তসলিমা নাসরিন
চার আগস্ট, বৃহস্পতিবার
কাল রাতেই ঠ আমাকে জিজ্ঞেস করে গেছেন সকালে নাস্তা কি খেতে চাই। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলাম, যা হয় তাই। ঠ সকালে ট্রেতে করে চা তো আছেই, ঘি এ ভাজা পরোটা, মাংস, ডিম ভাজা, ফল ইত্যাদি নানা কিছু নিয়ে এলেন। আমাকে নটার মধ্যে তৈরি হয়ে নিতে বললেন। চা ছাড়া আর কিছু আমার খেতে ইচ্ছে হয় না। একটি শাড়ি বের করে দিলেন ঠ। খেয়ে দেয়ে গোসল করে শাড়িটি পরে নিতে বললেন। আমি গোসল করে শাড়ি পরে নিই। একটি কালো চশমা দেন আমাকে পরতে। তাঁর নিজের একটি ওড়না আমার মাথায় পরিয়ে দেন। ঘড়ির দিকে তাকাই, ঘড়ির কাঁটা এত দ্রুত আগে আর চলেনি। আমার বুক কাঁপে। কাঁপনের শব্দ শুনি । ফাঁসিকাঠে ঝোলার আগে বুঝি এই হয় আসামীর। ওড়না-মাথার আমাকে কুৎসিত দেখতে লাগে। কিন্তু বোধবুদ্ধিহীন আমি মূর্তির মত নিশ্চুপ। ওড়নায় মাথা ঢাকার বিরুদ্ধে, এসব অর্থহীন পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন থেকে লিখছি আমি, মেয়েদের মনে মন্ত্র দিচ্ছি নির্যাতনের প্রতীকটিকে মাথা পেতে বরণ না করার জন্য, অথচ আজ আমিই এটিকে মাথায় তুলে নিচ্ছি, আজ আমাকেই পরতে হচ্ছে ওড়না। এবার আর লুকিয়ে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যাওয়ার জন্য নয়। নিজের পরিচয়খানি ওড়নায় আড়াল করে নয়। পর্দাবিরোধী তসলিমা আজ পর্দানশীন নারী হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে যাবে, জনসমক্ষে যাবে, নিজের তসলিমা পরিচয়টি নিয়েই সে যাবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বলি, তুমি কি তসলিমা? না। আমাকে আমিই চিনতে পারি না। মুখখানা এতদিনে শুকিয়ে লম্বাটে লাগছে। চোখদুটোর তলায় কালি পড়েছে। কালো চশমায় চোখ ঢাকা পড়লে নিজেকে আরও অচেনা লাগে। অচেনা লাগে লাগুক, তবু তো জানি যে এ আমি। এ আমি বলেই আমার রাগ হয়। এ আমি কী করছি! এ কি আমি করছি! আমি কি নিজেকে লুকোচ্ছি এভাবে! না। আমি কিছুই করছি না। তসলিমা মরে গেছে। তসলিমার শরীরে এ এক শক্তিহীন সাহসহীন বোধহীন মেয়েমানুষ কেবল। এ আমি অন্য কেউ। এই অন্য কেউটিকে আমার শরীরে ধারণ করতে আমার ঘৃণা হয়। যন্ত্রণার মত একটি অনুভব আমার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে আমাকে অস্থির করে মারে। একবার আমি আয়নার সামনে যাই, আরেকবার বিছানায় এসে বসি। দাঁড়িয়ে থাকি মাঝপথে দরজা ধরে, ঘরময় হাঁটি, শ্বাস কষ্ট অনুভব করে জানালার কাছে যাই, জানালার পর্দা সরিয়ে ইচ্ছে করে হাট করে জানালা খুলে শ্বাস নিই। কিন্তু পারি না। হাত শক্ত করে চেপে রাখি হাতে। এ হাত কি আমার হাত? না এ হাত আমার হাত নয়। এ হাত সেই অন্য কেউটির হাত। মনে মনে আজও আমি এই তারিখটি নাকচের আশঙ্কা নয় আশা করেছিলাম, কিন্তু ঙ ফোনে জানিয়ে দিলেন এ বাড়ির দরজায় ঠিক সোয়া দশটার সময় একটি গাড়ি এসে থামবে, ছোটদা থাকবেন গাড়িতে, খুব দ্রুত গাড়ি চলবে, ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে গাড়িটিকে গিয়ে পৌঁছতে হবে হাইকোর্টে। ঠর কাছে খবরটি শুনে আমার বুক ধ্বক করে ওঠে। শরীর শীতার্ত হতে থাকে শুনে যে সত্যি সত্যি আজ ঘটতে যাচ্ছে ঘটনা। আমাকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ঠ। বুঝি, তিনিও বুঝতে পারছেন আজ আমার মৃত্যু হতে পারে, আজ আমি নিহত হতে পারি পথে বা আদালতে কোনও আততায়ীর গুলিতে।অন্য কেউ এ সময় হলে আল্লাহর নাম নিত, আল্লাহু লা-ইলাহা ইল্লাহুয়াল হাইয়ুল কাইয়ুম লা তা খুজুহু.., হে আল্লাহ আমাকে বালা মুসিবত থেকে রক্ষা কর এসব বলত। আমার তো নাম নেবার কোনও আল্লাহ নেই, ভগবান নেই, নিজের নামটিও অনেকটা ভুলে বসে আছি। আগের মতই আমি স্তব্ধ বসে থাকি। দশটা বাজার আগে আগে ঙ জানান, সোয়া দশটা নয়, সাড়ে এগারোটা। এরপর সাড়ে এগারো বেজে যাবার পর আরেকবার ফোন ঙর, সাড়ে এগারোয় হচ্ছে না, বারোটা চল্লিশে। বারোটা চল্লিশ অবদি ঠায় বসে থেকে মৃত্যুর নানা রং দেখা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।
ঠর বাড়ির দরজার সামনে সাদা গাড়ি এসে থামে বারোটা তেতাল্লিশে। আমাকে দরজার কাছে নিয়ে যান ঠ। দ্রুত গাড়ির দিকে এগোলেন তিনি, আমি পেছনে। মাথা ঢাকা, মুখ ঠাকা, চোখ ঢাকা আমি। তারপরও বাইরের হঠাৎ আলো আমার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। মনে হয় চোখ বুঝি অন্ধ হয়ে গেছে। দীর্ঘ দুমাস পর দিনের আলো চোখে পড়ছে আমার। চোখ পারি না খুলে রাখতে, অনেকটা অন্ধের মত, জন্মান্ধের মত আমাকে শাদা আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা শাদা গাড়ির দিকে যেতে হয়। আমাকে আড়াল করে এগোন ঠ, আশেপাশের বাড়ির জানালা থেকে কেউ এদিকে চোখ ফেললে যেন চিনতে না পারে যে এ আমি। ছোটদা চালকের আসনে, পাশে গীতা। পেছনে মিলন। পেছনের আসনে বসার সঙ্গে সঙ্গে ছোটদার কণ্ঠস্বর শুনি, শুয়ে পড়। মুখ মাথা ঢাকা, চোখ বোজা, শুয়ে পড়ি। ব্যস্ত সড়কে গাড়ি চলতে থাকে। গাড়ি কোথায় চলছে তার কিছুই বুঝি না। গাড়ি দ্রুত চলে, গাড়ির পেছন গাড়ি চলে। ভেঁপুর শব্দে কান ফেটে যায়। মনে হয় যেন এক্ষুনি দুর্ঘটনা ঘটবে, মনে হয় এই বুঝি কেউ গাড়িটিকে থামাবে। ছোটদা ট্রাফিকের লাল বাতি মানছেন না টের পাই একটু পর পর গীতার ভয়ার্ত স্বর শুনি, ‘কামাল কি করতাছো! ধাককা লাগবো, গাড়ি আস্তে চালাও।’ গাড়িটি যে কেউ থামিয়ে ফেলতে পারে, পুলিশ পারে, কোনও দাড়িটুপির দল পারে। যদি থামায় গাড়িটিকে? গাড়িটি আমার, এ গাড়ির নম্বর ছাপা হয়েছে পত্রিকায় বহুবার। কেউ নিশ্চয়ই মনে রেখেছে নম্বর! গাড়ির গা ঘেঁসে যে রিক্সাগুলো যাচ্ছে সেসবের আরোহীরা গাড়ির জানালায় চোখ ফেললেই দেখবে কুখ্যাত তসলিমা শুয়ে আছে গাড়ির পেটে। বাস থেকে, ট্রাক থেকে, জিপ থেকে অনায়াসে দেখা যায়, দেখে অনুমান করে নেওয়া যায় পেটের মানুষটিকে। মৃত্যুর নীল রংটি ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি! মৃত্যু কোথায় চাও, পথে না আদালতে! মনে মনে বলি, আদালতে। অন্তত আদালতে যদি কোনও সুযোগ থাকে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার।
আদালতের ভেতরে গাড়ি ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ কথা ছিল পেছন দিক থেকে দোতলায় আদালত কক্ষে ওঠার যে দরজা, ঠিক সেটির সামনে ছোটদা গাড়ি থামাবেন। কিন্তু পুলিশ এই গাড়িটি থামিয়ে দেওয়ায় কোনও উপায় না দেখে গাড়ি ঘুরিয়ে যেখান থেকে আদালত অবদি কম হাঁটা পথ সেখানে থামানো হল। এর চেয়ে সামনে গাড়ি যাবে না আর। ছোটদা বিড়বিড় করে বলছেন, ‘কোর্টরুমে ঢোকার আগ পর্যন্ত কেউ যেন চিনতে না পারে।’ এখন আমাকে বেরোতে হবে। মুখ তুলতে হবে। আমাকে হাঁটতে হবে। ছোটদা, মিলন আর গীতা দ্রুত আমাকে আড়াল করে আদালত কক্ষের দিকে যেতে থাকেন। খুব দ্রুত। এত দ্রুত আমি কখনও হাঁটিনি আগে। ওড়নার ফাঁক দিয়ে যেটুকু দেখা যায়, দেখি আদালত প্রাঙ্গণ ভরে আছে পুলিশে, ট্রাক ট্রাক পুলিশ আর হাজার হাজার মানুষ। টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় যেমন গিজগিজে ভিড় হয়, তেমন ভিড়। পুলিশ দেখে আমার ভয় হয় না, ভয় হয় মানুষ দেখে। শুনেছিলাম আজ আমার জামিনের আবেদন খুব গোপনে সারা হবে কিন্তু স্পষ্টতই সে লক্ষণ নেই। হাজার মানুষের ভিড় আদালতের মাঠেই। দোতলায় নির্দিষ্ট কক্ষের দিকে যাওয়ার করিডোরে এত ভিড় যে হাঁটার কোনও উপায় নেই। পর্দানশীন মহিলা যাচ্ছে কোনও কক্ষে, সম্ভবত করিডোরের লোকেরা ভেবেছে যখন আমাকে নেওয়া হচ্ছিল কক্ষের দিকে। খানিকটা সরে জায়গা করে দেয়। কক্ষটিতে এক সুতো পরিমাণ জায়গা নেই। ঠেলে ধাকিকয়ে আমাকে ঢোকানো হল। কালো গাউন পরা ব্যারিস্টাররা বসে আছেন বেঞ্চে। জামিনের আবেদনে এত লোক থাকে না কোনও কক্ষে। মনে হয় এই কক্ষটি জামিনের জন্য নয়, কোনও জটিল মামলার ফাঁসির রায়ের জন্য। সারা হোসেন আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে বসালেন তাঁর পাশে। কানে কানে বললেন যে তাঁর বাবা দীর্ঘক্ষণ জামিনের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে এইমাত্র চলে গেলেন, বড় বোনের বাড়িতে গেলেন, বোন তাঁর মারা গেছেন আজ। কক্ষে আমীরুল ইসলাম আমার উকিল হয়ে কথা বলছেন। সারা হোসেনকে দেখে, ডঃ কামাল হোসেনের বাকি সব সহকারীদের মুখে চেয়ে বুকের ধুকপুক খানিকটা থামে আমার। কক্ষের বেঞ্চগুলো সব ভরে গেছে, বেঞ্চগুলোর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকশ কালো গাউন। ক আছেন বসে বেঞ্চে। কর পরনেও কালো গাউন। চোখাচোখি হলে একটু হাসলেন। আমার পেছনের বেঞ্চটি থেকে একজন ব্যারিস্টার বললেন আমরা আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে এসেছি, আপনার পক্ষের লোক, ভয় নেই। এই ভয় নেই বাক্যটি আমার বুকের ধুকপুক আরও খানিক কমালো। নাসরিন, নাসরিন, পেছন থেকে দাদার কণ্ঠস্বর, মাথার কাপড় ফালা, মাথার কাপড় ফালা। পেছন ফিরে দাদাকে ভিড়ের মধ্যে এক পলক দেখি। ওই এক পলক দেখেই স্বস্তি হয় আমার, কিন্তু মাথার কাপড় আমি ফেলে দিই না। হঠাৎ জানালায় চোখ পড়তেই দেখি জানালার ওপারে শত শত অচেনা মানুষের মুখ, মুখগুলো সব আমার দিকে, চোখগুলো, নাকগুলো, ঠোঁটগুলো, সব ভীষণ-ভাবে বিকট-ভাবে আমার দিকে। লোকগুলো আদলতের কোনও বিচারক নয়, উকিল নয়। লোকগুলো বাইরের। কারা এরা, কি উদ্দেশ্যে এসেছে। এদের মধ্যে কি নেই ইসলামী ঐক্যজোটের লোক! সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের লোক! নিশ্চয়ই আছে। কদিন থেকে প্রতিদিন এইসব খুনীগুলো আদালতে ভিড় করছে আমি আসবো এই আশায়। এদের কারও পকেটে নিশ্চয় আছে কোনও পিস্তল, কারও হাতে নিশ্চয়ই কক্ষটি ধ্বংস করে দেওয়ার বোমা, যে কোনও সময় আমাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়বে। আমীরুল ইসলাম আমাকে তাঁর পাশে দাঁড় করিয়ে বললেন, মহামান্য আদালত, আসামী হাজির। আসামিকে মাথা নত করে আদালতকে সম্মান দেখাতে বলা হয়। আসামী সম্মান দেখাতে ভুলে যায়, আসামীর চোখ বার বার চলে যায় জানালায়, জানালার ওপাশের জটলায়, ভীষণ ভিড়ে, চিৎকারে। আগে আত্মসমর্পন করেননি কেন? প্রশ্নটি আসামির দিকে ছুঁড়ে দেন বিচারক।
এতদিন আত্মসমর্পন করিনি কেন, আমি উত্তর দেওয়ার আগে আমীরুল ইসলাম বলেন, আসামী নিরাপত্তার অভাব বোধ করেছে।
আসামী নিজের মুখে বলে না কেন সে কথা?
আসামী মৃদুকণ্ঠে বলে সে কথা। কিন্তু কণ্ঠ এমনই মৃদু এমনই মৃত যে আসামীর স্বর কেবল আসামীই শুনতে পায়।
এরপর এক তাড়া কাগজ দেওয়া হল বিচারকের সামনে। ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম বলে যাচ্ছেন আমার পক্ষ থেকে, যা বলার, যা বলতে হয়। আমার চোখ বারবার বাইরের ভিড়ে, কান চিৎকারে। মনে হতে থাকে বন্ধ দরজা ভেঙে মানুষের ঢল আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এক্ষুনি। আমাকে ছিঁড়ে টুকরো করবে এরা। এ ঘরে জামিনের শুনানি অনেকক্ষণ থেকে চলছে, কেবল আমার সশরীর উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল, তাও সারা। তারপরও আরও দেরি হচ্ছে, জামিনের দশ হাজার টাকার নথিপত্র নিয়েই নাকি দেরি। জানালায় ততক্ষণে যেন পুরো ঢাকা শহর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। এবার মহামান্য আদালতের কাছে আবদার, আসামীকে আদালত কক্ষ থেকে তার গন্তব্য অবধি নিরাপত্তা দেওয়া হোক, এবং তার বাড়িতেও পুলিশের ব্যবস্থা করা হোক। মহামান্য আদালত নিরাপত্তার সমস্ত ব্যবস্থা করার ব্যাপারে রাজি হলেন। পেছনে গুঞ্জন, সামনে গুঞ্জন। গুঞ্জন বিচারকের বিচার নিয়ে নয়। গুঞ্জন বাইরের ভিড় নিয়ে। যা করার তাড়াতাড়ি কর। ভিড় বাড়ছে। ভয়ঙ্কর ভিড়। আততায়ীর ভিড়।
কী করে এখন আমাকে বের করা হবে আদালত কক্ষ থেকে! কেউ জানে না কি করে। সকলের কপাল ধীরে ধীরে কুঁচকে যাচ্ছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। আমি কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে হঠাৎ কেউ হাত ধরে কেউ সামনের দিকে টান দিল। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, ভিড় কমুক। সমস্বরে অনেকে বলে উঠল, ভিড় কমবে না, ভিড় আরও বাড়বে। জলদি বেরোতে হবে। একটুও দেরি নয়। এক্ষুনি। ভিড় বাড়ছে। বাইরে অবস্থা ভাল নয়। আমাকে টেনে দরজার বাইরে বের করা হল। এক সুতো জায়গা নেই সামনে। কোথায় এগোবো! পুলিশেরা জায়গা করতে চাইছেন, পারছেন না। অনেকগুলো খাকি পোশাকের পুলিশ আমার সামনে, আমার পেছনেও। আমার বাঁদিকে আমীরুল ইসলাম, ডান দিকে নীল পোশাকের পুলিশ অফিসার, দুজনেই শক্ত করে ধরে আছেন আমার দুটো বাহু। আমার দুহাত আঁকড়ে আছে দুজনকে। পেছনে দাদা, ছোটদা, গীতা, মিলন, ক। সবাই আমাকে শক্ত করে ধরে আছে। কোনও ধাককায় যেন আমি পিছলে না যাই কারও হাত থেকে। সামনে আইন সালিশ কেন্দ্রের কজন উকিল। মাঝখানে আমি। আমাকে ঘিরে বৃত্তটি ক্রমশ বড় হচ্ছে। কিন্তু আমরা কেউ সামান্যও নড়তে পারছি না। এক পা নড়তে পারছি না, এক সুতো না। হাজার মানুষের ভিড়। করিডোর উপচে পড়ছে মানুষে। মানুষের ঘাড়ের ওপর মানুষ। এই ভিড়ের মধ্যে যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। পুলিশ চিৎকার করছে লোক সরাতে। কোনও লোক সরছে না। জোরে ধাককা দিয়ে ভিড়ের মধ্যে অনেকে আমার চারপাশের আগল ভাঙতে চাইছে। একবার ভেঙে গেলেই হল, আমাকে নাগালের মধ্যে পেয়ে যাবে আততায়ীর দল। আমাকে দুহাতে সাঁড়াশির মত করে ধরে আছেন আমীরুল ইসলাম। পুলিশ অফিসার ঘামছেন। করিডোরে চিড়েচ্যাপ্টা হয়েও দাঁড়াবার জায়গা নেই বলে রেলিংএ লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে মানুষ। আমার সামনের লোকগুলো সামনে জোরে ধাককা দিয়েও লোক সরাতে পারছে না এক তিলও। বিস্ফোরণের ঠিক আগের মুহূর্ত প্রতিটি মুহূর্তই। পেছনে চলে যাবো কি না চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করি। পুলিশ অফিসার চেঁচিয়ে উত্তর দেন, না। কোত্থেকে যেন বিকট সব চিৎকার ভেসে আসছে। আমরা আটকা পড়ে গেছি করিডোরে। আমাদের সামনে যাওয়ার উপায় নেই, পেছনে হঠারও কোনও উপায় নেই। যে কোনও কিছুই এখন ঘটতে পারে, যে কোনও ভয়াবহ দুর্ঘটনা এখনই ঘটবে। যে কেউ আমার মাথা লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে পারে। অন্যরকম গন্ধ পাই বাতাসে, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। ভিড় আরও বাড়ছে, ভিড়ের মধ্যে ভিড় বাড়ছে। মানুষের মাথার ওপর মানুষ উঠছে। পুলিশ দিশেহারা। আমরা বিশ্রি রকম বন্দী।
চারদিকে বিকট বিকট শব্দ। সব শব্দ ছাপিয়ে বুকের ধুকপুক শব্দ শুধু। মৃত্যুর রং দেখছি। গাঢ নীল রং টি ধীরে ধীরে কালো হয়ে উঠছে। বিবিসির ইংরেজ সাংবাদিক রেলিংএর ওপর থেকে তাঁর লম্বা মাইক্রোফোনটি আমার মাথার ওপর ঝুলিয়ে রেখেছেন। রেলিং এ দাঁড়ানো সাংবাদিকরা চেঁচিয়ে প্রশ্ন করছেন, জামিন হয়েছে কি না, আমি কেমন বোধ করছি, এখন কী ভাবছি, আমার ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কি। কাণ্ডজ্ঞানহীন সাংবাদিকরা সামান্য বুঝতে চেষ্টা করেন না যে কারও কোনও প্রশ্নের উত্তর দেবার মত শারীরিক মানসিক কোনও অবস্থাই আমার নেই। সাংবাদিকদের জন্য অবশ্য সবই মজার বিষয়, এই যে আমি মৃত্যুর দুহাত দূরে দাঁড়িয়ে আছি, এ নিয়ে তাঁরা কেউ কোনও দুশ্চিন্তা করছেন না, এখন যদি আমার পেটে কেউ ছুরি বসায়, তা দেখে তাঁরা অখুশি হবেন না, বরং মহা আনন্দে বর্ণনা করবেন আমার খুন হওয়ার আদি থেকে অন্ত, এর নিউজ ভ্যালু নিয়ে মেতে উঠবেন। হঠাৎ পলকের মধ্যে দৃশ্য পাল্টে যায়। সামনের পুলিশগুলো শক্ত শক্ত লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে সামনে যাকে পাচ্ছে তাকে। পিটিয়ে সরাচ্ছে লোক। ধাওয়া খেয়ে কেউ না কেউ সামান্য হলেও সরে যায়। এই করে আমার যাওয়ার জায়গা জোটে। নীল পুলিশটি আমাকে বললেন সামনে যেতে। আমি সঙ্গে সঙ্গে বলি, ভিড় কমুক। পুলিশ ধমকে উঠলেন, ভিড় কমবে না, বাড়বে আরও। আচমকা পুলিশ অফিসারটি আমাকে দৌড় দিতে বলে নিজে দৌড়োতে লাগলেন, আমাকে টেনে নিতে লাগলেন সামনের দিকে। সামনের পুলিশগুলোর কাছে ইঙ্গিতে তাই হয়ত বলা হয়েছে। পুলিশগুলো বেধড়ক লাঠি চালিয়ে সবাই মিলে ধাককা দেবে সামনের দিকে, এই করেই যদি এগোনো যায়। তাই হল। সবাই দৌড়োচ্ছে, বৃত্তের সবাই। আমীরুল ইসলাম, দাদা, ছোটদা, মিলন, ক। আইন ও সালিশ কেন্দ্র, পুলিশ। দৌড় আমাকে দিতে হয়নি। সকলের দৌড় ফুঁসে ওঠা সাগরের উত্তাল জোয়ারের মত আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। সামনে করিডোর শেষ হতেই সিঁড়ি, সেই সিঁড়ি পেরিয়ে নিচে। যখন দাঁড়িয়েছি নিচে, খালি পা আমার, চটিজোড়া কখন ভিড়ে খসে গেছে জানি না, শাড়ি খুলে খসে পড়ছে। চিৎকার বাড়ছে চারদিকে। পুলিশের, অচেনা মানুষের, চেনা মানুষেরও। টুপিমাথার লোকগুলো পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ছুটে আসতে চাইছে এদিকে, পুলিশের চেয়ে টুপিমাথার সংখ্যা অনেক বেশি। চিৎকার চারদিকে, বিষম বিকট চিৎকার। অস্থিরতা আমার সারা শরীরে, এই বুঝি খুলি উড়ে যাবে, আর বুঝি একটি মুহূর্ত। শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে কন্ঠদেশ। আমি কথা বলতে চাইছি, পারছি না। ফ্যাসফ্যাস একটি শব্দ বেরোচ্ছে গলা থেকে। গলার ভেতর যন্ত্রণা হচ্ছে। ছোটদা দৌড়ে গেলেন গাড়ি আনতে, কয়েক মিনিটের মধ্যেই গাড়ি এল, কিন্তু কয়েক মিনিটকে কেবল আমার নয়, আমাকে ঘিরে যাঁরাই ছিলেন, সবারই মনে হল যেন ঘন্টা পার করে গাড়ি এনেছেন। দ্রুত আমাকে ঠেলে দেওয়া হল গাড়ির ভেতরে, আমার ডানে বামে দাদা, মিলন আর ক। গাড়ি দ্রুত আদালত প্রাঙ্গণ পেরোচ্ছে যখন, পেছনে পাথর ছুঁড়ছে চিৎকার করা লোকেরা। গাড়ির লেজে ঠোককর খাচ্ছে পাথরে বাঁধা ঘৃণাগুলো। সামনে পুলিশের গাড়ি, পেছনে পুলিশের ট্রাক। কেবল বাড়িতেই নয়, একেবারে ঘর অবদি পৌঁছে দিয়ে গেল নীল পোশাকের লোক। ঘর! সেই ঘর!
আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছেন মা। সে যে কি বিষম কান্না! কে এত কাঁদতে পারে মা ছাড়া! মার এলো চুল, এলো শাড়ি, শরীর শুকিয়ে অর্ধেক, আমার আর কত, মার চোখের নিচে অনেক বেশি কালি, ফুলে ঢোল হয়ে আছে কান্না -চোখ। চোখের জল নাকের জল গড়াচ্ছে মার গাল বেয়ে চিবুক বেয়ে বুকে। মাকে বলছি, কাঁদো কেন, আমি তো ফিইরা আসছি। মা তবু কাঁদেন। আমার ঘরে ফিরে আসার আনন্দে কাঁদেন মা, দীর্ঘকাল আমার না থাকার জন্য কাঁদেন, আমার শুকিয়ে যাওয়া শরীরটির জন্য কাঁদেন, আমার মলিন মুখটির জন্য কাঁদেন, দুমাস আমি কষ্টে থেকেছি ভয়ে থেকেছি বলে কাঁদেন। মা আমার জন্য ভয়ে নির্ভয়ে কাঁদেন। আমার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কাঁদেন। যেন হাজার বছর পর হারিয়ে যাওয়া কন্যাকে ফিরে পেয়েছেন মা, যেন হারিয়ে যাওয়া বড় আপন কেউ হঠাৎ ফিরেছে বাড়িতে। মার কান্না শেষ হয় না, আমার সারা শরীরে হাত বুলোনো শেষ হয় না মার। আমি আমার লেখার ঘরে ধপাস করে বসে পড়েছি। বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। মা কেঁদেই চলেছেন। কান্নার দমকে তিনি কোনও কথা বলতে পারছেন না। এতদিন পর ঘর ভরা আত্মীয় স্বজনের মধ্যিখানে আমি। যে পরিবেশে কোনওদিন ফিরতে পারবো আমার বিশ্বাস হয় নি। মৃত্যুর গুহা থেকে এভাবে বেঁচে ফিরব ভাবিনি, কেবল আমি কেন আমার আশেপাশে যারা ছিল, কেউ ভাবেনি, বড় করুণায় আমার শুকনো মুখটি দেখেছে। যেন স্বপ্নের মত ঘটে গেল পুরো ব্যাপারটি। আমার এখনও বিশ্বাস হয় না আমি সত্যিই আমার বাড়িতে বসে আছি। যতই নিরাপদে আমি এখন থাকি না কেন, আমি কিন্তু হাঁপাচ্ছি। আদালতের করিডোরের ভয় এত তীব্র ছিল যে সেটি দূর হতে অনেক সময় নেয়। ঘন ঘন পানি খাই কাঠ হয়ে থাকা গলাটি ভেজাতে। ক আমার পাশে এসে নিঃশব্দে বসেন। বলেন, আপনার পাসপোর্টটা দিন। পাসপোর্ট খুঁজে বের করে দিই। ক বলেন, কোনও সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দেবেন না। যে সাংবাদিকই আসবে, যেন বাড়ি থেকে বলে দেওয়া হয় আপনি এ বাড়িতে নেই।
মাথা নেড়ে আচ্ছা বলি। ক চলে গেলেন।
নিচে বাড়ির নিরাপত্তা প্রহরী, তার ওপর বাড়ি ঘিরে পুলিশ পাহারা, ঘরের দরজায় লম্বা লম্বা বন্দুক হাতে নিয়ে পুলিশ বসে গেছে। একইসঙ্গে ফোন বাজছে, ইন্টারকম বাজছে। নিচে সাংবাদিকরা ভিড় করে আছে। পাইকারি ভাবে সবাইকে বলে দেওয়া হয়েছে যে আদালত থেকে তসলিমা এ বাড়িতে সামান্য কিছুক্ষণের জন্য এসেছিল বটে, কিন্তু চলে গেছে আবার, কোথায় গেছে তা এ বাড়ির কেউ জানে না। এটাই বিশ্বাসযোগ্য কথা। তারপরও সাংবাদিকরা নিচে অপেক্ষা করছেন, কোনও রকম ফাঁক ফোকর দিয়ে ঢোকা যায় কি না দেখছেন অথবা কোনও রকম সংবাদ যোগাড় করা যায় কি না বাড়ির মানুষের কাছ থেকে অথবা পুলিশের কাছ থেকে। পাইকারির মধ্যে ফরিদ হোসেনও পড়েছেন। ফরিদ হোসেন অবশ্য বুদ্ধি করে বাড়ির দরজা অবদি আসতে পেরেছেন। তিনি আমার বাড়ির নাম করে ভেতরে ঢোকেননি, ঢুকেছেন ইস্টার্নপয়েণ্টের দু নম্বর বাড়ির পাঁচতলায় তাঁর বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছেন বলে, তারপর দুনম্বর বাড়িতে তিনি গেছেন বটে, তবে নিজেকে আড়াল করে এক নম্বর বাড়ির নতলায় এসে চার নম্বর দরজায় টোকা দিয়েছেন। ফরিদকে দরজা থেকে বলে দেওয়া হল আমি বাড়ি নেই। দরজা খোলার জন্য তিনি হেন কথার আবদার নেই যে করেননি। না, দরজা খোলা হয়নি। শেষমেষ দরজার তল দিয়ে দিয়ে গেলেন একটি প্রশ্নপত্র। মাত্র কটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার অনুরোধ করেছে টাইম ম্যাগাজিন। টাইমের বিদেশী সাংবাদিক নিজে এসেছেন, আমার কাছে তাঁর আকুল প্রার্থনা যেন জবাব গুলো দিই। ফরিদকে অবিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই আমার, সাংবাদিকদের মধ্যে ফরিদই আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। অনেকটা তিনি ঘরের লোকের মত। ফরিদ হোসেন এ বাড়িতে অনেক এসেছেন, তিনি জানেন এ বাড়ির পরিবেশ, নিশ্চয় তিনি অনুমান করেছেন যে যদি কোথাও থাকি আমি, এ বাড়িতেই আছি। আরেক দফা সুযোগ নিয়ে তিনি বিকেলে আবার যখন এলেন পাভেলকে নিয়ে, ভেতরে ঢোকার ছাড়পত্র তাঁকে দেওয়া হয়। ছাড়পত্র দেওয়া হয় ফরিদ সাংবাদিক বলে নয়। ফরিদ ফরিদ বলে, বন্ধু বলে। পাভেল কিছু ছবি তুলে নিলেন দ্রুত, আমি লক্ষ্য করার আগেই। প্রতিশ্রুতি দিলেন দুজনই, কোনও প্রাণীকে তাঁরা জানাবেন না আমি যে এ বাড়িতে আছি। ফরিদকে বললাম যে আমি কোনও সাক্ষাৎকার দেব না। কোথাও কোনও সাক্ষাৎকার দিচ্ছি না, কেবল বিবিসি সিএনএনকেই নয়, বিদেশি দেশি যত সাংবাদিক আছেন, সবাইকেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। টাইম ম্যাগাজিন হোক আর যে ম্যাগাজিনই হোক, আমি মুখ খুলব না বলে দিই কিন্তু ফরিদের মুহূর্মহূ অনুরোধে ঢেঁিক গিলতে হয় আমাকে, ঢেঁকি গেলা মানে রাজি হওয়া যে তাঁর প্রশ্নের উত্তর গুলো অন্তত লিখে হলেও আমি দেব। আজ তো নয়ই। কাল? দেখা যাক। ঢেকি গেলার পুরস্কার দেয় ফরিদ ফেরার পথে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের বলে যে আর যেখানেই থাকি আমি অন্তত এ বাড়িতে নেই। পরদিন সব পত্রিকায় আদালতের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শেষে লেখা হয়, আমি আদালত থেকে বাড়ি ফিরে মার সঙ্গে দেখা করেই আবার চলে গেছি কোনও গোপন ঠিকানায় আত্মগোপন করতে।
মা আমাকে খাবার টেবিলে বসিয়ে মাথার ওপর পাখা ছেড়ে দিয়ে মুখে তুলে ভাত খাইয়ে দেন। এক হাতে ভাত খাওয়ান, আরেক হাতে আঁচল টেনে চোখের পানি মোছেন। বেশি খাবার আমার পেটে ঢোকে না। মুখ সরিয়ে নিই। বাড়ির সবার সঙ্গে কথা বলতে চাই। কিন্তু পারি না। শরীর দুর্বল। শরীর নেতিয়ে পড়ে। হাঁটতে পারি না এ ঘর থেকে ও ঘর। শুয়ে পড়ি বিছানায়। শরীর ভরা ক্লান্তি, ক্লান্তি মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, আমাকে পাড়ায় না।
রাত এগারোটার দিকে বাড়িতে জ,ঝ,ঠ আর ঙ আসেন। কোনও এক রেস্তোরাঁয় আজকের জামিন পাওয়ার আনন্দের দিনটি উৎযাপন করে অনেকটা যুদ্ধজয়ের উৎসবে যোগ দিয়ে আমাকে দেখতে এসেছেন। রেস্তোরাঁয় ক ছিলেন। কিন্তু ক এই রাতে আর আসতে পারেননি আমার কাছে, বলেছেন আগামীকাল বা পরশু একবার আসবেন। এঁরা আমার পাশে ছিলেন আমার অন্ধকার সময়গুলোয়। যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ উন্মাদ হয়ে উঠেছে একটি মানুষকে হত্যা করতে, যখন বন্ধুরাও মুখ ফিরিয়ে রেখেছে ভয়ে, তখন এঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন, গভীর গোপন নিরাপত্তা দিয়েছেন। এঁরা আমার প্রাণ রক্ষা করেছেন। কী হন এঁরা আমার! আমার ভাইও নন, বোনও নন। অথচ এঁরাই আমার পরম আত্মীয়, এঁরাই আমার সত্যিকার বন্ধু। মৌলবাদীর দাবি আর সরকারের অনমনীয় মতের বিরুদ্ধে আজকের এই বিজয় এঁরা নিজেদের বিজয় হিসেবে মনে করছেন। আমার পক্ষে বাইরের রেস্তোরাঁয় কোনও উৎসবে যোগ দেওয়া সম্ভব নয়, সম্ভব হলে আমিও যোগ দিতে পারতাম। আমিও আনন্দ করতে পারতাম! কিন্তু আনন্দ কোথায় আমার মনে! জামিন পেয়েছি, কিন্তু সামনে আমার অনিশ্চিত একটি ভবিষ্যত। এঁরা সবাই জানেন আমার সামনের অনিশ্চয়তার কথা, কিন্তু আপাতত সব ভুলে আমাকে হাসতে বলছেন। অদ্ভুত একটি হাসি ঝুলে থাকে আমার ঠোঁটে। এঁদের মুখোমুখি সোফায় বসেছিলাম, সোফা ছেড়ে দিয়ে এঁদের খুব কাছে, পায়ের কাছে, ফরাসের ওপর বসি এসে। খুব ঘন হয়ে বসার অভ্যেস গত দুমাসে হয়েছে বলেই হয়ত। আমার কণ্ঠস্বর লঘুতে, নিচুতে, মৃদুতে। গত দুমাসে এভাবে কথা বলার অভ্যেস হয়েছে বলেই বোধহয়। আমি ক্লান্ত, যত না শরীরে, তারও চেয়ে বেশি মনে। এই মনের ওপর খুব বড় তুফান বয়ে গেছে, মনের দালানকোঠা ভেঙে গেছে। এই মনের ঘরকে শক্ত করে গড়তে আমি বড় শ্বাস নিই। এঁদের পাশে থাকা আমার শ্বাসে শুদ্ধ হাওয়া বইয়ে দেয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন