তসলিমা নাসরিন
দুই আগস্ট, মঙ্গলবার
নানা রকম কথা হচ্ছে। এমন কথাও হচ্ছে যে আমি দেশে নেই। বাংলাবাজারের বড় খবর, তসলিমা দেশে নেই। তসলিমা দেশ থেকে কিভাবে কোথায় পালিয়ে গেছেন তা বিস্তারিত লিখেছেন স্বয়ং মতিউর রহমান চৌধুরী। দেশের নামকরা সাংবাদিক এই মতিউর রহমান চৌধুরী ওরফে মতি চৌধুরী ওরফে মইত্যা। লিখেছেন, বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন দেশ ছেড়েছেন। ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ খবরটি দিয়েছে। এ খবরটিই অনুবাদ করে তিনি তাঁর বাংলা কাগজে গরম গরম পরিবেশন করছেন। আমি নাকি একটি পশ্চিমা দূতাবাসে ছিলাম, সেখান থেকে অন্য একটি পশ্চিমা দূতাবাসের পতাকাবাহী গাড়ি দিয়ে আমাকে কলকাতা পৌঁছোনো হয়েছে। সেখান থেকে বিমানে করে ইউরোপের একটি দেশে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মতি চৌধুরী জানাচ্ছেন যে রিভিউএর এ সংবাদটি গতকাল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কলকাতার পত্রপত্রিকাতেও তা ফলাও করে প্রকাশ হয়। গল্প লিখতে হয় তাই লেখা। এখানকারই কোনও অসৎ সাংবাদিক গল্পটি বানিয়েছে, তার কাছ থেকেই বিদেশের পত্রিকা লুফে নিয়েছে। সাংবাদিকদের গল্পের শিকার আমি তো আর আজ থেকে নই! ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউএর সংবাদদাতা সৈয়দ কামাল উদ্দিন নাকি বলেছেন, তিনি এই খবরটি বিশ্বস্তসূষেন পেয়েছেন, খবরটি সত্য কি না তা তিনি জানেন না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে আমার কথা জিজ্ঞেস করে মতি চৌধুরী দেখেছেন যে আমার ব্যাপারে কেউ ওখানে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। মন্ত্রিসভার গতকালের বৈঠক ছিল আমাকে নিয়ে, তাঁর বিশ্বাস, কোনও গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিশ্চয়ই ঘটে গেছে। একাধিক নীতিনির্ধারক কেন আমার প্রসঙ্গে হঠাৎ মুখে কুলুপ এঁটে ফেললেন, তা নিয়ে মতি চৌধুরী এখন ভাবনায় পড়েছেন। লণ্ডনের টাইমস পত্রিকার কথা বলেছেন তিনি। পত্রিকাটি নাকি খবর দিয়েছে যে আমি বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় পেলে বাংলাদেশ সরকার খুশিই হবে। ওখানে নাকি লেখা হয়েছে যে বাংলাদেশ সরকার চুপিসারে পশ্চিমা কূটনীতিকদের বলেছেন এ কথা। এই লেখার সঙ্গে একটি সিগারেট ধরাচ্ছি আমি এমন একটি ছবি গেছে। বাঁ হাতে সিগারেট, ডান হাতে জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি, মুখে ধোঁয়া। এরকম ছবিই সাধারণত চৌধুরী আমাকে নিয়ে কথা বলতে গেলেই ছাপেন। এখন এই সময় মতি চৌধুরী ঠিক না পারছেন বিশ্বাস করতে ফার ইস্টার্নের তসলিমা দেশে নেই সংবাদ। না পারছেন দিতে এমন কোনও খবর, যা তিনি বিশ্বাস করেন যে সত্য। অবশেষে জল্পনা কল্পনা করে কী ঘটছে আর ঘটতে যাচ্ছে তলে তলে, তার একটি চিত্র দাঁড় করিয়েছেন।
তাঁর চিত্রটি এরকম, আমি কোনও এক কম পরিচিত দেশের কোনও কূটনীতিকের বাড়িতে আত্মগোপন করে আছি। ঢাকা কর্তৃপক্ষ আমি কোথায় আছি না আছি সে ব্যাপারে নিশ্চিত। তবে আমাকে গ্রেফতার করে আন্তর্জাতিক মতামতকে জাগিয়ে তুলতে চান না। আমাকে ঘিরে যা হবে তা নিতান্তই দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারই হওয়ার কথা। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেষেন এ বিষয়টি একটি সাংঘাতিক মূল্যবান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি একটি সরকারি চাকুরে, সাধারণ চিকিৎসক। আমাকে অনেকেই হালকা মেজাজের পর্নোগ্রাফি লেখিকা বলেই নাকি মনে করতেন, অন্তত এই রক্ষণশীল সমাজের প্রেক্ষাপটে। কিন্তু পুরো ব্যাপারটিই বাড়াবাড়ি রকম অন্য দিকে মোড় নিল। পশ্চিমা কূটনীতিকদের হিসেবে একটা ভুল রয়ে গেছে, এটাই এখন সরকারের উμচ পর্যায়ে উদ্বেগের বিষয়। এই সমস্যা দূর করতে একটা সহজ ফর্মুলা উপস্থাপন করা হয়েছে, আমি নাকি আদালতে একজন আইনজীবী পাঠাবো,তিনি আদালতকে বলবেন যে আমি ব্যক্তিগতভাবে আদালতে হাজির হতে পারবো না কারণ আমার সামনে হত্যার হুমকি ঝুলছে। তখন আদালত আমার অনুপস্থিতিতেই জামিন মঞ্জুর করবে। আমার কাছে রয়েছে পাসপোর্ট, চুপিসারে আমি পারবো দেশ ত্যাগ করতে।
৪ আগস্ট আমার আদালতে যাওয়ার শেষ দিন। দিনটি পার হয়ে গেলে আদালত আমাকে পলাতক ঘোষণা করে দেবে। আমাকে পলাতক ঘোষণা করা হোক, তা সরকার চায় না। এই না চাওয়াটির সম্মান আদালত এখন রক্ষা করতেও পারে। এভাবে কূটনীতিক জটিলতা এড়ানোর চেষ্টা চলতে পারে। সরকারের মতে বল এখন আমার কোর্টে। সরকারি নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য অনুযায়ী বিদেশে চলে গেলে আমি আমার নাগরিকত্ব এবং পাসপোর্ট বহাল রাখতে পারবো, ইচ্ছে মত দেশে ফিরে আসতে পারবো। আমি বিদেশে চলে গেলে মৌলবাদীরা ক্ষুব্ধ হবে। কারণ বাংলাদেশকে বৃহত্তর ইসলামিকরণের দাবি সোচ্চার করতে তারা আমাকে একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছে। অবশ্য সরকার নাকি একে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু বলে মনে করছে না। সরকার এখন আমাকে নিয়ে টানা হেঁচড়া করতে চায় না। আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া আর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব — এ দুটো দিক সরকারকে এই ধরনের সিদ্ধান্তে এনেছে। ইত্যাদি ইত্যাদি..।
দেশে কি ঘটছে জিজ্ঞেস করলে ঠ বলেন, দেশ আর দেশ নেই। ঠ তাঁর আপিস থেকে কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছেন। আমি আসার পর থেকে তিনি আর বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন না। তাঁর বড় কন্যা ঠকে আজ একটি প্রশ্ন করেছে, কেন তাকে তার নিজের ঘরটিতে একবার ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, কেন বাড়ির অতিথিটির সঙ্গে, যে অতিথি তার ঘরটিতেই থাকছে, পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে না?
ঠ বলেছিলেন, তাঁর এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়া, খুব অসুস্থ, এসেছে ঢাকায় চিকিৎসা করতে। ডাক্তার বলে দিয়েছেন, রোগীর ঘরে যেন পারতপক্ষে কেউ না ঢোকে। জীবাণুমুক্ত পরিবেশ রক্ষা করার জন্যই এই আয়োজন। তা না হলে যে কারও শরীর থেকে জীবাণু উড়ে এসে রোগীর গা জুড়ে বসবে। এসব শুনে ঠ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে নিজেকে খুব পয়পরিস্কার করে তিনিই কেবল রোগীর ঘরে ঢুকবেন। বাড়ির অন্য কারওর রোগীর ঘরে ভিড় করার কোনও দরকারই নেই।
ঠর কন্যার বয়স ষোল। তার সন্দেহ যায় না। কেন সে উঁকি দিয়েও দূরসম্পর্কের আত্মীয়টিকে একটিবার দেখার অনুমতি পাচ্ছে না, সে কারণেই সন্দেহ।
ফস করে মেয়েটি বলে, নাকি ও ঘরে তসলিমা নাসরিন আছে?
ঠ চমকে ওঠেন। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায় তাঁর।
তসলিমা নাসরিন?
হ্যাঁ তসলিমা নাসরিন। সে তো লুকিয়ে আছে। বলা যায় না, ওঘরে হয়ত তুমি তাকে লুকিয়ে রেখেছো!
ঠ মিথ্যে বলেন না সাধারণত। অনেক কষ্টে আগের গল্পটি তাঁকে তৈরি করতে হয়েছিল। ছোট মেয়ে গল্পটি গিললেও বড় মেয়ে গেলেনি। তারপরও তিনি ষোলর সন্দেহ উড়িয়ে দিয়ে আমার সঙ্গে তাঁর কোনও পরিচয়ই নেই, দেখেননি আমাকে কোনওদিন, এ জাতীয় কিছু একটা বলে আপাতত বিপদ থেকে রক্ষা করলেন নিজেকে। কিন্তু বিপদের লালচক্ষু যখন সারাক্ষণই চোখের সামনে নৃত্য করতে থাকে, তখন একসময় করতেই হয় স্বরটিকে নরম, মাথাটিকে নোয়াতেই হয় কিছুটা। ঠ সারা সকাল ছটফট করেন, সারা দুপুর করেন, সারা বিকেল করে সন্ধেয় কন্যাটির কাছে জানতে চাইলেন আমার লেখা সে পড়েছে কি না। কন্যা বলল, পড়েছে এবং তার খুব ভাল লাগে আমার লেখা। তখনই ঠ সিদ্ধান্ত নেন মেয়েকে এ ঘরে এনে একবার আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবেন। এতে তিনি লাল চক্ষুর বিপদ থেকেও রক্ষা পাবেন। তাঁর বিশ্বাস তাঁর মেয়ে ইশকুলের কাউকে বলবে না এ কথা।
ঠ আমার কাছে জানতে চান আমি রাজি কিনা। আমার রাজি না হওয়ার কারণ নেই। তাঁর উৎসুক কন্যাটি নিয়ে ঠ এ ঘরে আসেন। সুন্দর মেয়ে। পরীক্ষায় ভাল ফল পাওয়া মেয়ে। মেয়েটি স্থির দাঁড়িয়ে থেকে বড় বড় চোখ করে আমাকে দেখে। বলি, ‘তোমার ঘরটা ছেড়ে যেতে হল, নিশ্চয়ই খুব অসুবিধে হচ্ছে তোমার!’
মেয়েটি মাথা নেড়ে বলে, না।
কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলল যে তার বিশ্বাস হচ্ছে না চোখের সামনে সে আমাকে দেখছে। অপ্রতিভ একটি হাসি আমার মুখে। কেন তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে এটি আমি। আমি ঠিক বুঝতে পারি না এই বিশ্বাস না হওয়ার ব্যাপারটি প্রিয় কোনও লেখককে চোখের সামনে দেখলে যেমন বিশ্বাস হয় না তেমন নাকি এক পলাতক আসামীকে দেখার উত্তেজনা! যার ফাঁসির জন্য দেশ জুড়ে আন্দোলন হচ্ছে। যাকে লক্ষ লক্ষ লোক খুঁজছে খুন করার জন্য!’
রাতে ঙ এলেন। ঠ সন্তর্পণে ঙকে নিয়ে ঢোকেন আমার ঘরে। ত্রস্ত উঠে বসি। ঙ ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়তে নাড়তে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলেন— আজও হল না। আমার কণ্ঠে থিকথিক করছে উত্তেজনা।
—কেন হল না?
—জানি না কেন হল না।
—কী হবে তাহলে?
—কী হবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
—জামিন হচ্ছে, হবে, এমন কথাই তো বলেছিলেন।
—এমনই তো আমি ভেবেছিলাম।
—সরকার নাকি আশ্বাস দিয়েছে..
—তা তো জানতাম যে দিয়েছে। এখন তো কিছুই স্পষ্ট হচ্ছে না আমার কাছে। কাউকেই এখন আর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না।
—নাকি দেরি হবে জামিন হতে?
—আর কত দেরি হবে? কিজানি, কিছুই বুঝতে পাচ্ছি না।
—তাহলে ভরসা কি কিছু নেই?
—ভরসা কার ওপর করব? কিছুরই হয়ত বিশ্বাস নেই।
ঙ চুপচাপ বসে থাকেন। এক কাপ চা খেতে চেয়েও চা আর খাবেন না জানিয়ে দেন। ঙর মুখের দিকে অসহায় তাকিয়ে থাকেন ঠ। তিনিও কিছু বলছেন না। ঘড়ির টিকটিক শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই ঘরে। গভীর একটি কুয়োর মধ্যে আমাকে যেন কেউ ফেলে দিল। বিছানায় বসে আছি, হাঁটু ভাঁজ, হাঁটুতে থুতনি। ধীরে ধীরে চোখ দুটো বুজে আসে। আমার হাত পা শিথিল হতে থাকে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন