গটমটে সাহেব বটে – শৈলেন ঘোষ

পৌলোমী সেনগুপ্ত

গটমটে সাহেব বটে – শৈলেন ঘোষ

যাক, এতদিনে ইতিমিচিসাহেবের একটা হিল্লে হল। এতদিন সাহেবের দিন কেটেছে একা একা। এবার একা একা দিন কাটানোর দিন শেষ হল। শেষমেশ একটি সঙ্গী জুটে গেল ইতিমিচিসাহেবের। সঙ্গীটির নাম বিল্লি। একটি বেড়াল। খুব ভাল, খুব ভাল। নেই কিছুর চেয়ে বেড়াল-শিশুই সই। এখন তাকে নিয়েই ইতিমিচিসাহেবের যত সাধ-আহ্লাদ। কখনও বেড়াল দুধ খাচ্ছে, না-হয় ভাত। কখনও বেড়াল কোলে বসছে, না-হয় ঘাড়ে। মাথায় উঠছে, নয়তো পিঠে। দুটিতে দোস্তি বটে!

একদিন হয়েছে কী, ইতিমিচিসাহেব বেড়াল-কোলে পথে হাঁটছেন। এমন সময় একটা প্যাংলা মতো পুঁচকে ছেলে বেড়াল-কোলে সাহেবকে দেখতে পেয়েছে। দেখতে পেয়ে এমন খিলখিল করে হেসে উঠল! হাসতে হাসতে আবার চেঁচিয়ে উঠে ছড়া কাটতে শুরু করে দিল:

বিল্লি কোলে উননি কে রে?

অদ্ভুতুড়ে সাহেব যে রে!

ঢাউস জুতো ফটাস ফটাস,

এই বুঝি পা পিছলে পটাস!

বলতে কী, ইতিমিচিসাহেব একটুও রাগ করলেন না। কারণ কী, তিনি একটুতেই হুটহাট রাগ করতে জানেন না। কিন্তু তিনি মনে মনে ভীষণ, ভী-ষ-ণ কষ্ট পেলেন। এমনকী, তাঁর বুকটাও কনকন কনকন করে উঠল। ওঠবারই কথা। যতই হোক ছেলেটা নেহাতই খোকা খোকা। সুতরাং, অমন দু’চোখ ড্যাবড্যাব করে তাঁর দিকে তাকিয়ে, এমন নেহাতই একটি খোকার খিলখিল করে হাসাটা যে অত্যন্ত অসভ্যতা, এখন, সে-কথা কে তাকে বোঝাবে। ঠিক আছে, না-হয় বোঝানো গেল, কিন্তু বোঝালেই যে শুনবে, তা-ই বা বিশ্বাস করি কেমন করে। না, ছেলে বোঝালেও শুনবে না, বকলেও মানবে না। বরং কাউকে দেখে ওই খুদে প্যাংলার একবার যদি মজা লেগে যায়, তবে আর রক্ষে নেই। হাসি যদি একবার খিলখিল করে ওঠে মুখে, তবে, নাচও তেমনই ধিনধিন করবে পায়ে। তুমি যদি তাড়া দাও, কি ধমকে মুখ নাড়া দাও, তোমার ছাড়া নেই। হাসিও মানবে না, নাচও থামবে না।

ঠিক আছে, মানতে হবে না। তোমার পেটে হাসি জমেছে তুমি গাল-গলা ফুলিয়ে যত পারো হাসো। কেউ মানা করছে না। কিন্তু হাসতে হাসতে একজন নিরীহ সাহেবের পেছনে লাগার কী দরকার শুনি? পেছনে লেগে খোঁটা দিয়ে ছড়া কাটা, সেটাও কি ঠিক হচ্ছে?

অবশ্য বেঠিক হচ্ছে কি না তাও বলা যাচ্ছে না।

কেন বলা যাচ্ছে না?

আরে বাবা, কথাগুলো তো আর মিথ্যে নয়। ইতিমিচিসাহেবের চেহারার দিকে একবার উঁকি মেরে দ্যাখো! বলো, মাথার টুপিটা দেখে কি তোমার চোখ ঝলসে যাচ্ছে? নাকি, পায়ের জুতোজোড়া দেখে মন বাহ-বাহ করে উথলে উঠছে? দেখে কি বলতে ইচ্ছে যায়, “গটমটে সাহেব বটে।” ছিঃ। মাথায় একটা ফুটো-ফাটা টুপি পরলেই কি সাহেব হওয়া যায়? না, পায়ে ছেঁড়াফাটা জুতো পরলে লোকে সাহেব বলবে? জুতোটা তো এখনই বাতিল করা উচিত। যা হালত হয়েছে কহতব্য নয়। প্রথম যেদিন পায়ে উঠেছে, বোধহয়, সেদিন থেকেই চলছে। না পালিশ, না মালিশ। সাহেব যদি খাঁটি সাহেবের মতো সাহেব না হতে পারে, তবে কী দরকার বাপু সাহেব বলে নিজেকে জাহির করার। সাহেব নামটা ছেঁটে ফেললেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।

দ্যাখো, ইতিমিচিসাহেব কেমন মুষড়ে পড়েছেন। মনে হয় ছেলেটার ছড়া শুনেই তাঁর এই মনস্তাপ। ইতিমিচিসাহেব না হয়ে অন্য কেউ হলে এতক্ষণে ছেলেটার ঘাড়ে ধাঁই-ধপাধপ বেশ ক’ঘা কষিয়ে দিত। বেরিয়ে যেত মুচকি হাসি। এক ঘুসোতে ছ্যাতলা-পড়া দাঁতকপাটি ছটকে দিত। তবে মানুষের সহ্যেরও তো একটা সীমা আছে। সাহেব কিছু বলছেন না বলে তুমিও তাকে দেখে হ্যা হ্যা করে হাসবে? এক্ষুনি যদি সাহেব তুলকালাম কাণ্ড শুরু করে দেন, তখন কী করবে?

হায়! হায়! কোথায় তুলকালাম কাণ্ড! ইতিমিচিসাহেব মনখারাপ-করা মুখখানা লুকিয়ে ফেলে হনহন করে হাঁটতে লাগলেন। ছেলেটার দিকে ভুলেও তাকালেন না। ছেঁড়া-ফাটা জুতো পরে অবশ্য হনহন করে হাঁটা কি চাট্টিখানি কথা। দু’হাত হাঁটছেন, তো তিন হাত ঠোক্কর খাচ্ছেন। তিনি তিন হাত ঠোক্কর খেলেই সেই প্যাংলা ছেলেটা তিন দু’গুণে ছ’বার হাতে তালি বাজাচ্ছে। সেইসঙ্গে হ্যা-হ্যা করে হাসি আর হল্লাবাজি। কিন্তু দ্যাখো, ছেলেটার এমন হই-হট্টগোলেও বেড়ালটার তেমন হেলদোল নেই। তিনি দিব্যি ঘুম দিচ্ছেন সাহেবের কোলের ভেতর। আশ্চর্য!

কী বিপদ! লজ্জায় যেন তাঁর মাথা কাটা যাচ্ছে। ভাগ্যিস, এদিকটা খানিক ফাঁকা ফাঁকা। নইলে এতক্ষণে লোক জমে হাসি-হল্লার হট্টগোল বেঁধে যেত। সুতরাং এই সুযোগে তিনি হনহন করে না হেঁটে পাঁই পাঁই করে ছুট দিলেন।

আরে মশাই করছেন কী, করছেন কী, এক্ষুনি যে পা হড়কে হাড় ভাঙবেন!

কে আর শোনে সে-কথা। তিনি ছুটলে ছেলেটাও যে ছুটে তাঁকে তাড়া করতে পারে, এই সোজা কথাটা কে না জানে! আর হলও তা-ই। ছেলেটা চিল চেঁচিয়ে তাঁর পেছনে ধাওয়া করল।

সাহেব, সাহেব, আর ছুটবেন না, থামুন। একটা ছোট্ট ছেলের ভয়ে ছুটে পালালে লোকে কী বলবে। তা ছাড়া ছুটোছুটি করার বয়সও আপনার নয়। মশাই জিভ বার করা জুতো পরে ছুটলে আপনার জিভও মুখের গর্তে বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারবে না। বেরিয়ে পড়বে। তখন সে আবার আর-এক বিপদ।

ওই দ্যাখো, বলতে-না-বলতেই তিনি টাল খেলেন। পড়তে পড়তেও তিনি পড়লেন না। বেড়ালটাকে বাগিয়ে ধরে তিনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর পায়ের দিকে চেয়ে তিনি আবার হনহন করেই হাঁটতে লাগলেন। তাঁর হাঁটা ছাড়া উপায়ও ছিল না। কারণ তাঁর দু’পায়ের দুটি জুতোরই মাথা ভেদ করে তাঁর দু’পায়ের দশটি আঙুল উঁকি মারছে। হ্যাঁ, এইবারই তাঁর চোখে মৃদু-মন্দ রাগ দেখা গেল। তিনি পায়ের ছেঁড়া জুতো খুলে ফেললেন। “দূর ছাই” বলে তিনি ছেঁড়া জুতো পথের ধারে ছুড়ে ফেলে দিলেন। আবার ছুটলেন। ছেলেটা এখনও তাঁর পিছু ছাড়েনি। অগত্যা খালি পায়ে তাঁকে এবার একটু দ্রুত ছুটতে হল। দ্রুত ছুটতেই দ্যাখো, আর-এক বিপত্তি! তাঁর মাথার টুপিটা গেল খুলে। হাওয়ায় উড়ে টুপি হুস-স-স! তিনি থতমত খেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মাথায় হাত দিলেন। ছেলেটা অমনই চেঁচিয়ে উঠল:

সাহেবের মাথায় ও কী মস্ত?

সেটিতে বোলান তিনি হস্ত।

উরি ব্যস, মাথায় জবর টাক রে!

কুকুরে কামড়ে দেবে ভাগ রে!

ইতিমিচিসাহেব এমন অপ্রস্তুত বোধ হয় আর কখনও হননি। তিনি আর দাঁড়ান। টুপিটা যেথায় গেল, সেথায় গেল। সেদিকে তাঁর চোখ গেল না। তিনি পড়িমরি ছুট দিয়ে পালাতে পারলেই বাঁচেন। এখন মান-সম্মানটা থাকলে বাঁচি।

রক্ষে, ছেলেটা আর ইতিমিচিসাহেবের পিছু নিল না। পিছু নিক, আর নাই নিক, ইতিমিচিসাহেব থামলেন না। তিনি ছুটলেন। ছুটতে ছুটতে ছুটতে— অনেকক্ষণ পর তিনি থামলেন। বড্ড হাঁফিয়ে গেছেন। তা যাবেন বইকী! এই বয়সে একটানা এতখানি দৌড় দেওয়া সোজা কথা! ঠিক বটে সোজা নয়। কিন্তু যে কাজটা সোজা ছিল, তিনি সেটি করলেন না। কেন, প্যাংলা ছেলেটাকে একটু বকা দিতে কী হয়েছিল? দিলে হয়তো ছেলেটা অমন দাঁত ছরকুট্টে হেসে ছড়া কাটত না। মধ্যিখান থেকে জুতোও গেল পা থেকে, টুপিও উড়ল মাথা থেকে। টুপিটা বেঁকাতেড়া হলেও মাথার টাকটা তো ঢাকা রেখেছিল। এখন, মাথায় এত বড় একটা টাক নিয়ে পাঁচজনের সামনে কেমন করে যান তিনি? মাথায় টুপি নেই, পায়ে জুতো নেই— এই অবস্থায় পথে বেরোলে কে তাঁকে সাহেব বলবে? অবশ্য এটাও ঠিক, টুপিটা যে ছিদ্র হচ্ছে, জুতোটা যে ছিঁড়ছে, এদিকে তাঁর খেয়াল রাখা উচিত ছিল। সাধে কি সবাই বলে:

ঠিক কাজটি, ঠিক সময়ে যে জন পারে করতে, /সেই খুঁজে পায় পথের হদিশ জীবনটাকে গড়তে।

যাকগে, ওসব কথা এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেবে কোনও লাভ নেই। কে বলতে পারে, আবার কেউ তাঁর টাক নিয়ে খোঁটা দেবে না। এখন ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি করার সময় এসেছে তাঁর নিজের। মাথার টাক ঢাকার একটা নতুন টুপি তাঁকে যেমন করে হোক জোগাড় করতে হবে। আর জোগাড় করতে হবে একজোড়া নতুন জুতো। অবশ্য জামাপ্যান্ট যা আছে, আপাতত চলে যাবে।

আরে বাবা জোগাড় করতে হবে বললেই কি জোগাড় করা যায়? না, দাও বললেই কেউ হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে? সুতরাং কী করা! এই কথাটা ভাবতে ভাবতে তিনি হাঁটতে লাগলেন। হাঁটতে হাঁটতে তিনি ঘরে ফিরলেন।

ঘরে ফিরেও কি নিস্তার আছে? ভাবনাটা এমন ব্যস্ত করে তুলল যে, তিনি না পারেন বসতে, না পারেন দাঁড়াতে। অবশ্য একটা টুপি তিনি দোকান থেকে এখনই কিনতে পারেন। জুতোটা না হলেও ক’দিন অবশ্য খালি পায়ে চালিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু খালি মাথায় পাঁচজনের সামনে দাঁড়ানো যায় না। সুতরাং সেদিন তিনি আর ঘর থেকে বেরোলেন না। শুয়ে পড়লেন। কখন যে রাত এল, আর কখন যে চোখে ঘুম জড়াল, সেসব তাঁর খেয়ালই থাকল না।

যাক, তবু ভাল, রাতটা তাঁর নির্বিঘ্নে কেটেছে। টাক নিয়ে তাঁর দিনের চিন্তাটা রাতের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়নি। কোলের কাছে বেড়াল নিয়ে তিনি অঘোরে ঘুমিয়েছেন। অবশ্য ভোরের আলোয় চোখ মেলতেই মনটা আবার সেই টাক টাক করে হাঁকপাক করতে লাগল। এবং তিনি ঠিকই করে ফেললেন, আজই একটা নতুন টুপি সওদা করবেন। কাজেই তিনি সময় নষ্ট না করে উঠে পড়লেন। তড়বড় করে বিছানা থেকে নামতেই তিনি থতমত খেয়ে গেলেন। আরে, তাঁর চোখের সামনে ওটা কী? তাঁর ঘুম-ভাঙা চোখদুটো কি ভুল দেখছে! তিনি চোখদুটো কচলে নিয়ে আবার দেখলেন। হ্যাঁ, তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন, তাঁর চোখের সামনে একটা ঝকঝকে টুপি। কোত্থেকে এল? তিনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ফ্যালফ্যাল করে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। তারপর সুড়সুড় করে এগিয়ে গিয়ে টুপিটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলেন। দেখতে দেখতে খুব সাবধানে মাথায় দিলেন। আশ্চর্য, একদম মাথার মাপসই। আয়নায় মুখ দেখলেন। বাস রে বাস, কী দারুণ ফিট করেছে। মানিয়েছেও তেমনই। এখন কে বলবে, সাহেবের মাথায় মস্ত টাক! আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে নিজেই বিভোর হয়ে গেলেন। আনন্দে তাঁর মনের ভেতরটা উথাল-পাথাল করতে লাগল। তাঁর মনে হল, এখনই তিনি লাফিয়ে ওঠেন। কিংবা গান গেয়ে চারদিক কাঁপিয়ে তোলেন। নয়তো, হেসে ওঠেন হা-হা করে। কিন্তু তিনি এসব কিছুই করলেন না। কেননা, হঠাৎ তাঁর চোখের ওপর ভেসে উঠল সেই প্যাংলা ছেলেটার মুখখানা। সেই তার দাঁত ছরকুটে হাসি, সেই তার খোঁটা দিয়ে ছড়া-কাটা, সেইসঙ্গে তার ধেই ধেই করে নাচ, সব যেন স্পষ্ট দেখতে পেলেন তিনি। আর থাকতে পারলেন না। তখনই বেরিয়ে পড়লেন ঘর থেকে। বেড়ালটা এখনও ঘুমোচ্ছে। ঘুমোক। বেড়াল ঘরেই থাক। আবার যদি দেখা হয়ে যায় ছেলেটার সঙ্গে তা হলে যা হবে না। এবার দেখা হলে আর বলতে হচ্ছে না তেড়া-বেঁকা টুপি! কাট ছড়া! হুঁ! এত কথা ভাবছেন বটে, কিন্তু থেকে থেকেই তিনি ভড়কে যাচ্ছেন। বারবার তাঁর মনে হচ্ছে, টুপিটা এল কোত্থেকে! এ যে বাবা ভেলকির খেল! ভেলকির খেল, না, অন্য কিছু, এ তো আর সেই ছেলেটা জানছে না। সুতরাং ছেলেটার দেখা পেলে মাথা উঁচিয়ে এমন ডাঁট দেখাবেন না তিনি! ছড়া কেটে খোঁটা দেওয়া বার করে দেবেন। সে না-হয় দেবেন, কিন্তু তার আগে ছেলেটার দেখা তো পেতে হবে।

এমন সময়ে হয়েছে কী, তিনি তখনও হাঁটছেন। হাঁটতে হাঁটতে তিনি যে অনেকখানি পথ হেঁটে ফেলেছেন, তেমনও নয়। হঠাৎ তাঁর বুকটা ধড়াস করে উঠেছে। সেই ছেলেটা চেঁচাচ্ছে:

ওই দ্যাখো সেই সাহেব যায়,

মাথায় টুপি আলগা পায়।

প্যান্ট জামা-শার্ট গায়ে পরে,

এদিক দেখে ওদিক ঘোরে।

সাহেব না তো আস্ত সঙ,

হেসেই মরি দেখলে ঢঙ।

না, এবার আর ইতিমিচিসাহেব রাগ সামলাতে পারলেন না। তিনি রেগেমেগে ফিরে দাঁড়ালেন। ছেলেটার মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে তার মাথার দিকে তাকিয়ে ফেললেন। আরে, ছেলেটার মাথায় যে তাঁর সেই ফুটোফাটা টুপিটা! ওই দ্যাখো, পায়ে সেই জিভ বার করা ঢলঢলে জুতোটা! ইতিমিচিসাহেবের সেই রাগ-রাঙা চোখদুটো ফস করে কেমন নরম হয়ে গেল। তাঁর সেই গম্ভীর গম্ভীর মুখের ওপর কেমন যেন আলতো হাসি ঝলমল করে উঠল। তিনি খুশি খুশি গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “তুই টুপিটা কোথায় পেলি রে?”

সে উত্তর দিল, “কোথায় পেয়েছি সে তুমিও জানো, আমিও জানি। সে নিয়ে কথা কাটাকাটি করে লাভ নেই। আমি জিজ্ঞেস করি, তুমি কোথায় পেলে অমন দামি টুপিটা?”

ইতিমিচিসাহেব জবাব দিলেন, “কোথায় পেয়েছি সে তুইও জানিস, আমিও জানি। সে নিয়ে কথা কাড়াকাড়ি করে লাভ নেই। আমি জিজ্ঞেস করি, তুই কোথায় পেলি ছেঁড়া জুতোজোড়া?”

উত্তরে ছেলেটাও বলল, “জুতো নিয়ে কথা টানাটানি করে লাভ নেই। রাস্তায় পড়ে ছিল, আমি কুড়িয়ে পেলুম।”

ইতিমিচিসাহেব বললেন, “টুপি নিয়েও কথা চালাচালি করে লাভ নেই। ঘুম ভাঙল। চোখ খুললুম। ঘরেতে দেখতে পেলুম।”

ছেলেটা বলল, “তোমার আলগা পা। মাথায় টুপি। তোমাকে পাগল পাগল দেখতে লাগছে।”

ইতিমিচিসাহেব যেমন ফস করে তখন নরম হয়ে গেছলেন, এবার তেমনই তিনি দপ করে জ্বলে উঠলেন। তিনি বললেন, “তোরও তো আদুল গা। মাথায় ফুটো টুপি। পায়ে ছেঁড়া জুতো। ঢাপ্পুস। তোকেও তো হাবলা মতো দেখতে লাগছে।”

ছেলেটা উত্তর দিল, “আমাকে হাবলাই বলো কী গাবলাই বলো, আমি তোমার মতো ক্যাবলা নই। আমি মাথায় টুপি পরে খালি পায়ে ট্যাঙাস-ট্যাঙাস করে ঘুরে বেড়াই না। দস্তুরমতো আমার পায়ে জুতো আছে।”

সাহেব বললেন, “ওই জুতোজোড়া আমার।”

ছেলেটা উত্তর দিল, “জানি তোমার। এখন আমার।”

তিনি রেগেমেগে বললেন, “খুলে দে, আমি পরব।”

সে বলল, “দেবে বইকী! ফেলে দেওয়ার সময় মনে ছিল না?”

তিনি বললেন, “অমন ট্যাঁক-ট্যাঁক করে কথা বললে, এক ঘুসো মারব।”

সে বলল, “তুমি এক মারলে আমি দুই মারব।”

তিনি বললেন, “তুমি দুই মারলে আমি চার মারব।”

“মারো দেখি।” বলেই ছেলেটা ঝট করে একটা ইট তুলে নিল। ভয় দেখাল, “মারব ইট, ফাটবে মাথা।”

“এই বেঁটকুলে, তোর কোনও গুরুজন নেই? সাহেবের সঙ্গে কথা বলার আদব-কায়দা শিখিসনি কারও কাছে? তুই তো আচ্ছা ব্যাদড়া।”

“তবে রে, আমায় ব্যাদড়া বলা। এই ছুড়লুম,” বলেই একটা ইট ছুড়ে দিল ছেলেটা। উঃ! লেগেছে। সটান ইতিমিচিসাহেবের মাথায় এসে লেগেছে।

ইতিমিচিসাহেবও রাস্তা থেকে ইট তুলে দিলেন ছুড়ে। ছিঃ! এটা বোধহয় ইতিমিচিসাহেব ঠিক করলেন না। একটা বাচ্চা ছেলের গায়ে ইট মারাটা একজন সাহেবের কেতায় মানায় না। এবার বোঝো! ছেলেটা এমন ইট ছুড়তে শুরু করল যে, ইতিমিচিসাহেবের কম্ম সারা। একটার পর একটা উড়ে আসছে শাঁই-শাঁই। আর দাঁড়াবেন কী, পালাতে পারলেই বাঁচেন। তিনি চোখ-কান বুজে দিলেন ছুট। ছুটতে ছুটতে তিনি পৌঁছে গেলেন নিজের ডেরায়। হাঁপিয়ে গেছেন। নাকাল হওয়া কাকে বলে! এই বয়সে একটা প্যাংলা ছেলে যে তাঁকে এমন করে অপদস্থ করবে, এ তিনি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি। তিনি ঘরে ঢুকে পড়লেন।

ঘরে ঢুকেই তাঁর চক্ষুচড়কগাছ। এ কী দেখেন তিনি! ঘরের মেঝে থেকে আর কড়িকাঠ পর্যন্ত ঠাসা একরাশ নোংরা পুরনো জুতো! জুতো মানে— ছেঁড়া জুতো, ফাটা জুতো, ফুটো জুতো, কাটা জুতো, বড় জুতো, ছোট জুতো, খেঁটে জুতো, বেঁটে জুতো— বাপরে বাপ, কত জুতো! জুতোর ঠেলায় তিনি ঘরে ঢুকতেই পারলেন না। অগত্যা ফ্যালো, ফ্যালো, ছুড়ে ফ্যালো। তিনি ঝড়ের বেগে হাত চালিয়ে ঘরের জুতো ঝপাঝপ রাস্তায় ফেলতে লাগলেন। তা সে-ও কি সহজ কাজ! একটা-দুটো-তিনটে-চারটে করতে করতে একশোটা-দুশোটা-তিনশোটা-চারশোটা জুতো রাস্তায় গড়াগড়ি খেতে লাগল। যখন পুরো ঘরটা সাফা হয়ে গেল, যখন দম নেওয়ার জন্যে তিনি হাঁফ ছাড়লেন, ঠিক তক্ষুনি তাঁর চক্ষুস্থির হয়ে গেল।

কেন কী দেখলেন তিনি?

দেখলেন, একজোড়া নতুন জুতো, ঝকঝকে। এতক্ষণ ছেঁড়া, ফাটা জুতোর নীচে চাপা পড়ে ছিল। আজব কাণ্ড! দেখে মনে হচ্ছে, একেবারে ঠিক সাহেবের পায়ের মাপে। তাঁর আর তর সইল না। তিনি ঝপ করে গলিয়ে ফেললেন পায়ে। হ্যাঁ, একদম ফিট! খুশিতে দিশেহারা হয়ে ঘরের ভেতর ক’বার মচমচ করে তিনি ঘুরপাক খেলেন। ঘুরতে ঘুরতে তিনি খিলখিল করে হেসে উঠলেন। তারপর হাঁক পাড়লেন, “বিল্লি, বিল্লি, কোথায় গেল্লি?”

বিল্লির সাড়া তিনি পেলেন না।

তিনি আবার ডাকলেন, “বিল্লি, বিল্লি, কোথায় লুকাল্লি?”

বিল্লির দেখা তিনি পেলেন না।

তবু তিনি ডাক ছাড়লেন, “বিল্লি, বিল্লি, আমাকে কি ভুললি?”

হায় রে, বিল্লির ‘মিঁউ’ শব্দটি পর্যন্ত শোনা গেল না।

তখন তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে বিল্লি, বিল্লি বলে চেল্লাচিল্লি শুরু করে দিলেন। পথে পথে খুঁজতে লাগলেন। খুঁজতে খুঁজতে পথঘাট তোলপাড় করে ফেললেন। কিন্তু তবুও বেড়ালের দেখা মিলল না। শেষমেশ হতাশ হয়ে তিনি হা-হুতাশ করতে লাগলেন। একবারও তাঁর মনে হল না, মহাপ্রভু বেড়ালই ছেঁড়া জুতো আর ফাটা জুতোয় ঘরভরতি করে একজোড়া নতুন জুতো লুকিয়ে রেখেছিল তার নীচে। রেখে ভেগে পড়েছে। কে জানে আর আসবে কি না! তবে ইতিমিচিসাহেবের মনটা বেড়ালটাকে খুঁজে না-পেয়ে বেশি দুঃখ দুঃখ পাচ্ছিল, না, একজোড়া নতুন জুতো পেয়ে বেশি খুশি খুশি লাগছিল, তা বলা মুশকিল।

কেননা, কে বলতে পারে নতুন জুতোর চেয়ে নতুন টুপি ভাল। না, টুপির চেয়ে জ্যান্ত বেড়াল? ভাবনার কথা বটে!

৪ নভেম্বর ১৯৯৮

সকল অধ্যায়

১. বিষে বিষক্ষয় – আশাপূর্ণা দেবী
২. আটচল্লিশ – অরবিন্দ গুহ
৩. ডোডো তাতাই পালা কাহিনি – তারাপদ রায়
৪. কৈলাসে চা পান – আশাপূর্ণা দেবী
৫. চোরে ডাকাতে – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৬. সাধু কালাচাঁদের নতুন কাজ – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
৭. ইলশেঘাই – লীলা মজুমদার
৮. শরচ্চন্দ্রের সন্ধিভেদ! – শিবরাম চক্রবর্তী
৯. ঝুনুমাসির বিড়াল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০. বিধু দারোগা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
১১. সাধু কালাচাঁদের পালাকীর্তন – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
১২. কে ফার্স্ট? – আশাপূর্ণা দেবী
১৩. ফ্ল্যাট রেস – জরাসন্ধ
১৪. চিত্তশুদ্ধি আশ্রম – বিমল কর
১৫. টেনাগড়ে টেনশান – বুদ্ধদেব গুহ
১৬. হাতি-চোর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৭. ছোটমাসির মেয়েরা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৮. মোটরবাইক, ষাঁড় ও লাকি – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১৯. ব্যাঙাচিদের লেজ – তারাপদ রায়
২০. বাজারদর – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২১. তেঁতুলমামার জগৎ – হিমানীশ গোস্বামী
২২. রাজার মন ভাল নেই – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৩. গজেনকাকার মাছ-ধরা – বিমল কর
২৪. দাদুর ইঁদুর – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
২৫. সাত নম্বর – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
২৬. মেজদার সার্কাস – চিত্তরঞ্জন সেনগুপ্ত
২৭. চোর – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৮. কুস্তির প্যাঁচ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৯. দুঃখহরা বড়ির শিশি – লীলা মজুমদার
৩০. পিলকিন’স ইলেভেন – বিমল কর
৩১. রাত যখন বারোটা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩২. ভুনিকাকার চৌরশতম – বিমল কর
৩৩. গ্রামের নাম জাঁকপুর – আশাপূর্ণা দেবী
৩৪. নিখোঁজ নিরুদ্দেশ হতে গেলে – আশাপূর্ণা দেবী
৩৫. বাঘের দুধ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৬. গগনবাবুর গাড়ি – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৭. গাবু – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৮. কুরুক্ষেত্র – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৯. কাক্কাবোক্কার ভুতুড়ে কাণ্ড – শৈলেন ঘোষ
৪০. হরিমতির বাগান – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪১. বড়দার বেড়াল – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৪২. মহাকর্ম – সমরেশ মজুমদার
৪৩. পায়রাডাঙায় রাতে – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৪. মামার বিশ্বকাপ দর্শন – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪৫. গটমটে সাহেব বটে – শৈলেন ঘোষ
৪৬. রাঘব বোয়াল – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
৪৭. স্কন্ধকুমার এবং অর্ধচন্দ্র – তারাপদ রায়
৪৮. পাগল হইবার সহজপাঠ – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪৯. বিপিনবিহারীর বিপদ – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৫০. সাদা রঙের পাঞ্জাবি – অনির্বাণ বসু
৫১. জগু যাবে বেড়াতে – বাণী বসু
৫২. কুঞ্জবাবুর পিঁপড়ে বাতিক – অমিতাভ গঙ্গোপাধ্যায়
৫৩. ভুলে যাওয়া – সিদ্ধার্থ ঘোষ
৫৪. ঝগড়ুটে ফাইভ – প্রচেত গুপ্ত
৫৫. বিপদভঞ্জনের সর্পদোষ – উল্লাস মল্লিক
৫৬. মাসির বাড়ি – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৫৭. জাগ্রত অসুরের গল্প – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৫৮. কাকাতুয়া ডট কম – প্রচেত গুপ্ত
৫৯. নতুন নাটকও ভন্ডুল – উল্লাস মল্লিক
৬০. রামখেলাওনের কেরামতি – সৌরভ মুখোপাধ্যায়
৬১. কলহগড়ের নিস্তব্ধতা – সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়
৬২. পটলার থিমপুজো – শক্তিপদ রাজগুরু
৬৩. সংকটমোচন কমিটি – প্রচেত গুপ্ত
৬৪. নতুন বন্ধু চিনু – জয়দীপ চক্রবর্তী
৬৫. বুঁচকির মেয়ের বিয়ে – নবনীতা দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন