৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৪

তসলিমা নাসরিন

সাত জুলাই, বৃহস্পতিবার

ট তাঁর বৈঠক ঘরের দরজা বন্ধ করে কথা বলেন। একা তিনি, কথা কার সঙ্গে বলেন তবে! অনুমান করি তিনি ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছেন। ফোন বাজেনি, কিন্তু কথা বলছেন ফোনে। এর অর্থ চাবি দিয়ে তালাটি খুলে তিনি কথা বলছেন। ট যে আমার কাছে মিথ্যে কথা বলেছেন ফোনের চাবি হারিয়ে গেছে, সেটি বলে তাঁকে লজ্জা দিতে ইচ্ছে করে না। আমি যেন শুনিনি ফোনে তিনি কথা বলছেন, যেন বুঝতে পারিনি কিছু, এমন ভাব করে থাকি যখন তিনি দরজাটি খুলে আমাকে ডাকেন ওই ঘরে, এবং আমি যাই। তিনি আমাকে বলেন, একা একা বসে থাকতে খারাপ লাগলে আমি যেন এ ঘরে এসে বই টই পড়ি। আমাকে ও ঘরে বসিয়ে তিনি কতগুলো ছবি তুললেন। ছবি তোলা তাঁর শখ। বেশ ভাল ছবি তোলেন। বড় বড় ক্যামেরা আছে তাঁর। ট মানুষটি খুব আধুনিক। ঘরে তাঁর একটি কমপিউটার আছে, ওতে তিনি ইলেকট্রনিক মেইলএর একটি ব্যবস্থা করতে চাইছেন। লন্ডনে তাঁর বান্ধবীর কাছে সেকেণ্ডের মধ্যে তিনি চিঠি পাঠিয়ে দিতে পারেন। আবার পৃথিবীর যে কোনও দেশ থেকেও তাঁর কাছে এক সেকেণ্ডেই কোনও খবর বা চিঠি চলে আসতে পারে। আজকাল নাকি মানুষের মধ্যে যোগাযোগের পথ আশ্চর্য রকম সহজ হয়ে যাচ্ছে।

দুপুরে ভাত নিয়ে নীলাম্বরী রুমানা আসেন। রুমানা টর বান্ধবীর বান্ধবী, আবার করও বান্ধবী। রুমানা খুব অসংকোচে নিজের জীবনের কথা বলেন। বিয়ে করেছিলেন, স্বামী তাঁকে আরও লেখাপড়া করতে দিতে চায়নি, চাকরি করতে দিতে চায়নি। স্বামী চাইত তার আদেশমত স্ত্রী চলবে। শেষে তিনি স্বামীকে তালাক দিয়ে নিজে এখন একা থাকেন। একটি ইশকুলে পড়ান। বেশ ভাল আছেন। কিন্তু মাঝে মাঝে নিঃসঙ্গতা তাঁকে অস্থির করে, কিন্তু তবুও তো তিনি কারওর দাসী বাদি হয়ে জীবন যাপন করছেন না, এটিই অনেক বড় তৃপ্তি তাঁর। একটি জিনিস লক্ষ করেছি আমার জীবনের কোনও গল্প শুনতে কেউ ইচ্ছে প্রকাশ করে না। সম্ভবত এ কারণেই করে না যে তারা পত্র পত্রিকায় পড়েছে আমার ব্যক্তিগত জীবনের কাহিনী অথবা কারও মুখে শুনেছে, সুতরাং তাদের জানার আর কোনও আগ্রহ নেই। কিন্তু যা পড়েছে বা শুনেছে তা সত্য কি না, তাও কেউ একবার যাচাই করতে চায় না। আমার মনে হয় চায় না এই জন্য যে মনে করে আমি অস্বস্তি বোধ করব, যেহেতু আমার জীবনে একাধিক সম্পর্কের ঘটনা আছে। অনেকে, যারা আমার পক্ষের লোক, তারাও আমার ব্যক্তিজীবন নিয়ে এমনই অস্বস্তিতে পড়ে যে তারা আমার পক্ষে তর্ক করতে গিয়ে বলে, ব্যক্তিজীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির দরকার কি, ব্যক্তিচরিত্র যেমনই হোক, এক জন লেখকের বিচার হবে কেমন সে লেখে তা দিয়ে। ব্যক্তি জীবনে, যেহেতু আমি একাধিক বিয়ে করেছি, তাই আমার চরিত্র ভাল নয়, এ ব্যাপারটি মনে মনে আমার অনেক পক্ষের লোকেরাও মানেন। চরিত্র খারাপ হলেই একটি মেয়ে একাধিক বিয়ে করে এই ধারণাটি আমাদের বড় বড় প্রগতিশীলদের মস্তিষ্কের একটি গোপন কোণে অজান্তে লুকিয়ে থাকে। যারা আমার লেখার পক্ষে অন্যের সঙ্গে তর্ক করে, কাউকেই আমার ব্যক্তিজীবনের পক্ষে, আমার পুরুষ-সম্পর্কের পক্ষে একটি শব্দ উচ্চারণ করতে শুনিনি।

আজ রুমানা আমার কাছে অবলীলায় তাঁর নিজের জীবনের কথা বলেছেন এর পেছনে দুটো কারণ আছে বলে আমার মনে হয়, একটি হল আমি নির্যাতিতা মেয়েদের পক্ষে লিখি, তাই তিনি ভেবেছেন আমার সঙ্গে আধ ঘণ্টার পরিচয়েই বলে ফেলা যায় তাঁর জীবনের গোপন সব কথা। আর একটি কারণ, যেহেতু আমিও তালাক দিয়েছি আমার স্বামীকে, তাই আমি তাঁর নিজের তালাকের ঘটনা শুনে জিভ কেটে বলে উঠব না, কি কাণ্ড কি কাণ্ড। তালাক ব্যাপারটিকে অতি স্বাভাবিক একটি ব্যাপার বলেই মেনে নেব। রুমানা তাঁর নিঃসঙ্গতার কথাও বলেন। নিঃসঙ্গতার কারণে তাঁর অস্থিরতার কথা। এটিকেও তিনি, আমার ধারণা, ভেবেছেন, নিঃসঙ্গতা বোধ আমারও আছে, ফলে আমি তাঁর নিঃসঙ্গতার রূপটি বুঝতে পারব। রুমানার প্রতিটি শব্দ আমি মন দিয়ে শুনি। কত কত মেয়ের কথাও তো এমন শুনেছি। আমাকে যে মেয়েরা তাদের ব্যক্তিগত কষ্টের কথা, দুঃখের কথা, যন্ত্রণার কথা, জীবনের পরাজয়ের কথা নিঃস−ঙ্কাচে বলে যায়, জানি তারা আমার কাছে কোনও একটি উত্তর চায়, কি করবে জীবনে, কী তাদের করা উচিত তার পরামর্শ চায়। কিন্তু আমি তো পরামর্শ দিতে পারি না। রহিমা সিদ্দিকীর সংসার সুখের ছিল না, তাঁর পাশা নামের স্বামীটি বড় বিচ্ছিজ্ঞর চরিষেনর ছিল, স্বামীর যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ রহিমা সিদ্দিকী যখন জিজ্ঞেস করতেন আমাকে, নাসরিন এখন বল আমি কি করব! আমি খুব বিপদে পড়তাম। জানি অন্য অনেকে এসব ক্ষেষেন খুব চমৎকার চমৎকার পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু আমি পারি না। আমার কেবল মনে হত, রহিমা সিদ্দিকীকে আমি বলে দেবার কে তিনি কি করবেন! তিনি নিজেই বুঝবেন তিনি কি করবেন। তাঁর যা ইচ্ছে করে তাঁর তো তাই করা উচিত। অনেকে যারা সমস্যার সমাধান চাইত, বলতাম, তোমার বা আপনার যা ইচ্ছে করে তাই কর বা করুন। আমার উত্তর কাউকে খুব সুখী করেছে বলে আমার মনে হয়নি।

রুমানা আমার কাছে কোনও পরামর্শ চান না। লুকিয়ে থাকা মানুষ সাধারণত দুর্বল হয়, দুর্বল মানুষের কাছে কেউ পরামর্শ চায় না। আমি নিজেই তো পরামর্শ চেয়ে বেড়াচ্ছি এখন। যেমন ক-কে পেলেই জিজ্ঞেস করি, কি করব? ক-কে আমার খুব শক্তিমান বলে মনে হয়। ক বলেন, ‘পালিয়ে যান, অথবা লুকিয়ে থাকুন। আপাতত এ দুটো ছাড়া আপনার আর করার কিছু নেই।’ আমার ইচ্ছে এখন এমনই সীমিত যে আমার যা ইচ্ছে করে তা আমি করতে পারি না। আমার এখন মনে হয়, মেয়েরা যখন পরামর্শ চাইত আমার কাছে, তাদের ইচ্ছেও খুব সীমিত থাকত বোধহয়। যা ইচ্ছে তাই করতে কজন মেয়ে আর পারে।

রুমানার সঙ্গে আমার সারাদিন কেটে যায়। কাল রাতে তিনি দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সেঁটেছেন বন্ধুদের নিয়ে। ফতোয়াবাজ নিপাত যাক স্লোগান লেখা পোস্টার। রুমানার মত আমারও ইচ্ছে করে পোস্টার সাঁটতে, মিছিলে যেতে। আমারও ইচ্ছে করে মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনের একজন কেউ হতে। কিন্তু সে ক্ষমতা আমার নেই।

সকল অধ্যায়

১. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০১
২. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০২
৩. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৩
৪. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৪
৫. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৫
৬. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৬
৭. ২. তাণ্ডব – ০১
৮. ২. তাণ্ডব – ০২
৯. ২. তাণ্ডব – ০৩
১০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০১
১১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০২
১২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৩
১৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৪
১৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৫
১৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৬
১৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৭
১৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৮
১৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৯
১৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১০
২০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১১
২১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১২
২২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৩
২৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৪
২৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৫
২৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৬
২৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৭
২৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৮
২৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৯
২৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২০
৩০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২১
৩১. ৪. দেশান্তর – ১
৩২. ৪. দেশান্তর – ২
৩৩. ৪. দেশান্তর – ৩
৩৪. ৪. দেশান্তর – ৪ (শেষ)
৩৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২২
৩৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৩
৩৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৪
৩৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৫
৩৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৬
৪০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৭
৪১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৮
৪২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৯
৪৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩০
৪৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩১
৪৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩২
৪৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৩
৪৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৪
৪৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৫
৪৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৬
৫০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৭
৫১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৮
৫২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৯
৫৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪০
৫৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪১
৫৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪২
৫৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৩
৫৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৪
৫৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৫
৫৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৬
৬০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৭
৬১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৮
৬২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৯
৬৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫০
৬৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫১
৬৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫২
৬৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৩
৬৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৪
৬৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৫
৬৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৬
৭০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৭
৭১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৮
৭২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৯
৭৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬০
৭৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬১
৭৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬২

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন