পৌলোমী সেনগুপ্ত
সবাই জানে সাধু কালাচাঁদের আসল নাম কী। রোল ইলেভেন। ক্লাস সেভেন। জুবিলি স্কুলের টানা বারান্দার দক্ষিণের শেষ ঘরটায় বাঁ দিকের ফোর্থ বেঞ্চের কোনে চাকু দিয়ে নিজেই নিজের নাম লিখেছে— কালাচাঁদ প্রামাণিক।
কিন্তু সে-নামে কেউ আর ডাকে না আজকাল। কী করে যে এ-নামটা তার চাউর হয়ে গেল তা আজ আর জানার উপায় নেই কোনও। সে অনেকদিন আগেকার কথা। তখন কালাচাঁদ প্রামাণিক এত উঁচু ক্লাসে পড়ত না। থ্রি-ফোর হবে। সেই সময়েই এই নামটা তার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
শোনা যায়, কালাচাঁদের মায়ের দেওয়া এই নাম। তিনি ইচ্ছে করে দেননি। তাঁর একটা কথায় কালাচাঁদের প্রামাণিক খসে গিয়ে নামের আগে সাধু বসে যায়।
পাশের বাড়ির জ্ঞানেন্দ্র দে-র পায়রা সন্ধের অন্ধকারে বাসা থেকে খপ করে ধরে নিয়ে গিয়ে কালাচাঁদ স্কুল-হস্টেলের ঠাকুরদের সঙ্গে ফিস্টি করেছিল। তখন জ্ঞানেন্দ্রর মা শাপশাপান্ত করতে থাকলে কালাচাঁদের মা বলেছিলেন, “কালাচাঁদ আমার সাধু প্রকৃতির ছেলে। কিছু করে ফেলে তা আর চেপে রাখতে পারে না। দু’ঘা মারলেই সব গল গল করে বলে দেয়। তবে কিনা— তখনই আবার একটা নতুন কাজ করে বসে। সে-কাজও অবিশ্যি লুকিয়ে রাখতে জানে না। বলে দেবেই দেবে। আগের জন্মে কোনও মহাপুরুষ ছিল। কখনও মিথ্যে কথা বলে না।”
সে-কথা পরদিন ক্লাসে ঢুকেই জ্ঞানেন্দ্র সবাইকে ডেকে বলে দিয়েছিল। একদম কালাচাঁদের মায়ের ভঙ্গিতে। শেষে বলেছিল, “নির্ঘাত মহাপুরুষ। নয়তো অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে থেকে একটা একটা করে তিন তিনটে পায়রা কী করে নিয়ে গেল— আমরা কেউ টের পেলাম না।”
সেই থেকে ওর নাম সাধু কালাচাঁদ। ভূগোল-স্যার, অঙ্ক-স্যার অব্দি সাধু কালাচাঁদ বলেই ডাকেন। চৌবাচ্চার অঙ্ক বোঝানোর সময় অঙ্ক-স্যার বোর্ডে চকখড়ি দিয়ে চৌবাচ্চা এঁকেছিলেন। তাতে নল এঁকে দিয়ে বলেছিলেন, “দেড় ঘণ্টায় যদি এই চৌবাচ্চা খালি হয়ে যায়— তা হলে আধঘণ্টায় এই চৌবাচ্চা ঠিক কতটা ভরবে? কত ঘনফুট জল আসবে আধঘণ্টায়?”
অঙ্কটা মিলিয়ে দিল ক্লাসের চার-পাঁচজন। সবচেয়ে আগে মেলাল জ্যোতির্ময় ঘোষাল। রোল ওয়ান।
কিন্তু পরদিন স্কুলে এসে আর জল মিলল না। টিফিনের পর হুলুস্থুলু কাণ্ড। একফোঁটা জল নেই ট্যাঙ্কে।
মভরু সবাইকে জল দেয়। আজ তিরিশ বছর দিচ্ছে। ফাঁকা গ্লাসগুলোয় জল ভরে দাঁড় করিয়ে রাখে। তারও মুখ শুকনো। মিউনিসিপিল্যাটি সকালে একবার বিকেলে একবার জল দেয়। দুপুরে কোথায় জল পাওয়া যাবে?
তখন অঙ্ক-স্যার লোহার মই বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন। ট্যাঙ্কের মুখ খুলে ভেতরে উঁকি দিলেন। তারপর চাতালের ওপর ঘোরাঘুরি করলেন। নীচের থেকে মাঠে দাঁড়িয়ে সবাই তা দেখতে পেল।
টিফিনের পর ফিফথ পিরিয়ডে অঙ্ক-স্যার ক্লাসে ঢুকেই বললেন, “এই স্কেলখানা কার? যার হয় এগিয়ে এসো। সত্যি কথা বললে কিছু হবে না।”
সবাই জানে, এ হল গিয়ে স্যারের ফাঁদ।
অঙ্ক-স্যার স্কেলখানা উলটে বললেন, “পেছনে লেখা আছে কে পি। ক্লাস সেভেন।”
কে পি-তে অনেকরকম নাম হয়। কমলেন্দু পাঠক। রোল সেভেন। কাজল পালিত। রোল থার্টিওয়ান। আবার রোল ইলেভেনের কথাও মনে আসে। কালাচাঁদ প্রামাণিক।
তিনজনকেই একসঙ্গে দাঁড় করালেন স্যার। প্রথমে কমলেন্দু। সে কারও সাতে-পাঁচে থাকে না। নদীর ওপার থেকে খেয়া নৌকোয় করে পড়তে আসে। বর্ষাকালে শহরেই দাদুর কাছে থাকে। ভাল কোদাল কোপায়। গাছ বসায়। সে বলল, “আমায় মারবেন না স্যার। আমার পিঠে ফোঁড়া। মরে যাব।”
“তুই যা!” বলে স্যার কাজল পালিতকে ডাকলেন। সে এমনিতে খুব রোগা। তারপর চোখে চশমা। অঙ্কে কোনওদিন একুশের বেশি পায়নি। সেকেন্ড চান্সে প্রোমোশন পায়। স্মৃতিশক্তির জন্যে আজ তিন মাস হল ব্রাহ্মীশাকের রস খাচ্ছে। সে বলল, “স্যার ও স্কেল আমি কোনওদিন দেখিনি। আমি রুল দিয়ে লাইন টানি।”
স্যার এবার ডাকলেন। বলা যায় হাঁক দিলেন। “সাধু কালাচাঁদ!
“ইয়েস স্যার।”
“কাছে এসো! এই স্কেলটিকে চিনতে পারো?”
“না স্যার।”
“ভাল করে দেখো।”
কাছে গিয়ে কালাচাঁদ ভাল করে উলটে পালটে দেখল।
“চেনা মনে হয়?”
চোখের সামনে তুলে ধরে ভাল করে পরখ করে দেখছিল কালাচাঁদ। একথায় পট পট করে তিন-চারবার পলক পড়ল চোখের।
“মনে পড়ছে না স্যার।”
“ভাল করে দেখো। যদি হারিয়ে গিয়ে থাকে। বলা তো যায় না—”
“তা ঠিক স্যার অবশ্য।” বলতে বলতে কালাচাঁদ কোমরের ঢলঢলে প্যান্টটা দু’হাতে বুক অব্দি টেনে তুলল। বাঁ হাঁটুর শুকনো ঘা-খানা টিফিনের সময় কী করে কেটে গিয়ে আবার চিন চিন করছে। এখন চুলকোনোর জন্যে ঝুঁকলেই স্যার সন্দেহ করতে পারেন। তাই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চিন্তিত অবস্থায় বাঁ হাতখানা মাথায় রাখল। সেখানে চুল নেই। নাপিতের কাঁচি লেগে একটি স্থায়ী গোলমাল হয়ে আছে। কবিরাজের পরামর্শে চুল বড় হলেই বাবা নিজের হাতে শোধন করা কাঁচিতে হেঁটে দিয়ে ঘৃতকুমারীর রস লেপে দেন। অন্যদিন মাথার চারদিকে মাছি ওড়ে। আজ টিফিনের চড়চড়ে রোদে রস শুকিয়ে যাওয়ায় কিছুক্ষণ হল আর মাছি দেখা যাচ্ছে না। নয়তো মাথার পেছনে ছটার মতো থাকবেই।
স্যার চেঁচিয়ে উঠলেন এবারে। “কী অবশ্য? ভাল করে দেখো।”
“দেখেছি স্যার। চিনতে পারছি না।” বলতে বলতে পেটটা ফোলাল। নয়তো হাফপ্যান্ট আবার নাইয়ের নীচে নেমে হাঁটুর মালাইচাকি ঢেকে দিত।
“গৌরাঙ্গ হ। হ বলছি।”
কালাচাঁদ গৌরাঙ্গ হয়ে গেল। হরিনাম গাওয়ার ভঙ্গিতে হাত দু’খানা ওপরে। হাঁটু একটু ভাঁজ করা। ঘা-খানা আরও চিরে গেল। কিন্তু কোনও শব্দ করা চলবে না। গৌরাঙ্গ হলে তাই নিয়ম।
“এবার দেখো তো। এ জিনিসটি চিনতে পারো?”
কালাচাঁদের চোখের সামনে স্যার ছাপা বইয়ের একখানা ছেঁড়া পাতা মেলে ধরলেন। এ হল গিয়ে সরল পাটিগণিতের একষট্টি আর বাষট্টি পৃষ্ঠা। হঠাৎ স্যার অর্ডার দিলেন, “সার্চ হিজ ব্যাগ।”
জ্ঞানেন্দ্র ছুটে গেল। ব্যাগ খুলতেই সুন্দর মলাট দেওয়া বইপত্র বেরিয়ে পড়ল। এদিকে কালাঁচাদ খুব পরিপাটি। খালি কাগজ দিয়ে প্রতিটি খাতা বই সুন্দর মলাট দেওয়া। তাতে সাদা কাগজের পটি আঠা দিয়ে আঁটা। কালাচাঁদের হাতের লেখা সুন্দর। গোট গোট করে লেখা: দিস বুক বিলংস টু শ্রীকালাচাঁদ প্রামাণিক। এ স্টুডেন্ট অব প্রি-এস এফ ক্লাস।
স্যার পড়ে বললেন, “সেটা কোন ক্লাস সাধু কালাচাঁদ?”
“এখন কথা বলব স্যার?”
“পারমিশন দিলাম।”
“নাইন-টেন তো স্কুল ফাইনালের ক্লাস। তাই তার আগের দু’ক্লাসের একটাতে আমরা পড়ি বলে স্যার—”
“ওঃ। তা ভাল। কীরে জ্ঞানেন্দ্র— পাটিগণিত পেলি?”
“এই তো স্যার—”
“দেখতো একষট্টির পাতা— আছে কিনা পাতাটা—”
“নেই স্যার।”
“দেখি।” বলে অঙ্ক-স্যার মন দিয়ে বইখানা উলটে-পালটে দেখলেন। তারপর বই বন্ধ করে ভাল করে তাকালেন। “কী গৌরাঙ্গ, প্রি-এস এফ ক্লাসের স্টুডেন্ট! স্কেল নিয়ে জলের ট্যাঙ্কে উঠেছিলে? তা বইয়ের পাতা সঙ্গে কেন?”
“এখন কথা বলব স্যার?”
“পারমিশন দিলাম।” বলেই স্যার স্কেল দিয়ে কালাচাঁদের হাঁটুতে সাঁই করে এক ঘা কষালেন।
গৌরাঙ্গ অবস্থায় কালাচাঁদ নির্বিকার চোখে বলল, “ওখানে মারবেন না স্যার।”
“কেন সাধু?”
“একখানা ঘা আছে স্যার! কাচা ঘা। পিঠে মারুন।”
“ওখানে আবার কিছু নেই তো?”
“না স্যার। পরিষ্কার পিঠ।”
“তা এবার সব বলে ফেলো সাধু কালাচাঁদ।”
“সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলব স্যার?”
“না। যেমন আছ থাকো।” অঙ্ক-স্যার এখানে নেমে স্কেলখানা দিয়ে কালাচাঁদের পিঠে পর পর তিন ঘা দিলেন।
“আপনি বলেছিলেন আধ ঘণ্টায় কতটা জল ভরবে? তাই দেখতে গিয়েছিলাম। জলের ট্যাঙ্কটাও তো একটা চৌবাচ্চা। না স্যার?”
অঙ্ক-স্যার এখানে থতমত খেয়ে দাড়িয়ে পড়লেন। “তাই বলে পাটিগণিতের পাতা ছিঁড়ে? স্কেল হাতে? জলের ট্যাঙ্কের ছাদে? কখন উঠেছিলি?”
“সন্ধের পর স্যার। আকাশে চাঁদ ছিল।”
“তা তো থাকবেই। তারপর?”
“অন্ধকার। কিছু দেখা যায় না। একা তো স্যার। সঙ্গে কাউকে পেলাম না। প্রথমে ছেঁড়া পাতাটা পড়ে এগোচ্ছিলাম। মভরু বাজারে যেতেই ট্যাঙ্কের নীচের কল ছেড়ে দিলাম। পাঁচ মিনিটে সব জল বেরিয়ে গেল। ওপরের কল খুলে দিলাম। কিন্তু কোথায় জল? এমনি ফুট, ঘনফুট কিছুই চোখে দেখলাম না।”
“তখন?”
“ভয় পেয়ে গেলাম স্যার। তাতেই গণ্ডগোল হয়ে গেল সব। তখন অন্ধকারে পাটিগণিতের পাতা পড়তে পারছি না। মভরুও বাজার থেকে ফিরে আসছিল। তাই তাড়াতাড়ি নেমে এলাম।”
“ওই তো মুশকিল। নীচের কলটার মুখ তো বন্ধ করে তবে নেমে আসবি।”
“তাই তো করা হল না স্যার। হাতে কলমে অঙ্কটা শিখতে গিয়ে—”
“স্কুলসুদ্ধ হুলুস্থুলু বাধালি আজ। নে হাত পাত। তোর নিজের স্কেল। ভালই লাগবে। কী বলিস।”
“হাজার হোক নিজের জিনিস তো স্যার। ভাঙবেন না কিন্তু।”
অঙ্ক-স্যার থমকে গিয়ে বললেন, “কেন?”
“পাতলা কাঠের জিনিস তো স্যার। ভেঙে গেলে জোড়া যায় না আর।”
“তাই বুঝি।” স্যারের কথাও শেষ হল— আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি কালাচাঁদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
কালাচাঁদ একটুও কাবু না হয়ে গৌরাঙ্গ অবস্থায় মিঠে হয়ে থাকবার চেষ্টা করে যেতে লাগল। শুধু একবার বলল, “তাই বলে নিজের মতো করে অঙ্কটা শেখার চেষ্টা করব না স্যার?”
স্যার তখনও মারছিলেন। থেমে বললেন, “সারা স্কুলকে পিপাসায় রেখে অঙ্ক শেখা! একদম হাতে কলমে!”
এবার আর কালাচাঁদ কোনও জবাব দিল না। তখন তার ওপর কিলচড় এসে পড়ছিল। স্কেলটা ভেঙে গেছে অনেকক্ষণ। পেট ফুলিয়ে ঢলঢলে হাফপ্যান্টটা প্রায় বুকের ওপর তুলে ফেলেছে। গৌরাঙ্গ অবস্থায় একদম সাধু হয়ে দাঁড়াল কালাচাঁদ। নির্বিকার। চোখের পলকও পড়ছে না।
আশ্বিন ১৩৮২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন