তসলিমা নাসরিন
সতেরো জুলাই, রবিবার
খবরের তো শেষ নেই। প্রতিদিনই ঘটনা, প্রতিদিনই খবর। তসলিমা নাসরিনদের সংস্কৃতি দেশ ও সমাজকে কলুষুষতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে —- এই শিরোনামটিতে নজর পড়ে। ঘটনাটি কি? ঘটনা হল পূর্তমন্ত্রী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে মাদকবিরোধী এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দিয়েছেন। কিন্তু মাদকবিরোধী অনুষ্ঠানে তসলিমা-প্রসঙ্গ কি করে ওঠে? ওঠে। ওঠাতে চাইলেই ওঠে। দেশের সর্বত্র যখন এই প্রসঙ্গ যে কোনও কিছুতেই উঠছে, তবে মাদকাসক্তি থেকে তরুণ সমাজকে রক্ষার জন্য যে বক্তৃতা সেখানে উঠবে না কেন! উঠছে ধর্ম প্রসঙ্গে। রফিকুল ইসলাম মিয়ার বিশ্বাস, ধর্মীয় মূল্যবোধ না থাকলেই লোকে মাদকদ্রব্য সেবন করে। ধর্মীয় মূল্যবোধটি নষ্ট করল কে? নষ্ট করেছে তসলিমা। তাই দেশে মাদকাসক্তি বাড়ার কারণটিও তসলিমা। দেশে খুন হত্যা সন্ত্রাস যা কিছুই ঘটবে, তার সবকিছুর কারণ তাহলে তসলিমা। কারণ তসলিমা ধর্ম মানে না। ধর্ম না মানলে যত মন্দ কাজ আছে সমাজে, সবই করে লোকে। মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে রফিকুল বললেন, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, এটা কোরানের কোথাও লেখা নেই, এ নিতান্তই কোরানের বিরুদ্ধে প্রচারণা, ধর্মকে আঘাত করে, ধর্মের অবমূল্যায়ন করে কেউ কিছু লিখবেন না, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করবেন না, এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ ধর্মের ওপর আঘাত সহ্য করে না, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধকে নস্যাৎ করার জন্য একটা মহল তসলিমাকে নিয়ে মাতামাতি করছে, এরা সমাজ সভ্যতাকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করছে। যে কথাটি জোর দিয়ে পূর্তমন্ত্রী বলেছেন তা হল, তসলিমা নাসরিনদের মত লেখকদের লেখার কারণে মানবসভ্যতা বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। তাদের তথাকথিত সংস্কৃতি দেশ ও সমাজকে কলুষতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। শরীর আমার সিদ্ধান্ত আমার এই সব বক্তব্য সভ্যতার চিহ্ন নয়। এরা সভ্যতাকে ধ্বংস করতে চায়।
তাহফিজে হারমাইন পরিষদের সভাপতি মাওলানা সাদেক আহমেদ সিদ্দিকী বিবৃতি দিয়েছেন, কোরান হাদিসের অবমাননাকারী তসলিমা ধর্মদ্রোহী ও রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পরও সরকার রহস্যজনক কারণে সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। আজ এ কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে তসলিমা নাসরিন ভারতের হাতের পুতুল। সে আত্মগোপন অবস্থায় বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে যাচ্ছে, অথচ সরকার তাকে খুঁজে পাচ্ছে না — এ কথা মানা যায় না। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, সরকার ভারতকে অখুশী করতে চায় না।
এসব খবর আমি শুনতে চাই না, সামান্য হলেও দেখতে চাই কিছু একটা ঘটছে দেশে, দেশটি মৌলবাদীদের হাতের মুঠোয় চলে যাচ্ছে না, আমি বিশ্বাস করতে চাই না যে, দেশটিতে এখন ইসলামী শাসন কায়েম হবে, আল্লাহর আইনে চলবে দেশ, মেয়েদের ঘরবন্দি করা হবে, পান থেকে চুন খসলে পাথর ছুঁড়ে মারা হবে। না, আমি ভাবতে চাই না আর কি কি হবে। অন্যরকম কিছু একটা দেখতে চাই। কতটুকু সত্য তা জানি না, কিন্তু আজকের কাগজ, যে কাগজটি মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনের কথা যে করেই হোক লেখে, লিখেছে মৌলবাদী শক্তির উত্থানের বিরুদ্ধে দেশে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠার প্রস্তুতি চলছে। সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ছাত্রসমাজ সচিবালয় ঘেরাও করবে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট দেশব্যাপী ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য মৌলবাদ বিরোধী পক্ষ পালন করবে। একাত্তরের ঘাতক বিরোধী আন্দোলনের জাতীয় কেন্দ্র জাতীয় সমন্বয় কমিটি নিয়মিত বৈঠক করছে। নারী সংগঠনগুলো ব্যাপক কর্মসূচির কথা ভাবছে। এই ভাবাভাবির পর পত্রিকার মন্তব্য, জামাত বনাম অন্যান্য ধর্মান্ধ শক্তির মধ্যে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের যে লড়াই লক্ষ করা যাচ্ছে, মৌলবাদী শিবিরে অনৈক্যের এই প্রধান দুর্বলতার কথা মাথায় রেখে প্রগতিশীল সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে ঐক্যের কোনও বিকল্প নেই, এই দাবি এখন দেশের সর্বত্র।
দেশের সর্বত্র কি এই দাবি? না। ঠিক নয়। এই দাবি অল্প কিছু মানুষের, যারা বুঝতে পারছে এ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই দেশটিকে রক্ষা করার।
রাতে জ ঘরে ঢুকলেন তাঁর এক বন্ধুকে নিয়ে। জ বললেন যে বন্ধুটি প্রগতির পক্ষের লোক, যদিও সরকারি চাকরি করেন। এই বন্ধুটির ওপর তাঁর সম্পূর্ণ আস্থা আছে বলেই তিনি এখানে নিয়ে এসেছেন। ঝ আপত্তি করেননি, আমি তো করিইনি। জর বন্ধুর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর তাঁকে ভাল মানুষ বলেই মনে হয়। বন্ধুটি আমাকে বলেন— আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই, মোল্লারা আপনাকে কখনই মারবে না। কারণ আপনাকে মারলে তাদের রাজনীতি করার কোনও ইস্যু থাকবে না। আপনাকে আর যারাই মারুক, মোল্লারা চাইবে আপনাকে বাঁচিয়ে রাখতে।
যুক্তিটি খুব খারাপ দেননি তিনি। কিন্তু এতে কি নিশ্চিন্ত হওয়া যায়! মৌলবাদী নেতারা না হয় আমাকে একটি জব্বর ইস্যু ভাবছে, রাজনীতি তাদের উদ্দেশ্য, ক্ষমতা দখল করা উদ্দেশ্য কিন্তু শত শত রাজনীতিঅজ্ঞ ধর্মান্ধ লোকও দলে আছে, ধরা যাক সেসব কোনও লোক অথবা মাদ্রাসার কোনও ছেলে, যে ছেলে রাজনীতি বা ইস্যু এসব এখনও শেখেনি, যাকে তার নেতারা বার বার বলেছে যে তসলিমা ইসলামকে ধ্বংস করে ফেলছে, তার মৃত্যু হওয়া উচিত, শুনে শুনে ছেলে বিশ্বাস করেছে যে আমাকে মারলে সে বেহেসতে যেতে পারবে, সে কেন আমাকে খুন করতে চাইবে না!
বন্ধুটি এই প্রশ্নের কোনও উত্তর দেন না। সারা মুখে চিকচিক একটি আনন্দ নিয়ে বলেন—সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ছাত্র সমাজ আজ সচিবালয় ঘেরাও করেছে। কোনও কোনও শহরে নাকি ডিসি অফিসও ঘেরাও করেছে। ছাত্রসমাজ কিছুতেই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে আর বাড়তে দেবে না। বললেন জর বন্ধু।
আচ্ছ!, আমি উদাসীন স্বরে বলি—মৌলবাদীদের কেন আজকাল সাম্প্রদায়িক শক্তি বলা হয়?
—তারা সাম্প্রদায়িক, তাই সাম্প্রদায়িক বলা হয়।
—কিন্তু তারা কি কেবলই সাম্প্রদায়িক? আর এখন তো কোনও সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে মারামারি হচ্ছে না যে তাদের সাম্প্রদায়িক বলে চিহ্নিত করতে হবে!
—তাহলে কি বলা উচিত তাদের? জর বন্ধু জিজ্ঞেস করলেন।
—ইসলামী মৌলবাদী বা ইসলামিক বা ধার্মিক বা ধর্মীয় শক্তি এধরনের কিছু। ধর্মীয় মৌলবাদী হলেই তো সাম্প্রদায়িক হয়, প্রগতিবিরোধী হয়, নারীবিরোধী হয়। আলাদা করে তাদের তো আর সাম্প্রদায়িক বলে ডাকার প্রয়োজন হয় না।
জ বললেন—সাম্প্রদায়িকতা এ দেশে খুব ঘটে বলেই সম্ভবত ওদের সাম্প্রদায়িক বলা হয়।
আচ্ছ!! খানিক থেমে আমি বলি—সাম্প্রদায়িকতা মানেটা কি? ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষদের ঘৃণা করা, এই তো! কিন্তু সম্প্রদায় বলতে এখানে কি বোঝানো হচ্ছে? হিন্দু সম্প্রদায়, মুসলিম সম্প্রদায়, বৌদ্ধ সম্প্রদায়, খ্রিস্টান সম্প্রদায়। তাই তো! সকলে মাথা নাড়েন।—হ্যাঁ তাই।
—তার মানে সম্প্রদায়টা ধর্মের ভিত্তিতে আমরাই সৃষ্টি করে দিচ্ছি। তার মানে আমরা বলে দিচ্ছি গৌতম রায় আর গোলাম হোসেন দুই বন্ধু, একই সঙ্গে একই আদর্শে বড় হয়ে উঠেছে, কিন্তু তারা ভিন্ন, কারণ তারা ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক। ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে এই যে এক একটি সম্প্রদায়ভুক্ত করে ফেলা,আলাদা করে ফেলা, এই ব্যাপারটিই, এই মানসিকতাটিই তো সাম্প্রদায়িক। ধর্ম আমাদের কাছে বড় হচ্ছে কেন?
—তাহলে তাদের কী বলে ডাকবেন, সেই মুসলমানদের, যখন তারা হিন্দুদের অত্যাচার করে?
—তারা মুসলমান বা বৌদ্ধের বিরুদ্ধে অত্যাচার করলে কি বলে ডাকা হবে? অত্যাচারী। মানবতাবিরোধী। এ-ই কি যথেষ্ট নয়?
—না। যথেষ্ট নয়। জর বন্ধু বললেন —কারণ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে যদি কাউকে ঘৃণা করা হয়, অত্যাচার করা হয়, তবে সেটি এত জঘন্য যে তাদের কেবল অত্যাচারী বললে কম বলা হয়।
—কম বলা হয় না। মানবতাবিরোধী বা মানববিরোধী শব্দটি তো সাম্প্রদায়িক শব্দের চেয়েও অনেক কুৎসিত, অনেক নিষ্ঠুর। আমার মনে হয় সম্প্রদায়ের ভাগটা ধর্মের ভিত্তিতে হওয়া উচিত নয়। হওয়া উচিত আদর্শ বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে। যেমন সেক্যুলার সম্প্রদায় আর মৌলবাদী বা ফাণ্ডামেন্টালিস্ট সম্প্রদায়।
—কিন্তু যারা এই দুই দলের কোনও দলে পড়ছে না। তাদের কি করবেন? যারা সেক্যুলারও নয়, ফাণ্ডামেন্টালিস্টও নয়? জর বন্ধু জিজ্ঞেস করেন।
—বিরোধ তো আসলে দুটো দলেই। সেক্যুলার আর ফাণ্ডামেন্টালিস্টের মধ্যে কনফ্লিক্ট হচ্ছে। এখন না সেক্যুলার না ফাণ্ডামেন্টালিস্ট লোকেরা হয় দূরে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ দেখবে, নয়ত কোনও একটি পক্ষ নেবে।
ঝ, জ, জর বন্ধু একে অপরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করেন।
হঠাৎ কোনও প্রসঙ্গ ছাড়াই আমি একটি প্রশ্ন করি—শব্দের কথাই যখন হচ্ছে, বলেন তো বর্ণবাদী আর সাম্প্রদায়িক এই দুটো শব্দের মধ্যে কোনটিকে বেশি খারাপ বলে মনে হয়?
জ বলেন — আমার কাছে তো সাম্প্রদায়িককেই বেশি জঘন্য মনে হয়।
বাকি দুজনের কাছেও তাই।
আমি চুপ হয়ে যাই। নিজের বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলো দুহাতে জড়ো করতে থাকি একটি বিন্দুতে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন