কাকাতুয়া ডট কম – প্রচেত গুপ্ত

পৌলোমী সেনগুপ্ত

টিকলুর মেজোমামা একেবারে ভেঙে পড়েছেন। ভেঙে পড়বারই কথা। তেইশ দিন হতে চলল, ঝুঁটি একটা কথাও বলেনি। আর বলবে বলে মনে হচ্ছে না। প্রথম প্রথম কথা শেখানোর সময় সে মুখ তুলে তাকাত। আজকাল হাই তোলা ধরনের অপমানজনক একটা ভঙ্গি করছে। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে নিচ্ছে।

একেবারে শুরুতে মেজোমামা ভেবেছিলেন, পরিবেশ নতুন। মানিয়ে নিতে সময় লাগছে। কিছু দিন যাক, ঠিক হয়ে যাবে।

কিছু দিন গেল, কিন্তু কিছুই ঠিক হল না। মুখে শুধু ‘ট্যা’, ‘খক্‌’, ‘ফস’ ধরনের আবোল তাবোল আওয়াজ! মেজোমামা এবার ভাবলেন, শরীরটরির খারাপ। দেখা গেল তাও নয়। সবই চলছে ঠিকঠাক। দু’বেলা পেটপুরে খাওয়া, সকালে বিকেলে ফল। দুপুরে ঠান্ডা-গরম জলে স্নান। ভোরে দাঁড়ে বসে ডিগবাজি খেয়ে আর ডানা ঝাপটিয়ে হালকা ব্যায়াম। তা হলে?

তা হলে কী, সেটাই বুঝতে পারছেন না মেজোমামা। রাগে দুঃখে হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। বাড়িতে কাকাতুয়া আছে, কিন্তু সে কথা বলে না। এর চেয়ে লজ্জার আর কী থাকতে পারে?

টিকলুর মেজোমামিমা বললেন, “শিক্ষা হল তো? তখনই আপত্তি করেছিলাম।”

কথাটা ঠিক, বাড়িতে কাকাতুয়া রাখার ব্যাপারে মেজোমামিমার গোড়া থেকেই আপত্তি ছিল। তিনি ঠান্ডা মাথায় টিকলুর মেজোমামাকে কথাটা বুঝিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আগেকার দিনে বড় বড় বাড়ি ছিল। ছিল বড় বড় ঘর। লম্বা লম্বা বারান্দা। বিশাল উঠোন। আর ছাদগুলো চওড়ায় এমন হত যে, মাঠের বদলে অনেক সময় পাড়ার ছোটখাটো ফুটবল ম্যাচ ছাদেই হয়ে যেত। তখন বাড়িতে খানকতক পশুপাখি পুষলে কোনও অসুবিধেই ছিল না। তখন এক-একটা বাড়িতে দশ-বারোটা বিড়াল কোনও ঘটনাই নয়। দুপুরবেলা বারান্দায় লাইন দিয়ে, লেজ গুটিয়ে বসে তারা মাছের কাঁটা খেত। আজকাল বড় বাড়ির ব্যাপারটাই উঠে গিয়েছে। এখন হল ফ্ল্যাট সিস্টেম। ফ্ল্যাটে সবকিছু হয় মাপমতো। খাট, চেয়ার, টেবিল, কম্পিউটার থেকে শুরু করে ফুলদানি, অ্যাকোয়ারিয়াম, এমনকী, মানুষের পর্যন্ত আগে থেকে মাপ নিয়ে, নকশা এঁকে সব ঠিক করা থাকে। সেখানে দুম করে জীবজন্তু ঢোকানো চলে না। তা ছাড়া পাখিটাখি পোষার হবি আজকাল উঠে যেতে বসেছে। এমনকী, ছোটরা পর্যন্ত আসল জীবজন্তুর বদলে আজকাল জীবজন্তুর রোবট পোষে। এত বড় একটা মানুষ পাখি পুষেছে শুনলে সকলেই হাসবে।

এত আপত্তির একটাও টিকল না। কাকাতুয়া আনা ফাইনাল হয়ে গেল। মামিমা তখন মোক্ষম অস্ত্র ছাড়লেন। শেষ অস্ত্র। মামাকে হুমকি দিলেন। বললেন, “তা হলে তুমি বেছে নাও, এই ফ্ল্যাটে কে থাকবে? আমি, না তোমার কাকাতুয়া?”

মামিমা আশা করেছিলেন, এই হুমকি শুনে মেজোমামা দুঃখ দুঃখ গলায় বলবেন, “এটা তুমি কী বলছ! সামান্য একটা পাখির জন্য তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। না, না, এ কখনও হতে পারে না। থাক, কাকাতুয়া পুষে কাজ নেই। এত বছর যখন কাকাতুয়া ছাড়া থাকতে পেরেছি, বাকি দিনগুলোও পারব।”

আশ্চর্যের বিষয়, হুমকি শোনার পর মেজোমামা সেরকম কিছু বললেন না! উলটে মুচকি হেসে বললেন, “কথাটা খারাপ বলোনি। ক’টা দিন বোনের বাড়িতে কাটিয়ে আসতে পারো। বলো তো, আমি নিজে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসব। আর সেই ক’টা দিন আমি না হয় পাখিটাকে ট্রেনিং দেব। ফাঁকা বাড়িতে ট্রেনিং দেওয়া সুবিধে।”

মামিমা বুঝতে পারলেন, এই মানুষকে আর কিছু বলে লাভ নেই।

আসলে টিকলুর মেজো-মামার কাকাতুয়ার শখ সেই ছেলেবেলা থেকে। স্কুলে পড়ার সময় ভোম্বলের পিসির বাড়িতে একবার দেখেছিলেন। সেই পাখি মেজোমামাকে দেখে ঘাড় কাত করে বলল, “অ্যাই ছেলে, হোমটাস্ক হয়েছে? হোমটাস্ক না করে খেলে বেড়াচ্ছ যে বড়?”

কাকাতুয়াটার কথার মধ্যে একটা ধমক ধমক ব্যাপার থাকলেও মেজোমামা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এবং তখনই ঠিক করেছিলেন, তিনিও একটা কাকাতুয়া পুষবেন।

বাবার বকুনিতে সেই শখ তখন মেটেনি। এত বছর পর মেটালেন।

পাখি যেদিন বাড়িতে এল সেদিন মেজোমামিমা সত্যি সত্যি বোনের বাড়িতে গিয়েছিলেন। তবে বাড়ি ছেড়ে যাননি, গিয়েছিলেন রান্না শিখতে। তিনি মাঝেমধ্যে বোনের কাছে রান্না শিখতে যান। এক-একদিন এক-এক রকম রান্না। সেদিন শিখলেন চকোলেট কেক। এতে একটু সময় লাগে। কেক ফ্রিজে ঢুকিয়ে ঠান্ডা করার ব্যাপার আছে। তাই বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেল। পাখি আসার কথা তিনি জানতেন না। বেল টিপতে দরজা খুলল কাজের মেয়ে বুনি। একগাল হেসে বলল, “বউদি, এসে গিয়েছে।”

মেজোমামিমা অবাক হয়ে বললেন, “এসে গিয়েছে! কে এসে গিয়েছে?”

বুনি বড় করে হেসে বলল, “ঝুঁটিপিসি। ঝুঁটিপিসি এসে গিয়েছে।”

মেজোমামিমা অবাক হলেন, ঝুঁটিপিসি! ঝুঁটিপিসি কে? ঝুঁটি নামে টিকলুর মেজোমামার কোনও বোন আছে বলে তো তার মনে পড়ছে না!

তিনি ভুরু কুঁচকে ঘরে ঢুকলেন এবং ঢুকেই চমকে উঠলেন!

বসার ঘরের ঠিক মাঝখানে বদখতভাবে একটা দড়ি টাঙানো। সেই দড়িতে ঝুলছে পিতলের দাঁড়। আর দাঁড়ে বসে আছে কাকাতুয়া! ঝলমল করছে। গায়ের রং ধবধবে সাদা। সেই সাদার মধ্যে একটা গোলাপি আভা যেন লুকোচুরি খেলছে! তাকিয়ে থাকলে চোখ জুড়িয়ে যায়। আর তার চেয়েও চোখ জুড়োনো হল মাথার ঝুঁটি! একেবারে লাল টকটক করছে যে! সেই ঝুঁটি এতই সুন্দর যে, একবার দেখলে মন ভরে না। মনে হয়, আরও একবার দেখি।

টিকলুর মেজোমামিমারও তাই মনে হল। তবু তিনি মনকে শক্ত করে মুখ ফেরালেন। দুর্বলতা দেখানো উচিত নয়।

মামিমাকে দেখে খানিকটা নার্ভাস হয়েই মেজোমামা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। হাসিমুখে বললেন, “ভেবেছিলাম দু’দিন দেরি করব। মনে হচ্ছে, করলে বড় একটা বোকামি হয়ে যেত। এত ভাল পাখিটা হাতছাড়া হয়ে যেত। ঠিক যেমন খুঁজছিলাম। এ হল তোমার মাল্লাকান কাকাতুয়া। ভারী ভদ্র আর বুদ্ধিমান। তার চেয়েও বড় কথা হল, কথা বলায় একেবারে মাস্টার। কথা একবার শুরু হলেই হল। চলতেই থাকবে, চলতেই থাকবে। তখন থামার জন্যে হাতে-পায়ে ধরতে হবে। হা হা। আনতে আনতে একটা নামও ঠিক করে ফেলেছি। ডাকনাম অবশ্য। ভাল নাম তোমার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করব। ডাকনামটা শুনবে?”

মেজোমামিমা ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেললেন। মানুষটা পাগল হয়ে গেলেন নাকি? মনে হচ্ছে তাই। মানুষের ডাকনাম হয়, পাখির কখনও ডাকনাম হয়! তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, “না, আমি শুনব না। ভাল নাম, ডাকনাম কোনও কিছুই শুনতে চাই না।”

মেজোমামা গদগদ গলায় বললেন, “আহা, শোনোই না। ডাকনাম দিয়েছি ‘ঝুঁটি’।”

মেজোমামিমা চোখ পাকিয়ে বুনির দিকে তাকালেন। ও, এই কারণে বিচ্ছু মেয়েটা বলছিল, ‘ঝুঁটিপিসি এসেছে!’

মেজোমামা গর্বিত হেসে বললেন, “তুমি যতই রাগ করো, ঝুঁটিকে দেখতে কিন্তু ভারী সুন্দর। তাই না?”

মামিমা নিজের ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বললেন, “হ্যাঁ তাই। তবে তাতে কিছু এসে যায় না। সুন্দরবনের রয়াল বেঙ্গল টাইগারও দেখতে সুন্দর। তার মানে এই নয় যে, তাকে বাড়িতে নিয়ে আসতে হবে এবং সোফায় বসিয়ে চা খেতে খেতে গল্প করতে হবে।”

মেজোমামা বললেন, “আহা, তুমি তো এখন শুধু এর রূপটুকুই দেখেছ, এর গুণের পরিচয় তো এখনও পাওনি। আমি যেরকম ভেবেছি, তার আদ্দেকটাও যদি পাখিটাকে শেখাতে পারি, তা হলেই সকলে একেবারে চমকে যাবে।”

কথাটা মিথ্যে নয়। টিকলুর মেজোমামা ঝুঁটিকে নিয়ে যা পরিকল্পনা করেছিলেন তা ভীষণ মারাত্মক। গুরুত্ব অনুযায়ী পরিকল্পনাগুলো সাজালে এরকম হবে—

পরিকল্পনা: এক) মোট আড়াইশো টেলিফোন নম্বর মুখস্থ। এর মধ্যে দেড়শো ল্যান্ড ফোনের, বাকি একশো মোবাইল ফোনের নম্বর।

পরিকল্পনা: দুই) বাজারদর থেকে আবহাওয়ার খবর, খেলাধুলার উপর দু’-একটা ভাষণ তৈরি করে শিখিয়ে রাখা হবে। বড় কিছু নয়। দশ-বারো লাইনের ছোট ছোট ভাষণ। এর ফলে হঠাৎ বাড়িতে কোনও অতিথি চলে এলে, তাঁর সঙ্গে অন্তত কিছুক্ষণ কথা চালাতে পারবে। এই যেমন, আলুর দাম, পৃথিবীতে গরম কেন বাড়ছে, মোহনবাগানের টিম বদল, এইসব। ট্রেনিং এমনভাবে হবে, যাতে ভাষণের মাঝখানে সে ঘাড় বেঁকিয়ে অতিথিকে জিজ্ঞেস করে, “চা খাবেন? না, কফি?”

পরিকল্পনা: তিন) রোজ সকালে খবরের কাগজ দেখে সেদিনের টিভি প্রোগ্রামের কয়েকটা কানের কাছে আওড়ে দিতে হবে। ক’টার সময় কোন চ্যানেলে টেনিস, কোন চ্যানেলে ক্রিকেট, কোন চ্যানেলে সিনেমা। সন্ধেবেলা জিজ্ঞেস করলেই বলে যাবে গড়গড় করে।

পরিকল্পনা: চার) পরিকল্পনা আছে, কুইজের একটা ট্রেনিং দিতে। এটা একেবারে টিকলুর জন্য ভেবেছেন মেজোমামা। টিকলু আর তার বন্ধুরা এলে ঝুঁটি হবে কুইজ মিস। কোনও সন্দেহ নেই, ব্যাপারটা দারুণ মজার হবে। তবে সমস্যা একটা আছে। প্রশ্নের জায়গায় আগে উত্তরগুলো যদি বলে ফ্যালে!

পরিকল্পনা: পাঁচ) কুইজের পরিকল্পনা যেমন টিকলুর জন্য, তেমনই এই পরিকল্পনাটা হয়েছে মেজোমামিমার কথা ভেবে। এর জন্য ঝুঁটির ট্রেনিং হবে গোপনে। মেজোমামিমা যখন বাড়িতে থাকবেন না, সেই সময়। কয়েকটি রান্নার বই আনা হবে। সেখান থেকে বাছাই করে রেসিপি মুখস্থ করানো হবে ঝুঁটিকে। রবিবার সকালে মেজোমামিমা যখন রান্নাঘরে ঢুকবেন, বাইরে দাঁড়ে বসে ঝুঁটি বলবে, এবার তিন চামচ চিনি দাও। তারপর এক বাটি দুধ। একটা ডিম ফাটিয়ে…।

পরের দিন ভোর থেকেই ট্রেনিং শুরু হয়ে গেল। মেজোমামা তিন দিনের ছুটি নিয়েছেন অফিস থেকে। পাখি যার কাছ থেকে আনা হয়েছে, সে বলে দিয়েছে, “শুরুটা ধীরেসুস্থে হওয়াই ভাল। একটু একটু করে। দেখবেন, প্রথমেই যেন ঘাবড়ে না যায়। সহজ-সরল কথা শেখাবেন।”

সেইমতো প্রথম ট্রেনিংয়ের কথাটা সহজ-সরলই বাছলেন মেজোমামা। কথাটা এরকম, “আহা! রান্না বড় খাসা!”

মেজোমামার ইচ্ছে ছিল, মামিমাকে পাখির প্রথম বুলি হিসেবে এটাই শোনাবেন। কাকাতুয়ার মুখে রান্নার প্রশংসা শুনে মামিমার রাগ একেবারে জল হয়ে যাবে।

কিন্তু ইচ্ছে ইচ্ছেই রয়ে গেল৷ এক ঘণ্টা, দু’ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা করে গোটা দিনটাই চলে গেল। ঝুঁটি চুপ করে রইল! একেবারে যাকে বলে স্পিকটি নট! দুপুরে ছোলা সেদ্ধ, পেঁপে, আধখানা কলা দিয়ে লাঞ্চ সেরে ঢেঁকুর তোলা ধরনের একটা ভঙ্গি করল। তারপর ঘাড় কাত করে ঘুমিয়ে পড়ল।

মেজোমামা খাঁচার সামনে টুল পেতে বিকেল পর্যন্ত বিড়বিড় করলেন, “আহা! রান্না বড় খাসা। আহা! রান্না…”

বুনি আড়াল থেকে ঘটনা দেখে ঘাবড়ে গেল প্রচণ্ড। রান্নাঘরে গিয়ে বড় বড় চোখ করে মামিমাকে বলল, “দাদার মনে হয় মাথা গরম হয়েছে। জল ঢালা দরকার বউদি।”

সত্যি সত্যি মাথা গরম হওয়ার কথা। কিন্তু মেজোমামা মাথা ঠান্ডা রেখে চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। তিন দিন গেল। চার দিন গেল। একটা গোটা সপ্তাহ চলে গেল।

ঝুঁটি মুখ ফুটে একটি কথাও বলল না!

মেজোমামা অফিসের ছুটি বাড়িয়ে নিলেন। ট্রেনিংয়ের সময় বাড়ল। গোটা বাক্যের বদলে ‘হ্যালো’, ‘গুড মর্নিং’, ‘টা টা’ ধরনের কথা দিয়ে চেষ্টা চলল ক’দিন। তাতেও কিছু হল না।

মেজোমামিমা বললেন, “এবার তুমি থামবে? একই কথা বলতে বলতে হয় তুমি পাগল হয়ে যাবে, নয়তো শুনতে শুনতে আমি পাগল হয়ে যাব। কেন বুঝতে পারছ না তুমি বিরাট ঠকেছ। লোকটা তোমাকে একটা অতি গবেট এবং মূর্খ কাকাতুয়া গছিয়ে দিয়েছে। অনেক হয়েছে, এবার চুপ করো। এর মধ্যেই বুনির অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছে। দেখছি, মেয়েটা সারাদিন নিজের মনে বিড়বিড় করে, ‘গুড মর্নিং’ ‘হ্যালো’ ‘টা টা’। ‘গুড মর্নিং…’ এরপর তো আমিও শুরু করব।”

ঝুঁটি আসার ঠিক বাইশ দিনের মাথায় মেজোমামা রাতে একটা ভয়াবহ স্বপ্ন দেখলেন। ঝুঁটির মূর্খামি নিয়ে স্বপ্ন! স্বপ্নটা এরকম— দাঁড়ে মাথা নামিয়ে ঝুঁটি বসে আছে। তার ঠোঁটে ধরা একচিলতে কাগজ। বুনি হাত বাড়িয়ে সেই কাগজের টুকরোটা নিল। তারপর চিৎকার করে বলল, ‘বউদি, শিগগিরই এসো, ঝুঁটির পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে! ঝুঁটির পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে।’

মেজোমামা তাড়াতাড়ি কাগজের টুকরো কেড়ে নিলেন। আরে, সত্যি তো! পরীক্ষার রেজাল্টই তো বটে! একটা বিষয়েও পাশ করেনি ঝুঁটি! সব বিষয়ে লাল কালির দাগ। সবচেয়ে বেশি নম্বর যা পেয়েছে, তা হল একশোর মধ্যে সাত!

মামা ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে ঘাম মুছলেন। নিজের মনেই বললেন, ‘কী ভয়ংকর! কী ভয়ংকর!’

অফিস যাওয়ার পথেই মামার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেল। অনেক হয়েছে, আর নয়। পাখি ফেরত যাবে। যার কাছ থেকে এনেছিলেন, ফিরিয়ে দিয়ে আসবেন তাকে। কালই দিয়ে আসবেন। কথাটা ঠিকই। আজকালকার দিনে পাখি পোষা মানায় না। ছেলেবেলার সাধ মিটল না বলে মেজোমামার মনটা বেশ খারাপ হল বটে, তবে অফিসের কাজের চাপে একসময় ভুলেও গেলেন।

মনে পড়ল সেই বাড়ি ফেরার পর।

মামিমা চা দিতে এসে অবাক হয়ে বললেন, “কী হল তোমার? ঝুঁটিকে কথা শেখাবে না?”

মেজোমামা ভাবলেন, পাখি ফেরতের সিদ্ধান্তটা ঘোষণা করে ফেলা যাক। তারপর ভাবলেন, থাকুক। চুপিচুপি নিয়ে এসেছিলেন, কাল ফেরতও দিয়ে আসবেন চুপিচুপি। মুখে বললেন, “আজ একটুও সময় নেই। ক’দিন ছুটি নিয়ে মুশকিল হয়ে গিয়েছে। অফিসে কাজ জমে গিয়েছে। বাড়িতেও ফাইল নিয়ে এসেছি। রাত পর্যন্ত কম্পিউটারে কাজ করব। এখন আর বিরক্ত কোরো না। বুনিকে বলো, ঝুঁটিকে যেন আজ রাতে ও-ই খেতে দিয়ে দেয়।”

সত্যি সত্যি টেবিলে ফাইল ছড়িয়ে কাজে বসে গেলেন মেজোমামা। বাড়িতে ঝুঁটিকে আনার পর কম্পিউটারে হাত দেওয়ার সময়ই পাননি। ধুলো ঝেড়ে কম্পিউটার চালু করলেন।

একটু দূরে দাঁড়ে দোল খেতে খেতে ঝুঁটি কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে আছে। মনিটরের আবছা নীল আলোয় তার চোখ দুটো যেন জ্বলজ্বল করছে।

মেজোমামা ফিসফিস করে বললেন, “একবার ওঠো। শিগগিরই ওঠো একবার।”

মেজোমামিমা ধড়মড় করে উঠে বসলেন। ক’টা বাজে? এত রাতে কী হল আবার! বিপদ আপদ কিছু?

মেজোমামা ফিসফিস করে বললেন, “সাংঘাতিক কাণ্ড! ওই ঘরে গিয়ে একবার দেখবে চলো, কী হয়েছে। খটখট আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। দরজা খুলে পাশের ঘরে গেলাম। গিয়ে যা দেখলাম, তা মারাত্মক। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, যা দেখলাম সেটা সত্যি নয়, আমার চোখের ভুল। তাই তোমাকে ডাকলাম।”

মেজোমামিমা দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকালেন। রাত একটা। না, পাখি পাখি করে মানুষটার মাথা সত্যি খারাপ হয়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে।

ঘুমঘুম চোখে তিনি পাশের ঘরে গেলেন এবং চমকে উঠলেন! এ যে অসম্ভব!

দাঁড় থেকে নেমে টেবিলে বসে আছে ঝুঁটি! শুধু বসে নেই, তার সামনে মেজোমামার কম্পিউটারটা খোলা!

মেজোমামা উত্তেজনায় কাঁপছেন। চাপা গলায় বললেন, “মনে হচ্ছে ঠোঁট দিয়ে কোনওভাবে সুইচ অন করে ফেলেছে।”

দু’পা এগোতেই দেখা গেল, ঘটনা অত সহজ নয়। ঝুঁটি মুখ নিচু করে তার বাঁকানো শক্ত ঠোঁট দিয়ে কি-বোর্ডের সুইচ টিপছে। আওয়াজ হচ্ছে খট, খট, খট…।

ও কি খেলা করছে?

পা টিপে টিপে আরও কাছে গেলেন দু’জন। না, ঝুঁটি খেলছে না। সে লিখছে! টাইপ করার ভঙ্গিতে মানুষের আঙুলের মতো তার ঠোঁট চলছে! পরদায় ইংরেজি হরফে যা ভেসে উঠছে, তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘তুমি কেমন আছ? আমি ভালই আছি। এদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা অতি উৎকৃষ্ট। ভয় হচ্ছে, ওজন না বেড়ে যায়! কম্পিউটারটা খেয়াল করিনি বলে এতদিন মেল পাঠাতে পারিনি। এবার থেকে নিয়মিত মেল পাঠাব…।’

মেজোমামার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তিনি মামিমার কানে কানে বললেন, “কিছু বুঝতে পারছ? বুঝতে পারছ কিছু? মার্ভেলাস! অসাধারণ! ঝুঁটি কম্পিউটারে চ্যাট করছে! ইস, আমারই বুঝতে ভুল হয়েছিল। ঝুঁটি এ-যুগের কাকাতুয়া। কোন দুঃখে মুখে কথা বলবে? তারা কথা বলবে কম্পিউটারে।”

আমরা টিকলুকে ধরেছিলাম, শনিবার স্কুল ছুটির পর ওর মেজোমামার বাড়িতে আমাদের নিয়ে যেতে হবে। আমরা ঝুঁটির কম্পিউটারে চ্যাট করা দেখব। টিকলু জানিয়েছে, সেটা সম্ভব নয়। কম্পিউটার চ্যাট একটা ব্যক্তিগত বিষয়। সেটা অন্য কারও দেখা উচিত নয়। তবে সে কথা দিয়েছে, আমাদের ঝুঁটির ই-মেল নম্বরটা দেবে। ইচ্ছে করলে, আমরা নিজেদের কম্পিউটার থেকে তার সঙ্গে গল্প করতে পারি।

রাত এগারোটার পর মেজোমামা নাকি নিয়ম করে ঝুঁটিকে এক ঘণ্টার জন্য কম্পিউটার ছেড়ে দিচ্ছেন।

অক্টোবর ২০০৬

সকল অধ্যায়

১. বিষে বিষক্ষয় – আশাপূর্ণা দেবী
২. আটচল্লিশ – অরবিন্দ গুহ
৩. ডোডো তাতাই পালা কাহিনি – তারাপদ রায়
৪. কৈলাসে চা পান – আশাপূর্ণা দেবী
৫. চোরে ডাকাতে – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৬. সাধু কালাচাঁদের নতুন কাজ – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
৭. ইলশেঘাই – লীলা মজুমদার
৮. শরচ্চন্দ্রের সন্ধিভেদ! – শিবরাম চক্রবর্তী
৯. ঝুনুমাসির বিড়াল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০. বিধু দারোগা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
১১. সাধু কালাচাঁদের পালাকীর্তন – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
১২. কে ফার্স্ট? – আশাপূর্ণা দেবী
১৩. ফ্ল্যাট রেস – জরাসন্ধ
১৪. চিত্তশুদ্ধি আশ্রম – বিমল কর
১৫. টেনাগড়ে টেনশান – বুদ্ধদেব গুহ
১৬. হাতি-চোর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৭. ছোটমাসির মেয়েরা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৮. মোটরবাইক, ষাঁড় ও লাকি – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১৯. ব্যাঙাচিদের লেজ – তারাপদ রায়
২০. বাজারদর – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২১. তেঁতুলমামার জগৎ – হিমানীশ গোস্বামী
২২. রাজার মন ভাল নেই – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৩. গজেনকাকার মাছ-ধরা – বিমল কর
২৪. দাদুর ইঁদুর – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
২৫. সাত নম্বর – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
২৬. মেজদার সার্কাস – চিত্তরঞ্জন সেনগুপ্ত
২৭. চোর – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৮. কুস্তির প্যাঁচ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৯. দুঃখহরা বড়ির শিশি – লীলা মজুমদার
৩০. পিলকিন’স ইলেভেন – বিমল কর
৩১. রাত যখন বারোটা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩২. ভুনিকাকার চৌরশতম – বিমল কর
৩৩. গ্রামের নাম জাঁকপুর – আশাপূর্ণা দেবী
৩৪. নিখোঁজ নিরুদ্দেশ হতে গেলে – আশাপূর্ণা দেবী
৩৫. বাঘের দুধ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৬. গগনবাবুর গাড়ি – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৭. গাবু – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৮. কুরুক্ষেত্র – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৯. কাক্কাবোক্কার ভুতুড়ে কাণ্ড – শৈলেন ঘোষ
৪০. হরিমতির বাগান – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪১. বড়দার বেড়াল – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৪২. মহাকর্ম – সমরেশ মজুমদার
৪৩. পায়রাডাঙায় রাতে – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৪. মামার বিশ্বকাপ দর্শন – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪৫. গটমটে সাহেব বটে – শৈলেন ঘোষ
৪৬. রাঘব বোয়াল – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
৪৭. স্কন্ধকুমার এবং অর্ধচন্দ্র – তারাপদ রায়
৪৮. পাগল হইবার সহজপাঠ – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪৯. বিপিনবিহারীর বিপদ – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৫০. সাদা রঙের পাঞ্জাবি – অনির্বাণ বসু
৫১. জগু যাবে বেড়াতে – বাণী বসু
৫২. কুঞ্জবাবুর পিঁপড়ে বাতিক – অমিতাভ গঙ্গোপাধ্যায়
৫৩. ভুলে যাওয়া – সিদ্ধার্থ ঘোষ
৫৪. ঝগড়ুটে ফাইভ – প্রচেত গুপ্ত
৫৫. বিপদভঞ্জনের সর্পদোষ – উল্লাস মল্লিক
৫৬. মাসির বাড়ি – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৫৭. জাগ্রত অসুরের গল্প – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৫৮. কাকাতুয়া ডট কম – প্রচেত গুপ্ত
৫৯. নতুন নাটকও ভন্ডুল – উল্লাস মল্লিক
৬০. রামখেলাওনের কেরামতি – সৌরভ মুখোপাধ্যায়
৬১. কলহগড়ের নিস্তব্ধতা – সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়
৬২. পটলার থিমপুজো – শক্তিপদ রাজগুরু
৬৩. সংকটমোচন কমিটি – প্রচেত গুপ্ত
৬৪. নতুন বন্ধু চিনু – জয়দীপ চক্রবর্তী
৬৫. বুঁচকির মেয়ের বিয়ে – নবনীতা দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন