তসলিমা নাসরিন
তিন জুলাই, রবিবার
এ ঘরের দরজাটিতে ঝর বাড়ির দরজার মত বাইরে থেকে তালা লাগাতে হয় না। ঘরের বাইরে যদিও আমার বেরোতে মানা, ঘরটি ভেতর থেকে বন্ধ করে বসে থাকলেই হয়। বাড়ির কাজের মানুষেরা নিচতলায় রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকে। ওপর তলায় শোবার ঘর। ওপরতলায় ঞ আর ঞর স্ত্রী সারাক্ষণই আছেন, তাঁদের নাকের ডগায় কোনও কাজের মানুষ এ ঘরে উঁকি দিয়ে কোনও নিষিদ্ধ মুখ দেখবে, সে আশঙ্কা নেই। সকালে ট্রেতে করে নাস্তা নিয়ে এলেন ঞর স্ত্রী। দুপুরেও তিনি খাবার এনে দিলেন, রাতেও। ভাল খাবার। ভাত, মাছ, শাক সবজি। চেটেপুটে খাই। জন্মের ক্ষিধে ছিল পেটে। ঞ আর ঞর স্ত্রী অনেকক্ষণ ধরে গল্প করে গেছেন আমার সঙ্গে। দেশের অবস্থার কথা বলে দুজনই খুব দুঃখ করেছেন। ঞ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে বলেছেন, ‘দেশে যে মৌলবাদীরা এমন শক্তি অর্জন করেছে তলে তলে, কোনওদিন বুঝিনি।’ বলেছেন আমার জন্য তাঁর খুব ভাবনা হয়। প্রগতিশীল সকলের জন্যই এখন ভাবনা হয়। মৌলবাদ যদি ঠেকানো না যায় তবে সকলের সর্বনাশ হবে, দেশটি মৌলবাদীদের পুরো দখলে চলে যাবে। এ দেশটি তখন আর মুক্তবুদ্ধির কোনও মানুষের বাসযোগ্য দেশ হবে না।
বাসযোগ্য যে হবে না সে বুঝি। পত্রিকায় পাতায় বিশাল বিশাল মিছিলের ছবি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের পত্রিকাগৃুলো যদিও মৌলবাদীদের বিশাল সভা মিছিলের কোনও খবর ছাপছে না, ভাব করছে যেন আন্দোলনে মৌলবাদবিরোধী শক্তিরই জয় হচ্ছে। কিন্তু মৌলবাদীদের পত্রিকা দেখলেই আঁতকে উঠতে হয়। ভয়াবহ সব কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলছে তারা। কেবল খবর না ছাপলেই তো মৌলবাদ মরে যায় না। আছে। তারাই এখন রাজত্ব করছে সর্বত্র। আজকের পত্রিকায় ছাপা হয়েছে গতকাল লণ্ডন টাইমসে ছাপা হওয়া সম্পাদকীয়। সম্পাদকীয়টির শিরোনাম আবার বাংলাদেশ। বাংলাদেশে শস্য উৎপাদন বাড়ছে। খাদ্যাভাব নেই দেশটিতে। কিন্তু এই যে উন্নতি ঘটছে দেশে, তা এখন হুমকির সম্মুখীন। উগ্র মৌলবাদীদের সহিংস আন্দোলন এ দেশ বিপদ নিয়ে আসছে। অসাবধানতায় একটি অগ্নিকাণ্ড শুরু হতে পারে দেশে। বাংলাদেশ সরকারের দুর্বলতার কারণে ইসলামী উগ্রবাদীদের আন্দোলনের মুখে এ রকম একটি ঘটনার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সরকার নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারের হুলিয়া জারি করে এবং দুজন সাংবাদিককে হাজতে পুরে এই দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরে দেশে পরস্পর বিরোধী হরতাল দেখা দেয়। সরকার প্রথম ভুল করে তসলিমা নাসরিনের লজ্জা উপন্যাসটি নিষিদ্ধ করে। সরকার আরও ভুল করে তসলিমা নাসরিনের শরিয়ার সংস্কার চেয়ে ধর্মদ্রোহিতা করেছেন বলে মৌলবাদীদের দাবির প্রতি নতিস্বীকার করে। এর ফলে মৌলবাদীদের আন্দোলনে ইন্ধন যোগানো হয়েছে। মৌলবাদীরা এখন ধর্মদ্রোহিতার আইন পাস এবং পত্রিকার ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করার আন্দোলন করছে এবং সাহায্য সংস্থা নিষিদ্ধ করার দাবি জানাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক এবং গ্রামীন অ্যাকশন কমিটি সারা বিশ্বে পথিকৃতের কাজ করছে। বেগম জিয়ার সরকারকে মৌলবাদীদের খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও তসলিমা নাসরিন সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। খবরটি ওয়াশিংটন থেকে পাঠানো। খবরটি এরকম, ‘বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। তাদের উদ্বেগ রাজনৈতিক সংকট নিয়ে। লেখিকা তসলিমা নাসরিনের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগের শেষ নেই। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বাংলাদেশ ডেস্কের প্রধান মিসেস রবিন রাফায়েল একজন শীর্ষ পর্যায়ের কূটনীতিককে ডেকে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, বাংলাদেশে এখন যা ঘটছে তা মোটেও সুখকর নয়। যুক্তরাষ্ট্র সরকার চুপ করে বসে থাকতে পারে না। আমাদের কাছে প্রতিদিনই খবর আসছে নানা সূত্র থেকে। এক অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে সেখানে। মৌলিক অধিকার খর্ব হচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। রাফায়েল বলেন, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত কোনও স্বার্থ নেই। দেশটা অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করে মানুষের জীবনমানের উন্নতি করুক এটাই যুক্তরাষ্ট্র চায়। অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচীর শুরুটা মন্দ ছিল না। যদিও বিনিয়োগ ছিল না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ঠিক মত চলবে — তাই আশা করা গিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে বিন্দুমাত্র সমঝোতা নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে সরকার ও বিরোধী দলের অবস্থানে বিস্তর ফারাক। এই অবস্থায় সংকট বাড়ছেই। রাফায়েল বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও জোরদার করতে চেয়েছে। ২০ জন সংসদ সদস্যকে যুক্তরাষ্ট্রে এনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। ..বর্তমান সঙ্কট নিরসনে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত বেশ তৎপর হয়েছিলেন। এখন তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছেন। ৫ জুলাই থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত ছুটিতে চলে যাচ্ছেন। লেখিকা তসলিমা নাসরিন সম্পর্কে রবিন রাফায়েল স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, তার লেখার স্বাধীনতা খর্ব করা যাবে না। তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ওয়াশিংটন থেকে সেন্সরশিপ বাই ম্যানহান্ট শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রকাশের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বাংলাদেশের একজন কূটনীতিককে পররাষ্ট্র দফতরে ডেকে নিয়ে বলেন, দুনিয়ার প্রচারমাধ্যম কী লিখছে দেখতে পাচ্ছেন নিশ্চয়ই। সরকার কেন তসলিমার নিরাপত্তা দিচ্ছে না। বাংলাদেশের কূটনীতিক বলেন, সরকার নিরাপত্তা দিচ্ছে না এটা ঠিক নয়। বিষয়টি আদালতে গড়িয়েছে। তসলিমা আদালতে গেলেই পারেন। এরপর সরকার তার সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দেবে। তাকে বিদেশে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। পাসপোর্ট নিয়ে তিনি সম্প্রতি বিদেশ সফর করেও এসেছেন। সফরকালেই তিনি কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা তসলিমার সাহায্যে বিশ্বের প্রতিটি দেশকে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছে। তসলিমার মৃত্যুদণ্ডের খবর সম্পর্কে বলছে, সরকার যে ব্যবস্থা নিয়েছে তা কোনও সভ্যতার মধ্যে পড়ে না। কোনও সভ্য সরকার এটা করতে পারে না।
এদিকে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। প্রায় দুই সপ্তাহ যাবৎ রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির নিউইয়র্কে রয়েছেন। তিনি সেখানে টাইম, নিউজ উইক ও নিউইয়র্ক টাইমসের সাথে একাধিক বৈঠক করেছেন, তাদেরকে বোঝাবার চেষ্টা করছেন যে তসলিমার ব্যাপারে সরকার কড়া কোনও মনোভাব গ্রহণ করেনি। এতে কাজ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। নিউইয়র্ক টাইমস কয়েকদিনের মধ্যে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশে সরকারের মনোভাব জানিয়ে কূটনীতিকরা দীর্ঘ একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। টাইম ম্যাগাজিন তাদের ঢাকা সংবাদ দাতাকে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠানোর জন্য বার্তা পাঠিয়েছে। সেখানেও চিঠি পাঠিয়ে বলা হয়েছে, তসলিমা সম্পর্কে সরকার কি অবস্থান নিয়েছে। নিউজ উইক বলেছে, তোমাদের লোকই রিপোর্ট পাঠিয়েছে। আমাদের কি করার ছিল! তসলিমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৩শ জন প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক এক বিবৃতি দিয়েছেন। বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার মৌলবাদীদের স্বার্থ রক্ষা করছে। মানবাধিকারকে হত্যা করছে। কথা বলার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্ক দূতাবাসে প্রতিদিন শত শত চিঠি আসছে নিন্দা আর নানা হুমকি দিয়ে। একজন কূটনীতিক বললেন, আমরা কি এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকব! দেশের জন্য আর কিছু করা যাচ্ছে না।
সর্বশেষ খবরঃ যুক্তরাষ্ট্র সরকার মনে করে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার মৌলবাদীদের বিকল্প শক্তি হিসেবে কাজ করছে। স্মরণ করা যায় যে ক্লিনটন প্রশাসন মৌলবাদী কোনওরূপ তৎপরতাকে প্রশ্রয় দিতে রাজি নয়।’
এই হল বাংলাবাজারের খবর।
বিদেশে আমার নামটি যদিও বারবার করে নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু দেশে মৌলবাদী ছাড়া আমার নাম মুখে আনছে না কেউই। মুখে না এনে তারা মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়ছেন। তাও ভাল। ভাল যে লড়ছেন। ব্যাপারটি আমার ব্যক্তিগত ঝামেলা বলে কেউ তো মাঠেই নামতে চাচ্ছিলেন না আগে। আওয়ামী লীগের সভায় জিল্লুর রহমান বলেছেন, ‘সরকারি ছত্রছায়ায় মৌলবাদী শক্তি মাঠে নেমেছে।’ ভাল যে বলেছেন কিছু। সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ছাত্রসমাজের সমাবেশ হয়ে গেল প্রেসক্লাবের সামনে। বক্তারা বলেছেন, স্বাধীনতা বিরোধী জামায়ত শিবির মৌলবাদী ফতোয়াবাজচক্র দেশব্যাপী অরাজকতা সৃষ্টি করেছে। এ অপশক্তিকে এখনই ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার চূড়ান্ত সময়। টিএসসিতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মত- বিনিময় সভা হয়েছে। সভায় অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক এমপি, কাজী আরেফ আহমদ, নূরুল ইসলাম নাহিদ, পান্না কায়সার, মঈনুদ্দিন খান বাদল, অধ্যাপক মাজহারুল ইসলাম, শাহেদ আলী, সুধাংসু চক্রবর্তী সবারই প্রায় একই বক্তব্য, ‘একাত্তরের ঘাতকরা আমাদের চ্যালেঞ্জ করছে। এখনই আমাদের উপলব্ধির সময়। ওদের বিরুদ্ধে শক্তভাবে দাঁড়াতে না পারলে আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রক্ষার জন্য প্রয়োজনে আমরা প্রাণ দেব। রাজনীতির ঐক্য ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই পারে আমাদের একত্রিত করতে। যার মাধ্যমেই কেবল একাত্তরের ঘাতকদের প্রতিহত করা সম্ভব।’ মতবিনিময় অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সর্বসাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া ও মৌলবাদী একাত্তরের ঘাতকদের প্রতিহত করার লক্ষ্যে ১৪টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে আছে, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে জনমত গঠনের লক্ষে স্কুল কলেজ মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের স্বাক্ষর গ্রহণ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন বক্তব্য না দেওয়া এবং ঘাতক দালালদের প্রতিহত করতে দলমত নির্বিশেষে সকলের ঐক্যের প্রতি আহবান ইত্যাদি।
বাকি খবরগুলোর শিরোনাম, হেলথ কোয়ালিশন পোড়ানোর সঙ্গে জড়িত জামাত কর্মীদের পুলিশ গ্রেফতার করছে না। মানবতাবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হন–ছাত্রলীগ। মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে নরসিংদীতে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল। মৌলবাদী গোষ্ঠী ধর্ম নিয়ে যে বাড়াবাড়ি করছে তা শুভ নয় — কাদের সিদ্দিকী। এ বাংলায় মৌলবাদের স্থান নেই — কুষ্টিয়া সাম্প্রদায়িক শক্তি প্রতিরোধ কমিটি। ৩০ জুনের হরতালে ছাত্র জনতার ওপর জুলুম নির্যাতনের প্রতিবাদে সমাবেশ মিছিল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন