তসলিমা নাসরিন
পনেরো জুলাই, শুক্রবার
বিশাল মিছিল এগিয়ে যাচ্ছে মার্কিন দূতাবাসের দিকে। বিশাল মিছিলের ছবি। হাতে ব্যানার, ফেস্টুন। বাংলাদেশের ধর্মীয় ও অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে মার্কিন দূতাবাস অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিল।
বিক্ষোভ মিছিলের আগে সমাবেশে সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের সমাবেশের বিশাল মঞ্চ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, বিদেশী শক্তির আঁচলে মুখ লুকিয়ে রাষ্ট্র ও ধর্মদ্রোহীরা কোনওদিনই রেহাই পাবে না। দেশপ্রেমিক তৌহিদী জনতা যে কোনও মূল্যে দেশের স্বাধীনতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষা করবে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন কোরানের অবমাননাকারী ও ধর্মদ্রোহী তসলিমার পক্ষে ওকালতি করে বিশ্বের মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন। বাংলাদেশের কোটি কোটি মুসলমানের আবেগ অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার পরও মুরতাদ তসলিমার পক্ষে আমেরিকার মত একটি দেশের প্রেসিডেণ্টের পক্ষাবলম্বন লজ্জাজনক ও ঘৃণ্যতম কাজ। সকাল সাড়ে নটা থেকে ব্যানার নিয়ে বিভিন্ন দল বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে জমা হয়। হাজার হাজার মানুষে সড়ক ফুটপাত সব ভরে যায়। মোট ১৩টি সংগঠন মিলে গড়ে উঠেছে এই সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ। বর্তমানে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন। ঘণ্টাব্যাপী গণজমায়েত শেষে বিশাল মিছিল বায়তুল মোকাররম ছেড়ে পল্টন হয়ে বিজয়নগরের দিকে যেতে নিলে পুলিশ কড়া ব্যারিকেড দিয়ে মিছিলের গতি রোধ করে। সংগ্রামী জনতা তখন ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ক্লিনটন, তসলিমা ও মুরতাদ বিরোধী স্লোগান দিতে থাকে। উত্তাল জনতাকে শান্ত করতে নেতৃবৃন্দকে হিমশিম খেতে হয়। মিছিলকারী স্লোগানমুখর তৌহিদী জনতা তখন রাস্তার ওপর বসে পড়ে। বিক্ষোভরত জনতাকে শান্ত করতে সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের নেতা এনডিএ সেক্রেটারি আনোয়ার জাহিদ বক্তৃতা করেন। নেতারা মিছিলকারীদের বায়তুল মোকাররমে ফিরে যাওয়ার জন্য বলেন। তারা ফিরে গিয়ে মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করেন। আনোয়ার জাহিদের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে স্মারক লিপি দিয়ে আসেন। আনোয়ার জাহিদের সঙ্গে ছিলেন জাগপার সভাপতি শফিউল আলম প্রধান আর খেলাফত মজলিসের মহাসচিব প্রিন্সিপাল মসউদ খান।
মার্কিন দূতাবাসে মোল্লাদের বিক্ষোভ মিছিল যাবে এই ঘটনা জানার পরই কাল শহরে পুলিশ নামানো হয়েছিল পল্টন আর বিজয়নগর এলাকার রাস্তায় এমন কি বাড়ির ছাদেও পুলিশ ছিল। যানবাহন চলাচল ওই এলাকায় বন্ধ থাকে। রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরা মিছিলকারীদের হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানাতে থাকে। একসময় তারাও নেমে পড়ে মিছিলে। কিন্তু পুলিশ বিজয়নগরের বেশি একটুও মিছিলকে সামনে এগোতে দেয় না।
গণজমায়েতে সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়কারী বায়তুল মোকাররমের খতিব ওবায়দুল হক বলেন, যতদিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তসলিমার পক্ষে দেওয়া বিবৃতি প্রত্যাহার না করবে, ততদিন তৌহিদী জনতার প্রতিবাদ জ্ঞাপন অব্যাহত থাকবে। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ধর্মদ্রোহীদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। আমার বিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মভীরু জনগণও ক্লিনটনের বিরোধিতা করবে। মুসলমান কখনও জালিমের পক্ষ নিতে পারে না। ইসলাম ধর্মকে যারা কটাক্ষ করে তাদের সঙ্গে মুসলমানের বন্ধুত্ব হতে পারে না। ইসলাম গ্রহণ করে যে ত্যাগ করে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
শায়খুল হাদিন বলেছেন, এক ভ্রষ্টা নারীর প্রেমে পড়ে ক্লিনটন তার পক্ষে ওকালতি করছেন। তিনি বারো কোটি মুসলমানের এবং বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন। বাঘের লেজ দিয়ে কান চুলকানোর পরিণাম ভাল হবে না। ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা প্রতিরোধ মোর্চার আহবায়ক মাওলানা মুহিউদ্দিন খান বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ গরিব হতে পারে কিন্তু তারা কারও চোখ রাঙানিকে ভয় পায় না। ২৯ জুলাই লং মার্চ আর মহাসমাবেশ করে তৌহিদী জনতা দেখিয়ে দেবে বাংলাদেশে ইসলামের দুর্গ কত মজবুত।
মোর্চার মহাসচিব ফজলুল হক আমিনী বলেছেন, টুপি দাড়ির ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র চলছে, তার শেষ জবাব দিতে সারাদেশের তৌহিদী জনতা আজ ঐক্যবদ্ধ। ২৯ জুলাই লং মার্চে ঢাকায় লাখো জনতার ঢল নামবে। মুসলমান কেবল আল্লাহর শক্তির কাছে মাথা নত করে, কোনও পরাশক্তির কাছে নয়।
আনোয়ার জাহিদ বলেছেন, আমরা বিশ্বাস করি হায়াত মওত আর রিযিকের মালিক আল্লাহ। মুসলমান একমাত্র আল্লাহকে ভয় করে, কোনও পরাশক্তিকে নয়। মার্কিন জনগণের বিরুদ্ধে আমাদের কোনও অভিযোগ নেই। বাংলাদেশের জনগণ ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের ভূমিকায়। তিনি ভ্রষ্টা নারী তসলিমার পক্ষে ওকালতি করেছেন। বারো কোটি মুসলমানের ঈমান ও আকিদাকে যে কুলাঙ্গার মেয়ে আঘাত করেছে ক্লিনটন তার সাফাই গেয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন গায়ে পড়ে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ঝগড়া বাঁধিয়েছেন। তসলিমা তার কবিতা ও প্রবন্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও ধর্মীয় মূল্যবোধের বিরুদ্ধে যে কটাক্ষ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কোনও নাগরিক তা করলে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনও তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতেন। কারণ ক্লিনটন বাইবেলে হাত রেখে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। মার্কিন ডলারে এখনও লেখা আছে, ইন গড উই ট্রাস্ট। অর্থাৎ আমরা আল্লায় বিশ্বাস করি। পলাতক তসলিমা বলছে কোর্টে বা জেলে গেলে মৌলবাদীরা আমাকে মেরে ফেলবে। তাই পাশ্চাত্যের কোনও দেশে আমার আশ্রয় প্রয়োজন। ইরানের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শাহকে যুক্তরাষ্ট্র আশ্রয় দিয়ে বাঁচাতে পারেনি। তাই তসলিমাকে আল্লাহ যেদিন নিয়ে যাবেন, কেউ বাঁচাতে পারবে না। পরাশক্তির আঁচলে মুখ লুকিয়ে রাষ্ট্র ও ধর্মদ্রোহীরা কোনওদিন রেহাই পাবে না। তসলিমা বাংলাদেশকে শুয়োরের বাচ্চা বলে গালি দিয়েছে। বাংলাদেশের সীমানা মুছে ফেলার কথা বলেছে। পবিত্র কোরআন সংশোধনের স্পর্ধা দেখিয়েছে। ভারতীয় পত্রপত্রিকায় তার বক্তব্য ফলাও করে ছাপা হয়েছে। এরকম নষ্টা ও দেশদ্রোহী মেয়ের মানবাধিকার নিয়ে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন উদ্বিগ্ন। অথচ বসনিয়া ফিলিস্তিন ও কাশ্মীরে যখন প্রতিদিন মুসলমানদের জবাই করা হচ্ছে তখন সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কোনও কথা বলেন না। এদেশের জনগণ তসলিমার বিচার চেয়েছে শুধু। এর আগে একটি মহল রাস্তায় গণআদালত বসিয়ে যখন কারও কারও বিচার করেছে, তখন মানবাধিকার নিয়ে ক্লিনটন কোনও উদ্বেগ প্রকাশ করেননি। ব্রিটিশ রচিত আইনের (২৯৫ ক) মাধ্যমেই তসলিমার বিচার দাবি করা হয়েছে। ধর্মদ্রোহীতার শাস্তির বিধান দুনিয়ার সকল দেশেই আছে। তসলিমার ময়মনসিংহের বাড়িতে কেউ হামলা করেনি, নিজেরাই নিজের বাড়িতে হামলা করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চাইছে। তৌহিদী জনতা এখনও সংযম প্রকাশ করছে। নতুবা তসলিমার বাড়ির একটি ইটও এতদিন থাকত না। আজকের এই বিক্ষোভ মিছিল এদেশে তৌহিদী জনতার আন্দোলনে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করল। বাংলাদেশের ইসলামের ওপর আজ ঘরে বাইরের শত্রুরা হামলা করছে। আঘাত যখনআসছে আমরা চুপ করে থাকতে পারি না। তবে এই আন্দোলন কোনও দেশের নাগরিকের বিরুদ্ধে নয়। এই আন্দোলন তসলিমা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে।
ফ্রীডম পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান প্রিন্সিপাল সিরাজুল হক বলেছেন, বাংলাদেশে ইসলাম থাকবে কি থাকবে না সেই ফয়সালার জন্য আজকের আন্দোলন।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব প্রিন্সিপাল মসউদ খান বলেছেন, ভিয়েতনাম, ইরান, সোমালিয়া থেকে মার্কিনীরা নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশের মুরতাদ নাস্তিকদের পাশে দাঁড়িয়ে আমেরিকাও রেহাই পাবে না। ইসলাম রাজনীতিবর্জিত ধর্ম নয়।
জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সেক্রেটারি সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মুফতী ওয়াককাস বলেন, প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের দেওয়া ঈমানী চ্যালেঞ্জ আমরা গ্রহণ করেছি। বিসমিল্লাহর নামে যারা আজ বাংলাদেশের ক্ষমতায় বসে আছে, তারা দেশ ও ইসলাম কোনওটাই রক্ষা করতে পারছে না। পলাতক তসলিমা কি করে বিবৃতি দেয়, তা আমরা সরকারের কাছে জানতে চাই।
জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সহ সভাপতি মাওলানা শওকত আলী বলেছেন, ১৬ হাজার এনজিওর অধিকাংশই কোটি কোটি ডলার খরচ করছে ইসলামের বিরুদ্ধে। তথাকথিত বিসমিল্লাহর সরকার যৌনবাদী লেখিকা তসলিমাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।
জাগপা সভাপতি প্রধান বলেন, ৩০ জুন সরকার দয়া করে মুরতাদ ঘাদানি চক্রকে তোপখানা রোডে আড়াইশ গজ জায়গা ছেড়ে দিয়েছিল। সেদিন পুলিশ না বাঁচালে জনতা তাদের জন্য মাত্র আড়াই হাত জায়গা নির্ধারণ করত। জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসাবেন তসলিমা ও দিল্লির সেবাদাস চক্রকে আর রাজপথে চিৎকার করবেন ইসলামের জন্য এটা হয় না। এই সরকার ইসলাম ও স্বাধীনতা কোনওটাই রক্ষা করতে পারবে না। খালেদা জিয়ার সরকারই তসলিমাকে নিরাপদ আশ্রয়ে রেখেছে।
জনতাকে প্রশ্ন করেন তিনি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বড় না আল্লাহ বড়?
জনতা সমস্বরে ধ্বনি তোলে, আল্লাহ বড়।
প্রধান বলেন, ক্লিনটনের প্রজা হতে আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করিনি।
ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের মুখপাত্র চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ ফজলুল করিম বলেছেন, মৌলবাদী বলে পরিচয় দিতে কোনও লজ্জা নেই। মৌলবাদ মানে মূল জিনিসে বিশ্বাস। কোরান, হাদিস, ইজমা, কিয়াম আমাদের মৌলিক ভিত্তি। মূলে যাদের বিশ্বাস নেই, তারা জারজ। তসলিমার মত মেয়ে সম্পর্কে জনসভায় কথা বলাও লজ্জাজনক। এই মেয়ে কোরানের বিরোধিতা করেছে। আর ক্লিনটন তাকেই সমর্থন করছে।
মুসলিম লীগএর মহাসচিব বলেছেন, একজনের ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য বারো কোটি মুসলমানের অনুভূতিতে আঘাত হানা যায় না। ক্লিনটন তসলিমার পক্ষে সাফাই গেয়ে বারো কোটি মুসলমানকে আঘাত করেছেন।
এরপর আরও আরও…. চলতেই থাকে..। একজনের পর আরেকজন। পড়তে পড়তে ক্লান্তি চলে আসে। আমার আর ইচ্ছে করে না জানতে কে কি বলেছেন। যথেষ্ট হয়েছে। আমি কেবল মিছিলের ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। মানুষগুলোকে মানুষের মত দেখাচ্ছে। তারা কারও বাবা, কারও কাকা, কারও ভাই, কারও ছেলে। তারা মিছিল শেষে বাড়ি ফিরে যাবে, খাবে, দাবে, ঘুমোবে, জাগবে, আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলবে, কথা বলবে বাংলায়, মনে সুখ হলে দুএককলি গানও গাইবে, সেও বাংলায়। আর সব বাঙালির মতই জীবন তাদের। কিন্তু এত আলাদা কেন তারা! কেন তারা চাইছে একটি মেয়েকে, মেয়েটি তাদের বোনের মত দেখতে, মেয়েটি তাদের মেয়ের মত দেখতে, খুন করতে! মেয়েটি ভুল করেছে যদি তারা মনে করেই, তাতে কি!ভুল কি মানুষ করে না! তাই বলে মেরে ফেলতে হয় কাউকে!
পাশ ফিরে শুই। দেয়ালে কি কি সব দাগ আছে, দাগগুলোর দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকলে হাতি ঘোড়া বাঘ মানুষ এসব যে কোনও আকৃতি খুঁজে পাওয়া যায়। হাতি ঘোড়া দেখছিলাম, এর মধ্যেই হঠাৎ আমি শোয়া থেকে চকিতে উঠে বসি। এ কী! এ আমি আগে ভাবিনি কেন! কেন ভেবেছি ওরা সব রাজাকার, সব স্বাধীনতার শত্রু! আমার শ্বাস পড়ে খুব দ্রুত। ফ্রীডম পার্টির নেতা কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশীদ, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক এলায়েন্সের আনোয়ার জাহিদ, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির নেতা প্রধান এরা তো সবাই মুক্তিযোদ্ধা! একাত্তরে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। তবে আজ মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকার এক মঞ্চে উঠে বক্তৃতা করছে, এক দলে নাম লেখাচ্ছে! এই মুক্তিযোদ্ধারা আজ একাত্তরের সবচেয়ে বড় শত্রু গোলাম আযমের সঙ্গে হাতে হাত রেখে চলছে, একাত্তরের ঘাতকদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ রেখে হাঁটছে!
শরীরটি একটি মরা সীমের ডালের মত নেতিয়ে পড়ে মেঝেয়।
রাতে জ এলেন। নিজেই বললেন আজ রাতে তিনি আর বাড়ি ফিরে যাবেন না, থেকে যাবেন। আমার খুব ভাল লাগে শুনে। আমি তো ঘুমোই না রাতে, কোনও রাতেই ঘুমোই না। আজ সারা রাত শুয়ে শুয়ে জর জীবনের গল্প শুনি। কি করে একাত্তরে তাঁকে পাকিস্তানি সেনারা দিনের পর দিন ধর্ষণ করেছিল, সেই ভয়ংকর, ভয়াবহ, নিষ্ঠুর, কুৎসিত দিনগুলোর কথা তিনি বর্ণনা করেন। শুনে চমকে উঠি, আঁতকে উঠি, হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়, বুকের স্পন্দন থেমে যায়, পাথর হয়ে থাকি। ঝও এ ঘরে শুয়েছেন। অনেকক্ষণ তিনি ঘুমিয়ে গেছেন। কেবল জ আর আমি জেগে। জ বলছেন, আমি শুনছি। জীবনের ঝুঁড়ি উপুড় করে ঢালছেন জ। জ কে আমার আর সাধারণ কোনও মানুষ বলে মনে হয় না, তাঁকে মহামানবী মনে হয়। গভীর শ্রদ্ধায় আর ভালবাসায় তাঁকে স্পর্শ করে রাখি। জকে একসময় আর মহামানবী বলে আমার মনে হয় না। মনে হতে থাকে জ বুঝি আমার মা, জ বুঝি আমি নিজেই। জর দুটো হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম নিজের হাতে। হাতদুটো আমার ইচ্ছে করে না শিথিল করতে। অন্ধকারে জর মুখটির ওপর ধীরে ধীরে আবছা একটি আলোর চুম্বন পড়ে। ওটুকু আলোতেই জকে বড় উজ্জ্বল লাগে।
জানালা খুলে ভোর দেখার সুযোগ নেই আমাদের, কিন্তু ভোরের সৌন্দর্যটুকু কল্পনা করে নিই। ভোরের সুগন্ধটিও মনে নিয়ে নিই।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন