তসলিমা নাসরিন
উনিশ জুন, রবিবার
শামসুর রাহমান কলাম লিখেছেন ভোরের কাগজে, নইলে বড় বেশি দেরি হয়ে যাবে। শুরুতে বলেছেন জ্ঞআমরা যারা লেখক শিল্পী এবং সাংবাদিক তারা আজ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন এবং বিপন্ন। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষে আমরা স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। পথে নেমেছি, বহু ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করেছি আমরা। .. স্বৈরশাসককে হটিয়ে আমরা উল্লসিত হয়েছিলাম, তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়িত হবে ভেবে আশান্বিত হয়েছিলাম। .. জনগণের রায়ে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হল। বহুদিন পর গণতন্ত্রের উজ্জ্বল মুখ দেখার আশায় উদগ্রীব হয়ে রইলাম। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়েই বেমালুম ভুলে গেল তিন জোটের রূপরেখার কথা। গণতন্ত্রের লেবাসের আড়ালে স্বৈরাচারই বহাল রয়েছে। বর্তমান সরকারের ক্রিয়া কলাপে আজ গণতন্ত্র সঙ্কটাপন্ন। গণতন্ত্রের একটি প্রধান শর্ত বাক স্বাধীনতা। প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বাক স্বাধীনতা খর্ব করার কোনও অবকাশ নেই। যত মত তত পথ। প্রত্যেকেরই নিজের মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। ঈশ্বরে বিশ্বাসী কোনও ব্যক্তি যেমন নিজের মত প্রকাশ করতে পারবেন, তেমনি একজন নিরীশ্বরবাদীও স্বমত প্রকাশ করতে পারবেন। নিজ নিজ মত প্রকাশের জন্যে কেউ নিগৃহীত, উৎপীড়িত হবেন না — এটাই গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবাই সমান অধিকার ভোগ করবেন। আস্তিক এবং নাস্তিকের অধিকার অভিন্ন থাকবে। ফরাসি লেখক ভলতেয়ার বলেছেন, তোমার মতের সঙ্গে আমি একমত নই, কিন্তু তুমি যাতে অকুণ্ঠচিত্তে নিজের মত প্রকাশ করতে পারো, সেজন্যে আমি আমার রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে লড়ব। ভলতেয়ারের এই অমর উচ্চারণ প্রকৃত গণতন্ত্রেরই বাণী। কিন্তু আমাদের দেশে কী হচ্ছে? সত্যিকার গণতন্ত্রচর্চা কি হচ্ছে এখানে? সখেদে বলতে হচ্ছে, না। মত প্রকাশের জন্য খণ্ডিত হচ্ছেন লেখক ও সাংবাদিক। মসিজীবীদের ওপর সবসময় খাঁড়া ঝুলছে। কবে কার গর্দান যাবে, কেউ বলতে পারে না। যে লেখক যা বলেননি তা লেখকটির ওপর আরোপ করে তাঁকে দণ্ড দেওয়া হচ্ছে। এখানে স্বাভাবিকভাবে তসলিমা নাসরিনের কথা এসে পড়ে। . .’ এরপর আমার প্রসঙ্গে কিছুক্ষণ বলে সাংবাদিকদের প্রসঙ্গে আসেন, আহমদ শরীফের বাড়িতে হামলার প্রসঙ্গ টানেন। তারপর বলেন, ‘বিএনপি সরকার দেশটিকে ফতোয়াবাজ ও মৌলবাদী দলগুলোর কাছে বন্ধক দিতে আদা জল খেয়ে লেগেছেন। যারা বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের বিরুদ্ধে ছিল আগাগোড়া, যাদের নেতা (গোলাম আযম) বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও বিদেশে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করেছে, যারা একাত্তরে ভুল করিনি সগর্বে বলে বেড়ায়, তারাই যখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্যক্তিদের দেশদ্রোহী আখ্যা দেয়, তখন তাদের কী আখ্যা দেওয়া যায় তা জনসাধারণের উপরই রইল।’ এরপর, আগাগোড়া নাস্তিক শামসুর রাহমানকে খানিকটা ডিপ্লোমেট হতে হয়, তিনি বলেন, ‘ইসলাম, আমরা জানি, শান্তির ধর্ম। ইসলামের নামে যারা অশান্তির সৃষ্টি করে, ক্ষমতা দখলের জন্যে ধর্মান্ধতার আশ্রয় নেয়, ধর্মকে ব্যবহার করে সওদাগরের মত তখন কি আমরা মারহাবা মারহাবা বলে উল্লাসে ফেটে পড়ব? ইসলাম বিপন্ন, এ কথা সেই শৈশবকাল থেকে শুনে আসছি। যারা প্রকৃত আলেম এবং ধার্মিক, তাঁরা বোঝেন ইসলাম রক্ষার সর্বশক্তি আল্লাহতালার আছে। ইসলামের বিপন্নতা ঘোচানোর অজুহাতে কারো ইসলামের রাখওয়ালা সেজে অন্যদের শান্তি নষ্ট করার, দাঙ্গা ফ্যাসাদ করার কোনও প্রয়োজন নেই। যাকে তাকে মুরতাদ বলে গলাবাজি করাও নিরর্থক। যারা কোনও লেখকের মাথার বিনিময়ে লক্ষ টাকা ঘোষণা করে প্রকাশ্য জনসভায়, সর্বক্ষণ সরলমতি মানুষকে প্ররোচিত করে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার জন্যে, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আবর্জনা বলার ঔদ্ধত্য দেখায়, হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে, সেসব ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে সরকার কেন গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করেন না? কাউকে হত্যা করতে উৎসাহ দান কি দণ্ডনীয় অপরাধ নয়? সরকারের কাছে আমাদের আরেকটি প্রশ্ন, আপনারা হরতাল বিরোধী, হরতাল হলে আপনাদের উন্নয়নের জোয়ারে ভাটা পড়ে, এমন কথা জোরে শোরে বলে থাকেন। কিন্তু ৩০ জুন যে তথাকথিত হরতালের ডাক দেওয়া হয়েছে সে সম্পর্কে আপনারা নিশ্চুপ কেন? এই হরতাল সফল করতেই যেন নীরবে সমর্থন জানাচ্ছেন তাদের প্রতি। ..’
শেষের এই কথাগুলি খুব প্রয়োজনীয়। –‘যে প্রতিক্রিয়াশীল, ফ্যাসিবাদী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তির দাপট বাড়ছে বৈ কমছে না, তাদের বিরুদ্ধে সুদৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির প্রতি। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের প্রতি। এই অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করতে না পারলে বিপণ্ন হবে আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি। মানবতাবাদী, প্রগতিশীল চিন্তাধারা রুদ্ধ হয়ে যাবে। আমরা নিমজ্জিত হব মধ্যযুগীয় অন্ধকারে, কূপমণ্ডুকতায় আবিল হয়ে উঠবে আমাদের জীবন। যাদের পূর্বসুরীরা কাজী নজরুল ইসলামের মত মহৎ প্রাণ কবিকে কাফের আখ্যা দিতে পারে, তারা এ দেশের সৃজনশীল লেখক ও ভাবুকদের বাকরুদ্ধ করতে এতটুকু দ্বিধা করবে না। এখন থেকেই সেই পাঁয়তারা চলছে তাদের। আমরা কি এদের বশ্যতা স্বীকার করবো, না কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবো, এর সদুত্তর এই মুহূর্তেই দিতে হবে আমাদের। নইলে বড় বেশি দেরি হয়ে যাবে। যেসব ফতোয়াবাজ মনে করে যে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলা তারা ফণা তুলেছে, সেই ফণা দেখিয়ে অনেককে দলে টানার অপচেষ্টায় মেতেছে। সূক্ষ্ম রাজনৈতিক তত্ত্ব বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে এখন ঐক্যবদ্ধভাবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই ফণার ছোবল থেকে বাঁচাতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে। লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগে অর্জিত আমাদের প্রাণের স্বদেশকে পাকিস্তান বানানোর চক্রান্তকে নস্যাৎ করতে হবে।’
আজ কবীর চৌধুরী আর সৈকত চৌধুরী দুজন মিলে একটি কলাম লিখেছেন আজকের কাগজে। মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়? এই প্রশ্ন তাঁদের। কলামটি আমার প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছেন, মামলার ব্যাপারটি তুলে মন্তব্য করেছেন, আবেগ এবং যুক্তির কথা বলেছেন। জ্ঞধর্ম পুরোপুরিভাবেই ব্যক্তির আবেগ, অনুভূতি ও বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে সঞ্চারিত হয়, মানুষ যখন আবেগের স্রোতে গা ভাসায়, তখন যুক্তির চোখ অন্ধ হয়ে যায়। বলেছেন, যুক্তি মানুষকে সভ্য হতে শেখায়, প্রগতি, কল্যাণ এবং এবং সভ্যতার ধারাবাহিত ক্রমবিকাশের গতিবেক ত্বরান্বিত করে। অন্ধ আবেগ সকল যুক্তির শালিনতাকে বর্বর ভাবে বর্জন করে, যা স্বাভাবিকভাবেই মানবসমাজ এবং মানবতাবাদের গুরুতর ক্ষতি সাধন করে। আর আবেগের এই সর্বগ্রাসী ক্ষুধা সঙ্গত কারণেই কুসংস্করাচ্ছত, অজ্ঞ, পশ্চাৎপদ ও দারিদ্র্যপূর্ণ জনজীবনে জায়গা করে নেয়। কারণ নিয়তিবাদী মানুষ ধর্মগ্রন্থ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং জীবন যাপনে ধর্মের পারলৌকিক বীজমন্ত্রে দীক্ষিত হয়। আবার এই আবেগকে পুঁজি করে একদল কায়েমী স্বার্থপর বংশীবাদক সমাজে তাদের সীমাহীন লালসার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়। একচোখা, বৈষম্যপূর্ণ এই সমাজব্যবস্থায় নিপীড়নের শিকার জন সাধারণ মানুষ। রিক্ত নিঃস্ব এই মানুষগুলো পরবর্তীকালে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না যার ফলশ্রুতিতে সভ্যতার ক্রমবিকাশ ব্যবস্থায় পুরোপুরি ধস নামে। ..
এদিকে মৌলবাদীরা যখন নুরজাহানকে মাটিতে পুঁতে হত্যা করছে, ধর্মের নামে অমানবিক ফতোয়া দিয়ে জনহিতকর প্রতিষ্ঠান এবং সংবাদপত্র অফিসগুলোতে হামলা চালাচ্ছে, গত ৩ জুন পুরানা পল্টন সিপিবি অফিস সংলগ্ন বইয়ের দোকান পাঠকমেলায় অবাধ লুটতরাজ এবং কোরান হাদিস শরীফের অবমাননা করেছে তখন ধর্মের ভেকধারী এই সরকার কেন তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না? গোটা জাতির কাছে আজ এই প্রশ্নের জবাব সরকারকে দিতে হবে। নয়ত সরকার, প্রগতিশীল সকাল কার্য রোধ করার মাধ্যমে নিন্দিত, ঘৃণিত, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে তুষ্ট করছে বলে প্রমাণিত হবে। মূলত এই ঘটনার মধ্য দিয়ে সরকার স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে মদদ যোগাচ্ছে। দলগুলোর লাগাতার সংসদ বর্জন, বাজেট অধিবেশনে বিরোদী দলগুলোর অনুপস্থিতি সম্ভাব্য রাজনৈতিক সংকট থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর কৌশল হিসেবে সরকার এই রাজনৈতিক অপকৌশল বেছে নিয়েছে । কিন্তু এই কৌশল সরকারের জন্যে আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত সময়ে তসলিমার জীবননাশের হুমকি, মাথার জন্য পুরস্কার ঘোষণা, লজ্জা উপন্যাস নিষিদ্ধকরণ এবং তসলিমার পাসপোর্ট আটককে সরকার নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিশ্বের কাছে পরিচিত করতে চেয়েছিল। অবশ্য তসলিমার নিরাপত্তার ব্যবস্থাসহ জীবননাশমূলক উস্কানিদাতাকে গ্রেফতার না করায় সরকারের প্রতি সকল সচেতন মহলের নিন্দা অব্যাহত ছিল। বর্তমানে উদ্ভূত সংকট নিরসন না করে জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরানোর চেষ্টায় সরকার তসলিমার বিরুদ্ধে একতরফা এই অপতৎপরতা শুরু করেছে। কিন্তু এর ফলে দীর্ঘ সময় ধরে লুকিয়ে রাখা সরকারের মৌলবাদী রূপটি জনসমক্ষে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। যতই এই ছদ্মবেশ খসে পড়ছে, আমরা ততই আতঙ্কিত হচ্ছি। কারণ সীমাহীন কূপমণ্ডুকতা, পশ্চাদপদ চিন্তা চেতনা সরকারের চরিষেন স্থায়ী ছাপ এঁকে দিচ্ছে। এতে করে খুব শিগগিরই আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বাংলাদেশ মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। বস্তুত, তসলিমার বিরুদ্ধে সরকারের এই বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ সম্পূর্ণভাবে পূর্ব পরিকল্পিত। বিগত সময়ের ফতোয়ার মাধ্যমে তসলিমার মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তসলিমা আইনের আশ্রয় চেয়ে বসেন। বাধ্য হয়ে শুধু লজ্জা উপন্যাস নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং পাসপোর্ট আটকের মধ্য দিয়ে সরকারকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। পরবর্তী সময়ে তসলিমার স্বপক্ষে এবং সরকারের বিপক্ষে বিশ্বব্যাপী যে জনমত গড়ে ওঠে তাতে সরকার তার পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সরকার তককে তককে ছিল কবে, কখন, কোথায় তসলিমা সর্বজনীনতা উপেক্ষা করে নিজস্ব কোনও মন্তব্য করেন এবং সরকার তাঁর বিরুদ্ধে আইনের(!) মাধ্যমে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। এ কথা আজ সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় কর্তৃক তসলিমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, এবং জলে স্থলে অন্তরীক্ষে তসলিমার বহির্গমনের বিধিনিষেধের সরকারি মৌলবাদী চরিষেনর মুখোশ উন্মোচিত করে দিয়েছে, যা তাদের ক্রোধান্বিত জিঘাংসারই বহিঃপ্রকাশ। তসলিমার প্রতি সরকারের এই আগ্রাসন লেখকের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। তাই আমরা সরকারের প্রগতিবিরোধী সকল মৌলবাদী কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাই এবং এর বিরুদ্ধে সকল প্রগতিশীল সকল বিবেকবান মানুষ, সমাজ ও সম্প্রদায়কে সোচ্চার হবার অনুরোধ জানাই।’
এ দুটো লেখা আমার মন ভাল করে দেয়। দেশের প্রধান দুজন বুদ্ধিজীবী আজ আমার কথা স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতে কোনও দ্বিধা করেননি, এবং এ সময়ে সব চেয়ে জরুরি যে বিষয়টি, মৌলবাদীদের প্রতিহত করা, তার আহবান তাঁরা জানিয়েছেন। আমার আর মনে হতে থাকে না যে আমার ফাঁসির ব্যাপারটি আজ খুব বড় একটি ইস্যু। আমার মাথার চেয়ে অনেক মূল্যবান এই দেশটি। দেশটিকে মৌলবাদের কবল থেকে রক্ষা করা এখন সবচেয়ে জরুরি। আমার দুঃখ হয়, মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনে আমার অনুপস্থিতির জন্য। আমাকে ব্যস্ত থাকতে হবে নিজের ফাঁসিটি ঠেকাতে। ব্যস্ত থাকতে হবে যায় যায় জীবনটিকে যেতে না দিতে। ঙর বাড়িতে আমি, অথচ ঙর সঙ্গে মন খুলে কথা বলার সুযোগ নেই। ঙ এ ঘরে আমার সঙ্গে কথা বললে শব্দ শুনে নিচতলা থেকে যে কেউ উঠে আসতে পারে ওপরে। যে কারও সন্দেহ হতে পারে যে এ ঘরে ঙ ছাড়া অন্য কেউ আছে। ঙ যদি তাকে বাধা দেয় এ ঘরে ঢুকতে, তখন তার সন্দেহ আরও ঘন হতে পারে যে এই ঘরে নিশ্চয়ই নিষিদ্ধ কেউ আছে। এবং তখন এই সন্দেহ একজন থেকে আরেকজনে সংক্রামিত হবে, এবং অবশেষে রাষ্ট্র হবে। নিঃশব্দে বসে থাকা, নিঃশব্দে শ্বাস ফেলা এখন আমার জন্য যেমন জরুরি, ঙর জন্যও তেমন। আমি আমাকে আর ঙকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য শ্বাস বন্ধ করে বসে থাকি, যখনই সিঁড়িতে কারও পায়ের শব্দ শুনি। দোতলায় ঙর শোবার ঘরের পাশেই এই লাইব্রেরি ঘরটি। নিচের তলায় অন্যদের ঘর, বৈঠক ঘর, রান্নাঘর, খাবার ঘর ইত্যাদি। ঙ সকালে আমাকে পত্রিকা দিয়ে গেছেন পড়তে, আর ইশারায় বলে গেছেন, বাথরুমে যেতে হলে যেন একটি টোকা দিই টেবিলে, তাতে তিনি বুঝবেন, আশেপাশে দেখবেন কেউ আছে কি না, তারপর আমাকে ইঙ্গিত করলে আমি ঙর ঘরে দ্রুত ঢুকে লাগোয়া বাথরুমটি যেন ব্যবহার করি। ঙ পাশের ঘরে শুয়ে বসে বই পত্রিকা পড়বেন, কান খাড়া থাকবে আমার টোকায়। আর যেহেতু বাড়ির খাবার আমাকে দেওয়া সম্ভব নয়, আমার জন্য তিনি বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসবেন। দুশ্চিন্তায় গলা জিভ এমন শুকিয়ে আছে ঙর যে কথা তিনি চাইলেও শব্দ করে বলতে পারেন না।
মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনে ৩০ জুনের হরতাল প্রতিরোধ কর্মসূচির আহবান প্রথম কোনও রাজনৈতিক দল জানায়নি, জানিয়েছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। ২৭টি সাংস্কৃতিক সংগঠন একাত্মতা প্রকাশ করেছে জোটের সঙ্গে। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, আরণ্যক, ঢাকা থিয়েটার, নাট্যচক্র, দেশ নাটক, নাট্যকেন্দ্র, ঢাকা নাট্যম, পদাতিক নাট্য সংসদ, গ্রাম থিয়েটার, মুক্ত নাটক দল, নবধারা নাট্য সম্প্রদায়, ঢাকা সুবচন, বাংলাদেশ থিয়েটার, প্রেক্ষাপট, ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী, গণশিল্পী সংস্থা, ঢাকা থিয়েটার মঞ্চ, স্বরশ্রুতি, কণ্ঠশীলন, মুক্তধারা, কারক নাট্য সম্প্রদায়, শ্রোত আবৃত্তি সংসদ, নটরাজ, দিব্য ঢাকা, বিশ্ববিদ্যালয় চারু শিল্পী পরিষদ। বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) আহবায়ক খালেকুজ্জামান এক বিবৃতিতে মৌলবাদী শক্তি কর্তৃক আহুত ৩০ জুনের হরতাল প্রতিহত করার জন্য সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহবানকে স্বাগত জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘মৌলবাদী শক্তি দীর্ঘদিন থেকেই গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ধ্যান ধারণার ওপর আঘাত হানার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। ফলে তসলিমা নাসরিনকে উপলক্ষ্য করে ফতোয়াবাজ মৌলবাদী শক্তি বিভিন্ন মতামতের মধ্যে উন্মুক্ত তর্ক বিতর্কের পরিবেশ হরণ করতে চায় যা মত প্রকাশ ও লেখকের স্বাধীনতার পরিপন্থী।’ এদের অপতৎপরতা প্রতিহত করার জন্য সর্বস্তরের গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল মহল ও ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন তিনি। আজ বিকেল ৫ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করবে বাসদ। জাতীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আশেক খান ও সাধারণ সম্পাদক সুরঞ্জন ঘোষ ফতোয়াবাজ, ধর্মান্ধ, কট্টর মৌলবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে রাজনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে প্রতিহত করার জন্য দেশের সকল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতি আহবান জানান। ওয়ার্কাস পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য হায়দার আকবর খান রনো বলেছেন ধর্মের আবরণে নৈরাজ্য সৃষ্টি ও ক্ষমতা দখলের চক্রান্তের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে সজাগ থাকতে হবে। ওয়ার্কাস পার্টি ৭ দফা কর্মসূচী নিয়ে ২৭ জুন সমাবেশ করবে। ২৭ জুন ঐক্যবদ্ধ নারীসমাজ ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানিয়ে মিছিল করবে। বাংলাদেশ লেখক শিবির হরতাল প্রতিরোধ করার জন্য আহবান জানিয়েছে। আজ গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য পরিষদ প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ করবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদ থেকে হরতাল প্রতিরোধের আহবান জানানো হয়েছে।
আবার একটু শোনা যাচ্ছে যে মৌলবাদীদের হরতাল নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে বিরোধ চলছে। দেশে আওয়ামী লীগ কোনও হরতাল ডাকলে সরকার থেকে হরতালের বিরুদ্ধে বাণীর পর বাণী দিতে থাকে, কিন্তু এবারের হরতালের ব্যাপারে একেবারে নিশ্চুপ। কিন্তু কিছু কিছু বিএনপির মন্ত্রী হরতাল বন্ধ করার কথা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলেও কোনওরকম মুখ খোলাতে পারেননি। বিরোধী দলের কেউ কেউ বলছে, যে, সরকারই এই হরতাল করাচ্ছে।
ওদিকে ইবলিসের দোসর তসলিমার ফাঁসির দাবিতে ৩০ জুন হরতাল সফল করার জন্য সভা সমাবেশ মিছিল চলছেই সারাদেশে। ইসলামী ঐক্যজোট ৩০ জুন যে করেই হোক হরতাল করার কথা বলছে। মুসলিম লীগ বলছে। মসজিদে মসজিদে সভা হচ্ছে। ফজলুল হক আমিনী চকবাজারের শাহী মসজিদ চত্বরের বক্তৃতায় বলেছেন, ‘আমাদের ঘোষিত ৩০ জুন তারিখের হরতাল হবে কোরানের ইজ্জত রক্ষার জন্য হরতাল। এই হরতাল প্রতিহত করার শক্তি এদেশে নেই। এই জমিনে আল্লাহর কোরানকে অবমাননা করা হয়েছে, ইনশাল্লাহ এই জমিনেই কোরানী শাসন কায়েম হবে। বর্তমান সংসদে যে অচলাবস্থা চলছে, কোরানী প্রতিষ্ঠা ছাড়া এ অবস্থা থেকে উন্নতি সম্ভব নয়। এদেশের সংসদ চলবে কোরানের বিধান অনুযায়ী, অন্যথায় শান্তি আশা করা যায় না। জাতি আজ দুই শিবিরে বিভক্ত, একদল হল কোরানের ইজ্জত রক্ষা করতে চায়, অন্যদল চায় ইসলাম ও কোরানকে মিটিয়ে দিতে। আগামী ৩০ তারিখেই প্রমাণ হবে কারা থাকবে আর কারা ধুলোয় মিশে যাবে।’
এসব হচ্ছে, তারপরও আমার মন ভালো। ভালো এইজন্য যে মৌলবাদ প্রতিরোধের জন্য প্রগতির পক্ষের লোকেরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে।
ঙ আমার জন্য ঠোঙায় করে দুপুরের খাবার নিয়ে এলেন। ফিসফিস করে আমাদের কথা হল কিছুক্ষণ দেশের পরিস্থিতি নিয়ে। মৌলবাদী দল সরকারি দলের সহযোগিতায় প্রতিপক্ষের চেয়েও শক্তিমান হয়েছে, একে কি কোনও রকম প্রতিরোধ দিয়ে ঠেকানো সম্ভব! সম্ভব না হলেও সম্ভব করার সবরকম চেষ্টা করতে হবে, এছাড়া আমাদের আর উপায় নেই। প্রতিরোধের আভাস পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু আমার জীবনের ঝুঁকি যে একবিন্দু কমেনি, তা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন ঙ।
বাথরুমে যাওয়ার ঝুঁকি না নেওয়ার জন্য সারাদিন খুব না হলেই নয় কিছু মুখে দিই। আমার ক্ষিধে তেষ্টাও পায় না আজকাল। একদিক দিয়ে ভালই। রোবটের মত জীবন। ঘুম নেই। সারারাত জেগে থাকি। নিঃশব্দে বই পড়ি। কাশি এলে মুখে বালিশ চেপে শব্দ গোপন করি। কান্না এলেও তাই।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন