পৌলোমী সেনগুপ্ত
সমস্যা একটা হলেই হল, তেঁতুলমামা তার সমাধান করে ফেলবেনই। আবার যেখানে সমস্যা-টমস্যা তেমন নেই, সেখানে তেঁতুলমামাকে নিয়ে হাজির করো, দেখবে দিব্যি সমস্যার সৃষ্টি করে ফেলেছেন তিনি।
আচ্ছা, নামটা ওরকম অদ্ভুত হল কেন? তেঁতুল নামটা কীরকম যেন! জানি এমন একটা প্রশ্ন তোমরা করবেই। ঠিকই বলেছ, নামটা তেমন মিষ্টি নয়, তাই তো? একটু টক টক ভাব। না, একটু কেন—চমৎকার মানে বেশ টক টক ভাব। তোমরা নিশ্চয়ই ভাবছ, লোকটি বোধহয় তেমন সুবিধের নয়। তেঁতুল যাঁর নাম তিনি নিশ্চয়ই মুখখানাকে মিষ্টি করতে পারেন না, দেখে নিশ্চয়ই ভয়-টয় হয়?
হ্যাঁ, এটাও একটা প্রশ্ন। এ প্রশ্নটাও তোমাদের মনে আসবে জানা কথা। এর উত্তরে জানাই, উঁহু তেঁতুলমামাকে দেখে মোটেই ভয় হয় না। যদিও তার চেহারার, মানে মুখের ইঞ্চি তিনেক জায়গা বেশ টুথব্রাশের ব্রিসল-এর মতো গোঁফে ভরা। আর তাঁর মোটা ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে যখন একদৃষ্টে কারওর দিকে তাকান, কিংবা গর্জন টর্জন করেন, বা তর্জন গর্জন করেন, তখন একটু-আধটু ভয় যে একেবারেই করে না তা নয়। তবে মানুষটি একেবারে মিষ্টি।
ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে অবশ্যই একটা কিছু সমস্যা নিয়ে যেতে হবে, নইলে তিনি খুব দুঃখ করেন। বলেন, আজকালকার ব্যাপারই সব বদলে গেল কেমন। আমাদের আমলে কতরকম সমস্যা ছিল। এক একটা মানুষের অন্তত সতেরো-আঠারো করে সমস্যা। এক বাড়িতে সাতজন লোক থাকলে আবার সাত সতেরোং একশো উনিশ প্লাস সাত, সব মিলিয়ে একশো ছাব্বিশটা সমস্যা। আর এখন যা দিনকাল পড়েছে, সমস্যাটমস্যা একেবারে সব হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। এইভাবে চললে দু’ হাজার খ্রিস্টাব্দে মানুষ সমস্যার অভাবে হাঁফিয়ে-টাফিয়ে মরেই যাবে।
কথাটা একটু অদ্ভুত মনে হচ্ছে, না? তেঁতুলমামা লোকটিই তো একটু অদ্ভুত। তবে মনে কোরো না, তেঁতুলমামার কথার মধ্যে কোনও পদার্থ নেই। ওঁর কাছে গেলেই টের পাবে। দুটি কথা শুনলেই বুঝতে পারবে তার কথার মধ্যে প্রচুর পদার্থ।
আচ্ছা, ওঁর বয়স কত?
এটাও একটা প্রশ্ন বটে। তেঁতুলমামার নিজের বক্তব্যকে যদি বিশ্বাস করতে হয় তা হলে তাঁর বয়স অন্তত পক্ষে ষাট, কেননা, তাঁর নাকি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বাধার সময় বয়স ছিল কুড়ির উপর। তা যদি হয় তা হলে তার বয়স ষাট বছর তো হবেই, বেশিও হতে পারে।
অথচ…।
হ্যাঁ, ঠিকই। একটা অথচ রয়েছে। দেখতে তাঁকে কিছুতেই ষাট বছরের মনে হয় না। মনে হয়, তাঁর বয়স ত্রিশ বছরের এক চুল বেশি নয়। তবে ওসব বয়স-টয়স নিয়ে আমাদের দরকার কী। কিছু লোক ওইরকম হয়। তাদের বয়স আন্দাজে বোঝা যায় না।
তোমরা তেঁতুলমামার কাছে যেতে চাও? জানতাম তোমাদের কৌতূহল হয়েছে। কিন্তু যাওয়ার আগে একটা সমস্যা ভেবে বার করো, যে সমস্যা বেশ কঠিন সমস্যা। তা নইলে কিন্তু তেঁতুলমামা খুবই দুঃখিত হবেন।
তেঁতুলমামা কোথায় থাকেন?
হ্যাঁ, এই প্রশ্নটা তোমরা করবেই জানি। অর্থাৎ তাঁর ঠিকানা তো? কিন্তু এখানে তা তো আর ছাপিয়ে দেওয়া যায় না। অর্থাৎ, পুরো ঠিকানা দিলে তোমরা দিন-রাত্তির তাকে বিরক্ত করবে হয়তো। সে-সব কিন্তু তিনি খুব অপছন্দ করেন। তবে কিছুটা বলে দিই। তিনি থাকেন কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছাকাছি একটা গলিতে। একটা পুরনো ধাঁচের ফ্ল্যাট বাড়িতে। তাঁর সঙ্গী রয়েছে একজন পুরনো ভৃত্য এবং সহকারী। লোকটির নাম স্যামু। আসল নাম স্যামুয়েল পিনটো। সম্পূর্ণ বাঙালি। চমৎকার রান্না করতে পারে। ওর তৈরি চিংড়ির কাটলেট কিংবা দো-পেঁয়াজা যে না খেয়েছে সে জানে না সে কী পেল না জীবনে। আর যে খেয়েছে? তার কথা অনুমান করে নাও।
আর রয়েছে ওই বাড়িতে একজন, তার নাম খুদে। কিন্তু খুদের লেজ আছে। আবার এটাও বলে দিই, খুদে খুব খুদে নয়। খুদে হচ্ছে একটা চমৎকার কুকুর—জাতে অ্যালসেশিয়ান। তেঁতুলমামার খুব দুঃখ, কুকুরটা বড়ই অলস প্রকৃতির। দরকার না হলে উঠে দাঁড়ায় না। রুটি আর ভাত দিলে ভাত খায়। রুটি ছোঁয় না খুব দরকার না হলে। আর তার একটি বিশ্রী নেশা আছে। খাওয়ার পর তাকে একটা জরদা-দেওয়া মিঠে পান খেতেই হবে।
কী, চমকে উঠলে কেন? সত্যিই খুদে জরদা-দেওয়া পান খায়। তবে বেশি না, দিনে বার তিনেক। কিন্তু এটাও তেমন চমকপ্রদ নয়। এবার যদি বলি এই খুদের আরও একটা খারাপ অভ্যেস আছে তা হলে তোমরা খুবই অবাক হয়ে যাবে। আমরাও খুব অবাক হয়েছিলাম। প্রথমে বিশ্বাসই করিনি। ওই খুদেটা ঘন ঘন গড়গড়ার নলে মুখ দিয়ে অম্বুরি তামাক টানে।
এই জন্য তেঁতুলমামা ওকে খুদে না বলে বলেন আলসে নবাব।
এইবার চলে যাওয়া যাক। দেখেই আসি একবার তেঁতুলমামাকে। কী, সমস্যা-টমস্যা কিছু সঙ্গে রেখেছ তো? রেখেছ? সমস্যাটি কী? ও, এই গরমের দিনে লোডশেডিংয়ের ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার উপায় কী?
বাঃ, চমৎকার সমস্যা। তেঁতুলমামা শুনলে খুশি হবেন।
তেঁতুলমামা ইজিচেয়ারে বসে ছিলেন। খুদে একটু দূরে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে। স্যামু দরজা খুলে দিল। তেঁতুলমামা বললেন, “ওরে, সব লোক এসেছে, ভালমন্দ কিছু এনে দাও স্যামুবাবু।”
স্যামু বলল, “যে আজ্ঞে।” বলে চলে গেল।
তেঁতুলমামা উপস্থিত তিন মূর্তিকে দেখলেন। প্রথমে খালি চোখ দিয়ে, পরে চশমা লাগিয়ে। হ্যাঁ, যে তিন মূর্তিকে তিনি দেখলেন তারা হল—সৌম্য, সুপ্রকাশ আর তুষার। থাকে শ্যামবাজারে। পড়ে স্কুলে। তারা একটা সমস্যা এনেছে—সমস্যাটার কথা আগেই বলেছি।
তেঁতুলমামা সমস্যার কথা শুনে খুবই খুশি হয়ে উঠলেন। বললেন, “স্যামু, চমৎকার কফি বানাও আর তার সঙ্গে অনুপান! হ্যাঁ, সমস্যাটা চমৎকার। চমৎকার।” তেঁতুলমামা উঠে দাঁড়িয়ে জানলা দুটো খুলে দিলেন, তারপর কী ভেবে জানলা বন্ধ করে দিলেন। তারপর বললেন, “অবশ্য সমস্যা যা এনেছ তা একটা নয়, আসলে দুটো। গরম হচ্ছে একটা সমস্যা। গরমের সমস্যার সঙ্গে লোডশেডিংয়ের সমস্যা যুক্ত হলে অবশ্য সমস্যাটা বিস্তারলাভ করে, গভীরও হয়। কিন্তু আসলে গরম এবং লোডশেডিং দুটি আলাদা—সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। তোমরা চাও গরমকালে যাতে ঠান্ডা থাকতে পারো, এই তো?”
তিন মূর্তি একসঙ্গে জানাল—ঠিক তাই।
তেঁতুলমামা বললেন, “তা হলে আমি কিছুক্ষণ ভেবে নিই, কী বলো?”
সুপ্রকাশ বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ভাবুন।”
ইতিমধ্যে স্যামু একগাদা চিংড়ি মাছের বড়া নিয়ে এল, আর সঙ্গে চমৎকার চা। অতএব মিনিট দশেক সময় দিব্যি কেটে গেল। স্যামু খালি প্লেট আর কাপ নিয়ে যাওয়ার পর তেঁতুলমামা বললেন, “স্যামুবাবু, এবারে আলসেটাকে একটু গড়গড়ার ব্যবস্থা করো!”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর।” বলল স্যামু।
দেখা গেল খুদে স্যামুর পেছন পেছন চলে গেল পাশের ঘরে, আর তার একটু পরেই আওয়াজ হতে লাগল গবলুম! গবলুম! আর বাতাসে ভেসে আসতে লাগল কী চমৎকার মিষ্টি গন্ধ!
বেশ কিছুক্ষণ ভেবে তেঁতুলমামা বললেন, “একটা উপায় আমি বার করেছি। এটা একটু খরচসাপেক্ষ। এতে ঘর চমৎকার ঠান্ডা থাকবে। একটা দিশি উপায় আছে, তা হল খসের পরদা করে দরজায় জানালায় পরদার মতো লাগিয়ে দিয়ে তাতে জল ছিটিয়ে দেওয়া। কিন্তু হাওয়া না থাকলে খসও বেশ গরম হয়। অর্থাৎ হাওয়া না হলে খসের জল তাড়াতাড়ি উঠে যায় না, আর জল উঠে না গেলে ঠান্ডাও হয় না। আসল ব্যাপারটা হল, হাওয়াটা শুকনো হওয়া চাই, আবার হাওয়া চলাচলও করা চাই। একটা উপায় হল, ইলেকট্রিক পাখা চালিয়ে দেওয়া। কিন্তু হাওয়া যদি শুকনো তেমন না হয় তা হলে পাখা যতই চলুক, জল শুকোবে কম, আর ঘরও তেমন ঠান্ডা হবে না। আবার লোডশেডিংয়ের সময় পাখাও তো চালানো যাবে না। অতএব আমি একটা নতুন ধরনের ঘরের পরিকল্পনা করেছি।”
“কীরকম?” তুষার প্রশ্ন করল।
“সেটা হল ঘরের দেয়ালগুলোর সঙ্গে টিন লাগিয়ে দেওয়া।”
“টিন?”
“হ্যাঁ, টিন। সমস্ত দেয়ালে টিন লাগানো হয়ে গেলে দেয়াল বরাবর আট ইঞ্চি টিন লাগাতে হবে সমান্তরাল করে। না, না—তার আগে দেয়ালের টিন থেকে অসংখ্য তাকের মতো করতে হবে। যেন আট ইঞ্চি বহু তাক দেয়াল থেকে বেরিয়ে রয়েছে।”
“তারপর আবার টিন দিয়ে ওই তাকগুলোকে ঢেকে দিতে হবে। তা হলে আট ইঞ্চি বাই আট ইঞ্চি অনেকগুলো ঢাকা তাক হবে। কিন্তু তারপর যে বাকি দুটো দিক থাকবে তার একটা দিক বন্ধ করতে হবে। এবারে একটা কাণ্ড করতে হবে।”
“কী কাণ্ড?”
“এবারে অসংখ্য সাপ জোগাড় করতে হবে। এ ব্যাপারে সাপ-বিশারদ দীপক মিত্রের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। যে সাপ সবচেয়ে বেশি ঠান্ডা সেই জাতের সাপ এনে প্রত্যেকটি তাকে একটি করে সাপ রেখে তাকের যে মুখটা খোলা ছিল সেটাকে বন্ধ করতে হবে। অবশ্য হাওয়া চলাচলের জন্য টিনের গায়ে পেরেক দিয়ে ছোট ছোট ফুটো করে দিতে হবে। এবারে ভারী মজা। সমস্ত দেয়াল ঠান্ডা—আর ঘরে ঢুকলে কোথায় লাগে দামি দামি এয়ার কনডিশনার!”
“ওরে ব্বাবা!”
তেঁতুলমামা বললেন, “এতেও যদি ঘর তেমন ঠান্ডা না হয় তা হলে আরও একটা উপায় আছে। ছাতের সঙ্গে লাগানো চ্যাপটা একটা ছাতের সমান টিনের ট্যাঙ্ক বানিয়ে তাতে জল ঢালতে হবে।”
সুপ্রকাশ বলল, “কিন্তু জল তো গরমে তেতে উঠবে!”
তেঁতুলমামা বললেন, “কে বলেছে তেতে উঠবে। ওই ট্যাঙ্কে পঞ্চাশটা কুমির এবং আলাদাভাবে ছ’শো ব্যাং থাকবে না? জানো তো এই সব জীবের রক্ত ঠান্ডা? ঠান্ডা ঠান্ডা এইসব জীব জলকে ঠান্ডা করে রাখবে, ঘর ঠান্ডা হয়ে যাবে। দিব্যি মজার ব্যাপার হবে। তবে কিনা একটা গোলমালও আছে।”
সৌম্য বলল, “কী গোলমাল?”
তেঁতুলমামা বললেন, “গোলমালটা আর কিছুই নয়—অত ঠান্ডায় শেষে নিউমোনিয়া-ফিউমোনিয়া না হয়! তবে সেজন্য ভাবনার কিছু নেই। শীতকালে যেসব সোয়েটার ইত্যাদি লাগে, সেগুলিকে বার করে নিলেই হল।” তেঁতুলমামা থামলেন।
হঠাৎ পাশের ঘরে খুদের গর্জন শোনা গেল। তেঁতুলমামা বললেন, “স্যামু? ও স্যামুবাবু? দেখো তো গড়গড়ার আগুনটা বুঝি নিবে গেল আলসের।”
সেদিনকার মতো বৈঠক ওইখানেই ইতি।
২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন