তসলিমা নাসরিন
চব্বিশ জুন, শুক্রবার
গানের যন্ত্রটি পড়ে আছে হাতের নাগালে, হাতটি কতবার চলে যায় যন্ত্রের বোতামে। বোতাম থেকে বারবারই ফিরিয়ে নিয়ে আসি হাত। আমি এটি বাজাতে পারি না। কারণ যে ঘরে কেউ নেই, যে ঘরটি তালাবন্ধ, সে ঘরে হঠাৎ করে গান বাজতে পারে না। কতবার উঠে আনমনে দরজার কাছে চলে যেতে চাই, নিজেকে সামলে রাখি, শক্ত করে ধরে রাখি যেখানে আছি সেখানে। গরমে সেদ্ধ হচ্ছি, তবুও পাখাটি ছাড়তে পারি না, কিঁ কিঁ কিঁ করে একটি শব্দ হয় পাখা চলতে থাকলে, নিচতলায় না যাক, দোতলা থেকে যদি কান পাতলে শোনা যায় শব্দটি! আলোটি জ্বালতে পারি না, জ্বাললে দরজার ফাঁকে কারও চোখ পড়লে যদি বোঝা যায় যে আলো জ্বলছে ঘরটিতে। খাওয়া দাওয়া পানি পান কম বলে পেচ্ছ!ব পায়খানার ঝামেলা তেমন নেই, অন্তত এই ব্যাপারটি টয়লেট ফ্ল্যাশ করে শব্দ তৈরি করার ঝুঁকি থেকে নিস্তার দিয়েছে। এই প্রাকৃতিক কর্মগুলো আমি জমা রাখি ঝ যখন এসে এ ঘরে গানের যন্ত্রটি ছাড়বেন তখনের জন্য। শুয়ে থাকলে পাশ ফিরি সাবধানে, যেন শব্দ না হয়। পত্রিকার পাতা ওল্টাতেও সতর্কতা, যেন শব্দ না হয়। ঝ আমাকে নিজ দায়িত্বে এক নৈঃশ−ব্দ্যর জগত তৈরি করে নিতে বলেছেন। ঝ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন যে তিনি ছাড়া বাড়ির কেউ জানে না যে এঘরে কোনও প্রাণী আছে। সুতরাং আমাকে সেভাবেই এ ঘরটিতে বাস করতে হবে। প্রাণহীনের মত। প্রাণহীনের মত বেঁচে থেকে নিজের প্রাণটি বাঁচিয়ে রাখছি। আমাকে এখানে রেখে যাবার পর থেকে ক আর ঙর কোনও খবর নেই। জামিন আমার হচ্ছে কি হচ্ছে না, হলে কবে হবে, তার কিছুই জানি না। প্রতিদিন অপেক্ষা করি ক বা ঙ কোনও খবর নিয়ে আসবেন, কিন্তু কেউ আসেন না। ঝ নিজে যতটুকু পারছেন করছেন। তাঁর সাধ্য থাকলে আরও কিছু করতেন। যে মানুষটিকে হত্যা করার জন্য পুরো একটি দেশ ক্ষেপে উঠেছে, সেখানে খুব বেশি করার কিছু থাকে না।
দুপুরবেলা ঝ ভাত নিয়ে ঢুকলেন ঘরে। এক থালার মধ্যে ভাত তরকারি সব। ক্ষিধে পেতে পেতে একসময় ক্ষিধে মরে যায়। ক্লান্ত একটি ঝিমুনি ধরা শরীর পড়ে থাকে। প্রতিদিন আমি এভাবেই পড়ে থাকি। থালাটি মাঝখানে রেখে ঝ আসন করে বসে গেলেন মেঝেয়। আমাকে ডাকলেন ওই থালা থেকেই খেতে। ক্লান্ত শরীরটি উঠিয়ে নিয়ে না ধোয়া হাতেই ভাত ওঠাই মুখে। মনে হয় পুরো থালার ভাত বুঝি খেয়ে উঠতে পারব, কিন্তু দুতিন মুঠো খেয়ে আর পারি না। হাঁফিয়ে উঠি। গিলতে কষ্ট হয়। হাত ধুয়ে ফেলি। পানি দু ঢোক খেয়েই আর খেতে ইচ্ছে করে না। ঝ একটি গেলাস এ ঘরে রেখে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, পানি খেয়ো মাঝে মধ্যে, পানিটা দরকার। আমি নিজেও জানি পানি খাওয়া দরকার। কলের পানিতে কি রকম একটা ব্লিচিং পাউডার গন্ধ আসে। আমার শান্তিনগরের বাড়িতে সবসময় পানি ফুটিয়ে খাওয়া হয়। এখানে ফুটোনো পানি পাওয়া দুষ্কর। ঝ লুকিয়ে ভাত যে আনেন এ ঘরে, সেটিই অনেক। তাঁর কাছে ফুটোনো পানির আবদার করা বাড়াবাড়ি। ঝ সিগারেটের প্যাকেট ছুঁড়ে দেন আমার দিকে। সিগারেট ফুঁকে কাশি শুরু হলে গানের যন্ত্রটি ছেড়ে দেন। ঝর দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করি, ঙ কেন আসছেন না? ক কেন আসছেন না? আমার কি জামিন হবে না? ঝর কাছে এসব প্রশ্নের কোনও জবাব নেই।
–ঙকে কি একটা ফোন করবেন?
–এত অস্থির হচ্ছ কেন? ঙ বলেছেন, কোনও খবর জানলে তিনি ফোন করবেন। আমি চুপ হয়ে থাকি।
–আজকের পত্রিকাগুলো নিয়ে আসবেন? নীরবতা ভাঙি।
ঝ খাওয়া শেষ করে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বলেন, কাগজ কলম যে দিয়ে গেলাম, কিছু কি লিখেছো?
–না।
–কেন?
–লেখা আসে না।
–কেবল পত্রিকা পড়ে পড়ে টেনশান করো তুমি।
–কি হচ্ছে না হচ্ছে দেশে, জানতে ইচ্ছে করে।
–তা জেনে কী লাভ? এগুলো পড়লে খামোকাই মন খারাপ হবে। বসে বসে নিজের লেখা লেখো। আরও কাগজ লাগলে আমি কাগজ দিয়ে যাবো।
–কিছু কি জানেন খবর? কি হচ্ছে? জামিনের ব্যাপারে উকিল কি বলছেন, তা তো কেউ আমাকে জানাচ্ছে না। ক নিশ্চয়ই জানেন কিছু। ক কোনও খবর দিচ্ছেন না..
ঝ বললেন, বিদেশি অ্যামবেসিগুলো থেকে ৩০ জন অ্যামব্যাসাডার দেখা করেছে ফরেন সেক্রেটারি আর হোম সেক্রেটারির সাথে। তোমার সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন তাঁরা।
–আমার সম্পর্কে?
–হ্যাঁ তোমার সম্পর্কে। ইউরোপ আর আমেরিকার অ্যামবাসাডাররা জানতে চেয়েছেন তোমার ব্যাপারে সরকার কি করছে, তোমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা হচ্ছে না কেন!
–কি করে জানেন?
–অবজারভারে ছাপা হয়েছে।
–ও।
–মিনিস্ট্রি থেকে বলে দেওয়া হয়েছে যে তসলিমা আইনের বাইরে নয়। আইন থেকে পালিয়ে আছে সে, তাকে নিরাপত্তা দেয়ার প্রশ্ন ওঠে না। কিছু মুসলিম দেশের ডিপ্লোমেট আবার বলছে যে বাংলাদেশ সরকার যা করছে ঠিক করেছে, তসলিমার শাস্তি হওয়া উচিত।
তন্ময় হয়ে খবর শুনি ঝর মুখে।
–অ্যামবাসাডাররা যখন নাক গলাচ্ছেন তোমার ব্যাপারে, তখন নিশ্চয়ই ভাল কিছু একটা হবে। ওরা যদি বলে তোমাকে জামিন দিতে, জামিন হয়েও যেতে পারে। আমি বলি, সরকার এখন দেশ সামলাবে না বিদেশ সামলাবে? দেশ তো আগে।
–গরিব দেশের আবার দেশ আগে!
–মুসলিম দেশগুলোর কাছ থেকে তো অর্থনৈতিক সুবিধে পাচ্ছে। সৌদি আরবের কথাই ধরুন না, হাজার হাজার বাংলাদেশের লোক কাজ করে ওখানে, তার ওপর ওদের টাকায় বড় বড় এনজিও হয়েছে, হাসপাতাল হয়েছে। মুসলিম দেশের কথাই বা সরকার শুনবে না কেন!
–তাও কথা।
ঝ অনেকক্ষণ চুপ করে থাকেন। হঠাৎ উঠে যান। ঘণ্টাখানিক পর ফিরে আসেন হাতে দুটো পত্রিকা নিয়ে। একটি পত্রিকা লুফে নিই। ঝর হাতে আরেকটি।
হাজার হাজার মৌলবাদীর মিছিলের ছবি তো আছেই। আরেকটি ছবি আমাকে আমূল কাঁপিয়ে দেয়, সেটি হকার সংগ্রাম পরিষদের ছবি। গতকাল সাপ নিয়ে মিছিল করেছে হকাররা। ব্যানারে লেখা তসলিমা নাসরিন ও আহমদ শরীফসহ সকল ধর্মদ্রোহী রাষ্ট্রদ্রোহীদের ফাঁসি/ জনকণ্ঠসহ সকল ধর্মদ্রোহী পত্রিকা নিষিদ্ধ কর ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন কর/ ৩০ জুন দেশব্যাপী অর্ধদিবস হরতাল পালনের দাবিতে/ বিক্ষোভ মিছিল/ বাংলাদেশ হকার সংগ্রাম পরিষদ। সাপ নিয়ে মিছিল করা হকাররা সার্ট প্যান্ট পরা। কারও মুখে দাড়ি নেই, কারও মাথায় টুপি নেই। হকাররা বলেছে যদি তসলিমাকে ফাঁসি না দেওয়া হয়, তবে সারা শহরে তারা দশ লক্ষ বিষাক্ত সাপ ছেড়ে দেবে।
দেখেছেন খবরটা? ঝর দিকে বাড়িয়ে দিই কাগজ।
ঝ বলেন, আপনি আপনি করা ছাড়ো তো। তুমি বলে স−ম্বাধন কর। আপনি স−ম্বাধন আমার বিচ্ছিজ্ঞর লাগে।
কি কাণ্ড! হঠাৎ করে এখন তাঁকে কি করে আমি তুমি বলি! তুমি বলার চেয়ে ভাববাচ্যে কথা চালিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সুবিধের।
–ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক এলায়েন্সের মহাসচিব আনোয়ার জাহিদ বলেছেন, হরতাল প্রতিহতকারীদের দাঁতভাঙা জবাব দিতে হবে। ভাবা যায়! আনোয়ার জাহিদ কি করে মৌলবাদীদের সঙ্গে মিশে গেলেন!
ঝ শুনে বললেন, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি জাগপার নেতা শফিউল আলম প্রধানও তো ভিড়েছে গিয়ে ওই দলে।
–কি রকম অবাক করা কাণ্ড ঘটছে দেশে!
–এদের কোনও চরিত্র নেই। এরা যে দিকে দেখে ঢেউ, সেদিকেই পাল তোলে।
–এ সময় আওয়ামী লীগ কি করছে? তারা কি আন্দোলনে নামবে না?
–ছাত্রলীগের ছেলেপেলেরা তো ক্ষেপে আছে আওয়ামী লীগের নেতাদের দিকে। ছাত্রদের মধ্যে এখনও কিছু আদর্শ অবশিষ্ট আছে। তারা পথে নেমেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনে নামার কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
–এরকম আগে কখনও শুনিনি। সাধারণত আওয়ামী লীগ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে ছাত্রলীগ তা অনুসরণ করে।
–বিদঘুটে অবস্থা।
–আমার মনে হয় না এত বড় মৌলবাদী দলের বিরুদ্ধে কেবল ছোট ছোট দল বাসদ জাসদ, ছাত্ররা আর সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক কর্মীরা পেরে উঠবে।
নিচে ফোন বাজছে। ঝ দ্রুত উঠে চলে যান। ঝর অপেক্ষায় বসে থাকি, ফোন সেরে তিনি ফিরে আসবেন এ ঘরে, এই অপেক্ষা। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও ঝর পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় না। ঝ কি একবার আসবেন না! একবার অন্তত! মেঝেতে শুয়ে পড়ি পত্রিকা খুলে। দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদকীয়টির শিরোনাম পশ্চিম ও তসলিমারা। ক্লান্ত চোখদুটো সম্পাদকীয়টিতে। ‘মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার প্রতি বিশ্ববাসীর সচেতনতা ক্রমশই বাড়ছে, এটা অত্যন্ত সুলক্ষণ। অন্যায়ভাবে, বেআইনীভাবে এক মানুষ আরেক মানুষের ওপর নির্যাতন করবে কিংবা এক গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ণ চালাবে এটা হওয়া উচিত নয় এবং তা হতে দেওয়াও উচিত নয়। এদিক থেকে যখন আমরা কাউকে কিংবা কোনও মানবাধিকার সংস্থাকে বা কোনও পত্র পত্রিকাকে মানবাধিকারের পক্ষে সোচ্চার হতে দেখি, তখন তাকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু ইদানীং মানবাধিকার রক্ষার নামে এমনসব অবিবেচক অর্বাচীন তৎপরতা চালানো হচ্ছে যা প্রকৃতপক্ষে মানবাধিকারেরই পরিপন্থী হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে এই অপতৎপরতা আজ খুব বেশী চলছে। তারা এমনসব কথা বলছে যাতে মনে হয় খুনীকে ফাঁসি দেওয়া যাবে না এবং অপরাধীর গায়ে হাত দেওয়াও অন্যায় হবে। জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হিসেবে তসলিমা নাসরিনের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। তিনি এখন পলাতক। পুলিশ তাকে ধরার জন্য চেষ্টা করছে। পশ্চিমা দৃষ্টিতে এটা নাকি ভীষণ অন্যায়। মানবাধিকারের দারুণ খেলাফ। এটা নাকি কারও মুখ বন্ধ করার শামিল। এ ধরনের কথা লেখা হচ্ছে ওয়াশিংটন পোস্টের মত কাগজে ডবল কলাম হেডিং এ। শুধু পত্রিকায় লেখাই নয়, রীতিমত ঝড় তোলা হয়েছে অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত তসলিমা নাসরিনের পক্ষে। যার জন্যে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে শেষ পর্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করতে হয়েছে। দুর্বল দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলে তসলিমা নাসরিনের নাম পর্যন্ত উল্লেখ না করে শুধু এইটুকু বলেছে যে দেশের আইনে সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত ও সমুন্নত রাখার বিধান রয়েছে। কোনও ব্যক্তি পলাতক অবস্থায় আইনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে অবশ্যই আইনগত নিরাপত্তা দাবি করতে পারে না। এর দ্বারা আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন, তসলিমা নাসরিন আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করে সকল নাগরিকের মতই আইনের সহযোগিতা ও নিরাপত্তা লাভ করতে পারেন। কিন্তু তসলিমা নাসরিন তা করছেন না। কারণ অপরাধীরা আইনকে ভয় পাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পশ্চিমা অপপ্রচারকারীরা এই সাদা কথাটা বোঝেন না, এটাই চরম বিস্ময়ের ব্যাপার। অথচ আমরা জানি, পশ্চিমা কোনও দেশেই, বিশেষ করে মানবাধিকারের পক্ষে সোচ্চার দেশগুলোতে, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অপরাধীদেরকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হয় না। এই তো সেদিন খুনের দায়ে অভিযুক্ত সাবেক ফুটবলার ও জে সিম্পসনকে ধরার জন্য পুলিশ জল স্থল আকাশ জুড়ে কী অভিযানই না পরিচালনা করল। সব দোষই দোষ, সব অপরাধই অপরাধ। ও জে সিম্পসন দুজন মানুষকে খুন করেছেন আর তসলিমা নাসরিন খুন করেছেন কোটি কোটি হৃদয়কে। কোটি কোটি হৃদয়ের যন্ত্রণা থেকেই তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে মামলা এবং তাকে ধরার প্রচেষ্টা। ও জে সিম্পসনের মতই সে ক্রিমিনাল। ও জে সিম্পসনকে ধরার জন্য যদি মার্কিন পুলিশ তার পিছু নিতে পারে, তাহলে তসলিমা নাসরিনকে ধরার জন্যও বাংলাদেশের পুলিশ চেষ্টা করতে পারে। এই প্রচেষ্টায় বাধ সাধার অর্থ মানবাধিকারের বিরুদ্ধাচরণ করা। আমরা মনে করি, পশ্চিমারা তসলিমা নাসরিনের মত লেখকদের পক্ষে যে তৎপরতাই চালাক তার সব কিছুই মানবাধিকারের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বস্তুত পশ্চিমা কিছু দেশ এই ক্ষেষেন অজ্ঞতার কারণেই হোক কিংবা বিদ্বেষদুষ্ট হয়েই হোক দ্বিমুখী নীতি অনুসরণ করছে। তারা তাদের আইন প্রয়োগ করলে দোষ নেই, কিন্তু আমরা আমাদের আইন প্রয়োগ করতে পারব না। পশ্চিমাদের এই দ্বিমুখীতার মূলে, আমাদের মতে, বিদ্বেষের চেয়ে অজ্ঞতাই বেশি কাজ করছে। তারা তাদের আইন ও মূল্যবোধকে যতটা বোঝেন, আমাদের আইন ও মূল্যবোধ সম্পর্কে ততটাই অজ্ঞ। কিন্তু তাদের অজ্ঞতা এতটা গভীর হতে পারে তা আমাদের বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। আমরা একটা জাতি। আমাদের একটা ধর্ম আছে, আদর্শ আছে। সেই ধর্ম ও আদর্শ অনুসারে বিচার, সামাজিকতা ও জীবন পরিচালনার জন্য স্বতন্ত্র বিধান রয়েছে, যেগুলোকে বাদ দিলে আমরা তখন আর কোনও জাতি থাকি না। আমাদের জাতির সদস্য যারা, তারা আমাদের আদর্শ ও আইনের অধীন। তসলিমাও তাই। এই তসলিমা অপরাধ করলে তার বিচার আমাদের আদর্শ আইনের মাধ্যমেই হবে, মার্কিন কিংবা অন্য কোনও দেশের আইন ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে নয়। আমাদের এই জাতিগত অধিকারকে জাতিসংঘ সনদও নিশ্চিত করেছে। সুতরাং পশ্চিমা দেশগুলো যখন আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে, তখন তারা শুধু জাতিগত অধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনই নয়, জাতিসংঘের সনদও পদদলিত করে। আমরা এই বিষয়টির দিতে পশ্চিমের সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমাদের তসলিমা নাসরিনদের মত ঘটনায় নাক না গলাবার জন্য তাদের প্রতি আহবান জানাই।’
ভাবি নাক গলালেই বা লাভ কি! আমাকে যে কোনও দিন খুঁজে পেয়ে যাবে পুলিশ অথবা মোল্লার দল। জেলে দেবে অথবা ফাঁসি দেবে। জেলের ভেতরে অথবা বাইরে যে কোনও জায়গায় খুন হব উন্মাদ মোল্লাদের হাতে। নিজের ভবিষ্যতটি আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি। পালিয়ে কতদিন বেঁচে থাকতে পারব! বিশাল বিশাল লাঠি হাতে মিছিল হচ্ছে, ওরকম একটি লাঠির একটি ঘা মাথায় খেলেই তো মরে পড়ে থাকব! জীবন আমার ফুরিয়েছে, বুঝি, যতই খোপের মধ্যে বসে থাকি না কেন! জীবনটির জন্য মায়া হতে থাকে! খামোকা ক, ঙ আর ঝ কে কষ্ট দেওয়া। তার চেয়ে নেমে পড়ি রাস্তায়। বলি যে এই আমি, আমাকে যা ইচ্ছে করার তোমাদের কর, করবেই যখন, এখনই কর। এভাবে ইঁদুরের মত বেঁচে থাকতে আর ইচ্ছে করে না, তার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল। একটি অদৃশ্য মৃত্যু এসে আমার পাশে শোয়। আমি মৃত্যুটিকে দেখতে থাকি। মৃত্যুর আপাদমস্তক দেখি, মৃত্যুর স্বাদ গন্ধ নিই। মৃত্যুকে খুব চেনা চেনা লাগে। এই মৃত্যু কতবার যে কাছে এসেছে আমার, কতবার যে পাশে বসে থেকেছে, পাশে শুয়েছে।’
৩০ জুনের হরতাল প্রতিরোধের শক্তি কারও নেই — গতকাল কয়েকশ সভায় সমাবেশে এই বাক্যটি বার বার উচ্চারিত হয়েছে। মুসলমানের এই দেশে কোরানের ইজ্জত রক্ষার জন্য এই হরতাল হচ্ছে। কারও শক্তি নেই হরতাল থামায়। ধর্ম ও দেশদ্রোহিতা নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত তারা প্রয়োজনে রক্ত দিয়ে হলেও আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুয়ত বাংলাদেশ এর সদর দফতরে জরুরি সভা হচ্ছে। মুসলিম লীগ বলেছে, পবিত্র কোরান, ইসলাম ও মুসলমানদের ইজ্জত রক্ষার জন্য এই হরতাল। শায়খুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক বলে বেড়াচ্ছেন, এই হরতালের সঙ্গে দলীয় রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই, সর্বস্তরের জনগণ এই আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে। ছাত্র শিবির সর্বস্তরের ইসলাম বিশ্বাসী ছাত্র জনতাকে এই আন্দোলনে যোগ দিতে বলছে। মাদ্রাসার ইমামরা বলছেন, হরতাল প্রতিহত করতে কোনও নাস্তিক বা ধর্মনিরপেক্ষবাদী ময়দানে এলে তাদেরকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হবে। নাস্তিকরা বাংলাদেশের সকল ধর্মের, জনগণের শষনু। সবাইকে ধর্ম রক্ষার জন্য জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। ইসলামের ইজ্জত রক্ষায় আমরা শহীদ হতে চাই। সরকার এখনও কুলাঙ্গার তসলিমাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। এই সরকারের ক্ষমতায় থাকার কোনও অধিকার নেই। আমরা আইন তুলে নিতে চাই না, কিন্তু সরকার যদি তাকে গ্রেফতার না করে তবে আমাদের যুবকরা কোনও পদক্ষেপ নিলে সে জন্য সরকারকেই দায়ি থাকতে হবে। ইসলামের প্রশ্নে কোনও আপোস নেই। জাগপা বিক্ষোভ মিছিল করেছে শহরে, ঐতিহাসিক পলাশী দিবস উদযাপন করা হয়েছে, শফিউল আলম প্রধান বলেছেন, জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে এখনই নব্য মীরজাফর, উমিচাঁদ ও ঘসেটি বেগমদের আস্তানা কাশিম বাজার কুঠিতে আঘাত হানতে হবে। ২৩ বছর পর আবারও জাতীয় পুনর্জাগরণ শুরু হয়েছে। ৩০ তারিখের হরতাল কোনও গদি দখল বা হালুয়া রুটির হরতাল নয়। এ হরতাল ধর্মীয় স্বাধীনতা ও জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষার জন্য। এটা পবিত্র কোরানের মর্যাদা রক্ষার হরতাল। ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে আজাদী পাগল জনতার হরতাল। জানবাজী রেখেও এই সংগ্রাম সফল করতে হবে। এবার হরতাল প্রতিরোধ করতে যাদের মাঠে নামানো হয়েছে দেশবাসী তাদের চেনে। ক্ষমতাসীন দিল্লী লবিকে সতর্ক করে দিয়ে প্রধান বলেছেন, ‘ভারতীয় রাজাকারদের মাঠে নামিয়ে স্বাধীনচেতা ধর্মপ্রাণ মানুষের এ গণবিস্ফোরণকে দাবিয়ে দেয়া যাবে না। তসলিমাগংদের বিচার চাই। তবে যে নেপথ্য শক্তি তসলিমাদের নির্মাণ করে, যে হুকুমত ও কানুন দেশদ্রোহী ধর্মদ্রোহী শক্তিকে প্রশ্রয় দেয় ও লালন করে, দেশপ্রেমিক জনতা এবার তাদের শেকড়ও উপড়ে ফেলবে। দেশপ্রেমিকদের কর্তব্য দেশ বিক্রেতা গাদ্দার ও ধর্মদ্রোহীদের বিষদাঁত চিরতরে ভেঙে দেয়া। পলাশীর পুনরাবৃত্তি আর হতে দেয়া হবে না।’ জাতীয় যুব কমাণ্ড সারা দেশে সন্ত্রাস করে বেড়াচ্ছে, এই দলও শহরে বড় বড় সভা করে বলছে, ‘যারা আমাদের দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনৈতিক বেসাতিতে লিপ্ত রয়েছে, তাদেরকে দেশপ্রেমিক জনতার পক্ষ থেকে প্রতিরোধ করতে হবে। কেননা এরা দেশের প্রকাশ্য শষনুর চেয়েও বিষাক্ত। ৩০ জুনের হরতালে যারা বাধা দেয়ার হুমকি দিচ্ছে তারাই স্বাধীনতার অপ্রকাশ্য দুষমন। তারা স্বাধীনতার স্বপক্ষের নামে সেই তসলিমাকে রক্ষা করতে চায়, যে তসলিমা বাংলাদেশকে শুয়োরের বাচ্চা বলে গালি দিয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের সীমানাকে রাবার দিয়ে মুছে ফেলার কথাও ঘোষণা করেছে।’
জানি না কখন পত্রিকা আমার হাত থেকে খসে পড়ে, জানি না কখন এক শরীর অবসাদ আমাকে নিস্তেজ করে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। এ কি ঘুম নাকি অন্য কিছ ! বার বার চমকে চমকে উঠি। ঘুম বা ওই অবসাদের ঘোরের মধ্যে দেখি আমার চারদিকে কিলবিল করছে সাপ। সাপ সাপ আর সাপ। বিষধর সব সাপ। হঠাৎ শরীরে সাপ উঠে আসে, আমি লাফিয়ে উঠি, চেয়ে দেখি আমাকে ছুঁয়ে আছেন ঝ। ঝ বললেন, কি হয়েছে তোমার? কাতরাচ্ছিলে ঘুমের মধ্যে।
–আমি ঘুমিয়েছিলাম?
কিঁ কিঁ করা পাখার চলার মধ্যেও আমি ঘেমে ভিজে উঠেছি।
–কি কাণ্ড, দেখতো! ঝ সিগারেটের একটি প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এটা রাখো তোমার কাছে। টেনশন হলে খাবে।
–রাত কত?
–দেড়টা বাজে। ঝ নাক কুঁচকে বললেন, এ বাড়িতে একদিনও তুমি গোসল করেছো?
–না।
–কেন করোনি? সেই যে জামাটা পরে আছো, এটা তো পাল্টাচ্ছে! না।
–কল ছাড়লে শব্দ হয় বলে ..
–ঠিক আছে। আমি এখন আছি এখানে। গান ছেড়ে দিচ্ছি। তুমি গোসল করে জামা পাল্টাও। তোমার গা থেকে জামা থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে।
ঝর আদেশ মেনে আমি শরীরটি উঠিয়ে গোসলখানায় নিই। আয়নায় নিজেকে দেখে চেনা যায় না। চোখের নিচে কালি, মাথার চুলগুলো আঠা আঠা, জট বাঁধা।
শরীরটিকে জলের নিচে ফেলি। ইচ্ছে করে না গোসল করতে। কী লাভ গোসল করে, গা পরিষ্কার থেকে। মরে গেলে এই শরীর দিয়ে দিয়ে কী হবে! নিজের জন্য নয়, গোসলটি আমি ঝর জন্য করি। গায়ের ঘামের গন্ধ দূর করে যখন ফিরি ঝ বললেন, চল ছাদে যাবে আমার সঙ্গে।
–ছাদে? বল কি! কেউ যদি দেখে ফেলে!
ঝকে এত আপন মনে হয় যে বলেই ফেলি তাঁকে তুমি।
–চল। এই রাতে কেউ টের পাবে না।
ঝ বারান্দার দরজা খুলে আমাকে নিয়ে ছাদে উঠলেন। ছাদে ওঠা মানে সিঁড়ি বেয়ে কোনও সত্যিকার ছাদে ওঠা নয়। টালির খাড়া ছাদে বেয়ে ওঠা। টাল সামলাতে না পারলে পড়ে গিয়ে ভর্তা হতে হবে। ঝ তরতর করে বেয়ে ওঠেন। অন্ধকারে পেছন পেছন আমি। ছাদে বসে তারা ভরা আকাশ দেখি। কতকাল আকাশ দেখি না। কতকাল তারা দেখি না। মরে গেলে, কে যেন বলেছিল, মানুষ আকাশের তারা হয়ে যায়। আমিও কি একটি ছোট্ট তারা হয়ে আমার দেশটিকে দেখব! তারা হয়ে দেখি টালির ছাদের ওপর বসে থাকা আমাকে, এক বিন্দু আমাকে। বুক ভরে শ্বাস নিই। গরমের রাতে অবকাশের ছাদে উঠে হাওয়া খেতে কি যে ভাল লাগত। আমার জীবন থেকে অবকাশ, শান্তিনগর, বাবা মা, ভাইবোন, বন্ধুবান্ধব,সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক জগত সব হারিয়ে গেল। আমি এখন পলাতক আসামী। যে কোনও মুহূর্তে আমাকে খুন করা হবে। এই এত সুন্দর এত আশ্চর্য সুন্দর পৃথিবীটিতে আমি আর বেঁচে থাকতে পারব না। আমাকে বেঁচে থাকতে কেউ দেবে না। একবার মরে গেলে আমি তো আর কখনও কিছুতেই আবার ফিরে আসতে পারব না এই পৃথিবীর কোথাও। আমি মরে গেলে পৃথিবী যেমন চলছে, তেমন চলতে থাকবে। সবাই থাকবে, কেবল আমিই থাকব না। প্রতিরাতে এরকম আকাশে তারা ফুটবে, কেউ কেউ রাত জেগে তারা দেখবে এই আমি যেমন দেখছি, কেবল আমিই আর দেখব না। গ্রীষ্ম গিয়ে বর্ষা আসবে, বৃষ্টির রিমিঝিমি শব্দ আর কোনওদিন শুনব না, মার রান্না করা ভুনা খিচুরি আর ইলিশ ভাজাও আর খাওয়া হবে না। শরতের আকাশের আশ্চর্য সুন্দর মেঘও আমার আর দেখা হবে না। শীত আসবে, চারদিকে উৎসব শুরু হবে, ভোরের শিউলি ফুলের ঘ্রাণ নেব না, ছোটবেলার মত ভাপা পিঠে আমার আর খাওয়া হবে না, বসন্তে ফুল ফুটবে, কৃষ্ণচুড়ার লালে ছেয়ে যাবে দেশ, দেখা হবে না আমার। মৃত্যু এত ভয়ংকর কেন, এত জঘন্য কেন, এত নিষ্ঠুর কেন! হঠাৎ ছাদে বসে গায়ে ঝিরিঝিরি হাওয়া পেতে পেতে আমার এত ভাল লাগে যে আমার মরতে ইচ্ছে করে না। ঝ কে বলি, আমার মরতে ইচ্ছে করছে না।
ঝ এগিয়ে এসে আমার একটি হাত স্পর্শ করেন। ঝর হাতটি আমি শক্ত করে চেপে ধরি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন