তসলিমা নাসরিন
ছয় জুন, সোমবার
সকালবেলা ঘ নিজে আমার জন্য ট্রেতে করে নাস্তা নিয়ে আসেন। হাতে বানানো পাতলা রুটি, ডিম, আলুপটলভাজা, চা। কাজের মহিলা দিনে দুবেলা আসে, সকালে নাস্তা আর দুপুরের রান্না করে চলে যায়, আবার সন্ধেয় এসে রাতের জন্য রান্না বান্না করে। মহিলা যখন রান্নাঘরে ব্যস্ত, ঘ এলেন এ ঘরে, চোখে তাঁর করুণা। যখন আমাকে এ বাড়িতে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল আগে, তখন ওই চোখে দেখেছি আমাকে নিয়ে তাঁর গর্ব। অনেককে তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আমার সঙ্গে পরিচিত হতে। আমাকে নিয়ে সেই উচ্ছাস আর নেই, গর্বের জায়গায় দুফোঁটা করুণা চিকচিক করছে। কাজের মহিলার চোখ ফাঁকি দিয়ে বেড়ালের মত দৌড়ে গিয়ে আমাকে টুপ করে ঢুকতে হয়েছে পেচ্ছ!বখানায়। তিনি সতর্ক। কোনও জানালা দরজার ফাঁক দিয়ে কেউ যেন আবার দেখে না ফেলে আমাকে। নাস্তা খেয়ে বন্ধ ঘরটিতে বসে বসে আজকের পত্রিকাগুলো পড়ি। একটি পত্রিকাতেও কোনও বিবৃতি নেই। কেউ প্রতিবাদ করেনি আমার বিরুদ্ধে সরকারের এই মামলার, এই হুলিয়া জারির। আমি কী আশা করেছিলাম? আজকের পত্রিকা ছেয়ে যাবে প্রতিবাদে? বিবৃতিতে? হ্যাঁ আশা করেছিলাম। আমার ফাঁসি চেয়ে গত শুক্রবারে যে মিছিলটি বায়তুল মোকাররম থেকে বেরিয়েছিল, সে মিছিল থেকে কিছু লোক জনকণ্ঠ পত্রিকা আপিসে ঢিল ছুঁড়েছিল। জনকণ্ঠে ইসলামের ন্যায় নীতি আদর্শ মহিমা ইত্যাদি বর্ণনা করার জন্য একটি নিয়মিত বিভাগ থাকে, ইসলামের প্রশংসা করাই এর মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু সেদিন এই বিভাগটিতে কোন একটি সুরার ব্যাখ্যা মৌলবাদীদের পছন্দ হয়নি। পছন্দ হয়নি বলে ঢিল ছোঁড়া। সেদিনই ঢিল ছোঁড়ার প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠলেন বুদ্ধিজীবীরা। কিন্তু মিছিলগুলো যে আমার ফাঁসির জন্য ছিল এবং সেই কথার জন্য, যে কথা আমি বলিনি এবং তা পত্রিকায় প্রকাশিত, তারপরও কেউ সেই বিবৃতিতে বলেননি যে, যে কথা তসলিমা বলেনি সে কথার ভিত্তিতে তার ফাঁসি চাওয়া অন্যায়। আজকের পত্রিকাগুলোর খবর ঃ তসলিমা নাসরিনকে পুলিশ খুঁজছে। পুলিশ তাকে গ্রেফতারের জন্য হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। গতকাল সারা রাত এবং গতকাল রোববার সারাদিন গোয়েন্দাশাখার কয়েকটি দল ঢাকা মহানগরী এবং পাশ্ববর্তী এলাকায় ব্যাপক তল্লাশি অভিযান চালায়। তার আত্মীয় স্বজনের বাসায় পুলিশ তার খোঁজ করেছে। আত্মীয় স্বজনকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। পুলিশের ধারণা তসলিমা গ্রেফতার এড়ানোর জন্য ঢাকা মহানগরী অথবা দেশের অন্য কোথাও নিরাপদ জায়গায় আত্মগোপন করে আছেন। দেশের বাইরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বা সীমান্ত এলাকায় তাকে পেলে গ্রেফতারের আদেশ দেওয়া হয়েছে। তসলিমাকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশের কয়েকটি বিশেষ দলকে ময়মনসিংহ সহ ঢাকার বাইরে পাঠানো হয়েছে। এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, আমরা নাজুক অবস্থার মধ্যে আছি। তসলিমা নাসরিনকে গ্রেফতারের দায়িত্বে নিয়োজিত অফিসার-কনস্টেবলদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। সব কটি দল তাকে গ্রেফতার অভিযানে ব্যস্ত রয়েছে।
আমার বিরুদ্ধে সরকারের মামলা আর আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হতেই মৌলবাদীরা খুশিতে আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটায়নি। বরং আন্দোলনে এখন জোর বেড়েছে। আজ তাদের প্রশ্ন, এখনও কেন তসলিমাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না? তাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না, এ কোনও কথা হল? তাকে পেতে হবে এবং ফাঁসি দিতে হবে। এক্ষুনি। তাদের তর সইছে না। কেবল আমাকেই নয়। আরও দাবি এখন তাদের। অন্যান্য মুরতাদদেরও ফাঁসি দিতে হবে। তাদেরও গ্রেফতার কর। এনজিও বন্ধ কর। কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা কর। জনকণ্ঠ বন্ধ কর। মৌলবাদীদের পত্রিকায় প্রধান খবর, তসলিমার ফাঁসির দাবি অব্যাহত। জামাতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সভা সংগঠনের আমীর গোলাম আযমের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মুরতাদ ও ধর্মদ্রোহীদের কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানানো হয়। জামাতে ইসলামী আগামী ৮ জুন দাবি দিবস পালন করবে। ওলামা পরিষদ, খেলাফত মজলিশ, ইসলামী সংগ্রাম পরিষদ, মসজিদ রক্ষা আন্দোলন, বাংলাদেশ মসুল্লি কমিটি, আঞ্জুমানে তালামীযে ইসলামিয়া, খাদেমুল ইসলাম ছাত্র পরিষদ, নাস্তিক নির্মূল কমিটি, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন থেকে কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারী ভারতের পদলেহী জাতির কলংক কুখ্যাত মুরতাদ তসলিমা নাসরিনকে সরকার এখনও গ্রেফতার করে ফাঁসি দিচ্ছে না বলে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। নাস্তিক মুরতাদ প্রতিরোধ আন্দোলনের সংবাদ সম্মেলনে শায়খুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক বলেছেন, কতিপয় নাস্তিক ও ধর্মদ্রোহী ব্যক্তির ঔদ্ধত্য চরমসীমা লঙ্ঘনের পর্যায়ে। এরা কোরান ও হাদিসের সংশোধন ও পরিবর্তনের মত মারাত্মক দুঃসাহস দেখাচ্ছে। এই মহল দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাস ও ঈমান আকিদার ওপর নগ্ন হামলা করছে, এর আগে যা কখনও হয়নি। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, বর্তমানে দেশে যে সরকার ক্ষমতাসীন তারা বিসমিল্লাহর দোহাই দিয়ে ভোট বাগিয়ে মসনদে বসেছে। বলা হয়ে থাকে যে সাংবিধানিকভাবে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্মের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। অথচ ইসলামের ওপর ফ্রি স্টাইলে আক্রমণের মোকাবেলায় সরকার নিস্ক্রিয় সাক্ষী গোপালের ভূমিকা অনুসরণ করে চলেছে। এমন কী নাস্তিক মুরতাদদের সুকৌশলে পৃষ্ঠপোষকতা দান করে চলেছে। তিনি সরকারের তীব্র নিন্দা করেন। অবিলম্বে নাস্তিক মুরতাদদের ধর্ম বিরোধী তৎপরতার জন্য কঠোর শাস্তির দাবি জানান। এবং সেই সঙ্গে ধর্মদ্রোহীতা আইন প্রণয়ণের দাবি জানান। দেশ ও ধর্মের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র ও গণতৎপরতা বন্ধ করতে প্রতিরোধ গড়ার লক্ষ্যে আগামী ১০ জুন শুক্রবার বাদ জুম্মা ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল হবে, আগামী ১৬ জুন বৃহস্পতিবার দেশব্যাপী বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং স্মারকলিপি পেশ। ১৭ জুন শুক্রবার সকাল নটায় ওলামা মাশায়েখ দ্বীনদার বুদ্ধিজীবী সম্মেলন এবং বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
কেবল ঢাকায় নয়, সারা দেশেই মৌলবাদীদের সভা সম্মেলন চলছে। প্রতিটি সভায় বলা হচ্ছে, তসলিমার ফাঁসি চাই। মৌলবাদী সংগঠনের বিবৃতি তো আছেই। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬২ জন শিক্ষকও বিবৃতি দিয়েছেন, তাঁরাও আমার ফাঁসির দাবি করেছেন। ১৬২ জন শিক্ষকের মধ্যে আছেন, সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর এবং মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডঃ জহুরুল হক ভুঁইয়া, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সহ সভাপতি ডঃ মোঃ আবদুল হক, ডঃ মোঃ তাজুল ইসলাম, ডঃ মোঃ ইকবাল হোসেন, ডঃ মোঃ মইনুদ্দিন, অধ্যাপক এম এ ফারুক, ডঃ আবদুল হামিদ .।
না, কোথাও আমার বিরুদ্ধে সরকারের করা মামলাটির প্রতিবাদ করে একটি বিবৃতি নেই, একটি প্রতিবাদ নেই। খুঁজতে খুঁজতে একটি অখ্যাত পত্রিকার এক কোণে দেখি বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) পক্ষ থেকে আবদুল্লাহ সরকার বিবৃতি দিয়েছেন — দেশে যে মুহূর্তে ফতোয়াবাজ ধর্মান্ধ শক্তি প্রকাশ্য দিবালোকে হামলা চালাচ্ছে, তখন সরকার ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তাদের ওই জাতীয় অপকীর্তিতে ইন্ধন জোগানোর জন্য লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা করেছে। ভারতীয় দি স্টেটসম্যান পত্রিকায় কথিত বক্তব্য প্রকাশিত হবার পর তসলিমা নাসরিন তার প্রতিবাদ করেছেন। তসলিমার সেই প্রতিবাদ স্টেটসম্যান এবং বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকসমূহে প্রকাশিত হবার পরও মামলা দায়েরের ঘটনা লেখকের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপের সামিল এবং ফতোয়াবাজ মৌলবাদী শক্তির কাছে আত্মসমপর্ণের নামান্তর। সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বেলাল চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতনও বিবৃতি দিয়েছেন। গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী সদস্যরা বাক, ব্যক্তি স্বাধীনতা, ও মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে সরকার ও সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট চক্রের আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য সকল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির প্রতি আহবান জানিয়েছেন। আমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা প্রত্যাহারেরও দাবি জানিয়েছেন।
বাসদ একটি ছোট রাজনৈতিক দল। জাসদ ভেঙে বাসদ হয়েছে। সেই বাসদও টুকরো হয়ে গেছে। বাসদের একটি টুকরো এই বিবৃতিটি দিয়েছে। গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটও ছোটখাটো একটি জোট। কিন্তু বড় দলগুলো কোথায়? যে আওয়ামী লীগ বিএনপির পান থেকে চুন খসলেই যে রাস্তায় নেমে পড়ে, সেই আওয়ামী লীগ কোথায়? কোথায় বড় বড় বামদল? মানবাধিকারের এই লঙঘন কেন তাদের চুপ করিয়ে রাখছে! আমার বন্ধুরা কোথায়? আমার কবি বন্ধুরা? লেখক বন্ধুরা? কোথায় বুদ্ধিজীবীরা? যাঁরা মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন! সবাই কেন চুপ হয়ে আছেন? আমার পক্ষে কথা বলতে ইচ্ছে যদি না হয়, বলবেন না। এখন পক্ষ বিপক্ষ বড় কথা নয়। বড় কথা অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। প্রতিবাদ করছেন না কেন তাঁরা? তাঁরা কি ভাবছেন এটি আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার! এটি কি সত্যিই আামার ব্যক্তিগত ব্যাপার! আমি কি কাউকে খুন করেছি যে আমার বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদ করতে সংকোচ হচ্ছে! জার্মানীর এক প্রোটেস্টান্ট নেতা মার্টিন নিয়েমোলেরএর কথা মনে পড়ছে, নাৎসীরা যেভাবে ধরে ধরে মানুষ মারছিল, সে প্রসঙ্গে বলেছিলেন, প্রথম ওরা কম্যুনিস্টদের জন্য এল, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি কম্যুনিস্ট নই, এরপর ওরা ইহৃুদির জন্য এল, আমি প্রতিবাদ করিনি কারণ আমি ইহুদি নই, এরপর ওরা ট্রেড ইউনিয়নিস্টদের জন্য এল, আমি প্রতিবাদ করিনি কারণ আমি ট্রেড ইউনিয়নিস্ট নই, এরপর ওরা ক্যাথলিকদের জন্য এল, আমি প্রতিবাদ করিনি কারণ আমি ক্যাথলিক নই। এরপর ওরা আমার জন্য এল, তখন আমার পক্ষে কথা বলার দেখলাম কেউ নেই।
সমাজতান্ত্রিক দলের যাঁরা আমার পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন তাঁদের সঙ্গে আমার কোনওদিন আলাপ হয়নি। তাঁদের সঙ্গে কখনও আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করিনি দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থা নিয়ে কথা বলে, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা নিয়ে। কিন্তু করেছিলাম তো অনেকের সঙ্গে। আমরা তো অনেকেই একই আদর্শের জন্য লড়াই করছিলাম, তাঁরা আজ হঠাৎ হারিয়ে গেলেন কেন? তাঁরা আজ কেউ আমার সঙ্গে নেই কেন!
বুকের ভেতর হু হু করে। আচমকা একটি আশঙ্কা আমাকে আঁচড় কাঁটতে থাকে। বন্ধ জানালাটির দিকে চোখ রেখে শুয়ে থাকি। জানালার ছিদ্র দিয়ে যে সরু একটি আলো ঘরে ঢুকছিল, ধীরে ধীরে সেটি দেখি কমে যাচ্ছে। বাইরে অন্ধকার। ভেতরেও অন্ধকার। দুই অন্ধকারের মাঝখানে আমি, আমি আর আশঙ্কা।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন