা আবদুল গফুর সাহেব, শেরপুর সিনিয়র মাদ্রাসা
১০. হযরত মাওলানা আবদুল মতিন সাহেব, চকমতি আলীয়া মাদ্রাসা
আরও অন্যান্য দেশ বরেণ্য ওলামাগণ বক্তব্য রাখিবেন।
আপনারা তৌহিদের ডাকে দলে দলে যোগদান করে মুরতাদ বিরোধী জেহাদের শপথ নিন।

বেরাদারানে ইসলাম
আসসলামু আলাইকুম।
মুরতাদ, ভ্রষ্টা ও কুলাঙ্গার তসলিমা নাসরিন কোরআন পাকের জঘন্য অবমাননা করেছে। আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছে (নাউজুবিল্লাহ), ৩০৮ কোরআন পাককে মনগড়া ধোঁকাবাজির গ্রন্থ বলেছে (নাউজুবিল্লাহ)।

নারী মুক্তির নামে আমাদের নারী সমাজকে অবাধ যৌন সম্পর্ক তথা বেশ্যাবৃত্তিতে প্ররোচিত করার স্পর্ধা দেখিয়েছে ( নাউজুবিল্লাহ)।

মুরতাদ সালমান রুশদী, তসলিমা নাসরিন ও কাদিয়ানীরা কোরআন হাদিস সুন্নাতে রাসুল( দঃ), সুন্নাতে সাহাবার (রাঃ) অপব্যাখ্যা করে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহকে হেয় এবং হাস্যাস্পদ করার স্পর্ধা দেখিয়েছে।

মুরতাদ সালমান রুশদী, মুরতাদ তসলিমা নাসরিন ও কাদিয়ানী এবং এক শ্রেণীর এনজিও রা আন্তর্জাতিক ছত্রছায়ায় ইসলাম এবং মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। হাককানী ওলামা সমাজ ও মুসলিম নেতৃবৃন্দকে হেয় এবং হাস্যাস্পদ করার স্পর্ধা দেখিয়ে যাচ্ছে। আমাদের ইসলামী আক্বিদা, তাহজীব, তমদ্দুন ও জেহাদী চেতনাকে ধ্বংস করে সুকৌশলে অপসংস্কৃতি অনুপ্রবেশ করানোর ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র চলছে। ভণ্ড পীরদের অপতৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুসলিম জাহান এক মহা ফিৎনার সম্মুখীন হয়েছে। এই সার্বিক পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করার জন্য বালাকোটের বীর শহীদানদের উত্তরসূরী আঞ্জুমানে এত্তেহাদে মুসলেমীন তৌহিদী জনতার পক্ষ থেকে ইসলাম, মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্রকে স্তব্ধ ও নিশ্চিহ্ন করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করছে। মুসলিম সমাজে জেহাদী চেতনা এবং ঈমানী চেতনাকে সম্বল করে জেহাদের ডাক দিচ্ছে।

উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে ঈমানী দায়িত্ব পালনের তাগিদে উক্ত মহা সমাবেশে দলে দলে যোগদান করে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতিকে সুদৃঢ় করার ও কাফের মুরতাদ ও ধর্মদ্রোহীদের প্রতিরোধের জেহাদকে এগিয়ে নিয়ে চলুন। শান্তি, শৃঙ্খলা এবং সাহসিকতার সাথে মহা সমাবেশে যোগ দিন। নাসরু মিনাল্লাহে ওয়া ফাতহুন কারিব (বিজয় অতি নিকটবর্তী)। আল্লাহ হাফেয।

আরজ গুজার
আঞ্জুমানে এত্তেহাদে মুসলেমীন এর পক্ষে
আলহাজ্ব মাওলানা আনিসুর রাহমান

____________________________________________

বাবার কথা খুব মনে পড়ছে আমার। একবার যদি বাবার সঙ্গে আমার দেখা হত! মনে মনে বাবাকে বলতে থাকি, কতদিন দেখা হয় না তোমার সঙ্গে, কত দীর্ঘদিন! শেষ যখন দেখি, দেখে তোমাকে মনে হয়নি তুমি সেই আগের তুমি, আগের সেই ঋজু শরীর আর নেই, আগের সেই গমগমে কণ্ঠস্বর, আগের সেই জুতোর মচমচ শব্দ, আগের সেই….তুমি তো হেরেছো জীবনে অনেক, আমিও। তুমি তোমার গ্রামকে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিলে, চেয়েছিলে ধানে পাটে শাকে সবজিতে বৃক্ষে ফলে ছেয়ে যাক তোমার শখের গ্রাম, এত সবুজের স্বপ্ন তুমি কি করে লালন করতে! তোমার স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে যতই ওপরে উঠি, যতই উঠি কোনও শীর্ষের নাগাল পাই না এই কৌতূহলী আমিও। বিনিময়ে ওই গ্রামের লোকেরা তোমার মাথায় কুড়ুলের কোপ বসালো। আর আমার স্বপ্নের ওপর দেশসুদ্ধ মানুষ ঢেলে দিচ্ছে মণ মণ পাথর, গজারি কাঠ, হাতবোমা, আগুন, বিষাক্ত সাপ, ফাঁসির দড়ি, কী ভীষণ তাণ্ডব চারিদিকে, তাই না? একটি মানুষকে হত্যা করবে বলে লক্ষ লক্ষ লোক তাড়া করছে, হন্যে হয়ে খুঁজছে, তুমি কি ভয় পাচ্ছে!, রক্তচাপ বাড়ছে? না বাবা ভয় পেও না, আমি ঠিক দাঁড়াবই, ওদের পাথর, বোমা, সাপ আর ফাঁসির দড়ির সামনে আমি অনড় দাঁড়িয়ে থাকব, এত অনড় দাঁড়াব যে ওরা ওদের অস্ত্র নিক্ষেপ করে আমার দেহকে নির্মূল করবে হয়ত, কিন্তু বিশ্বাস! বিশ্বাস তো মরবে না, যা আমি ছড়িয়ে দিয়ে গেছি হাজার মানুষের মধ্যে, তা মানুষ গোপনে হলেও রোপণ করবে, ওতে জল দেবে, আর চারা যদি বড় হতে হতে বৃক্ষ হয়, মহীরূহ হয়, তবে জগতে কত কুড়ুল আছে যে কোপ বসাবে ওদের গায়ে? না হয় বসাক, মরা বৃক্ষের আনাচ কানাচ থেকে আবার বুঝি অঙ্কুরোদগম হয় না? হয়। বাবা তুমি ভে−ঙা না, যেমন মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলে আমাকে, তেমন দাঁড়িয়ে থাকো। আমরা হেরে গেছি বটে আজ, মানুষ আজ চাবুক মারছে আমাদের পিঠে, একদিন দেখো, তোমার গ্রামও ধানে পাটে শাকে সবজিতে বৃক্ষে ফলে সমৃদ্ধ হবে, একদিন দেখো আমার স্বপ্নগুলোও ডালপালা মেলবে। বিত্ত নেই, মান নেই, আমাদের বুকের ভেতর নিষ্কলুষ স্বপ্ন ছাড়া আর আছে কি, বল!

 

রাত এগারোটায় ঘরে ঢোকেন ছোটদা, পেছনে বাবা, বাবার পেছনে গীতা। বাবাকে দেখে আমি ছুটে যাই তাঁর কাছে। তিনি আমাকে বুকে টেনে মাথায় পিঠে হাত বুলোতে থাকেন। কোনও শব্দ বেরোয় না তাঁর মুখ থেকে। কেউ কোনও কথা বলছে না। আমি চেপে আছি আমার কান্না আমার বুকের ভেতর, আমার কণ্ঠদেশে। ছোটদা চোখ মোছেন। আমি যদি জোরে কাঁদতে পারতাম, খুব জোরে, তবে হয়ত একটু স্বাভাবিক হতে পারতাম। বাবার হাত ধরে আমি মেঝের বিছানায় বসাই। পাশে বসি।

—কেমন আছো মা? বাবা জিজ্ঞেস করলেন। কণ্ঠ কাঁপছে তাঁর।

আমি কেমন আছি তা আমাকে জিজ্ঞেস করার কোনও অর্থ হয় না। মনে মনে বলি, আমি কেমন আছি তা তো তোমরা সব জানোই, কেন খামোকা জিজ্ঞেস করছ। আমি কোনও উত্তর দিই না।

— তোমার ভয় করে মা? ভয় কইর না। মনে সাহস রাখো।

ঝ বলেন—ওকে আমি অনেক বলেছি ভয় না পেতে। যা হয় হবে। মোল্লারা মেরে ফেলবে, এত সোজা নাকি! আমরা কি নেই নাকি?

ছোটদা বলেন—নাসরিন, বিদেশ থেইকা, ইউরোপ আমেরিকা থেইকা দিনে হাজারটা ফোন আসে তর খবর নিতে। আমরা কইয়া দিই আমরা কিছু জানি না কই আছে। কয়, হেল্প করতে চায়। ইন্ডিয়া থেইকা সানাল এডামারুকু নামে এক লোক যে কত ফোন করছে।

বাবার বেদনার্ত মুখের দিকে তাকানো যায় না। কিন্তু কথা বলতে চাইছেন, কিন্তু পারছেন না। আমিই বা কি বলব। ছোটদাই বলেন কথা। বলেন যে পুলিশ এসে তাণ্ডব চালিয়েছে বাড়িতে। বিপদ আঁচ করে তিনি আমার কমপিউটারের হার্ডডিস্ক রাতের অন্ধকারে শফিক আহমেদের বাড়িতে রেখে এসেছেন। আর যা কিছুই হোক, লেখাগুলো বেঁচে থাকবে।

গীতার হাতে কিছু বাটি। খুলে বলল—মা রান্না কইরা দিছে। এইগুলা খাইয়া নে।

ছোটদা বলেন— হ খা। মা কইছে তরে মুখে তুইল্যা খাওয়াইয়া দিয়া যাইতে।

বাবা আমাকে কাঁটা চামচে তুলে আম খাওয়াতে থাকেন। মা ল্যাংরা আম কেটে পাঠিয়েছেন। পছন্দের খাবারগুলো পাঠিয়েছেন। রুই মাছ ভাজা, বড় বড় গলদা চিংড়ির ঝোল, খাসির মাংস, পোলাও। ছোটদা বললেন—আজকে কইলাম মারে যে দেখা করার একটা সম্ভাবনা আছে। মা দৌড়াদৌড়ি কইরা বাজার কইরা রাইন্দা ফেলল। মা তো সারাদিন কান্দে। খায় না। ঘুমায় না। মারে কত কই কাইন্দা কোনও লাভ নাই। মা তবুও কান্দে।

—চেম্বারের কি অবস্থা? অবকাশেও নাকি ..

আমার প্রশ্ন শেষ হয় না, ছোটদা বললেন—বাবার চেম্বার তো অর্ধেক ভাইঙ্গা ফেলছে। ভেতরে যন্ত্রপাতি রাখার আলমারি ভাঙছে, টেবিল ভাঙছে। বাবা তো এখন চেম্বারে যাইতেই পারে না। নতুন বাজার দিয়া মিছিল যায় প্রত্যেকদিন। দৌড়াইয়া লুকাইতে হয় আশেপাশের দোকানে। অবকাশের বাইরের ঘরের দরজা জানালা ভাইঙ্গা ফেলছে। বাইরের গেটে এখন তালা দেওয়া থাকে। এখন তো পুলিশ আইছে। পুলিশ থাকে বাসায়।

বাবার হাত স্থির হয় না। হাতটি দ্রুত তিনি বুলোতে থাকেন আমার পিঠে, মাথায়।

—পুলিশ? সরকার পুলিশ দিল?

—হামলার পরে ত আমরা ডঃ কামাল হোসেনের সাথে যোগাযোগ করছি। উনিই বলছেন যেন পুলিশের প্রটেকশান চাই। চাওয়ার বেশ কিছুদিন পর পুলিশ আইছে। তাছাড়া এমনিতেই তো সব সময় যাইতাছি, সারা হোসেনের সাথে জামিনের ব্যাপারে কথা হইতাছে। উনারা তর জামিনের ব্যাপারে খুব চেষ্টা করতাছেন। আমারে বলছে, সব সময় রেডি থাকতে, কোর্টে যাইতে হইব এমন খবর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন আমরা তরে হাজির করি।

—তুমি ত আর জানতা না আমি কই আছি। হাজির করতা কেমনে?

—ক ত জানত। ক মাঝে মাঝে ডঃ কামাল হোসেনের সাথে দেখা করতে যায় জামিনের খবরাখবর নিতে। ওইখানেই দেখা হইছে কয়দিন।

—ময়মনসিংহে কারা মিছিল করে? আমি ময়মনসিংহের মেয়ে জাইন্যাও করে?

—হুহ, তর মামারাই করে।

—মামারা?

গীতা বলে—শরাফ মামা তো মিছিল করে।

বাবা বলেন—পীর বাড়ির সব লোকই মিছিলে যায়।

—নান্দাইলের মিছিলে তো কাকারাও যায়। ছোটদা বলেন।

হঠাৎ একটি ভয় আমার মাথার ওপর বাদুরের মত ঝুপ করে পড়ে। মৃত্যুভয়। আমি কাগজ কলম টেনে নিয়ে দ্রুত লিখি আমার ব্যাংকের টাকা পয়সা যেখানে যা আছে সব কিছু এখন রেজাউল করিম কামালের তত্ত্বাবধানে থাকবে, তাঁকে টাকা তোলার সব রকম অধিকার দেওয়া হল। কাগজটি ছোটদার হাতে দিই। ছোটদা পড়ে বলেন, —আমারে সব অথরাইজ কইরা দিলি যে! তুই কি বাঁচবি না নাকি!

—কথা কইও না। কাগজটা রাখো পকেটে। আমি বলি।

ছোটদা কাগজ পকেটে রেখে বলেন—এত বেশি ভাবিস না তো! সব ঠিক হইয়া যাইব, দেখিস।

বাবা হাত বুলিয়েই যাচ্ছেন আমার মাথায়, পিঠে, বাহুতে। ছোটদা বললেন, বাবারে তো মারছে মোল্লারা। মাইরা ধাককা দিয়া ফালাইয়া দিছে ড্রেনে।

—কি কও? আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠি।

—হ। মোল্লাগোর মিটিং হইতাছিল বড়বাজারে। বাবা শুনতে গেছিল।

বাবা অপ্রস্তুত হেসে বললেন— না মা, তেমন কিছু না। চিন্তা কইর না। তেমন কিছু হয় নাই।

প্রসঙ্গটি তিনি চাননা উঠুক। কিন্তু আমি শুনবই। বললেন—ওই একটু গেছিলাম শুনতে।

—কেন?

—কী ওদের প্রোগ্রাম, কি করতাছে .. মিটিংএর ভিতরে যাই নাই। দূরে দাঁড়াইয়া ছিলাম।

—তারপর?

—তারপর আর কী! দুইটা লোক চিনে ফেলছে আমারে যে আমি তোমার বাবা..

ছোটদা পেছন থেকে বললেন—তারপর তো ধইরা দিল মাইর। −ড্রনএ পইড়া গেছিল। পরে দৌড়াইয়া একটা চেনা লোকের ফার্মেসিতে ঢুইকা পইড়া বাচছে। নাইলে কি হইত কে জানে।

আমি চোখ বুজি। দীর্ঘ একটি শ্বাস বেরিয়ে আসে।

বাবা বলেন— বিদেশ থেইকা এত বলা হইতাছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তো চেষ্টা করতাছে। তাতে কি বেইল হইব না!

আমি ঠোট উল্টে বলি—জানি না।

বাবা বলেন—যদি বেইলটা হইয়া যায়, তাইলে তো বাসায় ফিরতে পারবা। সরকার যদিপুলিশ প্রটেকশানের ব্যবস্থা করে তাইলে তো তোমার আর ভয়ের কিছু নাই।

ঘরে বইসা বইসা লিখবা। বিদেশের মন্ত্রীরা তো বলতাছে তোমারে প্রটেকশান দিতে। আমি আবারও মাথা নেড়ে বলি—যদি যদি যদি। এইটা যদি হয়, তাইলে ওইটা হইব। জানি না কি হইব। এই সরকার আর মৌলবাদীদের মধ্যে তো কোনও পার্থক্য দেখতাছি না। কী হয় শেষ পর্যন্ত কে জানে।

 

ঝ ছোটদাকে ইঙ্গিত করেন ওঠার জন্য। এই ইঙ্গিতটি আমাদের বুকে তীরের মত বেঁধে। ইচ্ছে না থাকলেও ছোটদা ওঠেন। বাবাকে উঠতে বলেন।

—আরেকটু বসুক আরেকটু। ঝর দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে বলি।

—না। খামাকা রিস্ক নেয়ার দরকার নেই। তোমার ফ্যামিলির লোকজন কোথায় কে যায় তার খবর রাখা হয় না মনে কর?

ছোটদা বললেন—উরে বাবা, সারাক্ষণই তো সবার পেছনে এসবির লোক থাকে। আমি যেইখানেই যাই সেইখানেই যায়। আজকে ত সন্ধ্যার সময় বাসা থেইকা বার হইছি, সারা ঢাকা শহর চককর দিছি, এসবির গাড়িও ফলো করল তিন ঘন্টা। এমন অলি গলির মধ্যে ঘুরপাক খাইলাম , একসময় ওরা হাল ছাইড়া দিছে অথবা মিস করছে। তারপরে তো এইখানে আইলাম।

বাবা ঝকে বললেন—আপনি যে কি ঝুঁকি নিয়ে আমার মেয়েটাকে এইরকম আশ্রয় দিয়েছেন, আপনার কাছে আমরা খুব কৃতজ্ঞ।

ঝ বললেন—না না না কৃতজ্ঞতা জানাবেন না। আমি যা করেছি, এটা আমার কর্তব্য মনে করেই করেছি। কেবল আমি তো না, আরও অনেকেই ওকে সাহায্য করছে।

আমি অসহায় দাঁড়িয়ে থাকি। আধঘণ্টা সময়ও কি কাটানো যেত না! আমার সাধ মেটে না। ঘুমের মধ্যে সুখের একটি স্বপ্ন যেন মুহূর্তের মধ্যে দেখা দিয়ে গেল। অদৃশ্য হয়ে যাবার আগে বাবা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, সাহস রাখো মা, সাহস রাখো। সাহস হারাইও না। তুমি যেই কথা লেখছ, তাতে তুমি যদি সত্যিই বিশ্বাস কইরা থাকো, তাইলে যতদিন বাঁচো, মাথা উঁচা কইরা বাঁচো। তবে এখন সাবধানে থাকতে হবে। তোমার বন্ধুরা আছে। আমরা আছি। চিন্তা কইর না।

ছোটদা আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খান।

দরজার কাছে আমি পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। কেবল মনে হতে থাকে এ দেখাই বুঝি শেষ দেখা।

বাকি রাত ছবি আঁকি। আমার নিজের ছবি। নতুন নিউজ ইউক ম্যাগাজিনে আমার যে ছবিটি ছাপা হয়েছে, সেটি দেখেই আঁকি। আমার ছবিটির চারপাশে অনেকগুলো সাপ আঁকি, সাপগুলো ফণা তুলে আছে আমার দিকে। সাপের মাথায় সাদা টুপি, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। ঝ সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে আমার আঁকা দেখেন। একসময় ঘুমিয়ে পড়েন। এঘরেই তিনি আরেকটি তোশক পেতে বিছানা করে নিয়েছেন।

সকল অধ্যায়

১. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০১
২. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০২
৩. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৩
৪. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৪
৫. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৫
৬. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৬
৭. ২. তাণ্ডব – ০১
৮. ২. তাণ্ডব – ০২
৯. ২. তাণ্ডব – ০৩
১০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০১
১১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০২
১২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৩
১৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৪
১৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৫
১৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৬
১৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৭
১৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৮
১৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৯
১৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১০
২০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১১
২১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১২
২২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৩
২৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৪
২৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৫
২৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৬
২৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৭
২৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৮
২৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৯
২৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২০
৩০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২১
৩১. ৪. দেশান্তর – ১
৩২. ৪. দেশান্তর – ২
৩৩. ৪. দেশান্তর – ৩
৩৪. ৪. দেশান্তর – ৪ (শেষ)
৩৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২২
৩৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৩
৩৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৪
৩৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৫
৩৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৬
৪০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৭
৪১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৮
৪২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৯
৪৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩০
৪৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩১
৪৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩২
৪৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৩
৪৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৪
৪৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৫
৪৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৬
৫০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৭
৫১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৮
৫২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৯
৫৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪০
৫৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪১
৫৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪২
৫৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৩
৫৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৪
৫৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৫
৫৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৬
৬০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৭
৬১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৮
৬২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৯
৬৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫০
৬৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫১
৬৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫২
৬৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৩
৬৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৪
৬৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৫
৬৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৬
৭০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৭
৭১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৮
৭২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৯
৭৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬০
৭৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬১
৭৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬২

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন