তসলিমা নাসরিন
তেইশ জুলাই, শনিবার
সারা দেশে ২৯ জুলাইএর লংমার্চ এবং মহাসমাবেশ সফল করার জন্য মিছিল হচ্ছে, সভা সমাবেশ হচ্ছে। এমনকি মসজিদগুলোয় বিশেষ মোনাজাত হচ্ছে। সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের গতকাল বায়তুল মোকাররম থেকে জুম্মার নামাজের পর মিছিল বের করে। নেতারা ঘোষণা করেছেন, ২৯ জুলাইয়ের আগে যদি সরকার তসলিমাকে ফাঁসি না দেন আর ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন না করেন, তবে ঢাকায় সেদিন মহাবিস্ফোরণ ঘটবে, ব্লাসফেমি আইন এদেশে কেউ ঠেকাতে পারবে না। আজ বাদ জোহর, বাদ আসর কেবল ঢাকায় নয়, সংগ্রাম পরিষদের নেতারা মানিকগঞ্জে যাচ্ছেন বক্তৃতা করতে, সাভারে যাচ্ছেন।
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকারমে গতকাল মসজিদের খতিব মাওলানা ওবায়দুর রহমান খুতবা পাঠ করেন, তসলিমা সহ সকল মুরতাদের ফাঁসি চাওয়া এখন প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব।
সুপ্রীম কোর্টের রায়ে গোলাম আযম এ দেশের নাগরিকত্ব পেয়ে গেছেন। তাঁকে অভিনন্দন জানাতে এখন লোক যাচ্ছে জামাতে ইসলামির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। এসোসিয়েশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশের প্রতিনিধিরাও তাঁকে অভিনন্দন জানাতে গিয়েছে। তাদের উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে গোলাম আযম বলেছেন, ইসলামকে বিজয়ীর আসনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রয়োজন সঙ্ঘবদ্ধ প্রচেষ্টার। আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করতে হলে যে যেখানে আছে, সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ২৮৮ ২৬ তারিখে চট্টগ্রামে গোলাম আযম জনসভা করবেন, জনসভাটি বিশাল এবং সফল করার জন্য জামাতে ইসলামী এখন চব্বিশঘন্টা ব্যস্ত। শক্তিশালী একটি মুল প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বারোটি সাবকমিটিও করা হয়েছে। পোস্টারিং, মাইকিং, যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা, প্রচার, আপ্যায়ন, নিরাপত্তাসহ নানা রকম সাব কমিটির কর্মীদের এখন দম ফেলার সময় নেই । গোলাম আযমের সভা হবে শুনে চট্টগ্রামের ছাত্রঐক্য বলছে, যে কোনও মূল্যে এই সভা ঠেকাবে তারা, প্রয়োজনে রক্ত ঝরবে।
গতকাল জুম্মার নামাজের পর ময়মনসিংহের বড় বাজারে সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের জনসভা হয়। ওতে বড় বড় নেতারা বড় বড় কথা বলেন। আনোয়ার জাহিদ বলেছেন, ধর্মদ্রোহী তসলিমা নাসরিন যদি দেশ থেকে পালিয়ে যায়, তবে সরকারকে এর জন্য কড়ায় গণ্ডায় হিসাব দিতে হবে। ভারত চায় না বাংলাদেশ মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে মাথা উঁচু করে টিকে থাকুক তাই ভারত তসলিমা গংদের লেলিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ কোরান রসুলের ওপর ভিত্তি করে টিকে আছে, থাকবে। ফজলুল হক আমিনী বলেছেন, এদেশের বারো কোটি মানুষ ভারতের দালাল নয়, এরা আল্লাহর দালাল। তৌহিদী জনতার আন্দোলনের মুখে ইসলাম বিরোধীরা ভেসে যাবে। আমিনী আওয়ামী লীগ, বিএনপি আর জাতীয় পার্টিকে কোরানের পক্ষের শক্তিকে সমর্থন করার আহবান জানিয়েছেন।
প্রধানও ময়মনসিংহে। প্রধান বলেছেন, ব্লাসফেমি আইন এই সংসদে পাস করতে হবে, তা না হলে জনগণ এই সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন সংসদ গঠন করে ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন করবে।
মেজর বজলুল হুদা বলেছেন, যারা কোরানের বিরুদ্ধে কথা বলে, তাদের ঠাঁই এই জমিনে হবে না, হতে পারে না।
বক্তাদের মধ্যে ঢাকার নেতারা তো আছেনই, মুসলিম লীগের এম এ হান্নানও ছিলেন। এম এ হান্নান ময়মনসিংহের লোক, মুসলীম লীগের নেতা। নতুন বাজারে এম এ হান্নানের বিশাল বাড়ি, তাঁর বাড়ির সামনের মাঠে অনেকগুলো বাড়ি করে ভাড়া দিয়েছেন তিনি, অনেক দোকানপাট; দোকানগুলোর কিছু বাবা পজিশন কিনে আরোগ্য বিতান দিয়েছেন, ওষুধের দোকান, নিজের একটি চেম্বারও করেছেন। যদিও মালিক এখনও হান্নানই। এই হান্নান আমাকে আমার বালিকা বয়স থেকে দেখছেন, তিনি আজ আমার ফাঁসির জন্য গলা ফাটাচ্ছেন। বক্তারা সকলেই মৌলিক পাঁচ দফা দাবি তো আছেই ওগুলোর সঙ্গে আরও কিছু দাবির কথা বলেন, তা হল গত হরতালের দিনে গ্রেফতারকৃত পাঁচ জন ছাষেনর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি, কিশোরগঞ্জের শহীদ আরমানের খুনীদের বিচার,তারাকান্দায় নিরীহ জনতার বিরুদ্ধে ব্র্যাকের মামলা প্রত্যাহারের দাবি।
আমার শহর ময়মনসিংহ আজ কাঁপছে মৌলবাদীদের চিৎকারে। জামাতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল কামরুজ্জামান জামাতে ইসলামির রুকন সম্মেলনে ময়মনসিংহের ইসলামি একাডেমিতে বলেছেন, সরকারের রহস্যময় ভূমিকা ও দুর্বলতার কারণেই বিদেশিরা আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানোর সাহস পাচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে দরিদ্র হতে পারে কিন্তু বিদেশি হস্তক্ষেপ কখনও বরদাস্ত করবে না। এ দেশের মানুষ জীবন দিয়ে হলেও কোরান ও ইসলামের মর্যাদা রক্ষা করবে। এই রুকন সম্মেলনেও এম এ হান্নান ছিলেন। বাবার দীর্ঘকালের বন্ধু এম এ হান্নান।
জনকণ্ঠের খবর, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কথা নয়, এদেশের বারো কোটি মানুষের কথা শুনতে হবে সরকারকে। কে বলেছেন? নিজামী। বলেছেন, ইউরোপীয় পত্রিকাগুলো তসলিমা নাসরিনের পক্ষে মতামত প্রকাশ করে এদেশে আন্দোলনের জন্য উস্কানি দিচ্ছে। বিপথগামী এক মহিলার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্ব স্ব দেশের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের মন্ত্রণালয়গুলোকে ব্যবহার করছে। ঢাকায় জামাতে ইসলামির জনসভায় নিজামী বলেন, গোটা বিশ্বকে ইহুদি গোষ্ঠী নাচাচ্ছে। তারা জানে তাদের পথের কাঁটা একমাত্র ইসলাম। ধর্মদ্রোহীদের বিচারের জন্য বিল আনা হয়েছে সংসদে, কিন্তু খালেদা সরকার সে বিল পাস করেনি। গণতান্ত্রিক সরকারকে গণতান্ত্রিকভাবে কাজ করতে হবে। ইউরোপীয় গোষ্ঠীর কথা না শুনে এদেশের বারো কোটি মানুষের কথা শুনতে হবে।
তসলিমা সম্পর্কে নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়। নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে আমি নাকি আমার নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ ত্যাগের চিন্তাভাবনা করছি। আগামী মাসে আমি নরওয়ের লেখক সম্মেলনে যোগ দিতে যাবো। জুলাইয়ের বারো তারিখে সুইডেনের এক রেডিও সাক্ষাৎকারে নরওয়ের পরারাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের একজন বলেছেন যে আমি এ মুহূর্তে কোনও দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার কথা ভাবছি না। বলেছেন আমাকে যারা আশ্রয় দিয়েছেন, তাদের সঙ্গে পরোক্ষভাবে যোগাযোগ রাখছেন নরওয়ে সরকার।
আমার প্রশ্ন হল আমি কি ভাবছি বা ভাবছি না তা নরওয়ের মন্ত্রণালয় কি করে জানে! কি করে তারা জানে যে আমি দেশ ত্যাগের চিন্তাভাবনা করছি। এরকম ভাবনা তো আমি ভাবছি না। বানিয়ে বলা! কূটনীতির ব্যাপার! নাকি সত্যিই কেউ আমার হয়ে যোগাযোগ করছে নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে। কার সঙ্গে যোগাযোগ আছে নরওয়ের সরকারের! ঙর সঙ্গে! ঙ অনেকদিন আসেন না, কোনও খবরই জানি না।
আরেকটি ভাল খবর ঝ দিলেন, ডাঃ এস এ মালেক, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের কলাম আজ ছাপা হয়েছে, লেখাটির শিরোনাম ফতোয়াবাজদের চিন্তা চেতনা। ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে লেখা। আমার প্রসঙ্গ টেনেছেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। তাঁর মূল কথা, তসলিমা নাসরিনের লেখায় বাড়াবাড়ি থাকতে পারে কিন্তু তারপরও অস্বীকার করার উপায় নেই যে সমাজ সংস্কারক হিসেবে তাঁর আবির্ভাব হয়েছে ..।
কবীর চৌধুরী আর সৈকত চৌধুরী আগের মত আমাকে চিঠি লিখছেন এমন করে কলাম লিখেছেন। মূলত আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে লেখাটি। আওয়ামী লীগ ২৭শে জুলাই পান্থপথে মহাসম্মেলন করতে যাচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে। আওয়ামী লীগের দরকার জামাতে ইসলামি আর জাতীয় পার্টিকে। এ সময় আওয়ামী লীগের ইচ্ছে নেই মৌলবাদী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে জামাতকে হারানো। কবীর চৌধুরীরা লিখেছেন, যুগে যুগে প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ শক্তি তখনই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যখন প্রগতির পক্ষের শক্তিগুলো কোনও না কোনও ছুতোয় ঐ ফ্যাসিস্ট অপশক্তির সাথে সমঝোতা করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, ইতিহাসে তার অজস্র নজির দেখতে পাওয়া যায়। আওয়ামী নেতৃত্ব কেন বুঝতে পারছেন না যে জামাতিদের সঙ্গে তাদের বর্তমান নৈকট্যের ফলে ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা গাছেরও খাচ্ছে, তলারও কুড়োচ্ছে। তারা একই সাথে সরকার পরিচালনার সার্থক দাবিদার এবং বিরোধীদলগুলোর অন্তর্ভুক্ত। এরা সুই হয়ে ঢোকে, ফাল হয়ে বেরুবে বলে। .. লেখাটির শুরু করেছেন, ‘তসলিমা, সকাল গড়িয়ে অন্ধকার নামলে রাত্রির বুকে মাথা রেখে তুমিও কি আমাদের মত ঘুমোবার আয়োজন কর? নাকি ব্যথাতুর চোখে কাটিয়ে দিচ্ছ বিনিদ্র রজনী?’ .. শেষ করেছেন এভাবে, ‘তসলিমা তুমি ঘুমোতে যাও। আমরাও ঘুমোবার আয়োজন করি। দেখি সাময়িক মৃত্যুর পথ পেরিয়ে আবার নতুন জাগরণে কোনও স্বপ্নকে প্রোথিত করে যেতে পারি কি না।’
মনে মনে বলি কবীর চৌধুরী আর সৈকত চৌধুরীকে, আমি ঘুমোতে পারি না, অনেকদিন ঘুমোতে পারি না। তাই ঘুমোবার আয়োজনও করি না কোনও রাতে। জেগে থাকি নিশাচর পাখির মত, পাখি ইচ্ছে করলে যে কোথাও উড়াল দিতে পারে, আমি পারি না। আমার না পারাগুলো নিয়ে আমি জেগে থাকি। রাতের পর রাত জেগে থাকি। যা ঘটছে প্রতিদিন এ দেশে, তা দেখে বিস্ময় জাগে, বিস্ময় আমাকে ঘুমোতে দেয় না। একটি কালো লোমশ আতঙ্ক আমাকে ঘুমোতে দেয় না।
ভাল খবর, মন্দ খবর। খবরের শেষ নেই। সব ফেলে আমি ইজেলের দিকে যাই। সারারাত ছবি আঁকি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন