দাদুর ইঁদুর – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

পৌলোমী সেনগুপ্ত

“আজ শেকসপিয়ারস!” বইয়ের র‍্যাক থেকে একটা মোটা বই টেনে নিয়ে দাদু লাফাতে লাগলেন, “কাল সারারাত ধরে ব্যাটারা শেকসপিয়ার চিবিয়েছে।” বই যেখানে ছিল, সেইখানেই কুচো কুচো কাগজ পড়ে আছে। দু’-একটা টুকরো বইয়ের গায়ে লেগে ঝুলছে! “আর ক্ষমা করা যায় না। নো মারসি। এটা ধেড়েদের কাজ, নেংটিদের দাঁতে শেকসপিয়ার সইবে না।”

বইটার বুকে হাত বুলোতে বুলোতে দাদু চিৎকার করলেন, “দেওকিনন্দন, এ দেওকিনন্দন।”

নীচের বাগানে যেন মেঘ ডেকে উঠল, “জি হাঁ।”

“তুরন্ত আ যাও।”

দাদু ডেকচেয়ারে বসলেন। চোখমুখ খুবই ভীতিপদ। “বুঝলে, পরশু মেটিরিয়ামেডিকা, তার আগের দিন রবীন্দ্ররচনাবলী, আজ শেকসপিয়ার। খিদে আর হজমশক্তি, দুটোই ক্রমশ বাড়ছে। মেটিরিয়ামেডিকায় ওষুধ আছে। নাক্সভমিকার পাতা খেয়ে ব্যাটারা আগে খিদে বাড়িয়েছে।”

“ওষুধের নাম লেখা পাতা খেলেও ওষুধের কাজ হয় দাদু?”

“হবে না? সেই ঘটনার কথা তোমার মনে নেই? উত্তাল নদী পেরোতে হবে। নৌকো নেই। সাঁতার জানা নেই। শিষ্যের হাতে গুরু একটা কাগজের মোড়ক দিয়ে বললেন, এইটা মুঠোয় ধরে হেঁটে পার হয়ে যাও। শিষ্য হেঁটে নদী পার হচ্ছে। সত্যিই সে ডুবছে না। মাঝনদী বরাবর এসে তার মনে হল, আচ্ছা দেখি তো কী আছে এতে। খুলে দেখলে লেখা আছে রাম-নাম। যেই মনে হওয়া রামনামের এত জোর, ব্যস, ভড় ভড় করে ডুবে গেল।”

‘মনে আছে, বাবা বহুবার আমাকে এই গল্প বলেছেন। তবে রামনামের জোর হিসেবে নয়, শিষ্যের বিশ্বাসের গল্প। গল্পটা শেষ করেন এই বলে—বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর।”

“সেই বিশ্বাসে আমার কথাটাও তুমি মেনে নাও, তর্ক কোরো না। মেটিরিয়ামেডিকা বুকে চেপে ধরলে খাবি-খাওয়া রোগী বিছানায় উঠে বসে।”

“তা হলে এত মানুষ মারা যায় কেন?”

“বিশ্বাস নেই বলে।”

“তার মানে সেই বিশ্বাস।”

“তোমার সঙ্গে তর্ক করতে চাই না। আই হ্যাভ নো টাইম। আমার মন খারাপ। আমার শেকসপিয়ার খেয়ে গেছে।”

“জি হাঁ।” হাঁ-হাঁ করে দেওকিনন্দন ঘরে ঢুকল। নীচের বাগানে একা একা বোধহয় কুস্তি করছিল।

মাথার পেছনে মাটি লেগে আছে। ভোজপুরি গোঁফজোড়া খাড়া হয়ে আছে। দেওকিনন্দন সামনে থাকলে দাদুও গলাটাকে খুব গম্ভীর মতো করার চেষ্টা করেন। দেওকির আদুরে নাম রেখেছেন দাদু দেবু।

“দেবু, একটা ইঁদুরকল চাই।”

“জি হাঁ। লে আয়েগা। লেকিন জাঁতিকল কি খাঁচাকল?”

“জাঁতি নেহি, জাঁতি নেহি। উ বীভৎস হ্যায়। খাঁচা মাঙতা।”

“ঠিক হ্যায় জি, হো জায়েগা। লেকিন লেংটিকে লিয়ে কি ধেড়ে কে লিয়ে?”

“ইধার আও।”

দেওকি সামনে ঝুঁকে পড়ল। দাদু বইটার কুরে কুরে খাওয়া অংশ দেওকির সামনে তুলে ধরলেন।

“এ কিসকা কাম?”

দেওকি ভাল করে দেখে বললে, “ধাড়িয়াকা।”

“তব ধেড়ে কি লিয়ে খাঁচাকল লে আও।”

কল এসে গেছে। দাদুও এসে গেছেন কোর্ট থেকে। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ। দাদুর লাইব্রেরি ঘরে কলের কেরামতি চলেছে। দাদু নির্দেশ দিচ্ছেন। দেওকি করে যাচ্ছে।

“ময়দাকা এতনা ছোটা ছোটা গোলি বানাও। ময়দা কি খায়েগা? সন্দেহ হ্যায়। লোভনীয় কুছ চিজ চাহিয়ে।”

আমি মেঝেতে থেবড়ে বসেছিলুম। বললুম, “কেক।”

“ওটা তোমার প্রিয়, ইঁদুরের প্রিয় হবে কি? কেয়া দেবু, প্রিয় হোগা?”

“লাড্ডু হোগা জি।”

“হাঁ হাঁ, লাড্ডু লে আও।”

দেওকি সামনের দোকান থেকে এক টাকার লাড্ডু কিনে আনল। প্রথমেই একটা লাড্ডু আমার হাতে দিয়ে দাদু বললেন, “টেস্ট করো।”

মুখে দিয়ে বললুম, “ভেরি টেস্টফুল।”

দেবুকে একটা দিলেন। “ক্যায়সা?”

“বহত বড়িয়া।”

দাদু একটা খেলেন। “হাঁ, মালুম হোতা হ্যায়, বড়িয়া।”

ঠোঙায় পড়ে আছে আর-একটা। দেওকি সেটাকে কলে পুরল। এখন কলটাকে কোথায় রাখা হবে? ইঁদুরের চোখে পড়া চাই। ইঁদুরের আবার চোখ কী! সর্বত্র তার চোখ। দেওকির পরামর্শে কলটাকে একটা বইয়ের র‍্যাকের তলায় রাখা হল।

ভীষণ ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। অন্যান্য দিন দাদুই আমাকে টেনে তোলেন। আজ আবার দাদুর কী হল! ঘুম ভেঙেই চোখের সামনে সেই ফরসা টকটকে মুখ দেখতে না পেলে কেমন যেন লাগে।

দাদুকে খুঁজে পেলুম লাইব্রেরি-ঘরে। হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বসে আছেন। সামনে ইঁদুরকল। গোঁফঅলা এইটুকু ইঁদুর কলের জাল-লাগানো দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। আশ্চর্য! কলের ভেতরের লাড্ডুটা সে চেখেও দেখেনি। দাদুর মুখটা যেন কেমন হয়ে গেছে। দুঃখ দুঃখ ভাব।

হাঁটুর ওপর হাত রেখে শরীরটা সামনের দিকে ঝুলিয়ে ইঁদুরটাকে দেখছিলুম। এইবার থেবড়ে বসে পড়লুম।

“কী সুন্দর দেখতে দাদু।”

“বিউটিফুল।”

“গা-টা দেখেছ? তেল-চুকচুকে। চোখ দুটো যেন জ্বলজ্বলে পুঁতির মতো। মুখটা কত বুদ্ধিমান।”

“অসাধারণ। এত কাছ থেকে ইঁদুর আমি কোনওদিন দেখিনি। বড় আদরের জিনিস হে।”

“কী করবেন?”

“সারারাত বেচারা না-খেয়ে আছে? একটা বিস্কুট আন তো।”

বিস্কুট নিয়ে এলুম। দাদু গুঁড়ো গুঁড়ো করে কলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। ইঁদুরটা কাঁপতে কাঁপতে কোণের দিকে চলে গেল। বিস্কুট ছুঁলই না। দাদু বললেন, “প্রাণভয়ে ভীত। কেমন বুঝতে পারে দেখেছ? জানে মৃত্যু এগিয়ে আসছে।”

নীচে দেওকির বাজখাঁই গলা শোনা গেল। দাদু কলটা তাড়াতাড়ি হাতে তুলে নিলেন। “দেওকির হাত থেকে একে বাঁচাতে হবে খোকা। দেখলেই মারতে চাইবে। চল, বাগানের এক কোণে ছেড়ে দিয়ে আসি।”

দেওকির চোখে ধুলো দিয়ে আমরা দু’জনে বাগানের পাঁচিলের ধারে এসে কলটা খুলতেই ইঁদুরটা বেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে তেড়ে এল এক ডজন কাক।

“তাড়াও, তাড়াও, গেল গেল!” দু’জনে হইহই করে কাক তাড়াতে লাগলুম। কাকের পেটে যেতে যেতেও ইঁদুরটা একটুর জন্যে বেঁচে গেল। জল যাবার নর্দমা ধরে সোজা দৌড়ে রান্নাঘরের জানলা দিয়ে বাড়িতে ঢুকে গেল।

“বাঁচ গিয়া। বাঁচ গিয়া। ঘরের ছেলে ঘরে গিয়া।”

দাদুর ধেই ধেই নৃত্য। আমি দম বন্ধ করে ছিলুম এতক্ষণ। আমিও নাচতে লাগলুম। দেওকি বললে, “হুয়া কেয়া?”

দাদু বিজয়ীর মতো বললেন, “বাঁচ গিয়া, বাঁচ গিয়া।”

“কৌন বাঁচ গিয়া জি?”

“চুহা। চুহা।”

দাদুর সে কী নাচ!

১১ মার্চ ১৯৮১

সকল অধ্যায়

১. বিষে বিষক্ষয় – আশাপূর্ণা দেবী
২. আটচল্লিশ – অরবিন্দ গুহ
৩. ডোডো তাতাই পালা কাহিনি – তারাপদ রায়
৪. কৈলাসে চা পান – আশাপূর্ণা দেবী
৫. চোরে ডাকাতে – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৬. সাধু কালাচাঁদের নতুন কাজ – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
৭. ইলশেঘাই – লীলা মজুমদার
৮. শরচ্চন্দ্রের সন্ধিভেদ! – শিবরাম চক্রবর্তী
৯. ঝুনুমাসির বিড়াল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০. বিধু দারোগা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
১১. সাধু কালাচাঁদের পালাকীর্তন – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
১২. কে ফার্স্ট? – আশাপূর্ণা দেবী
১৩. ফ্ল্যাট রেস – জরাসন্ধ
১৪. চিত্তশুদ্ধি আশ্রম – বিমল কর
১৫. টেনাগড়ে টেনশান – বুদ্ধদেব গুহ
১৬. হাতি-চোর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৭. ছোটমাসির মেয়েরা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৮. মোটরবাইক, ষাঁড় ও লাকি – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১৯. ব্যাঙাচিদের লেজ – তারাপদ রায়
২০. বাজারদর – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২১. তেঁতুলমামার জগৎ – হিমানীশ গোস্বামী
২২. রাজার মন ভাল নেই – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৩. গজেনকাকার মাছ-ধরা – বিমল কর
২৪. দাদুর ইঁদুর – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
২৫. সাত নম্বর – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
২৬. মেজদার সার্কাস – চিত্তরঞ্জন সেনগুপ্ত
২৭. চোর – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৮. কুস্তির প্যাঁচ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৯. দুঃখহরা বড়ির শিশি – লীলা মজুমদার
৩০. পিলকিন’স ইলেভেন – বিমল কর
৩১. রাত যখন বারোটা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩২. ভুনিকাকার চৌরশতম – বিমল কর
৩৩. গ্রামের নাম জাঁকপুর – আশাপূর্ণা দেবী
৩৪. নিখোঁজ নিরুদ্দেশ হতে গেলে – আশাপূর্ণা দেবী
৩৫. বাঘের দুধ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৬. গগনবাবুর গাড়ি – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৭. গাবু – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৮. কুরুক্ষেত্র – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৯. কাক্কাবোক্কার ভুতুড়ে কাণ্ড – শৈলেন ঘোষ
৪০. হরিমতির বাগান – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪১. বড়দার বেড়াল – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৪২. মহাকর্ম – সমরেশ মজুমদার
৪৩. পায়রাডাঙায় রাতে – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৪. মামার বিশ্বকাপ দর্শন – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪৫. গটমটে সাহেব বটে – শৈলেন ঘোষ
৪৬. রাঘব বোয়াল – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
৪৭. স্কন্ধকুমার এবং অর্ধচন্দ্র – তারাপদ রায়
৪৮. পাগল হইবার সহজপাঠ – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪৯. বিপিনবিহারীর বিপদ – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৫০. সাদা রঙের পাঞ্জাবি – অনির্বাণ বসু
৫১. জগু যাবে বেড়াতে – বাণী বসু
৫২. কুঞ্জবাবুর পিঁপড়ে বাতিক – অমিতাভ গঙ্গোপাধ্যায়
৫৩. ভুলে যাওয়া – সিদ্ধার্থ ঘোষ
৫৪. ঝগড়ুটে ফাইভ – প্রচেত গুপ্ত
৫৫. বিপদভঞ্জনের সর্পদোষ – উল্লাস মল্লিক
৫৬. মাসির বাড়ি – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৫৭. জাগ্রত অসুরের গল্প – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৫৮. কাকাতুয়া ডট কম – প্রচেত গুপ্ত
৫৯. নতুন নাটকও ভন্ডুল – উল্লাস মল্লিক
৬০. রামখেলাওনের কেরামতি – সৌরভ মুখোপাধ্যায়
৬১. কলহগড়ের নিস্তব্ধতা – সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়
৬২. পটলার থিমপুজো – শক্তিপদ রাজগুরু
৬৩. সংকটমোচন কমিটি – প্রচেত গুপ্ত
৬৪. নতুন বন্ধু চিনু – জয়দীপ চক্রবর্তী
৬৫. বুঁচকির মেয়ের বিয়ে – নবনীতা দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন