তসলিমা নাসরিন
ষোল জুলাই, শনিবার
বিবিসিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর অ্যানিটা টিসেন বলেছেন, মৌলবাদীরা তসলিমা নাসরিনকে হত্যার হুমকি দেওয়ার পরও সরকার তাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা তসলিমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাহার করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। আমরা তার নিরাপত্তার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং যারা তাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের প্রশ্নে সরকারের একটা দায়দায়িত্ব রয়েছে। আমরা দেখতে চাই, মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বাংলাদেশেও সমুন্নত রয়েছে। তসলিমা নাসরিন তার দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিলে এবং স্বদেশে ফিরে গেলে তার প্রাণের ভয় থাকলে আমরা তাকে জোর করে ফেরত না পাঠানোর জন্য দ্বিতীয় দেশটির কাছে আহবান জানাবো।
বিবিসি থেকে বাংলাদেশ সরকারের পূর্ত মন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় এ ব্যাপারে। রফিকুল ইসলাম মিয়া যা বলেন তা হল, তসলিমা আসলে কোথায় আছেন সরকার তা জানে না। কয়েকদিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও সংসদে এ কথা বলেছেন। তসলিমা অ্যামনেস্টির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, কিন্তু সরকারের সঙ্গে কেন যোগাযোগ করছেন না! তাঁর বিরুদ্ধে একটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলে, দেশের আইন অনুসারে তিনি নিজেকে স্বাভাবিকভাবেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে সোপর্দ করবেন। এছাড়া তিনি আদালতের মাধ্যমে জামিনের আবেদন করতে পারেন। তসলিমা যদি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন, তবে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাঁকে পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া হবে। কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তা যত শক্তিশালীই হোক না কেন, তারা তসলিমার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবে না। তসলিমাকে কেউ হত্যার হুমকি দিয়েছে, এ খবর সরকারের জানা থাকলে নিশ্চয়ই তাকে যারা হুমকি দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবে।
আমার ভাল লাগে ভাবতে যে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মত বড় একটি সংস্থা আমার জীবন বাঁচাবার জন্য চেষ্টা করছে। এতে কি কাজ হবে? ঝ বলেন, নিশ্চয়ই হবে। আমার প্রশ্ন, দেশে দেশে কত মানুষকেই তো অত্যাচার থেকে বাঁচাতে অ্যামনেস্টি চেষ্টা করে। অ্যামনেস্টি কি সকলকে বাঁচাতে পারে? পারে না তো। অ্যামনেস্টির আবেদন কি সব দেশের সরকারের কানে ঢোকে? ঢোকে না তো! ঢুকলে দেশে দেশে বর্বরতা জন্মের মত শেষ হত।
ঝর হাতেই দিয়েছিলাম অ্যামনেস্টির কাছে লেখা আমার চিঠিটি গত পরশুদিন। ঝ আমাকে বলছিলেন এভাবে মরার মত বসে না থেকে চেষ্টা করতে কিছু। চেষ্টা করার আছে কি আমার! অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, লেখক সংগঠন পেন ফতোয়ার পর আমাকে চিঠিপত্র পাঠিয়েছিল। তারা যেহেতু আমাকে সাহায্য করার জন্য নিজ দায়িত্বেই এগিয়ে এসেছিল, তাদেরকেই জানানো যেতে পারে যে পারলে যেন আমাকে সাহায্য করে এবার। এখনই আমার সত্যিকার সাহায্য প্রয়োজন। ঝ ফ্যাক্স করে দিয়েছেন অ্যামনেস্টির কাছে লেখা চিঠিটি। আদৌ চিঠিটি কারও হাতে পৌঁছবে কি না, আদৌ চিঠিতে কোনও কাজ হবে কি না, তা না জেনেই শেষ চেষ্টা করার মত লিখেছিলাম চিঠি, পারলে আমাকে যেন এই বিপদ থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করে, যেন আমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারকে বলে। কিন্তু সরকার মুখে যতই কথা বলুক, কি করে বিশ্বাস করতে পারি যে এই সরকার আদৌ আমাকে কোনও নিরাপত্তা দেবে! ঝকে বলি, তাহলে আদালতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করিই না হয়। ঝ বলেন, তোমার মাথা খারাপ হলে যাও।
—কেন, এখন তো ঠেলায় পড়ে সরকার থেকে বলা হচ্ছেই যে আমি চাইলে আমাকে নিরাপত্তা দেওয়া হবে।
—বলেছে তো ঠিক। কিন্তু আদালতে যাবেই বা কোন সাহসে? সরকার তোমাকে নিরাপত্তা দেওয়ার আগেই যদি মোল্লারা তোমাকে খুন করে বসে!
—আমাকে নিরাপত্তা দিক তা হলে, আমি যাই আদালতে।
—তুমি আসামী। হুলিয়া জারি হওয়া আসামীকে কেউ কি নিরাপত্তা দিতে আসে নাকি! ওরা বলছে, তুমি আদালতে আত্মসমর্পণ করবে, তারপর প্রচলিত আইন অনুযায়ী তোমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে ওরা। কথাটি ওরা বলছে, কিন্তু মানবে যে তার গ্যারেন্টি কি?
—কিন্তু এ ছাড়া আর তো উপায়ও নেই। এ কাজটিই আমাকে যে করেই হোক করতে হবে।
ঝ বললেন—তোমার উকিলের পরামর্শ ছাড়া কিছুই করা তোমার পক্ষে ঠিক হবে না।
—কিন্তু ক সেদিন তো আমাকেই ডিসিশন নিতে বললেন। উকিলও নাকি বলেছেন।
—তোমার উকিল তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে বললেও তুমি তা নিতে যেও না। এই ভুলটা কোরো না। এখন উকিলকেই সিদ্ধান্ত নিতে দাও। উকিলের ওপরই ছেড়ে দাও সব।
এদিকে তসলিমাকে ফাঁসি দেওয়ার দাবিতে ২৯ জুলাই তারিখে যে লং মার্চ হবে, এবং মানিক মিয়া এভিন্যুতে যে মহাসমাবেশ, তা সফল করার জন্য দেশ ক্ষেপে উঠেছে। ৩০ জুনের হরতাল সফল হওয়ার পর প্রবল উত্তেজনায় ইসলামপন্থীরা এখন লাফাচ্ছে। সত্যিকার লাফানো যাকে বলে। দেশ জুড়ে সভা হচ্ছে, মিছিল হচ্ছে। ইসলামী নেতারা এক শহর থেকে আরেক শহরে সফর করছেন বিশাল বিশাল জমায়েতে তসলিমার ফাঁসি হওয়ার গুরুত্ব বোঝাতে। নেতারা সবখানেই সাদর সম্বর্ধনা পাচ্ছেন। বিস্তর হাততালি মিলছে তাঁদের। তাঁরা ঘোষণা দিচ্ছেন, সেদিন, মানে ২৯ জুলাই তারিখের সফলতা প্রমাণ করবে যে এ দেশে কোরানের সম্মান সুরক্ষিত হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হবে কোরানের বিধান।
প্রতিদিন সারাদেশে সভা মিছিল হচ্ছেই, হচ্ছেই ২৯ জুলাইএর লং মার্চের জন্য। ২৯ জুলাই এর লং মার্চ সফল করার জন্য ব্যাপক আয়োজন চলছে। কোনও নগর বন্দর শহর গ্রাম বসে নেই, প্রচণ্ড উৎসাহ উদ্দীপনা সকলের মধ্যে। কোনও শহর নেই দেশে যে শহরে লং মার্চের জন্য সভা বা মিছিল হচ্ছে না। কোনও গ্রাম নেই দেশে, যে গ্রামে লং মার্চ সফল করার পোস্টার পড়ছে না। কোনও এলাকা নেই দেশে, যে এলাকায় মানুষেরা তসলিমাকে ফাঁসি দেবার স্বপ্ন দেখছে না।
গতকাল জুম্মার নামাজ শেষে দেশের প্রতিটি মসজিদে ২৯ জুলাইয়ের লংমার্চ সফল করার লক্ষ্যে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। খবরটি ঝর মুখে প্রথম শুনি। পরে অবশ্য পত্রিকার পাতাতেও দেখি। বড় বড় মসজিদের দোয়া সমাবেশে লং মার্চের বড় বড় নেতা ভাষণ দেন। তসলিমার মৃত্যু কামনায় আল্লাহর দরবারে হাত ওঠানো হয়।
—বদমাশগুলো এখন খতিবকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে। ঝ বলেন।
—কি রকম? খতিব আবার মরলো কবে?
—ওই যে বলেছিল যে সংসদে কেউই মুসলমান নয়। এখন মৌলবাদ-বিরোধীরা বলছে খতিব সংসদকে অপমান করেছে। খতিবের শাস্তি হওয়া উচিত। শুনে মৌলবাদীরা বলছে, বিশেষ করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর কথা, যে, তাঁকে তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে আর জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
গান চলছে, গানের আড়ালে কথা বলছি আমরা। খেতে খেতে কথা বলছি। এক থালা থেকে ভাত তুলে খেতে খেতে কথা। ঝর থালা থেকে খেয়ে খেয়ে এখন অভ্যেস হয়েছে, আলাদা পাতে কি করে খেতে হয়, বোধহয় ভুলেই গেছি। গান চলতে থাকলেই কেবল কথা বলতে হয় আমার। এতেও এমন অভ্যেস হয়ে গেছে যে গান থেমে গেলে কথাও আমার থেমে যায়। বাড়ির সকলে জানে যে ঝ আজকাল এ ঘরে একা বসে তাঁর খাবার খান, সকলে জানে যে ঝ একা একা অনেক রাত পর্যন্ত গান শোনেন, জানে যে ঝর কিছু হাতে গোনা বন্ধু বান্ধবকে ওপরের এই ঘরটিতে ডেকে আনা হয়, এ ঘরে বসেই তাঁরা কথা বলেন। বাইরের বন্ধুরা চলে গেলে ঝ এই ঘরে একা একা গান শোনেন আর ছবি আঁকেন। জানে যে ঝ ছাড়া এ ঘরটিতে আর কোনও প্রাণী নেই।
—মৌলবাদীরা ঠিক কম্যুনিস্টদের মত কাজ করছে। আমি বলি।
ঝ জোরে হেসে উঠে বললেন—এরা তো একজন আরেকজনের শত্রু।
আমি বলি—কম্যুনিস্ট পার্টি যেভাবে কাজ করত, যেরকম অরগানাইজড ছিল তারা, যেরকম কমিটেড, মৌলবাদী সংগঠনগুলো ঠিক তাই, তারা কম্যুনিস্ট পদ্ধতিটা ব্যবহার করছে।
ঝ বললেন—তা ঠিক। এদিকে কম্যুনিস্টরা হয়ে গেছে ফাঁকিবাজ।
কতটুকু ফাঁকিবাজ হয়েছে অথবা আদৌ হয়েছে কি না সে নিয়ে আমাদের আলাপ বেশি এগোয় না কারণ দরজায় ঝর বাড়ির কাজের এক মেয়ে এসে দরজায় টোকা দিয়ে বলে, বাড়ির দরজায় কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে ঝর সঙ্গে দেখা করতে। ঝ দ্রুত উঠে যান। বাইরে থেকে এ ঘরের দরজায় তালা লাগাতে ঝ ভোলেন না। অনাকাঙ্খিত কারও উপস্থিতি আমাদের আতঙ্কিত করে। কোনও অচেনা আগন্তুক এ বাড়ির দরজায় দাঁড়ালে অবশ্যই আশঙ্কা হওয়ার কথা। কে এসে দাঁড়িয়েছে, সে আমি জানি না। আমি কান পেতে থাকি, কোনও অশোভন শব্দ ভেসে আসে কি না। আশঙ্কায় কান পেতে থাকি। খোপের দিকে চোখ চলে যায় বারবার। দোতলার বারান্দায় কথাবার্তা হচ্ছে কোনও, শব্দ কানে আসে। কিন্তু অনুমান করতে পারি না, কি কথা। কি কথা কার সঙ্গে! ঘণ্টা খানিক পর ঝ দুমিনিটের জন্য এসে বলে যান, তাঁর এক আত্মীয় এসেছিল, দুদিন থাকার ইচ্ছে নিয়ে এসেছিল আত্মীয়টি, তাকে নানা কৌশল করে বিদেয় করেছেন তিনি।
রাতে ঝ আর এ ঘরে আসবেন না। সারারাত আমাকে অন্ধকারে স্থির শুয়ে থাকতে হবে, সারারাতই আশঙ্কারা আমার চারপাশে নৃত্য করবে, এরকমই জানি। এরকমই হয় আমার একাকী রাতগুলোয়। কিন্তু রাত তখন কত জানি না, আমাকে চমকে দিয়ে ঝ দরজা খুলে ঢোকেন। হাতে তাঁর ছোট্ট একটি টর্চ। ঝর পেছনে ঙ, ঙর পেছনে যে মানুষটি, তাঁকে দেখে নিজের চোখকে আমি বিশ্বাস করতে পারি না। তিনি শামসুর রাহমান। ভালবাসায় আবেগে কাউকে জড়িয়ে ধরার অভ্যেস আমাদের নেই। কিন্তু আমার ইচ্ছে করে শামসুর রাহমানকে জড়িয়ে ধরতে, তাঁর কাঁধে মাথা রেখে আকুল হয়ে কাঁদতে। শামসুর রাহমান, ঙ, ঝ সব মেঝেয় বসে গেলেন। ঘরের আবছা আলোর বাতিটি জ্বেলে দেওয়া হল। আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে রইলেন শামসুর রাহমান, আমার একটি হাত তাঁর হাতে। এই হাতটি আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, আশ্বাস দিচ্ছে, এই হাতটি আমাকে নির্ভরতা দিচ্ছে, অভয় দিচ্ছে। আমরা দুজন কেউ কোনও কথা বলছি না। কেবল তাকিয়ে আছি দুজন দুজনের দিকে। আমাদের চোখে নিশ্চয়ই কোনও ভাষা আছে, যা আমরা পড়তে পারছি। আমরা তো জানি আমাদের কথা। আমরা তো জানি কি ঘটে যাচ্ছে আমাদের জীবনে। যুদ্ধক্ষেষেন পরাজিত দুজন সৈনিক যেমন করে নিজেদের দিকে তাকায়, যে সহমর্মিতা নিয়ে, যে উৎকণ্ঠা আর আশাহীন বেদনা নিয়ে, যে কষ্ট আর যন্ত্রণা নিয়ে, তেমন করে আমরা তাকিয়ে আছি। নীরবতা ভাঙলেন ঙ।
—যেদিন আমি শামসুর রাহমানকে বললাম তুমি কোথায় আছো তা আমি জানি, তারপর অনেকদিন তিনি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত আজ হল সুযোগ।
শামসুর রাহমান ধীরে মৃদু কণ্ঠে বললেন—তুমি কিছু মনে করো না সেদিনের সেই ফোন রেখে দেওয়ার জন্য। আমি খুব নার্ভাস ছিলাম।
আমি বললাম—রাহমান ভাই, আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। আমি খুব ভুল বুঝেছিলাম আপনাকে। আমার মাথার ঠিক ছিল না তখন!
—বুঝি। বুঝতে পারি সব।
একটু থেমে, আগের সেই ভুল বোঝাটিকে মন থেকে বিদেয় করি।
—কী হচ্ছে রাহমান ভাই এসব? এসব কী হচ্ছে দেশে?
—কি বলব বল। ভাষা নেই কিছু বলার।
—আমি কি বেঁচে থাকতে পারব রাহমান ভাই? নাকি ওরা আমাকে সত্যিই মেরে ফেলবে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন শামসুর রাহমান। চোখ তাঁর ছলছল করে।
—যদি ব্লাসফেমি আইন পাস হয়ে যায়!
—তাহলে আমাদের সবাইকেই মরতে হবে।
—এই যে মোল্লাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে এখন, এতে কি ঠেকানো যাবে না ব্লাসফেমি আইন?
—আন্দোলনে কতটুকু কাজ হবে জানি না। চেষ্টা তো করছি কিছু করতে। খালেদা জিয়ার সরকার দেশটাকে ধ্বংস করে দিল। মোল্লাদের পক্ষে কাজ করছে। তাই তো দেশসুদ্ধ যা ইচ্ছে তাই করছে মোল্লারা।
দেশ নিয়ে আমাদের আরও কথা হতে থাকে। রাজনীতির আরও গভীর আলোচনা হতে থাকে। ধীরে ধীরে এমন হয় যে আমি ভুলে যাই যে আমি এখন পলাতক, আমার সামনে ফাঁসির দড়ি। ভুলে যাই যে একটি ভয়াবহ অনিশ্চিত জীবন আমার। যেন আমি আগের আমি। আগের আমি যেমন করে শামসুর রাহমানের সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করতাম যে কোনও বিষয়ে, দেশ সমাজ রাজনীতি সাহিত্য সংস্কৃতি, তেমন গল্প করছি। দুচোখে স্বপ্ন আমাদের। সত্যিকার একটি গণতান্ত্রিক সেকুলার রাষ্ট্রের স্বপ্ন, বৈষম্যহীন একটি সুস্থ সমাজের স্বপ্ন। কোনও নির্যাতন নেই, অত্যাচার নেই, অন্যায় নেই, দুর্নীতি নেই, উৎপীড়ন নেই এমন জীবনের স্বপ্ন। হঠাৎ সেসব হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলো ফিরে আসতে থাকে আমার মধ্যে। নিজের ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে নিজের মৃত্যুভয়টি নিয়ে বেঁচে থাকা আমি অন্যরকম হয়ে উঠি। বেশিরকম আমি হয়ে উঠি। শামসুর রাহমান আমার প্রাণটি আমার দৃঢ়তাটুকু আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে যান। যান, যেতে হয় তাঁকে। যান অনেক রাতে।
সেই রাতেই ঝকে বলি, আমি ছবি আঁকব।
ঝ জিজ্ঞেস করলেন—ছবি আঁকতে জানো তুমি।
—জানি না কিন্তু চেষ্টা করব।
—কি ছবি আঁকবে?
—তোমাকে।
—আমাকে?
—তোমার একটি ছবি দাও।
ঝ একটি ক্যানভাস আর ছবি দিলেন। রঙ তুলি দিলেন। কি করে রং তুলিতে নিতে হয় শিখিয়ে দিলেন। আমি শুরু করে দিই। সারারাত আঁকি। যেন নতুন একটি জীবন আমার, এই জীবনের সঙ্গে গত প্রায় দুমাসের জীবনের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। যেন ইচ্ছে করলেই আমি ঘর থেকে বেরিয়ে কোথাও হেঁটে আসতে পারি। যেন কোথাও কেউ কখনও আমাকে মেরে ফেলার দাবি ওঠায় নি কোনওদিন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন