৩. অতলে অন্তরীণ – ৪০

তসলিমা নাসরিন

তেরো জুলাই, বুধবার

কালও কোনও পত্রিকা ছিল না, আজও নেই। ঝর দেখা নেই। ঝ যখন ঢুকলেন ঘরে, তখন রাত। দুদিন পর খাবার জুটল। খাবার গিলতে গেলে গলায় যন্ত্রণা হয়। রাত দশটার দিকে ক আর ঙ এলেন। নিঃশব্দে এলেন। ওঁরা নিঃশব্দেই আসেন। নিঃশব্দে এসে নিঃশব্দে চলে যান। কথা যখন বলেন, প্রায় নিঃশব্দেই বলেন। ওঁরা এলে ওঁদের এই জগতের কেউ বলে মনে হয় না। যেন স্বর্গ থেকে দেবদূত এলেন। স্বর্গ বলে কোথাও কিছু নেই জেনেও আমার এরকমই মনে হয়। ওঁরা জানেন সব, বোঝেন সব। আল্লাহর ওপর লোকে যেমন নিজের জীবনটির দায়িত্ব দিয়ে ভারমুক্ত হয়, আমিও তেমন ওঁদের কাছেই জীবনের দায় দায়িত্ব দিয়ে বসে আছি। নিজের ওপর আমার বিশ্বাসটুকু অনেককাল হারিয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস এখন ওঁদের ওপর। ওঁরা ইচ্ছে করলে আমাকে বাঁচাতে পারেন, ইচ্ছে করলে বাঁচাতে ওঁরা নাও পারেন। ওঁরা যতক্ষণ থাকেন, ততক্ষণ আমি নিজের কোনও অস্তিত্ব অনুভব করি না। ওঁদের মুখে দেশে ঘটতে থাকা নানারকম তাণ্ডবের গল্প শুনি। আমার কিছুতেই মনে হতে থাকে না যে যাবতীয় তাণ্ডব এই আমি মানুষটির জন্য। মনে হয় তসলিমা নামের মেয়েটি অন্য কেউ। ওঁদের সঙ্গে সঙ্গে তসলিমার জন্য আমিও দীর্ঘশ্বাস ফেলি। কী এক ঘোরের মধ্যে থাকি যে মনে হয় না ওঁরা বসে আছেন বা কথা বলছেন বা শুনছেন। ওঁরা চলে গেলে বুঝি ওঁরা এসেছিলেন। ঙ জানালেন সরকারের সঙ্গে বিদেশি কূটনীতিকদের দীর্ঘ দীর্ঘ বৈঠক হচ্ছে। আমার উকিলের সঙ্গেও বৈঠক হচ্ছে। কিন্তু সরকার রাজি নয় আমাকে জামিন দিতে। ঙর হাতে চুল।টর বাড়িতে যে পরচুলাটি ফেলে এসেছিলাম, সেটি তিনি নিয়ে এসেছেন। চুল হাতে নিয়ে বসে থাকি। ভাবলেশহীন মুখে বসে থাকি। স্পন্দনহীন বসে থাকি।

ক আর ঙ দুজন দেশের যে সব কথা মুখে শোনালেন, হাতের পত্রিকা খুলে পড়ে শোনালেন আমাকে, তা হল, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো যে যৌক্তিক, তা বলে বেড়াচ্ছেন চারদিকে। সরকারি আদেশেই বলছেন সব। যেসব পত্রিকায় আমার খবর ছাপা হচ্ছে, সবকটি পত্রিকায় চিঠি লিখে জানাচ্ছেন যে বাংলাদেশ সরকার যা করেছেন ঠিক করেছেন। ওয়াশিংটন পোস্টে আমাকে নিয়ে লেখা একটি সম্পাদকীয় নিয়ে তিনি আপত্তি করছেন। অন্যের ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত দিয়ে আমি নাকি বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ আইন অমান্য করেছি। একশ বছরের বেশি আগে ব্রিটিশ সরকার ২৯৫ ক নামক আইনটি চালু করেন। আইনটি আমার নয় তার নয়, একেবারে খোদ ব্রিটিশের আইন। সুতরাং এই আইন সভ্য হতে বাধ্য!

একবারও কি হুমায়ুন কবীর লোকটি ভেবেছেন যে একশ বছর আগের পুরোনো জিনিস সবসময় নতুন জীবনে আর জগতে খাটে না, সময় গেলে পুরোনো মূল্যবোধ, পুরোনো আইন, পুরোনো মানসিকতার সংস্কার করতে হয়! একবার কি খবর নিয়ে দেখতে চেয়েছেন, ইংরেজরা নিজেরা এই আইনটি আর ব্যবহার করে কি না! গণতন্ত্র কাকে বলে তাও শিখিয়েছেন হুমায়ুন কবীর। নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের দায়িত্ব তসলিমার মৌলিক অপরাধের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ আর অসন্তোষের ব্যাপারে সাড়া দেওয়া।

এদিকে সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ বিশাল এক সমাবেশের আয়োজন করেছে, ওতে যোগ দেওয়ার জন্য আর ২৯ জুলাইএর লং মার্চ সফল করার জন্য জনগণকে আহবান জানিয়ে বায়তুল মোকাররমের খতিব, শায়খুল হাদিস, চরমোনাইএর পীর, ব্যারিস্টার কোরবান আলী, আনোয়ার জাহিদ সকলে মিলে একটি বিবৃতি দিয়েছেন, বিবৃতিটি এরকম। জ্ঞ৩০ জুনের হরতালের অভূতপূর্ব সাফল্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের বারো কোটি মুসলমান এই রায় ঘোষণা করেছে যে বাংলাদেশ একটি মুসলিম রাষ্ট্র এবং এই রাষ্ট্রের কোনও নাগরিকের কোরান অবমাননা ও ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের লিপ্ত হওয়ার কোনও অধিকার নেই। এই হরতালের মাধ্যমে কোরান অবমাননাকারী নাস্তিক মুরতাদদের শাস্তির দাবি জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। বারো কোটি মানুষ এই রায় দিয়েছে যে ধর্মদ্রোহীরাই রাষ্ট্রদ্রোহী। বাংলাদেশের মানুষ এই দাবিকে সমর্থন করেছে যে ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ কোনও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের ভাল এবং জনহিতকর কাজের বিরোধী নয়, কিন্তু এনজিও নামধারী কিছু প্রতিষ্ঠান দেশের সংবিধান ও ধর্ম বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। আমাদের জনগণের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে তারা মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করা ও ইসলাম বিরোধী এবং সামাজিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টির অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। ৩০ জুনের হরতাল পালনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ এই তথাকথিত এনজিওদের অপতৎপরতা বন্ধের দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে ক্ষমতাসীন সরকার বারো কোটি মানুষের এই রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে নাস্তিক মুরতাদদের শাস্তি, এনজিওর অপতৎপরতা বন্ধ, ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের কোনও উদ্যোগই গ্রহণ করেননি। বরং আন্দোলনকারী নেতা ও কর্মীদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছেন। গণধিকৃত তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলেও তাকে আজ পর্যন্ত সরকার গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়েছেন। অথচ সরকারের নাকের ডগায় বসে তসলিমা নাসরিন তার ধর্মদ্রোহী ও রাষ্ট্রদ্রোহী অপকর্ম সমানে চালিয়ে যাচ্ছে। আর সরকারের এই নতজানু নীতির সুযোগে রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব বিরোধী ইসলামের শত্রু বৈদেশিক শক্তি আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নগ্ন হস্তক্ষেপ করে চলেছে। তসলিমা নাসরিনকে কেন্দ্র করে মার্কিন সরকার ও পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশ অত্যন্ত আপত্তিকর ভূমিকা গ্রহণ করেছে। ভয়েস অব আমেরিকাসহ মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো যে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে তা আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে মারাত্মকভাবে বৈরীমূলক।

১৩টি ইসলামি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান সমন্বয়ে গঠিত সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ তাই ১৪ জুলাই বৃহস্পতিবার সকাল দশটায় বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে এক বিক্ষোভ সমাবেশ ও মার্কিন দূতাবাসের দিকে এক বিক্ষোভ মিছিল ও স্মারকলিপি প্রদানের আয়োজন করেছে। দল মত নির্বিশেষে সকল নাগরিককে আমরা এই সমাবেশ ও মিছিল সফল করে তোলার আহবান জানাচ্ছি।’

তৌহিদী জনতা যে কোনও মূল্যে লং মার্চ সফল করবে। ঝ বললেন ইনকিলাব পত্রিকাটি হাতে নিয়ে।

লং মার্চ যদি সত্যি সত্যিই সফল হয়ে যায়!

আশঙ্কাটি আমার গা থেকে নেমে যেতে থাকে ক, ঙ, ঝর দিকে। আশঙ্কাটি ক্ষণকালের জন্য আমাদের স্তব্ধ করে রাখে।

ঝ বলে যাচ্ছেন, প্রতিরোধ মোর্চা থেকে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে কোরানের ইজ্জত রক্ষার জন্য সারা দেশে যে নজিরবিহীন হরতাল পালন হয়েছে, সুতরাং আগামী ২৯ জুলাই কোরান দিবস পালন হবে, সারাদেশ থেকে ঢাকার দিকে লং মার্চ কর্মসূচীতে তার চেয়ে অনেক বেশি লোকের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের আলামত পাওয়া যাচ্ছে। তৌহিদী জনতার এই ঈমানী জবাবকে কোনও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে স্তব্ধ করা যাবে না। ইসলাম বিরোধী নাস্তিক মুরতাদরা ইসলামের পুনরুত্থান দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠেছে। শায়খুল হাদিসের দল দেখছি দেশের বিভিন্ন শহরে সফর করছে আর ভাষণ দিচ্ছে।

ঙ প্রশ্ন করলেন—তুমি নাকি গত পরশু সাক্ষাৎকার দিয়েছো! কাল লিখল ইনকিলাব এ।

—‘সাক্ষাৎকার! পরশু!’ অসহায় তাকাই।

—হ্যাঁ তুমি নাকি এগারো তারিখে ইংলণ্ডের দ্য টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক ক্রিস্টোফার টমাসকে বলেছো, তুমি আদালতে যাওয়ার পথে বা জেলের ভেতর মৌলবাদীদের হাতে মরতে প্রস্তুত নও। তুমি নাকি নিরাপত্তা চেয়েছো, বলেছো দেশ ত্যাগ করবে না।

—তাই নাকি! তেতো হাসি ঠোঁটে।

—এটাই নাকি কোনও সংবাদপষেনর সঙ্গে তোমার প্রথম সাক্ষাৎকার! হানটেড ফেমিনিস্ট সিকস সেইফটি, নট এসকেপ রুট, ফিচারটির শিরোনাম এই।

—আশ্চর্য, এমন খবর কি করে দেয়! আমি বুঝি না এদের ব্যাপারগুলো। আমি আবার কথা বললাম কখন কার সাথে। আমি দেশ ছেড়ে পালাতে চাই না এটা ঠিক। কিন্তু, কি করে ওই লোকেরা জানলো তা! আমি তো কোনও সাংবাদিকের সাথে কথা বলিনি!

ঙ বললেন— অনুমান করে নিয়েছে বোধহয়।

হতে পারে।

ঙ বলেন —সাংবাদিকরা আজকাল অনুমানের ভিত্তিতেই অনেক কিছু লেখে। কিন্তু তুমি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে!, তা লিখেছে। তা কি করে জানবে? আর মিথ্যে কথাই বা লিখবে কেন যে তোমার সঙ্গে কথা হয়েছে। তোমার সঙ্গে সরাসরি কোনও কথা হয়েছে নাকি কারও মাধ্যমে কথা হয়েছে! তোমার ভাই কামালের কথা লিখেছে। তোমার বিপজ্জনক পরিস্থিতির কারণে পরিবারের লোকেরা অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কামাল বলেছে, তোমার বাবার বাড়িতে হামলা হয়েছে, তারা যেখানে যাচ্ছে, সেখানেই তাদের পেছনে সরকারি গোয়েন্দার লোক পিছু নিচ্ছে। এসব অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চাইছে সবাই।

ক বললেন— কামালের সঙ্গে হয়ত ক্রিস্টোফারের কথা হয়েছে।

—সে হতেই পারে। ঙ বললেন।

—আসলেই এ কথা লেখা আছে যে আমার সঙ্গে কথা হয়েছে! নাকি ইনকিলাবের বানানো গপ্প এটি! আমি প্রশ্ন করি।

ক বললেন—ইনকিলাবকেই বা বিশ্বাস করা যায় কি করে! হয়ত টাইমসে লেখা হয়েছিল হাইডিং এ আসার আগে যে কথা বলেছিলেন তসলিমা সেসব, নিশ্চয়ই এটা আগের কোনও ইন্টারভিউ।

একটু থেমে কর দিকে তাকিয়ে বললেন–নাকি ট!

কর কপালে ধীরে ধীরে ভাঁজ পড়তে থাকে।

ঙ বললেন—দ্য টাইমসে এর আগে তোমাকে নিয়ে সম্পাদকীয় লিখেছে,সেন্সরশিপ বাই ডেথ। আর ইনকিলাব খবরটি নিয়েছে অষ্ট্রেলিয়ার পত্রিকা দ্য অষ্ট্রেলিয়ান থেকে।

ঝ সবাইকে থামিয়ে বললেন—এটা তো খুব ভাল খবর যে বিদেশের বড় বড় পত্রিকায় লেখালেখি চলছে এ নিয়ে।

তা ঠিক তা ঠিক বলে ক আর ঙ দুজনই সায় দিলেন কিন্তু এও বলে দিলেন যে সাংবাদিকরা যদি আজ আমার সঙ্গে যোগাযোগের কোনও রকম পথ অবিষ্কার করতে পারে, তবে মোল্লাদের বেশিদিন লাগবে না আমাকে খুঁজে পেতে। সুতরাং সাবধান। এই রহস্যটি নিয়ে আমি ভাবতে থাকি। যদি ইনকিলাবের খবর সত্য হয়, তবে কি করে ওই সাংবাদিক আমি দেশে কি করছি না করছি জানছে! কোনও কি গুপ্তচর আছে কোথাও! ধন্দে পড়ি।

ঝ প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন যে সংসদে তোফায়েল আহমেদ, মোহাম্মদ নাসিম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন যে সরকারি দল ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বিধিবহির্ভূত বাজেট অধিবেশনের শেষ মুহূর্তে মওলানা ওবায়দুল হককে তসলিমা সম্পর্কে বলার সুযোগ করে দিয়েছে।

এ সময় ক হেসে উঠলেন, পত্রিকার একটি পাতা ঝর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন— গোলাম আযমের কথা উঠছে না যে! গোলাম আযম জামাতের সভায় বক্তৃতা দিচ্ছে।

—ইনডোর সভায় নিশ্চয়ই! বলতে বলতে ঝ পত্রিকাটির পাতা তুলে নিলেন।

—ইনডোর হবে কেন! বিশাল ময়দানে। দিনের আলোয়।

পত্রিকার পাতার দিকে ঝুঁকে দেখি ছবিটি। মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা গোলাম আযমের মাথায় জিন্নাহ টুপি, মুখে শাদা দাড়ি, সামনে অগুনতি শাদা টুপির শ্রোতা। কি কাণ্ড কি কাণ্ড! কেউ বাধা দিল না! এত সাহস পেয়ে গেছে গোলাম আযম! স্পর্ধা হল কি করে! কোথায় এখন আওয়ামী লীগ, কোথায় নির্মূল কমিটি! কেউ কিছু বলছে না?

ঙ ঠোঁট উল্টে বললেন— কে আর কী করতে পারবে!

—গোলাম আযম কাদের সাথে দেখা করেছে, সেটা পড়েন।

কর কথায় খবরটিতে দ্রুত চোখ বুলিয়ে থ হয়ে যাই, সুপ্রিম কোর্ট গোলাম আযমকে বাংলাদেশের নাগরিক বলে রায় দেওয়ার পর বাংলাদেশ হিন্দু সংগ্রাম কমিটির লোকেরা জামাতের কার্যালয়ে গিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানান। আর গোলাম তাঁদেরই উদ্দেশে বলেন, যে, ধর্মের ভিত্তিতে যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, সেটিই প্রকৃত বন্ধুত্ব। এ ধরনের বন্ধুত্বই সবচেয়ে গভীর হয়। ধর্মহীন বন্ধুত্ব ক্ষণভঙ্গুর হতে বাধ্য।

আশ্চর্য! গোলাম আযম ওই হিন্দুদের বলেছেন, আপনাদের মত সত্যের সাধককে শ্রদ্ধা না করে পারছি না। কারণ আপনারা বাংলাদেশের নির্যাতিত সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে যাচ্ছেন। একজন প্রকৃত ধার্মিকের সাথে অপর ধার্মিকের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবেই। একজন ধার্মিক আরেকজন অধার্মিকের চেয়ে ধার্মিককে বেশি পছন্দ করবে, এটাই স্বাভাবিক।

এটুকু পড়েই আমি পত্রিকাটি কর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলি—গোলাম আযম ঠিকই বলেছেন, মিথ্যে বলেননি। তাই তো দেখি আমরা, এদেশের জামাত নেতা ভারতে গিয়ে বিজেপি নেতার সঙ্গে দেখা করছে। কোলাকোলি করছে। দাওয়াত খাচ্ছে। দুদলে তো ভাল বন্ধুত্ব।

ঝ পত্রিকার পাতাটি মাঝখান থেকে তুলে নিয়ে বলেন—সারা দেশে দেখছি হরতাল সফল হয়েছে বলে বিশাল জনসভা হচ্ছে, মোল্লারা মহানন্দে মিছিল করে বেড়াচ্ছে। বলছে, ৩০ জুনের সর্বাত্মক হরতাল এদেশে ইসলামি শাসন কায়েমের পথে জ্বলন্ত মাইলফলক। এসবই খবর! কোনও কি ভাল খবর নেই?

ঙ বলেন—বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট আর গণফোরামের একটি মতবিনিময় সভা হয়েছে। সভায় বলেছে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

ঝ বললেন—আর কত বলবে এসব! শুনেছিই তো অনেক। যেতে হবে যেতে হবে বললে তো আর চলছে না। এখন গিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে যে গিয়েছে। যাচ্ছে না তো! গেলে কি করে গোলাম আযম সভা করতে পারে ঢাকা শহরে!

আধো আলোয় বসে আমাদের চাপা স্বরের কথাবার্তা তখনও শেষ হয়নি, তখনও দেশের অবস্থা যেটুকু জেনেছি সেটুকুতে জানার ইচ্ছে মেটেনি আমার, ক আর ঙ উঠে পড়লেন হঠাৎ। অন্ধকারে বেড়ালের মত হেঁটে, বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবেন ওঁরা। ওঁদের সামনে সামনে হাঁটবেন ঝ। পথ দেখিয়ে নেবেন।

অনেক রাতে ঝ তাঁর এক শিষ্যকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। বড় বিশ্বস্ত শিষ্য। শিষ্যটি একটি ছাত্রনেতা। ছাত্রনেতাটিকে ঝর ডেকে আনার কারণ হল, আমাকে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নেতাটি সাহায্য করতে পারে। পালাতে আমি চাইছি না, কিন্তু ঝ মনে করছেন না আর কোনও উপায় আমার আছে বাঁচার। প্রায়ান্ধকার ঘরটিতে বসে ছাত্রনেতা দেশের সীমানা ডিঙিয়ে যাওয়ার ভিন্ন ভিন্ন রোমহর্ষক পদ্ধতির কথা বলে। আমাকে রাতের অন্ধকারে এ বাড়ি থেকে তুলে সীমান্তের কাছাকাছি কোনও জায়গায় ছেড়ে দেওয়া হবে। ওখানে পাহাড়, হাওড় বা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করতে দৌড়োতে হবে ঊর্ধ্বশ্বাসে।

আমার পরনে থাকবে আপাদমস্তক বোরখা, লম্বা চুল। ঝ যোগ করলেন।

আমি মলিন কণ্ঠে বলি—ওখানে যদি বর্ডারের বিডিআর দেখে ফেলে! যদি ধরা পড়ি!

—টাকা দিলে কাজ হয়।

—টাকা দিলে যদি কাজ না হয়। যদি মোল্লাদের হাতে পড়ি!

ছাত্রনেতা মুখ মলিন করে বলল—এসব ঝুঁকি তো আছেই। ঝুঁকি নিয়েই তো কত লোক যাচ্ছে।

পালাবার কোনও পদ্ধতিই আমাকে আকর্ষণ করে না। মন খারাপ করে বসে থাকি। ঝ খুব মন দিয়ে ছাত্রনেতাটির নানা রকম পদ্ধতি প্রক্রিয়া শুনতে থাকেন।

সকল অধ্যায়

১. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০১
২. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০২
৩. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৩
৪. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৪
৫. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৫
৬. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৬
৭. ২. তাণ্ডব – ০১
৮. ২. তাণ্ডব – ০২
৯. ২. তাণ্ডব – ০৩
১০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০১
১১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০২
১২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৩
১৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৪
১৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৫
১৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৬
১৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৭
১৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৮
১৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৯
১৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১০
২০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১১
২১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১২
২২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৩
২৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৪
২৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৫
২৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৬
২৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৭
২৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৮
২৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৯
২৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২০
৩০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২১
৩১. ৪. দেশান্তর – ১
৩২. ৪. দেশান্তর – ২
৩৩. ৪. দেশান্তর – ৩
৩৪. ৪. দেশান্তর – ৪ (শেষ)
৩৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২২
৩৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৩
৩৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৪
৩৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৫
৩৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৬
৪০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৭
৪১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৮
৪২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৯
৪৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩০
৪৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩১
৪৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩২
৪৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৩
৪৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৪
৪৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৫
৪৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৬
৫০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৭
৫১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৮
৫২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৯
৫৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪০
৫৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪১
৫৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪২
৫৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৩
৫৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৪
৫৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৫
৫৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৬
৬০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৭
৬১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৮
৬২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৯
৬৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫০
৬৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫১
৬৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫২
৬৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৩
৬৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৪
৬৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৫
৬৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৬
৭০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৭
৭১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৮
৭২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৯
৭৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬০
৭৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬১
৭৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬২

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন