৩. অতলে অন্তরীণ – ৩২

তসলিমা নাসরিন

পাঁচ জুলাই, মঙ্গলবার

গতকালের পত্রিকায় ছাপা খবর ইচ্ছে করেই পড়িনি। আজ হাতে নিয়েই দেখি বিশাল মিছিলের ছবি। সন্ত্রাসী নৈরাজ্যবাদীদের গ্রেফতার ও বিচার, দৈনিক ইনকিলাবসহ বিভিন্ন সংবাদপষেন হামলাকারীদের শাস্তি প্রদান ও ব্লাসফেমী আইন প্রণয়নের দাবিতে জাতীয় যুব কমাণ্ড কেন্দ্রীয় কমিটি গতকাল রাজধানীতে যে বিশাল মিছিল করেছে, তার ছবি।

তসলিমা পালালে সরকারকে জনতার আদালতে যেতে হবে। জাতীয় যুব কমাণ্ড ঘোষণা করেছে যে তসলিমা নাসরিন সম্পর্কে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের বক্তব্য সংবাদপষেন প্রচারকারী ইউসিসএর প্রেস বিজ্ঞপ্তিটির জন্য দুঃখ প্রকাশ করা না হলে যুব কমাণ্ড বাংলাদেশের মার্কিন তথ্য কেন্দ্র ঘেরাও করবে। গতকাল দৈনিক বাংলার মোড়ে আয়োজিত এক সমাবেশে যুব কমাণ্ড নেতারা এ ঘোষণা দেন। বলেন, বাংলাদেশের মাটিতে কুখ্যাত মুরতাদ তসলিমা নাসরিনের ফাঁসি কার্যকর করা হবে। তারা সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, সরকারি সংস্থাগুলোকে ফাঁকি দিয়ে তসলিমা যদি পালিয়ে যায়, তাহলে ক্ষমতাসীনদের জনতার আদালতে দাঁড় করানো হবে। বক্তারা অবিলম্বে তসলিমা নাসরিনকে গ্রেফতারের দাবি জানান। যুব কমাণ্ড সভাপতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের উদ্দেশে বলেন, তসলিমার প্রতি তোমার ভালবাসা থাকতে পারে, কিন্তু এটি আমেরিকা নয়, এটি বাংলাদেশ। ওলামা মাশায়েখের এ দেশে ইসলামের অবমাননা করা হলে জনতা চুপ করে থাকবে না। তসলিমাকে এ দেশ থেকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নরওয়ের কূটনীতিক কোনও ভূমিকা রাখলে বাংলাদেশ জ্বলে উঠবে।

ইনকিলাবের গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো হচ্ছে গ্রামে গঞ্জে, দেশের আনাচে কানাচে তৌহিদী জনতা ফুঁসে উঠছে আমার ফাঁিসর দাবিতে। গ্রাম গঞ্জে হরতাল সফল হয়েছে। হরতাল সফল হওয়া মানেই মনে প্রাণে এ দেশের জনগণ তসলিমার ফাঁসি চাইছে, ব্লাসফেমি আইন চাইছে। চারদিকে সভা হচ্ছে ধর্মপ্রাণ মানুষের। তারা একটি কথাই বার বার বলছে, ধর্মদ্রোহী তসলিমার মুক্তি নেই, সরকার যদি তসলিমার পক্ষ নেয়, তবে সরকারকেও তারা দেখে ছাড়বে। গ্রামে গঞ্জে নাস্তিক মুরতাদ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হচ্ছে। ঈশ্বরগঞ্জে, যে ছোট্ট শহরটিতে আমার ছোটবেলার একটি সময় কেটেছে, যেখানে ইয়াসমিনের জন্ম হয়েছে, সে শহরের লোকেরা তসলিমার ফাঁসি চাই লেখা ব্যানার নিয়ে মিছিল করছে। জমিয়াতুল মোদ−র্রছিনের ঈশ্বরগঞ্জ শাখা এই বিক্ষোভ মিছিলটি করেছে। বিরাট বিক্ষোভ মিছিল। ছবি দেখেই অনুমান করা যায়, কত শত লোক নেমেছিল সেই মিছিলে। সভায় মাদ্রাসার বড় বড় শিক্ষকরা বলেছেন, ইহুদি খ্রিস্টান ও ব্রাহ্মণ্যবাদের পদলেহী ইসলাম ও দেশদ্রোহী এক অশুভ শক্তি আল্লাহ, আল্লাহর রাসুল ও পবিত্র কোরানের আয়াতের বিকৃত তরজমা করে তা নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করেছে। কুলাঙ্গার তসলিমা নারী স্বাধীনতার নামে পবিত্র কোরানের আমূল পরিবর্তন দাবি করছে। যার ফলে বিশ্বাসী মানুষ সারা দেশে প্রতিবাদে ফেটে পড়ছে এবং তসলিমাসহ সকল মুরতাদদের ফাঁসি দাবি করছে।

আমেরিকা ও বিবিসির ডবল স্ট্যাণ্ডার্ড নিয়ে ইনকিলাবের প্রতিবেদন — ৯৯ ভাগ মানুষ নয়, এক তসলিমার পক্ষ নিয়েছে খ্রিস্টান দুনিয়া। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের কাছে তসলিমা নাসরিন চরমভাবে ধিকৃত ও প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর তার উদ্ধার ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে আমেরিকা ও ভারতসহ খ্রিস্টান দুনিয়া। তাদের এই কাজে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে উৎকটভাবে মুসলিমবিরোধী, প্রবলভাবে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান বিরোধী এবং নির্লজ্জভাবে ভারতপন্থী ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন বা বিবিসি। এই স্ব আরোপিত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এসব শক্তি অনেক অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার সুমহান নীতি চরমভাবে লঙ্ঘন ও পদদলিত করেছে। তসলিমা নাসরিনের ব্যাপারে রবাহুত দরদ ও একাত্মতা প্রকাশ করতে যেয়ে ভারত, আমেরিকা, পশ্চিমা বিশ্ব এবং বিবিসি মত প্রকাশের স্বাধীনতার আবরণে যে সব কথাবার্তা বলছে, তার ফলে তাদের অজ্ঞাতে তাদের ডবল স্ট্যান্ডার্ড রূপটি উৎকট হয়ে প্রকাশ পেয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে বিবৃতি গেছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অবস্থিত পশ্চিমা দূতাবাসগুলোর নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক আইন এবং এ দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা আছে, নিশ্চয়ই তারা তসলিমাকে অবৈধভাবে কোনও দূতাবাসে কোনও আশ্রয় দেয়নি।

ইনকিলাবের খবর, তসলিমা সম্পর্কে পশ্চিমা অনুরাগীদের বাড়াবাড়ি এক ভয়ানক বিকৃতি। বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের অনুরাগী পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম ও কর্তৃপক্ষের বাড়াবাড়ি এশীয় গণমাধ্যমের দৃষ্টিতে এক ভয়ানক বিকৃতি বলে চিহ্নিত হয়েছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক ব্যাংকক পোস্ট এর পয়লা জুলাই সংখ্যায় ধর্মীয় সতর্কতার ক্ষেষেন অস্বস্তিকর ঘাটতি শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধে ধর্মের সুস্থ প্রভাব উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সেক্যুলারিজমের নামে ধর্মকে অস্বীকার করার প্রবণতা এক ধরনের উগ্রতা। পত্রিকাটিতে বলা হয় এই উগ্রতা সেক্যুলারিজম শব্দটিকেই বিকৃতিতে পর্যবসিত করেছে। ভারতীয় সাংবাদিক খুশবন্ত সিংএর উদ্ধৃতি দিয়ে তসলিমা নাসরিনের মত দ্বিতীয় শ্রেণীর কাল্পনিক উপন্যাস লেখিকার ব্যাপারে কিছু করাটা এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এই ঝুঁকি দেখা দিয়েছে সেক্যুলার ফান্ডামেন্টালিস্ট অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতাপন্থী মৌলবাদীদের তরফ থেকে। কেননা, এরা তাদের অসহিষ্ণুতা ছড়িয়ে দিচ্ছে যদিও ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে, আসলে তা পরিণামে সকল ধর্মেরই মূলে আঘাত হানছে। রুশদি সৃষ্ট যন্ত্রণাদায়ক হট্টগোলের শেষে এবার যে তসলিমা অ্যাফেয়ার এর উদ্ভব ঘটেছে এতে যেন সেক্যুলারিজম উগ্র বিকৃতির মধ্যে বিলীন হয়ে না যায়। এখনকার পরিস্থিতিকে আর রিলিজিয়াস ফাণ্ডামেন্টালিজম বলে বিষোদগার করার উপায় নেই। বরং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মৌলবাদ শব্দটিকেই এখন নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। সততার সঙ্গে ধর্মের দিকে তাকালে কারও পক্ষেই মৌলবাদ মৌলবাদ বলে চিৎকার করা সম্ভব হবে না। তসলিমা নাসরিনের লেখালেখি এবং তার জীবন বৃত্তান্ত সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে তা যদি ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য নাও করা হয় তবু সে যে তার মত প্রকাশের ক্ষেষেন সীমা ছাড়িয়ে গেছে, এটা মানতেই হবে।

আরও খবর; খেলাফত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দেশের প্রখ্যাত উলামায়ে কেরাম ও ইসলামি চিন্তাবিদদের এক বৈঠকে কুখ্যাত তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে সাম্প্রতিক দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রে গভীর উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বলা হয়, নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে জাতির দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাবার জন্য সরকার একটি ভ্রষ্টা মেয়েকে নিয়ে ঘৃণ্য রাজনীতি শুরু করেছে তার পরিণতিতে অবশেষে সরকারকেই ভুগতে হবে। সভায় দেশের বর্তমান পরিস্থিতির আশু অবসানকল্পে অবিলম্বে তসলিমা নাসরিনকে গ্রেফতার করে শাস্তি দেবার জন্য সরকার কাছে জোর দাবি জানানো হয়। সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয় যে সরকার যদি আগামী ১০ জুলাই রোববারের মধ্যে তসলিমাসহ চিহ্নিত সকল ধর্মদ্রোহী রাষ্ট্রদ্রোহীদেরকে গ্রেফতার করে বিচারের ব্যবস্থা না করে, তবে তৌহিদী দেশবাসীকে সাথে নিয়ে আগামী ১১ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর সুগন্ধা কার্যালয় ঘেরাও করা হবে। সভায় দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করা হয় যে, সরকার যদি তসলিমাকে দেশের বাইরে যাবার সুযোগ করে দেয়, তবে অবশ্যই দেশব্যাপী সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু হবে।

আরমান হত্যাকে পুঁজি করেছে ইসলামী দলগুলো। মিছিল করছে আরমান কেন খুন হল তা নিয়ে। খুলনায় ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী প্রতিরোধ কমিটির বিশাল সভা হচ্ছে, মিছিল হচ্ছে। আবার বামঘেঁষা পত্রিকা জানাচ্ছে, বামফ্রণ্টের সমাবেশ ও মিছিলও হয়েছে, মৌলবাদীদের প্রতিহত করার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানানো হয়েছে। মৌলবাদী পত্রিকায় প্রতিদিনই গরম গরম খবর। সিলেটে তৌহিদী ছাত্র জনতাকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে সিলেটে সমাবেশ হচ্ছে। ধর্মদ্রোহী মুরতাদ নাস্তিক এনজিও চক্রের বিরুদ্ধে গ্রামে গঞ্জে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালন হয়েছে, এবং অমৌলবাদীদের হামলায় আহতদের হিসেব দিয়ে লেখালেখি চলছে।

দেশে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। এ অবস্থায় আদালতে আমার হাজির হবার যে তারিখটি ছিল, সে তারিখটিও তুমুল তাণ্ডবে ভেসে গেল। হ্যাঁ, কাল ছিল আমার আদালতে হাজিরা দেবার দিন, কাল মুখ্য মহানগর আদালতের হাকিম আমার হাজিরার সময় আরও এক মাস বাড়িয়ে দিয়েছেন।

আজ দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পাট চুকলে ঞ আমার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন। ঞর জীবনের অনেক কথাই বললেন। মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সেই পাকিস্তান আমল থেকে তিনি জড়িত, সে সময় কি রকম সেই আন্দোলন ছিল বর্ণনা করলেন। কি রকম ভাবে তিনি এবং তাঁর তখনকার বন্ধুরা পাকিস্তান সরকারের সাম্প্রদায়িক নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বললেন। টগবগে এক একজন স্বপ্নবান তরুণ যোদ্ধা সরকারি নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, কিন্তু নিজেদের আদর্শ বিসর্জন দেননি। তখনকার দিনের সঙ্গে তুলনা করলে মৌলবাদীদের জোর এখন অনেক বেশি। স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়েছে ঞর। কত সংগ্রামের পর, কত সাধনার পর নিজেদের জন্য একটি দেশ পেয়েছেন, সেই দেশ কি না এখন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ! এত কিছুর পরও ঞর দুচোখে দুফোঁটা স্বপ্ন নক্ষষেনর মত জ্বলে। নক্ষত্র থেকে আলো এসে আমার চোখে পড়ে। আমি বুক ভরে শ্বাস নিই। হারিয়ে যাওয়া একটি শক্তি একটু একটু করে কোত্থেকে যেন ফিরে আসে আমার মধ্যে।

বাংলাদেশঃ মৌলবাদের অভয়ারণ্য–এই শিরোনামে আজ কবীর চৌধুরী আর সৈকত চৌধুরীর লেখা একটি কলাম ছাপা হয়েছে। কলামের শুরুটি এরকম, ‘কেমন আছো, তসলিমা?

ভাল নেই নিশ্চয়ই। ভাল থাকার কথাও নয়। মাথার ওপর হুলিয়া নিয়ে, স্বজন ছেড়ে, সর্বোপরি লেখালেখির জগত থেকে দূরে সরে থাকা যে কোনও সৃষ্টিশীল মানুষের পক্ষেই অসম্ভব এক কষ্টকর কাজ।

ভাল আমরাও নেই তসলিমা। বাংলাদেশ ভাল নেই। সব ভালবাসা আজ নির্বাসনে। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ধর্মের শাশ্বত কল্যাণের বাণী, প্রগতির উর্ধ্বমুখ সব আজ জিম্মি হয়ে আছে এক শ্রেণীর ধর্মান্ধ, ক্রোধান্ধ, বর্ণবাদী, মতলববাজ মানুষের হাতে। ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থতা, লোভ, হিংসা, হানাহানি, ক্ষমতার রশি আঁকড়ে ধরার প্রাণপণ প্রচেষ্টা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। গোটা জাতিকে পরমুখাপেক্ষী মেরুদণ্ডহীন প্রজাতিতে রূপান্তরিত করার হীন প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে সর্বত্র। যে স্নিগ্ধ সহিষ্ণু স্নেহের আঁচলে সাজানো আমাদের গৃহকোণ, সেখানে আজ মৌলবাদের হিংস্র থাবা। এই তো সেদিন ডঃ আহমদ শরীফের বাসায় বোমা হামলা হল, তারপর হামলা এল শফিক রেহমানের ওপর। মৌলবাদী অপশক্তি তাদের শক্তি প্রদর্শন করে ক্ষমতার মহড়া দিচ্ছে প্রগতির শরীরে আগুন ধরিয়ে। ঘরে আগুন, বাইরে আগুন, বুকের ভেতরে আকণ্ঠ এক জ্বালা – এই যেন বেঁচে থাকা। আর এদিকে একত্রিশ শতাংশ ভোটারের গণতান্ত্রিক(!) সরকার গণতন্ত্র এনেছি, গণতন্ত্র দিয়েছি বলে ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছে। আমাদের চোখ খোলা, খোলা কানও, তবু বুকের ভেতরে মাতম ওঠে কণ্ঠ রোধের কষ্টে। সময়ের ঘড়ি ক্রমশ সামনে এগোয়, আর আমাদের দেশ ক্রমাগত পেছনে যাচ্ছে, হাজার বছরেরও পেছনে। অলিখিত কিন্তু প্রকাশ্য ধর্মযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে ধর্ম সেবকেরা সকল আইন শৃঙ্খলা সভ্যতার রীতিনীতি উপেক্ষা করে। ধর্মের নামে অমানবিক ফতোয়া দিয়ে ধ্বংস করছে জনহিতকর প্রতিষ্ঠান, ধর্মনাশের ধুয়া তুলে নরপশুরা মাটিতে পুঁতছে সাধারণ জনগণ, সংবাদপত্র অফিসে তথা গণতন্ত্রের প্রাথমিক সৈনিকদের বাসভূমিতে বোমা ছুঁড়ছে। আজ গোটা দেশের আকাশ জুড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে একাত্তরের সেই পুরোনো শকুন। সময় হয়েছে তসলিমা, যুদ্ধে যাবার। বেশ আছো তসলিমা, আপাত নিরাপদ দূরত্বে। কেমন আশায় ছিলাম দীর্ঘ অন্ধকার থেকে আলোয় এসে নব্বইএর গণঅভ্যুত্থান থেকে ফিরে পাবো একটি সেক্যুলার বাংলাদেশ। আমাদের স্বপ্ন সাধনায় চাওয়া পাওয়ায় নতুন মন্ত্রে জেগে উঠবে নতুন স্বদেশ। কেমন ভুলের বাসরে গড়েছিলাম বাংলাদেশ। আর কেনই বা ভুলের ভালবাসার এমন অন্তঃক্ষরণ এই অবেলায়। ..

তারপর অনেক কথা। শেষ করেছেন এভাবে, ‘এদিকে ধর্মান্ধ তৌহিদী পুংগবেরা ৩০ জুনে হরতাল ডেকেছিল। ভণ্ড সরকার সে হরতাল রোখেনি। আমরা স্বাধীনতার পক্ষের মানুষেরা এই হরতাল রোখার জন্য সবাইকে একত্রিত হবার ডাক দিয়েছিলাম। আমরা খুব ভাল করেই জানি যে এর ফলে আমাদের ওপরও হামলা হতে পারে। তবুও আমরা রুখে দাঁড়িয়েছি সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে, সকল ধর্মীয় উন্মাদনার বিরুদ্ধে। আমরা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ধর্ম উন্মাদদের এবং মৌলবাদী সরকারকে জানিয়ে দিতে চাই যে আমরা আমাদের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও সকল মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়ে যাবো। মৃত্যুর ভয়ে আমরা ভীত নই। আমরা সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে এই সরকারের হাতে শুধু ইসলাম ধর্ম এবং লেখক শিল্পী সাংবাদিকরাই বিপণ্ন নয়, একই সঙ্গে বিপর্যস্ত দেশের বারো কোটি মানুষ। ধর্মের নামে ধর্মনাশ করে চলেছে মৌলবাদীরা। আর সরকার গণতন্ত্রের নামে বলি দিচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের চেতনাকে।

তসলিমা, যৌবন যার, মনের বিশ্বাসের সঙ্কল্পের ক্ষেষেন, তার জন্য যুদ্ধে যাবার এখনই শ্রেষ্ঠ সময়।’

কলামটি পড়া শেষ করে চোখ বুজি, বোজা চোখের বাঁধ ভেঙে জল নামে, গড়িয়ে নামতে থাকে গালে। দুহাতে মুছি জল। জল আরও নামে। মুখটি বালিশে গুঁজি রাখি। বালিশ ভিজে যেতে থাকে। থাক, ভিজুক। আজ ভিজে যাক সব।

 

গভীর রাতে ক তাঁর বাহিনী নিয়ে ঝড়ের বেগে এসে আমাকে তুলে নিয়ে গেলেন ঞর বাড়ি থেকে টর বাড়ি। টও একজন শিল্পী, তবে ঞর মত বিখ্যাত নন, ঝর মতও বিখ্যাত নন। ক আর তাঁর গাড়িচালক বন্ধু আমাকে আজ এ বাড়ির ভেতর ঢুকিয়েই বিদেয় হননা। তাঁরাও ভেতরে ঢোকেন। টর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন আমার। ট অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য। ঘরগুলোর আলো নিবিয়ে বৈঠক ঘরে অল্প একটি আলো জ্বেলে রেখেছিলেন শুধু। এটি আলাদা কোনও বাড়ি নয়। অ্যাপার্টমেণ্টে বিল্ডিং। ট এই অ্যাপার্টমেণ্টে একা থাকেন। ক, কর বন্ধু আর ট টর বৈঠক ঘরের কার্পেটে বসে অনেকক্ষণ দেশের অবস্থা নিয়ে কথা বললেন। আমি নির্বাক শ্রোতা। অত্যন্ত প্রতিভাবান যুবক এই ট। একসঙ্গে হাজারটা কাজ করেন। বহুকাল ইউরোপে ছিলেন। এখন দেশে ফিরে এসে শিল্পের জগতে নিজেকে নিবেদন করেছেন। কর অনেকদিনের বন্ধু ট। কর কারণেই সম্ভব হয়েছে টর বাড়িতে আমার আশ্রয় পাওয়া। কিন্তু এখন ঝামেলা হল, এবাড়িতে রাঁধেন না, বাড়েন না। তিনি সকালে বেরিয়ে যান, ফেরেন রাত্তিরে। এই অবস্থায় আমার থাকাটি চলবে এখানে, কিন্তু খাওয়াটির ঠিক কি হবে কও ঠিক জানেন না। ক বলেন যে তিনি নিজে অথবা কাউকে যোগাড় করবেন খাবার নিয়ে আসার জন্য। কেবল খাবার নিয়ে আসাই নয়, আমার সঙ্গে দিনের বেলাটা কেউ যেন থাকতে পারে, সে ব্যবস্থাও করবেন। ককে আমার আগের চেয়ে বেশি প্রাণবন্ত লাগে। আগের সেই দুশ্চিন্তাটি এখন আর তাঁর মধ্যে নেই। আসলে বিপদের মধ্যে দীর্ঘদিন কাটালে বিপদকে বোধহয় আর বিপদ বলে মনে হয় না। ক এখন মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনে রীতিমত একজন সাহসী যোদ্ধার ভূমিকায়। আমাকে একটি গুরুদায়িত্বও দিলেন, ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে ছড়া মত কিছু স্লোগান লিখে দিতে হবে। তিনি শিগরি একটি লিফলেট ছাপবেন। বললেন কাল এসে তিনি নিয়ে যাবেন ছড়াগুলো।

ক আর তার সুদর্শন গাড়িচালক বন্ধুটি বিদেয় হলে ট আমাকে নিয়ে অন্ধকার বারান্দাটিতে বসলেন। কালো একটি আকাশ চোখের সামনে। নিঝুম সারা পাড়া। ট বলতে থাকেন স্বপ্নময় কণ্ঠে তাঁর জীবনের টুকরো টুকরো কথা। এ বাড়িতে তিনি তাঁর প্রেমিকাকে নিয়ে বহুদিন থেকে সংসার করছেন। প্রেমিকাটি এখন লন্ডনে পড়াশুনা করতে গেছেন, ফিরে আসবেন মাস কয় পর। ট এবং তাঁর বান্ধবী বিয়েতে বিশ্বাসী নন, তাঁরা ভালবাসায় বিশ্বাসী। ভালবাসাই তো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে। জিজ্ঞেস করলাম বিয়ে না করে স্বামী স্ত্রীর মত বাস করার কারণে কোনও অসুবিধে হয় কি না, অর্থাৎ লোকেরা মন্দ বলে কি না।

ট চমৎকার হেসে বললেন, লোকে মন্দ বললে আমার বয়েই গেল!

–আপনার বান্ধবীও কি তাই? পরোয়া করেন না লোকের কথা?

–ও তো আমার চেয়েও বেশি সাহসী।

এমন জুটি সমাজে বিরল। তারপরও ভাল লাগে ভাবতে এই কুসংস্কারাচ্ছত সমাজেই সাহসী কিছু মানুষ নিজেদের পছন্দমত জীবন যাপন করছেন। সংস্কার অনেকেই ভেতরে ভেতরে ভাঙছে। একদিন, আমার বিশ্বাস, পুরোনো পচা নীতিরীতিগুলো ভেঙে গুঁড়া হয়ে যাবে, মানুষ তার নিজ সত্ত্বা নিয়ে, অধিকার নিয়ে, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে বাস করবে একটি শিক্ষিত সুন্দর সমাজে। ট আর আমি বারান্দায় বসে রাতের অপরূপ রূপ দেখি। শীতল হাওয়া এসে এই গ্রীষ্মের আগুনে পোড়া আমাদের শরীরে শীতল শান্তির পরশ বুলিয়ে যায়। আমাদের মনেও ফুরফুরে হাওয়াটি বইতে থাকে। আমরা আর দেশের অবস্থার কথা বলে দুঃখ করি না। জীবন ও জগতের সৌন্দর্যের কথা বলি। অনেকদিন পর আমার মনে হয় জীবন খুব সুন্দর, একে হারানোর কোনও অর্থ হয় না।

রাতে ট তাঁর শোবার ঘরটি ছেড়ে দেন আমার জন্য। নিজে তিনি অন্য ঘরে ঘুমোন।

সকল অধ্যায়

১. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০১
২. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০২
৩. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৩
৪. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৪
৫. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৫
৬. ১. প্যারিসের ডায়রি – ০৬
৭. ২. তাণ্ডব – ০১
৮. ২. তাণ্ডব – ০২
৯. ২. তাণ্ডব – ০৩
১০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০১
১১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০২
১২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৩
১৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৪
১৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৫
১৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৬
১৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৭
১৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৮
১৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ০৯
১৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১০
২০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১১
২১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১২
২২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৩
২৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৪
২৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৫
২৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৬
২৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৭
২৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৮
২৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ১৯
২৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২০
৩০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২১
৩১. ৪. দেশান্তর – ১
৩২. ৪. দেশান্তর – ২
৩৩. ৪. দেশান্তর – ৩
৩৪. ৪. দেশান্তর – ৪ (শেষ)
৩৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২২
৩৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৩
৩৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৪
৩৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৫
৩৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৬
৪০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৭
৪১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৮
৪২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ২৯
৪৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩০
৪৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩১
৪৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩২
৪৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৩
৪৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৪
৪৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৫
৪৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৬
৫০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৭
৫১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৮
৫২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৩৯
৫৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪০
৫৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪১
৫৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪২
৫৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৩
৫৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৪
৫৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৫
৫৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৬
৬০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৭
৬১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৮
৬২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৪৯
৬৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫০
৬৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫১
৬৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫২
৬৬. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৩
৬৭. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৪
৬৮. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৫
৬৯. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৬
৭০. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৭
৭১. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৮
৭২. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৫৯
৭৩. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬০
৭৪. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬১
৭৫. ৩. অতলে অন্তরীণ – ৬২

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন