তসলিমা নাসরিন
সতেরো জুন, শুক্রবার
শুক্রবার দিনটি ভয়ংকর দিন। এই দিন ধর্মের দিন। মৌলবাদীর দিন। এই দিনের অপেক্ষা মৌলবাদীরা করে, কারণ এই দিনে মসজিদগুলোয় দুপুরের নামাজটি পড়তে সাধারণ লোকেরা যায়, যারা সপ্তাহের অন্য কোনওদিনই কোনও ওয়াক্ত নামাজ পড়ে না, তারা ছুটির দিন ঘুম থেকে উঠে নাস্তা টাস্তা খেয়ে গোসল টোসল সেরে মসজিদে যায় নামাজ পড়তে, ছোটবেলায় পড়া দুএকটি সুরা মনে করতে পারলে সেগুলোই বিড়বিড় করে অথবা সুরা টুরা না জানলেও ইমামের পেছনে দাঁড়িয়ে আর সবাই যেমন উঠবস করে, তারাও উঠবস করে। এই উঠবস করা মানুষগুলোর দিকেই এখন নজর মৌলবাদীদের, এদের তারা দলে ভেড়াতে চায়। সপ্তাহে একবার উঠবস করা মানুষগুলো সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ। তারা মোল্লা নয়, মুসল্লি নয়, ধর্ম নিয়ে মাথাব্যথা নেই। রোজার সময় এলে রোজা করে, যত না ধর্মের কারণে, তার চেয়ে বেশি সামাজিক কারণে। খাচ্ছে দাচ্ছে চাকরি বাকরি করছে সংসার করছে সন্তান পালন করছে। বাস্তব এই জীবনটি নিয়েই তারা ব্যস্ত। সংসারের নানারকম ভাবনার মধ্যে ধর্ম-ভাবনার অবকাশ জোটে না। তবে সুপ্ত একটি বিশ্বাস আছে ওপরে আল্লাহ বলে কেউ আছে, পরকাল বলে কিছু আছে, দোযখ বেহেস্ত বলে কিছু আছে। তারা নির্বাচনের সময় হয় আওয়ামী লীগকে নয় বিএনপিকে সমর্থন করছে। জামাতে ইসলামী দলটির দিকে বিশেষ কোনও মোহ নেই। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, সুস্থ রাজনৈতিক অবস্থায় বিশ্বাসী, দ্রব্যমূল্যের স্থিতিতে বিশ্বাসী, হাসপাতালে ওষুধের পরিমাণ যথেষ্ট থাকায় বিশ্বাসী, সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ কম হওয়ায় বিশ্বাসী, সন্ত্রাস বন্ধে বিশ্বাসী, হরতাল না হওয়ায় বিশ্বাসী। তাদের মাথার মধ্যে যদি ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যে ইসলাম ধ্বংস করে ফেলছে এক মহিলা, মহিলা ভারতের চর, হিন্দু মৌলবাদীদের প্ররোচনায় আর মুসলমানের জাতশষনু ইহুদিদের সঙ্গে আঁতাত করে ইসলাম ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে নেমেছে, তখন জাত্যাভিমানে আঘাত লাগে বইকি! তখন তারা যায়, আজ না গেলেও পরশু না গেলেও তরশু গিয়ে শায়খুল হাদিসের মিছিলে গিয়ে দাঁড়ায়। যারা এখনও দাঁড়াচ্ছে না, তাদের মাথায় ইসলাম ধ্বংসের গল্পটি ঢুকিয়ে সভায় এবং মিছিলে টানার চেষ্টা ধর্মব্যবসায়ীদের।
ভাবছি আমি এসব নিয়ে সকাল থেকেই। আজকের বাংলাবাজার পত্রিকার একটি খবর নিয়েও ভাবছি।
তসলিমাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরুরস্কার ঘোষণা
সিলেটঃ শাহ ওয়ালীউল্লাহ (রঃ) যুবুব সংস্থা্থা নামক একটি সংগঠন লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে ধরিয়ে দেয়ার বিনিময়ে ৫০ হাজার টাকা পুরুরস্কার প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। সিলেট শহরের ২৪, পূর্বাশা, তালতলা এলাকায় সংস্থা্থার কার্য্যালয়। আলহাজ্ব নূরে আলম হামিদীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংস্থার এক জরুরি সভায় দেশ জাতি ও ধর্মের স্বার্থে তসলিমা নাসরিনকে ধরিয়ে দেয়ার জন্যে সর্বস্তরের জনতার প্র্রিতি আহবান জানানো হয়।
এই গরিব দেশে এমন পুরস্কারের লোভ দেখালে মৌলবাদী নয় এমন অনেক লোকও আমাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়বে। যেখানে ১০০ টাকা দিয়ে কাউকে খুন করার জন্য লোক ভাড়া করা যায়, সেখানে দেড় লক্ষ টাকা তো অনেক টাকা। আমাকে খুন করলে ধর্মান্ধ মূর্খদের বিশ্বাস, আখেরে বেহেসত নিশ্চিত হল। আমাকে খুন করলে এখন অভাবী লোকের জন্যও ইহজগতের অভাব দূর হল। কে না চাইবে আমাকে খুন করতে! খুন খারাবির মধ্যে না গিয়ে ধরিয়ে দিতে পারলেও ৫০,০০০ টাকা দেয়া হবে। এটি কম টাকা নয়। এত টাকা একসঙ্গে পাওয়ার স্বপ্নও অনেকে দেখেনি। কদিন আগে মৌলবাদী এক নেতা ঘোষণা দিয়েছে, তসলিমাকে এখনও পুলিশ ধরছে না, আমরাই দায়িত্ব নেব তাকে ধরার, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালাবো তসলিমাকে ধরার জন্য। এখন নিশ্চয়ই টাকার লোভে তল্লাশি সত্যি সত্যিই চলছে।
১৫৩ জন হাফেজে কোরান ৩০ জুনের হরতাল সফল করার জন্য বিবৃতি দিয়েছেন, বুকের তাজা রক্ত দিয়ে হলেও কোরানের ইজ্জত তাঁরা রক্ষা করবেন। ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী প্রতিরোধ মোর্চা যেটি হয় হয় করছিল, সেটি হয়ে গেছে গঠন। শুক্রবারটিতে তাই সুগঠিত মোর্চা নিয়ে নামা গেছে পথে।
ছ আমাকে তাঁর ঘরে ডাকেন, শুয়ে শুয়ে তিনি পড়ছিলেন আমার নির্বাচিত কলাম। বললেন, তিনি বেরিয়েছিলেন, তাঁর মেয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন, ওখানে আমার এই বইটি পেয়ে নিয়ে এসেছেন। বইটি পড়া প্রায় শেষ। বসতে বললেন বিছানার পাশের চেয়ারটিতে। বললেন, এসব কী লিখেছো তুমি?
আমি চুপ।
তোমার লেখা খুব সুপারফিসিয়াল লেখা। তোমাকে লোকে নারীবাদী বলে কেন? এইগুলো তো নারীবাদ নয়।
আমি চুপ।
তোমার লেখায় কোনও কিছুর বিশ্লেষণ নেই। কোনও তাত্ত্বিক চিন্তাভাবনা নেই। কোথাও কোথাও সমস্যার কথা বলেছো, কিন্তু সমস্যা কেন, কিভাবে সমস্যার সমাধান হবে এসবের জানো না তো কিছু।
আমি চুপ।
খুব হালকা লেখা। ভেবেছিলাম তোমার নাম হয়েছে, তুমি বোধহয় চিন্তা ভাবনা করে লেখো। ভাল লেখো। কিন্তু না। আমি খুব হতাশ হলাম।
আমি চুপ।
তুমি আমার লেখা কিছু বই পড়ে দেখো। তবে বুঝতে পারবে নারীবাদ কাকে বলে।
চুপ।
তুমি যা লেখো, এগুলোর নাম কি জানো?
চুপ।
এগুলোর নাম রোমান্টিকতা। এসব রোমান্টিকতা দিয়ে তুমি সমাজের কিছুই করতে পারবে না।
শ্বাস।
তুমি যদি সত্যিকার নারীবাদী হতে, সত্যিকার নারীবাদ নিয়ে লিখতে তবে মোল্লারা তোমার বিরুদ্ধে কোনও কথা বলার সুযোগ পেত না।
শ্বাস।
না বুঝে ইসলাম ধর্মের কথা উল্টো পাল্টা লিখেছো বলেই তো ওরা ক্ষেপেছে।
নাতিদীর্ঘশ্বাস।
অনেকে তো তোমাকে দায়ী করছে মোল্লাদের উত্থানের জন্য!
দীর্ঘশ্বাস।
যখন ঘরে ফিরে আসি, চিৎ হয়ে শুয়ে ঘরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকি। নিজের এই অস্তিত্বটি আমাকে বড় অস্বস্তি দিতে থাকে। মনে মনে বলতে থাকি দিনের আলো যেন না ফোটে, যেন আমাকে আর না দেখতে হয় নিজের এই মুখটি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন