তসলিমা নাসরিন
উনত্রিশ জুন, বুধবার
ঝ দুপুর বেলা খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। বললেন কাল তিনি ভুলে যাননি, কাল সারাদিনই তিনি বাইরে ছিলেন, কিছু অতিথি এসেছিলেন রাতে। ঝর পক্ষে সম্ভব হয়নি এ ঘরে ঢোকা। আজ তিনি আপিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছেন। ঙর সঙ্গে তাঁর কাল রাতে ফোনে কথা হয়েছে। ঙ বলেছেন আজ রাতে তিনি আসবেন। ঝ দুদিনের ঘটনা বললেন। রবিবার তিনি সারাদিনই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছিলেন। বিকেলে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নাগরিক সমাবেশ ছিল শহীদ মিনারে। সমাবেশ শেষে সন্ধের দিকে একাত্তরের ঘাতকদের বিচার চাই স্লোগান দিতে দিতে মিছিলটি প্রেসক্লাবের দিকে যায়। প্রেসক্লাবের সামনে তখন বিশাল মঞ্চে মৌলবাদী দলের সভা হচ্ছিল। মৌলবাদীদের হাতে ছিল গজারি কাঠের লাঠি। শুরু হয়ে গেল দুই দলে সংঘর্ষ, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। একদল ধাওয়ায় ব্যস্ত, স্টেডিয়াম পুরানা পল্টন এলাকা পর্যন্ত এসব চলতে থাকে। আরেকদল ছাত্র মৌলবাদীদের মঞ্চ একসময় দখল করে নেয়। মঞ্চ পুড়িয়ে দেয়, ওদের ব্যানারগুলোও পুড়িয়ে দেয়, মাইক চেয়ার সব ভেঙে ফেলে। ছাত্ররা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে মৌলবাদবিরোধী স্লোগান দিতে থাকে। পুলিশ এসে হঠাৎ লাঠিচার্জ করে। অনেকে আহত হয়, এরমধ্যে ঝুনু নামের মেয়েটিও আহত হয়।
কোন ঝুনু?
রওশন আরা ঝুনু।
হ্যাঁ সেই ঝুনু। নাহিদের সঙ্গে যে মেয়েটি তসলিমা সপক্ষ গোষ্ঠী করেছিল।
লাঠিচার্জের পর ওখানেই সমাবেশ শুরু করে বক্তৃতা শুরু হয়। মোফাজ্জল হোসেন মায়া, আসাদুজ্জামান নূর বক্তৃতা করেন। এরপর সাতটার দিকে ছাত্রজনতার মিছিল যায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউএর দিকে। জিরো পয়েন্ট হয়ে স্টেডিয়ামের দিকে যেতে নিলে বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেট থেকে কয়েকশ মৌলবাদী গজারি কাঠের লাঠি নিয়ে মিছিলে হামলা করে। কয়েকজন আহত হয়। এভাবে কয়েক দফা হামলা হয়, মৌলবাদবিরোধী ছাত্র জনতা দৌড়ে পালায়, এক দল আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে, আরেক দল জিরো পয়েণ্টের দিকে। পুলিশ লাঠিচার্জ করে। কাঁদানে গ্যাস ছাড়ে। দু পক্ষে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। স্টেডিয়ামে খেলা চলছিল, খেলার কিছু দর্শক রাজাকার রাজাকার বলে স্লোগান দিতে দিতে হামলাকারীদের দিকে ঢিল ছুঁড়তে থাকে, পুলিশ গিয়ে তাদেরও ধাওয়া করে।
মিছিলের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ আর মৌলবাদীদের বর্বর হামলার প্রতিবাদ করেছে বাসদ, জাসদ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফন্ট কেন্দ্রীয় কমিটি, ছাত্র ঐক্যফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটি।
কি হচ্ছে দেশে, তা ঝ সংক্ষেপে বলে গেলেন, ১.ছাত্রনেতারা বলেছে আগামীকাল বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে স্বাধীনতাবিরোধী জামাতী ফতোয়াবাজদের বিতাড়িত করা হবে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যতই চেষ্টা করুন পুলিশি পাহারা দিয়ে জাগ্রত জনরোষ থেকে স্বাধীনতাবিরোধীদের রক্ষা করতে পারবেন না। যে কোনও মূল্যে শহীদের রক্তমাখা বাংলার মাটিতে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতিহত করা হবে। ২.ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি কার্যকরী পরিষদের এই জরুরি সভায় স্বাধীনতা বিরোধী, ফতোয়াবাজ, ধর্মব্যবসায়ী ও কিছু মৌলবাদী রাজনৈতিক দল দেশব্যাপী যে বিশৃঙ্খলা আর অরাজকতা সৃষ্টি করেছে তা থামাতে হবে। ৩. তসলিমা পক্ষ মিরপুরে সভা করেছে, তারা আগামীকাল সকালে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি প্রতিরোধ কমিটিতে যোগ দেবে। ৪. ইনকিলাবের বিরুদ্ধে ধর্মীয় দাঙ্গা আর অরাজকতা সৃষ্টির অভিযোগে ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন আদালতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের ছাত্র মারুফুল ইসলাম একটি মামলা দায়ের করেন।
–শহীদ মিনারে জোটের নাগরিক সমাবেশে কে কি বললেন?
–সুফিয়া কামাল বললেন, ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত কোনও আন্দোলনে বাঙালি মাথা নত করেনি। এখনও করবে না। ধর্মান্ধ মোল্লারা আজ ফতোয়ার নামে সাম্প্রদায়িকতা ছড়াচ্ছে। আল্লাহর নামে জেগে উঠুন, মৌলবাদীদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করুন। শামসুর রাহমান বলেছেন, দেয়ালে আমাদের পিঠ ঠেকে গেছে, এখন আর পিছু হটার উপায় নেই। জান যায় যদি যাবে, তবু মানুষের কল্যাণের জন্য আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। এখন আমাদের অগ্নি পরীক্ষার সময়, যদি জয়লাভ করতে না পারি, তবে আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো। আওয়ামী লীগের নেতা আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, দেশ আজ গভীর সংকটের মুখোমুখি। সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে প্রতিহত করতে হবে। সাম্প্রদায়িক শক্তি আমাদের স্বাধীনতা বিপন্ন করতে চায়। তাদের মোকাবিলা করে বুঝিয়ে দিতে হবে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে স্বাধীন থাকবে। যে কোনও মূল্যে বাংলার মাটিতে ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবে।
–আর কি?
–প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদের উত্থান ও প্রতিকার নামে জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রে একটি সেমিনার হয়েছে। সেমিনারে বক্তারা মৌলবাদের উত্থানের জন্য বিএনপি সরকারকে দায়ি করেছেন। কবীর চৌধুরী বলেছেন, মৌলবাদীরা ধর্মের স্বার্থে নয়, নিজেদের স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করছে। বাইরের একটি শক্তি এদের অস্ত্র আর অর্থ দিচ্ছে। এরা মানুষের রগ কাটছে। সরকার জেনেও এদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বরং যারা মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করছে। এভাবেই মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে এবং এরা দেশকে এক ভয়াবহ সঙ্ঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সেমিনার শেষে কবীর চৌধুরী, ওয়াজেদ মিয়া, মাওলানা সৈয়দ আবদুল্লাহ আল চিশতি, হাফেজ জিয়াউল হক বিশেষ মোনাজাত করেন।
–কবীর চৌধুরী মোনাজাত করেছেন?
বিস্ময়ে আমি হাঁ হয়ে থাকি।
–হ্যাঁ করেছেন। ঝর নির্লিপ্ত উত্তর।
–না, আমার মনে হয় না।
–বললাম তো করেছেন।
— দু হাত তুলে?
–হ্যাঁ দুহাত তুলে। ছবি ছাপা হয়েছে।
–ওদিকে মোল্লারা কি করছে?
–মোল্লারা অনেক কিছুই করছে। শহরগুলোয় তো মিছিল হচ্ছে সভা হচ্ছে। গ্রামের অবস্থা খারাপ। এনজিওগুলোয় যে মেয়েরা কাজ করত, এখন করতে ভয় পাচ্ছে। যাচ্ছে না। এনজিওর ইশকুলগুলোয় ছাত্রী সংখ্যা কমে গেছে। গ্রামের সব মানুষকে নাকি খ্রিস্টান বানানোর মতলব করছে এনজিওগুলো। তিরিশ তারিখের হরতালের সময় আশংকা করা হচ্ছে এনজিওর ওপর হামলা হবে।
–আর কি?
–আরও অনেক কিছু। এত জানতে চেও না। মাথাটাকে একটু হালকা রাখো ভাই। ঝ তাঁর জ্বালানো সিগারেটটি আমার দিকে বাড়িয়ে দেন।
সিগারেট খেতে খেতে সরকারি প্রেসনোটের কথা বলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া এক প্রেসনোটে বলা হয়েছে, সরকার বেশ কিছুদিন যাবৎ লক্ষ করছে যে কতিপয় ব্যক্তি ও সংগঠন প্রকাশ্যে বিভিন্ন সময়ে কোনও ব্যক্তির জীবননাশের হুমকি প্রদান এবং হত্যাকারীদের জন্য পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে আসছেন। এ ধরনের ঘোষণা আইনের চোখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সরকার আশা করে যে এ ধরণের বেআইনী ঘোষণা প্রদান থেকে সংশ্লিষ্ট সকলে বিরত থাকবেন এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবেন। অন্যথায় সরকার তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য থাকবে।
সরকারের টনক কি নড়েছে! না নড়েনি, নড়লে এ পর্যন্ত যতগুলো মোল্লা আমাকে হত্যার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছে, তাদের ধরা হত। কাউকেই ধরা হয়নি। খুলনায় দাদার করা মামলার কিছু ফল পাওয়া যেত। তাও হয়নি। আইনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলার কি দরকার। আইনের ব্যবস্থাটি নিয়ে নাও না। ভবিষ্যতের ফতোয়ার জন্য অপেক্ষা করছ কেন বাবা! বর্তমানেই তো বহাল আছে ফতোয়া। প্রতিদিন মোল্লারা মিছিল মিটিংএ এই যে বলছে তসলিমার ফাঁসি যদি সরকার না দেয়, তবে তারা নিজেরাই দেবে ফাঁসি, তাদের ধরছো না কেন! সত্যিই কি ধরতে চাইছো! আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে চাইছো! না। চাইছো না।
ঙ এসেছেন রাতে। আমি অনেকগুলো প্রশ্ন করি একদমে, জামিনের খবর কি, কর খবর কি, ক আসছেন না কেন, উকিলের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ হয়েছে কি না কারও, আমার আত্মীয়রা বেঁচে আছে কি না, হরতাল হবে কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। ঙ বলেন, জামিনের খবর তিনি জানেন না। ক ব্যস্ত, তাঁর চাকরি বাকরি আছে, তার ওপর মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনে নিজেকে জড়িয়েছেন। কর সঙ্গে একবার তাঁর কথা হয়েছে, ক বলেছেন যে তিনি দেখা করেছিলেন আমার উকিলের সঙ্গে, উকিল বলে দিয়েছেন হাইকোর্ট থেকে জামিন হবে এমন কোনও নিশ্চয়তা তিনি পাননি। ডঃ কামাল হোসেন দেশের অনেক জায়গায় গণফোরামের সভায় বক্তৃতা করছেন, মানুষকে মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলছেন। এখন তিনি দেশের বাইরে গেছেন একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সম্মেলনে বক্তৃতা দিতে, তিনি না ফেরা পর্যন্ত জামিনের নতুন কোনও খবর পাওয়া যাবে না। আমার আত্মীয়দের কোনও সংবাদ ঙ পাননি। তাঁরা বেঁচে আছেন কি না এ সম্পর্কে ঙ কিছু জানেন না। হরতাল হবে বলে তিনি ধারণা করছেন, এবং দুদলের সঙ্ঘর্ষে অনেকের মৃত্যু হবে বলেও তিনি আশঙ্কা করছেন। ক আর ঙ যদিও দুজনই ব্যস্ত। ঙ ব্যস্ত সাংস্কৃতিক জোটের কর্মসূচি নিয়ে, বিভিন্ন সভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। আমার কথা তিনি ভুলে থাকেন না, আমাকে দেখতে আসেন না, সে আমার নিরাপত্তার কারণেই আসেন না। ক আর ঙ দুজনেই চেষ্টা করেছেন নতুন কোনও আশ্রয়ের জায়গা পেতে, দুজনই ব্যর্থ হয়েছেন। এক বাড়িতে বেশিদিন থাকা আমার উচিত নয় তাঁরা জানেন। কিন্তু নতুন কোনও আশ্রয়ের জায়গা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চেষ্টা তাঁরা থামিয়ে দেননি। আজও একজনকে অনুরোধ করেছেন ঙ, কাল তার উত্তর পাওয়া যাবে। ঙ আমার পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়েছেন। মনে জোর রাখতে বলেছেন। বলেছেন জামিন পাওয়া যদি সম্ভব না হয় তবে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা আমি না চাইলেও আমাকে ভাবতে হবে। দিন দিন পরিস্থিতি অস্বাভাবিক রকমের খারাপ হচ্ছে দেশে। যে কোনও সময় যে কোনও মন্দ কিছু ঘটে যেতে পারে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন