পৌলোমী সেনগুপ্ত
চিঠিখানা ডাকঘরের ভেতর একটা হাতবোমার মতোই ফাটল যেন হঠাৎ!
বোমারু চিঠিই বটে, কিন্তু যে-বস্তু হাত করা মাত্রই বিস্ফোরণ ঘটে আর প্রাপককে সঙ্গে সঙ্গে ত্রিশূন্যে উড়িয়ে নিয়ে যায়, সেরকমটি ঠিক না-হলেও ভাগলপুর ডাকঘরের একটা দুর্ঘটনাই বলা যায় বোধহয়।
বোম্বেটের মতোই নামঠিকানা চিঠিখানার।
শ্রীমচ্ছরন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ভাগলপুর— লেখা ছিল চিঠিখানায়।
হাতে হাতে ফিরতে লাগল চিঠিটা। ডাকঘরের বড় পোস্টমাস্টার থেকে শুরু করে অধস্তন সাবপিয়ন অব্দি সবাই এক নজরে দেখে নিলেন ঠিকানাটা।
“কুওন হ্যায় ইয়ে মচ্ছর!”
“কোই বঙ্গালি হোই মেরা মালুম!” বঙ্গালিদের রহস্যবিদ পাঁড়েজি মর্মভেদ করেন শেষটায়, “কুনো বঙ্গালিবাবু হোবে নিস্চোয়।”
“কোই বঙ্গালিবাবু?”
“জরুর। কাহেনা, ইয়ে চাটোপাটো বানডোপাডো— ইসব ঘোস বোস ডাটো ফাটো— বঙ্গালি লোকেরই হোয়ে থাকে।” বঙ্গভাষাতেও বেশ দখল ছিল পাঁড়েজির। বঙ্গালিদের রহস্যবিদ পাঁড়েজিই বাতলান, “বঙ্গালি ছোড় কর আউর কোই হোবে না…ইয়ে চাটোপাটো…!”
“চাটোপাটো তো হুয়া, লেকিন ইয়ে মচ্ছর?”
“উওভি ওহি বঙ্গালিরাই হোয়। মচ্ছরকা মৎলব হ্যায় মোসা। মোসা, ওই যে গুন গুন করকে কুট কুট কাটতা হায়— ওহি মোসা।”
“উওভি বঙ্গালি? ওহি মোসা?”
“জরুর। ইনকো উনকো আসুন মোসা বোসুন মোসা, কোন লোক বোলে? ওই বঙ্গালিলোক।”
“কাহে বোলে?”
“কেয়া মালুম!”
“আরে, ওহি উলোককা আদত।” আদত কথাটা প্রকাশ করে দেন পাঁড়েজি; ব্যাখ্যায় বিস্তারিত করে।
“বঙ্গালি ভদ্দর আদমিকা বাতচিত ওইসন। ওহি মোসা মোসা।”
“মোসা মোসা? যিসকো হামলোক মচ্চর বোলৎ না?”
“আলবত।”
“তবতো মালুম হো গিয়া। ইনকো হাম বঙ্গালিটোলাসে বাহার কিয়ে গা…” বলে চিঠিখানা নিয়ে পিয়নটি দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে পড়ল।
মহল্লায় মহল্লায় হল্লা লাগাল গিয়ে। মহলে মহলে টহল দিয়ে ফিরল…।
“হিঁয়া পর মচ্ছর কৌন হায়? মচ্ছর?”
“মচ্ছর কোই নেহি, মগর ছারপোকা বহুৎ বা।” হয়তো বা সাড়া আসে কোনও বাঙালির।
“না জি! ছারপোকাসে হমরা কাম নেহি। মচ্ছর চাহিয়ে—”
“না, মচ্ছর কোই না, লেকিন ঘুণপোকা বিস্তর!” ব্যাখ্যা দিয়ে বিশদ করতে গিয়ে কেউবা খুন হয়।
“ছার ঘুনসে হমার কাম না বা! হম্ মচ্ছর ঢুঁড়তা হ্যায়।”
“ঢুঁড়িয়ে!”
“হিঁয়া পর মচ্ছরবাবু কোন আছোন মোসা?”
“কোই নেহি!” একবাক্যে সবার জবাব।
সবাই চিঠিখানার পত্রপাঠ জবাব দিয়েছেন ওই বলেই, চিঠিখানা হাতে না-নিয়েই।
কেবল একজনা মাত্র হাতে হাতে জবাব দিলেন না। হাতে রাখলেন চিঠিখানা।
“হাম ইয়ে বাবুকা পছানতা হায়, দে দুঙ্গা।”
জানালেন তিনি। “পাণিগ্রাহীর কাণ্ড নির্ঘাত,” আওড়ালেন তিনি আপন মনে।
তাঁর বন্ধু পাণিগ্রাহী কাশীবিদ্যাপীঠে এসে পাণিনি গ্রহণের পর থেকেই এই সন্ধিবিচ্ছেদ সমাসদ্বন্দ্বে আগাপাশতলা মশগুল হয়ে রয়েছেন।
মচ্ছরের গুনগুন ধ্বনির ভেতরেই ব্যাকরণের স্বরব্যঞ্জনবিসর্গসন্ধির কুজ্ঝটিকা ভেদ করে শরৎচন্দ্রের কৌমুদীচ্ছটা দেখতে পেলেন বুঝি!
বেশ হৃষ্টপুষ্ট বলিষ্ঠ চিঠি।
তার মধ্যে তাঁর বন্ধু পাণিগ্রাহীর কাণ্ড ছিল আরও।
ছোট-বড় খান পঞ্চাশেক চিরকুট তার ভেতর। সে সবের একখানি মাত্র তাঁর উদ্দেশে আর বাকি উনপঞ্চাশখানা ভাগলপুরময় উনপঞ্চাশজনার মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করা।
তাঁর চিরকুটের লিখন:
“প্রিয় শরৎ, তুমি ওখানে আছ জেনে ভাবলাম ডাকব্যয় বাবদ কেন নাহক সরকারের ঝকমারির মাশুল গোনা। তাই আমার এই চিঠির সঙ্গে অন্যান্যগুলিও তোমার উদ্দেশে পাঠালাম। এই চিঠিগুলি তুমি কালবিলম্ব না-করে বিভিন্ন এলাকার বন্ধুদের পৌঁছে দেবে, আমি আশা করি। পুনশ্চ, আমি বেশ ভাল আছি, ভাবনার কোনও কারণ নেই।”
সারাদিন শরৎচন্দ্র সেই বোঝা বয়ে শহরময় বাড়ি বাড়ি ঘুরে চিঠি বিলি করলেন। ফেরার সময় মোটাসোটা দেখে এক পাথর কুড়িয়ে আনলেন পথের থেকে।
আসলে সাহিত্যিক হলেও বৈজ্ঞানিকের মন ছিল তাঁর। সেই পাথরটিকে মেজে ঘষে কার্বলিক সাবান মাখিয়ে ধুয়ে মুছে বীজাণুহীন বেশ হাইজিনিক করে তুললেন। তার পরে সেটিকে মোড়কের খোলস মুড়ে ভাল করে প্যাক করে উক্ত বন্ধুবৎসল পত্রদাতার উদ্দেশে ভিপি পার্সেল করে ছাড়লেন তিনি।
শরৎচন্দ্রের সন্ধিভেদ যদি বা সহজ হয়, তাঁর অভিসন্ধি ভেদ করা কারও কর্ম নয়।
পাথরের সঙ্গে রইল ছোট্ট একটি চিরকুট:
“প্রিয়—, তুমি বেশ ভাল আছ জেনে আমার বুক থেকে যেন পাষাণভার নেমে গেল। যেটি নেমে গেছে, সেই পাথরখানা এই সঙ্গে তোমাকে ভিপি করে পাঠলাম। ইতি তোমার শরৎ।”
পৌষ ১৩৮২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন