তসলিমা নাসরিন
আট জুলাই, শুক্রবার
আজ দুপুরে খাবার নিয়ে জ-র কন্যা এল। দুশ্চিন্তাগুলোকে আপাতত দূরে সরিয়ে জীবনের ছোটখাটো জিনিস নিয়ে যদি মগ্ন হতে পারতাম! কিন্তু কি করে তা সম্ভব। জর কন্যার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বারবার আনমনা হয়ে পড়ি। মন স্থির হতে পারে না কোথাও। ভেতরে তুমুল তুফান নিয়ে বাইরে স্থবির বসে থাকতে হয়, এমনই স্থবিরতা যে একটু বাতাসও বয় না ভুল করে। জর কন্যার মুখে কুয়োকাটার গল্প শুনি, শুনতে থাকি, মন কিন্তু আমার কুয়োকাটায় নয়, মন বায়তুল মোকাররমে, মন পল্টনে, মন মিছিলে, মিটিংএ। রাতে ঙ এলেন। দেশের ভয়াবহ অবস্থার কথা বর্ণনা করেন তিনি। ভয়াবহ অবস্থাই বটে। জামাতে ইসলামীর সমাবেশ হয়েছে। ধর্মদ্রোহী, জাতিদ্রোহী, নাস্তিক ও মুরতাদদের শাস্তির দাবিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে জামাত। পল্টনের বিশাল সমাবেশে মতিউর রহমান নিজামী বলেছেন, জ্ঞদেশ আজ দুই দলে বিভক্ত। একদল কোরানের পক্ষে, অন্যদল বিপক্ষে। কোরানের বিরুদ্ধ শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে বিএনপি ধর্মপ্রাণ ভোটারদের সমর্থন পাবার অধিকার হারিয়েছে। তাদের কাজের এই ধারা অব্যাহত থাকলে অচিরেই সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হবে। যে ক্ষুদ্রগোষ্ঠী ইসলাম ও কোরানের বিরুদ্ধে বলছে ও লিখছে তারা দেশ, জাতি ও সংবিধান বিরোধী। বাক স্বাধীনতার অজুহাত তুলে এরা ধর্মের বিরুদ্ধে বলছে। পৃথিবীর কোথাও এমন নজির নেই। বিএনপি সরকার এদের দমন করতে ব্যর্থ। তারা এক্ষেষেন অদক্ষতা ও অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। আমি তাদের পরিস্কার ভাষায় আরেকবার সতর্ক করে বলতে চাই, এর পরিণাম ভাল হবে না। এর জন্যে তাদের বড় ধরনের মূল্য দিতে হবে। সরকারের এনজিও বিষয়ক ব্যুরো ৫২টি এনজিওর বিরুদ্ধে দেশের স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উত্থাপন করেছে। সরকার এ ক্ষেষেনও স্পষ্ট ভূমিকা রাখতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। তারা যদি ব্যর্থতার এই ধারা বজায় রাখে তবে তাদের পক্ষে বেশিদিন আর ক্ষমতায় টেকা সম্ভব হবে না। .. কোরান না থাকলে আমরা থাকি না। আমরা কোরানের মর্যাদা রক্ষার জন্য সংগ্রাম করছি। দেশে যারা ধর্মদ্রোহিতা করছে আমরা শুধু তাদের বিরুদ্ধে নই বরং তাদেরকে আন্তর্জাতিক যেসব মুরুব্বি নাচাচ্ছে, আমরা তাদের বিরুদ্ধেও। .. বিএনপির মধ্যে ওৎ পেতে থাকা রাম ও বামপন্থীরা বার বার মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে। সরকার এসব ট্যাকল করতে না পারলে তাদের ভবিষ্যত অন্ধকার।’ বক্তাদের মধ্যে ছিলেন মতিউর রহমান নিজামি, মাওলানা আবদুস সোবহান (দুজনই সংসদ সদস্য), মুহম্মদ কামরুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা, জসিম উদ্দিন সরকার, সাইফুল ইসলাম খান মিলন, আবু জাফর মোহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ ইত্যাদি লোকজন।
ইসলাম ও কোরানের অবমাননাকারীদের শাস্তির দাবিতে ১৩টি সংগঠনের সংগ্রাম পরিষদ গঠন হয়েছে। এই পরিষদে আছেন তাঁদের দলবলসহ বায়তুল মোকাররমের খতিব মাওলানা ওবায়দুল হক, নারিন্দার পীর সাহেব, ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা প্রতিরোধ মোর্চার আহবায়ক মাওলানা মুহিউদ্দিন খান, মহাসচিব ফজলূল হক আমিনী, এনডিওর সেক্রেটারি আনোয়ার জাহিদ, ফ্রিডম পার্টির সেক্রেটারি প্রাক্তন জেনারেল মেজর বজলুল হুদা, খেলাফত মজলিশের অধ্যাপক আখতার ফারুক, জাগপার সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলনের মাওলানা এটিএম হেমায়েত উদ্দিন, মুসলিম লীগের এডভোকেট মোহাম্মদ আয়েনউদ্দিন, নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি আশরাফ আলী, পিএনপির সভাপতি শেখ শওকত হোসেন নীলু, ভারতীয় দালাল প্রতিরোধ কমিটি গোলাম নাসির, যুব কমাণ্ডের সদস্য সচিব আবু নাসের মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ। সংগ্রাম পরিষদ থেকে সম্মিলিত কর্মসূচীর মাধ্যমে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জোট ভুক্ত কোনও সংগঠন এককভাবে কোনও কর্মসূচী গ্রহণ করবে না। কিসের জন্য সংগ্রাম? সংগ্রাম হচ্ছে ইসলাম ও কোরানের অবমাননাকারীদের শাস্তি প্রদান, ব্লাসফেমী আইন প্রবর্তন, কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা, ধর্মদ্রোহী, দেশদ্রোহী ও একশ্রেণীর এনজিওর অপতৎপরতা প্রতিরোধ, ভারতীয় আগ্রাসন ও বিজাতীয় হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ। ১৪ ও ২৯ জুলাইয়ের সম্মিলিত কর্মসূচী সফল করার জন্য মূল প্রতিনিধিদের এক জরুরি সভা আগামীকাল সন্ধে সাতটায় ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে। সভা ও বিক্ষোভ আগের মতই চলছে। দেশব্যাপী। খেলাফত ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাস্তিক নির্মূল কমিটি, মুসলিম ব্রিগেড, ইসলামিক পার্টি, বাংলাদেশ ইমাম উলামা পরিষদ, মুসলিম লীগ, ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলন, সত্য সন্ধানী আন্দোলন ইত্যাদি দল এখন রীতিমত ব্যস্ত।
অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের টনক নড়েছে এতদিনে। বলেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনার সঙ্গে মৌলবাদের কোনও সম্পর্ক নেই। এদেশের মানুষ মৌলবাদী হতে পারে না। ধর্মান্ধতা ও ফতোয়াবাজির কারণে আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে এবং এতে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার, এসব নিয়ে বাড়াবাড়ির পরিণাম ভাল হবে না।’ সাইফুর রহমানের টনক এইজন্য নড়েছে যে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা নাকি আর টাকা বিনিয়োগ করতে চাইছে না এ দেশে। মৌলবাদীরা দেশকে যে অচল করে ফেলছে তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে দিব্যি বলে দিলেন যে ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু এ দেশে তো ধর্ম কোনও ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়। ধর্ম এখানে রাষ্ট্রীয় ব্যাপার, ধর্ম এখানে আইনের ব্যাপার।
আজকের কাগজের খবর, বাংলাদেশে মৌলবাদীদের সহিংসতার কারণে গত দু মাসে ৮টি বিদেশি কোম্পানী বিনিয়োগ না করে ফিরে গেছে। এরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে এসেছিল কিন্তু মৌলবাদী তৎপরতার কারণে তারা পরিবেশ অনুকূল নয় বলে চলে গেছে। এর মধ্যে তিনটি ছিল জাপানি প্রতিষ্ঠান। এরা বাংলাদেশে যৌথভাবে ইলেকট্রনিক শিল্পের সম্ভাবনা যাচাই করতে এসেছিল। বৃটিশ কোম্পানী ম্যাক্সওয়েলের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা এসেছিলেন যৌথ উদ্যোগে গার্মেন্টস স্থাপনের চিন্তা মাথায় নিয়ে। একই প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল একটি জার্মান কোম্পানী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেভিয়ার্স কোম্পানীর এক কর্তা এসেছিলেন খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের সম্ভাবনা পর্যবেক্ষণ করতে। এ সময় বাংলাদেশে একের পর এক মৌলবাদী তৎপরতা,প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি, পত্রিকা অফিসে হামলার ঘটনায় ওঁরা বিস্মিত হয়েছেন বলে জানা গেছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ধরনের ঘটনা কি করে ঘটছে এই প্রশ্ন ওঁরা করেছিলেন স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে। মার্কিন কর্তাটি এসেছিলেন ৩০ জুনের হরতালের দিন। ঐদিন সারা বেলা ওঁকে সফরসঙ্গীদের দিয়ে বিমানবন্দরে কাটাতে হয়েছে। পরে মার্কিন দূতাবাস থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে পরের ফ্লাইটে তিনি চলে গেছেন। সোনার গাঁ হোটেলে তাঁর হোটেল বুকিং ছিল ১১ জুলাই তারিখ পর্যন্ত। ওটা তিনি বাতিল করে দেন। বিভিন্ন দূতাবাসগুলোতে যখন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা খোঁজ নিচ্ছেন তখনই তাঁরা জানছেন বাংলাদেশের ফতোয়ার ঘটনা, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কর্তৃক পত্রিকা অফিসে হামলার ঘটনা, সরকার কর্তৃক এনজিও বিরোধী আইন তৈরির চেষ্টার খবর। এসব জেনে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন।
রাতে শুতে যাবার আগে কর দিয়ে যাওয়া প্লাস্টিকের ব্যাগে যে তোয়ালে ছিল, সেটি ভেজা হাত মুখ মোছার জন্য তুলতে গিয়ে দেখি ভেতর থেকে টুপ করে একটি কাগজ পড়ল পায়ের ওপর। কাগজটি একটি চিঠি। ছোট্ট চিঠি। ইয়াসমিনের লেখা। বুবু, কোথায় আছো কেমন আছো কিছুই জানি না। যেখানেই থাকো, বেঁচে থেকো। কতটুকু ভাল থাকতে পারবে তা জানি না। এই সময়ে বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে জরুরি। একটা কথা মনে রেখো, আমরা সবাই সারাক্ষণ তোমার কথা ভাবছি। আমরা সবাই তোমাকে খুব ভালবাসি বুবু।
রাতে শুয়ে কোনও ঘুম আসে না। এপাশ ওপাশ করি। শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। একটি গোঙানোর শব্দ আমি ভেতর থেকে বেরোতে থাকে। বাড়ি যাবো বাড়ি যাবো বলে ভেতর থেকে শিশুর মত একটি কান্না উথলে উঠতে থাকে। কান্নাটিকে থামাই, গোঙানোকে থামাতে পারি না। শব্দ শুনে ট এলেন আমার ঘরে। উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা আমার শিয়রের কাছে বসে আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ২৪৪
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন