পৌলোমী সেনগুপ্ত
ধর্মদাসের বাবা প্রায়ই বড়াই করে বলত, “সারাজীবন এত চুরি করলাম কিন্তু পুলিশ একবারের জন্যেও আমাকে ধরতে পারেনি।” অতএব তার কাছে চুরিকর্ম বড় কর্ম হয়ে উঠেছিল। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই ধর্মদাস তার বাবাকে নানান জিনিস নিয়ে আসতে দেখত। সেগুলো যে চুরি করে নিয়ে আসা তা বুঝতে একটু সময় লেগেছিল। ধর্মদাসের মা তার স্বামীর এই জীবিকা পছন্দ করত না। পছন্দ করত না বলেই ছেলের নাম রেখেছিল ধর্মদাস। এই শখের ব্যাপারে তার স্বামীর আপত্তি ছিল না; কারণ চোরদের ধর্মে মতি না থাকলে চুরি করতে গেলে বিঘ্ন ঘটতে পারে।
ধর্মদাসের মা তাকে স্কুলে ভরতি করিয়েছিল।
মহিলা ভাল সেলাই জানত। সেই টাকায় ছেলেকে পড়াত সে। পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল ধর্মদাস। অল্পতেই বুঝে নিত। তাই স্কুলের শিক্ষকরা তাকে খুব ভালবাসত, যত্ন নিত। ধর্মদাসের বাবা এতে ছেলের কৃতিত্ব দেখতে পেত না। বুদ্ধিমান না হলে ভাল চোর হওয়া যায় না। অতএব সে বুদ্ধিমান এবং তাই ছেলে বুদ্ধিমান হয়েছে। ছেলে যে গম্ভীর প্রকৃতির আদর্শ পড়ুয়া হয়ে যাচ্ছে তাতে তার বিন্দুমাত্র চিন্তা হয়নি। ধর্মদাসের মা ভয় পেয়েছিল ছেলেকে বেশিদূর পড়তে দেবে না তার বাবা। জোর করে নিজের জীবিকায় ঢোকাতে চাইবে। কিন্তু লোকটা কখনও আপত্তি করেনি। এক বিকেলে একজন চোর এল দেখা করতে ধর্মদাসের বাবার সঙ্গে। চা মুড়ি খেতে খেতে চুরিচামারি নিয়ে কথা বলছিল। যত দিন যাচ্ছে বাজার খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কলকাতার থেকে সল্টলেক এখনও অবশ্য ব্যাবসা করার পক্ষে ভাল জায়গা। যারা জানলা খুলে ঘুমোয় তাদের ঘরে আঁকশি ঢুকিয়ে জিনিসপত্র বের করে নেওয়া যায়। অবশ্য বেশিরভাগ বাড়ি তৈরি হওয়ার পর জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখে বাসিন্দারা পুরনো বাড়িতে ফিরে যায়। শনি-রবিবার পিকনিক করতে আসে। সেইসব বাড়িতে গ্রিল কাটার যন্ত্র নিয়ে ঢুকলে সারা দিনরাত ধরে মনের সুখে চুরি করা যায়। সল্টলেকে পুলিশ কম। দিনের বেলায় যাদের রাস্তায় দেখা যায় না, রাত্রে তো যাবেই না। এইসব গল্পের মাঝখানে পড়াশুনো করে ধর্মদাস বাড়ি ফিরল। ক্লাস টেনে পড়ে সে। মাথায় বেশ লম্বা হয়েছে। বাবা এবং বাবার বন্ধুর দিকে না তাকিয়ে ভেতরে চলে যেতেই বন্ধু ধর্মদাসের বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “ছেলে তো সাবালক হয়ে গেছে। কাজকর্ম শেখাও।”
ধর্মদাসের বাবা হেসে বলল, “পড়ছে, পড়ুক না।”
“পড়ে কী হবে? চাকরি পাবে ভেবেছ? আজকাল খুঁটির জোর না থাকলে চাকরি পাওয়া যায়? খুব বোকামি করছ। তা ছাড়া চাকরিতে কত মাইনে পাবে? অ্যাঁ?”
ধর্মদাসের বাবা বলল, “নিজের লাইনে ছেলেকে আনতে চাই না।”
বন্ধু বলল, “এই এক ঢঙ হয়েছে। সেদিন এক বাড়িতে চুরি করতে গিয়েছি। কর্তা-গিন্নি ঘুমোবার আগে গল্প করছিল। গিন্নি চাইছে তার ছেলে ডাক্তারি পড়ুক। কর্তা বলছে, না, ডাক্তারি করে তো বুঝতে পারছি জ্বালা, ছেলেকে এ-লাইনে আনতে চাই না।”
ধর্মদাসের বাবা বলল, “তুমি বুঝতে পারছ না। আমরা অশিক্ষিত লোক। শুধু বুদ্ধি দিয়ে যে ধরনের চুরি করে এসেছি এতকাল, তা ব্যাকডেটেড হয়ে গেছে। এভাবে দশ-পনেরো বছর পরে চুরি করা চলবে না। এখন চুরি করার নতুন নতুন কায়দা তৈরি হবে। কম্পিউটার না কী যেন বলে, সেই যন্ত্র বলে দেবে কীভাবে চুরি করতে হবে। পড়াশোনা করে শিক্ষিত না হলে সেসব জানবে কী করে? যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে না?”
বন্ধুর চোখ বড় হয়ে গেল। ঘোর কাটতেই ধর্মদাসের বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, “এইজন্যে তোমাকে গুরু বলি দাদা। ওঃ, দারুণ মতলব ভেঁজেছ।”
ধর্মদাসের বাবা যখন বন্ধুর পরামর্শ মেনে নিয়ে সল্টলেকের বাড়িতে বাড়িতে চুরি করছিল তখন ধর্মদাস জয়েন্ট এনট্রান্স পাশ করে যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভরতি হয়ে গিয়েছে। ধর্মদাসের বাবার জীবিকার ধরন একটু আলাদা। কোনও সঙ্গী নিয়ে সে চুরি করে না। ঝুঁকি নেয় না। তার চেহারাটি মন্দ নয় বলে কেউ চট করে তাকে চোর বলে ভাবতেও পারে না। কোনও এক নতুন বাড়িতে তখন পালিশের কাজ চলেছে। মিস্ত্রিরা ব্যস্ত। ভোরবেলা থেকে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ধর্মদাসের বাবা লক্ষ করেছে বাড়িতে কর্তা-গিন্নি ছাড়া কেউ নেই। সাড়ে ন’টায় মিস্ত্রিদের কাজ করতে বলে তারা বেরিয়ে গেল অফিসে। পেছন পেছন গিয়ে বাসে না ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তারপর ফিরে গিয়ে মিস্ত্রিদের জিজ্ঞেস করল, “দাদা-বউদি অফিসে চলে গেছে?” মিস্ত্রিরা বলল, এইমাত্র তারা বেরিয়ে গেছে। ধর্মদাসের বাবা খুব হতাশ হল। মিস্ত্রিদের কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা এমনভাবে করতে লাগল যে তাদের ভাবতে অসুবিধা হল না যে, সে বাবুর ভাই। বাড়িতে ফোন ছিল। কল্পিত নম্বর ডায়েল করে দাদা দাদা বলে কথাও বলল। ততক্ষণে তার ওপর মিস্ত্রিদের আস্থা এসে গিয়েছে। বাড়ির যাবতীয় দামি জিনিস সুটকেসে পুরে বেরিয়ে আসতে অসুবিধে হল না ধর্মদাসের বাবার। চুরির পরিমাণ যদি বেশ কয়েক হাজার টাকার হয় তা হলে প্রায় একমাস বিশ্রাম নেয় সে। তবে এ-লাইনে চুরি করা যত সহজ, চোরাই জিনিস বিক্রি করে সঠিক দাম পাওয়া তত কঠিন। যে নিচ্ছে সে চোরাই জিনিস জেনে কম টাকা দেবে। আবার তার কাছে পুলিশ এলে সে ফাঁস করেও দিতে পারে কে তাকে জিনিস দিয়েছে। সেইজন্যে ধর্মদাসের বাবা কলকাতায় চোরাই জিনিস বিক্রি করে না। ট্রেনে চেপে পটনায় চলে যায়। ওখানে দামটাও একটু বেশি পাওয়া যায়, আবার ঝুঁকিও কম।
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তে মাথা বিগড়াল ধর্মদাসের। সে ছাত্র রাজনীতিতে ঢুকল। বুদ্ধিমান এবং শিক্ষিত ছেলে বলে নেতা হতে দেরি হল না। তার মা মাথা চাপড়াতে লাগল। ছেলের পড়ায় মন নেই। দিনরাত বিক্ষোভ মিছিল বের করছে। ওই করতে করতে যুবনেতা হয়ে গেল। কাগজে ছবি বের হল। সে তার মাকে স্পষ্ট বলে দিল, পড়াশুনায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ তার নেই। দেশের জন্যে কাজ করতে চায় সে। মায়ের রাগ অভিমান কোনও কাজে লাগল না। রাজনৈতিক কাজে তাকে পার্টি বিভিন্ন জেলায় পাঠাতে লাগল। এসব আশা করেনি ধর্মদাসের বাবা। সে দেখেছে কত ছেলে ওই সব করে পায়ের তলার মাটি হারিয়েছে। কিন্তু সে যেহেতু কখনও ছেলেকে কিছু বলেনি তাই এক্ষেত্রেও চুপ করে থাকল। কিন্তু মনখারাপ হয়ে যেত তার। ছেলে তার ঐতিহ্য রাখল না।
হঠাৎ কাগজে খবর ছাপা হল নির্বাচন হচ্ছে। পার্টি তার ছেলেকে নমিনেশন দিয়েছে। ছেলে এত চাপা এবং গম্ভীর যে, খবরটা বাড়িতে জানায়নি। নির্বাচন মানে একগাদা টাকা খরচ এবং হেরে গেলে সর্বনাশ। যদিও পার্টি টাকা দেবে নির্বাচন লড়তে, তবু কিছু খরচ তো হবেই। ধর্মদাসের বাবা লক্ষ করল বড় বড় ব্যবসায়ীরা হঠাৎ এগিয়ে এসে তার ছেলেকে টাকা দিচ্ছে নির্বাচনে লড়াই করার জন্যে। এই ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই কালোবাজারি, মানুষকে ঠকিয়ে টাকার পাহাড় করেছে। হঠাৎ চিন্তাটা মাথায় আসামাত্র ধর্মদাসের বাবা দু’হাত তুলে নাচতে লাগল। তার স্ত্রী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার? পাগল হয়ে গেলে নাকি?”
ধর্মদাসের বাবা বলল, “আমি রিটায়ার করলাম। আমার চুরি করা শেষ।”
স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, “এতদিন বাদে হঠাৎ এমন সুমতি হল কেন?”
ধর্মদাসের বাবা বলল, “এইবার তোমার ছেলে চুরি করবে।”
“চুরি করবে? কী যা তা বলছ?”
“ঠিক বলছি। এই যে কালোবাজারির কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা নিচ্ছে, জিতে গেলে তারা ওকে ছেড়ে দেবে ভেবেছ? যা দিয়েছে তার একশোগুণ আদায় করে নেবে। ওকে দিয়ে বেআইনিভাবে কাজ করিয়ে নেবে, অর্ডার পাশ করাবে। ও সেটা করতে বাধ্য। আর করলেই ওকে ওরা কমিশন দেবে। আমি দু’-চার হাজার চুরি করেছি, ও দু’-চার লাখ করবে। তারপর ধরো ও যদি মন্ত্রী হয়ে যায় তা হলে তো কথাই নেই। বিশ-চল্লিশ লাখ চুরি করবে। আর যদি দিল্লির মন্ত্রী হয় তা হলে বিশ-চল্লিশ কোটি। চাকরি করে যা চুরি করতে পারত না মন্ত্রী হয়ে তার হাজার গুণ করবে। ওঃ, কী আনন্দ হচ্ছে আমার।” ধর্মদাসের বাবার প্রাণ তখন গড়ের মাঠ। ফুরফুরিয়ে হাওয়া বইছে সেখানে।
রাতদুপুরে বাড়ি ফিরল ধর্মদাস। নির্বাচনের কাজ করতে করতে সে খুব ক্লান্ত। মা জেগেই ছিল। হাতমুখ ধুয়ে ছেলে যখন খেতে বসল তখন মা বলল, “আজ একটা ভাল খবর আছে। কিন্তু সেইসঙ্গে খারাপ খবরও।”
ছেলে জিজ্ঞেস করল, “আগে ভাল খবরটা বলো।”
মা বলল, “তোর বাবা আর চুরি করবে না। চুরি করা ছেড়ে দিয়েছে।”
ছেলে খাওয়া থামিয়ে বলল, “এটা নিয়ে ভাবছিলাম। এখন বাবা যদি ধরা পড়ে যেত তা হলে বিরোধীপক্ষ আমার বারোটা বাজিয়ে দিত। চোরের ছেলেকে কেউ ভোট দিত না। যাক, বাবার মতি বদল হল কেন?”
মা বলল, “সেটাই তো খারাপ খবর। তুই রাজনীতি করছিস আরও বড় চোর হবি বলে। ছি ছি ছি খোকা। তোর মনে এই ছিল? আমি এত কষ্ট করে তোকে লেখাপড়া শিখিয়েছি কেন? ভবিষ্যতে তুই চোর হবি বলে? তাই পড়া ছেড়ে নেতা হবি?”
“আমি চোর হব মানে?” ছেলে ঘাবড়ে গেল।
“নয়তো কী? যত বড় নেতা হবি তত চুরি করবি। কাগজে নাকি বেরিয়েছে। মন্ত্রীরাও চুরি করে ধরা পড়েছে। তোর বাবা সেই আনন্দে নাচছে। সে যা পারেনি তুই তার বহুগুণ বেশি পারবি। একেই বলে বাপের রক্ত বদলে যায় না। ছিঃ।’ মা কেঁদে উঠল।
ছেলে বলল, “বাবা এ-কথা বলেছে? বিধানচন্দ্র রায়, মহাত্মা গাঁধী, সুভাষচন্দ্র বসু, মাও জে দং, লেনিন নেতা ছিলেন। তাঁরা কি মহামানব ছিলেন না? তাঁরা কি চোর ছিলেন?”
মা মাথা নাড়ল ঘাবড়ে গিয়ে, “না। তা কেন হবে? ওঁরা প্রণম্য মানুষ।”
“তবে? আমি তো ওঁদের পথ অনুসরণ করছি। এই যে বাবা এতদিন চুরি করল এবং সেটা মহাকর্ম হল, কারণ একবারও ধরা পড়েনি। তা রক্তের কথা যদি বলো আমিও তো সেই রেকর্ড করতে পারি। হাজার হোক ছেলে তো। এ নিয়ে তুমি একটুও দুশ্চিন্তা কোরো না মা।”
মা ঠিক বুঝল কি বুঝল না, কিন্তু ছেলের নামে সওয়া পাঁচ আনার মানত করে ফেলল।
২ জুলাই ১৯৯৭
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন