কুস্তির প্যাঁচ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

পৌলোমী সেনগুপ্ত

কুস্তির প্যাঁচ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

যে লোকটা রোজ ভোররাতে উঠে দেড়শো বুকডন আর তিনশো বৈঠক দেয়, তারপর জিমন্যাস্টিকস করে, বালির বস্তায় ঘুসি মারে এবং কুংফু ক্যারাটে জুডো অভ্যাস করে, তার আবার মর্নিং ওয়াকের কী প্রয়োজন, এটা অনেকেরই প্রশ্ন! কিন্তু গোয়েন্দা বরদাচরণ এর জবাব দিতে পারবেন না। তবে এটা ঠিক যে, আজও প্রতিদিন সকালে তাঁকে দাদুর সঙ্গে প্রাতঃভ্রমণে যেতে হয়। যখন থেকে হাঁটতে শিখেছেন, সেই তখন থেকে আজ অবধি রোজ।

বরদাচরণের দাদুর বয়স পঁচাশি। যৌবনকালে নামকরা কুস্তিগির ছিলেন। অনেক মেডেল কাপ শিল্ড পেয়েছেন। এখনও শালগাছের মতো ঋজু ও প্রকাণ্ড শরীর। রোজ কুড়ুল চালিয়ে দু’মন করে কাঠ কাটেন। পুকুরে ঘণ্টাখানেক সাঁতরান। কুয়ো থেকে বিশ-ত্রিশ বালতি জল তোলেন। যৌবনে গোটা একটা খাসির মাংস খেয়ে ফেলতে পারতেন। ডিম খেতেন দু’ডজন করে। আধ সের ঘি। পাঁচ সের দুধ। এখন আর অত খান না। তবু যা খান, তা তিনটে লোকের খোরাক। সকালে উঠে পরিষ্কার বাতাসে শ্বাস নিয়ে ফুসফুস পরিষ্কার করতে প্রাতঃভ্রমণ তাঁর নিত্যকর্ম। এখনও তাঁর চুল পাকেনি। দাঁত পড়েনি, চামড়া কোঁচকায়নি। পঁচাশি বছরেও দিব্যি সুঠাম চেহারা অম্বিকাচরণের। তবে কিনা লোকটা একটু বাতিকগ্রস্ত। তাঁর কাছে সবকিছুই সেই আগের মতোই আছে, কিছুই পালটায়নি।

এই যে বরদাচরণ এখন পূর্ণযুবক, ইয়া দশাসই লম্বাচওড়া চেহারা, তার ওপর নামকরা গোয়েন্দা, এসব অম্বিকাচরণের খেয়ালই থাকে না। সকালে উঠেই তিনি দাঁতন করে, পুজোপাঠ সেরে থানকুনিপাতা আর কলি-ওঠা ছোলা খেয়ে হাঁক দেন, “দাদুভাই, অ দাদুভাই।” ডাক শুনে মনে হয় যেন তিন-চার বছর বয়সি নাতিকে ডাকছেন। সেই ডাক শুনে বরদাচরণ গুটিগুটি দাদুর কাছে এসে দাঁড়ান। তারপর দাদুর হাত ধরে পিছু পিছু বেরিয়ে আসেন। দাদু অম্বিকাচরণ যেভাবে বহুকাল আগে ছোট্ট বরদাচরণকে সাবধানে নর্দমা পার করাতেন, এখনও তেমনি হাত ধরে নর্দমা পার করে দেন। গাড়ি ঘোড়া দেখলে বলেন, “সরে এসো দাদুভাই, চাপা দেবে যে!” কুকুর বা গোরু দেখলে হাঁ হাঁ করে ওঠেন, হাতের লাঠিটা আপসাতে আসাতে বলেন, “যাঃ যাঃ, দাদুভাই ভয় পেয়ে কাঁদবে!”

বরদাচরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কী আর করবেন! পরশুদিনও তিনি একজন ডাকাতকে ধরতে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমেছেন। গত মাসেই তিনি খুনি রঘুবীর সিংয়ের পিস্তলের মুখে পড়েছিলেন। এই তো সেদিন কুখ্যাত একদল হাইজ্যাকারের পিছু নিয়ে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের এক বোয়িং সাতশো সাঁইত্রিশ বিমানের একেবারে কেবিনের মধ্যে দুর্দান্ত ফাইট করে চারজন বিমান-ছিনতাইকারীকেই ঘায়েল করে এলেন। কিন্তু দাদুকে সে-কথা কে বোঝাবে?

দাদুর সঙ্গে বরদাচরণের এই মর্নিং ওয়াক দেখে সবাই ভারী অবাক হয়।

হঠাৎই একদিন একখানা ঘটনা ঘটল। যাকে বলা যায় বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা। প্রায় ষাট বছর আগে মুর্শিদাবাদের এক নবাবের বাড়িতে বিখ্যাত পাঞ্জাবি কুস্তিগির শের সিংকে অম্বিকাচরণ হারিয়ে দেন। তাই নিয়ে খুব হইচই হয়েছিল। নবাব খুশি হয়ে সোনায় বাঁধানো একখানা কাপ উপহার দিয়েছিলেন অম্বিকাচরণকে। এখনকার বাজারে সেই কাপটার দাম হেসেখেলে বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা তো হবেই। অম্বিকাচরণ একখানা কাচের বাক্সে যত্ন করে কাপটা রেখে দিয়েছিলেন। নিজ হাতে রোজ মোছেন, কেউ এলে দেখান। হঠাৎ একদিন দেখা গেল, কাপটা নেই। তার বদলে কাচের বাক্সে একটা চিরকুট পড়ে আছে। তাতে লেখা, “অম্বিকাভাই, লড়াইটায় জোচ্চুরি ছিল। তুমি আমাকে চিত করতে পারোনি। আমার কোমরটা মাটিতে লেগেছিল মাত্র। কিন্তু নবাবের ব্যান্ডপার্টি তখন এমন জগঝম্প বাজনা শুরু করে দিল, আর তাই শুনে তুমি জিতেছ ভেবে সব মেয়ে-বউরা এমন শাঁখ বাজাতে আর উলু দিতে লাগল যে, আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। ওরকম আওয়াজ আমি জীবনে শুনিনি। তোমাকে কাঁধে নিয়ে লোকের সে কী নাচ! আমি নবাবকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম যে, লড়াইটা এখনও শেষ হয়নি, কিন্তু কে কার কথা শোনে! নবাব আমাকে আমলই দিলেন না। সেই থেকে মনের মধ্যে আগুন পুষে রেখেছি। ইচ্ছে ছিল তোমাকে অনেক আগেই হারিয়ে দিয়ে প্রমাণ করি যে, তোমার চেয়ে আমি অনেক বড় কুস্তিগির। কিন্তু সেই সুযোগ আর এতকালের মধ্যে ঘটে ওঠেনি। নানা ধান্ধায় আমাকে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। তবে সর্বদাই আমি তোমার খোঁজখবর রেখেছি। এতদিন বাদে ফের তোমার পাত্তা মিলেছে। তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসে তোমাকে পেলাম না। দেখলাম, সেই ট্রফিটা তোমার ঘরে আজও সাজানো আছে। দেখে পুরনো স্মৃতিটা চাগিয়ে উঠল। রক্ত গরম হয়ে গেল, হাত-পা নিশপিশ করতে লাগল। সামনে তোমাকে পেলে রদ্দা লাগাতাম। যাই হোক, এই ট্রফিটা আমি আমার বলেই মনে করি। তাই এটা চুপিচুপি নিয়ে যাচ্ছি। এতে যদি তোমার আপত্তি থাকে, তবে আগামীকাল বেলা বারোটার মধ্যে জেমিনি হোটেলের বারো নম্বর ঘরে এসো। ট্রফিটি যদি নিতান্তই ফেরত পেতে চাও, তা হলে আমার সঙ্গে আর-একবার তোমাকে কুস্তি লড়তে হবে। যদি তুমি জেতো, তা হলে তোমাকে ট্রফি তো ফেরত দেবই, ওস্তাদ বলেও মেনে নেব। আর যদি তুমি হারো, তা হলে আমাকে ওস্তাদ বলে সেলাম জানাবে। ইতি শের সিং।”

এই চিরকুট পেয়ে অম্বিকাচরণ তো মহা খাপ্পা। বাতাসে ঘুসি ছুড়তে ছুড়তে বলতে লাগলেন, “ব্যাটা শের সিংয়ের এত সাহস! সেদিন লড়াইতে যে ওর লেংটি খুলে নিইনি, তাই ওর সাত জন্মের ভাগ্যি! এমন প্যাঁচ মেরেছিলাম যে ব্যাটা একেবারে কুমড়ো-গড়াগড়ি। আবার বলে কিনা সেদিন ও-ই নাকি জিতেছিল। আয় না ব্যাটা, এখনও এই বুড়োবয়সে ভেলকি দেখিয়ে তোকে এরোপ্লেন-প্যাঁচ মেরে ধোবিপাটে আছড়ে মারতে পারি কিনা, দেখে যা!”

বরদাচরণ তাড়াতাড়ি দাদুকে ধরে বসিয়ে পাখার বাতাস টাতাস দিয়ে একটু ঠান্ডা করে বললেন, “সেদিন কী ঘটেছিল তা বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু এতদিন পরে লোকটা আবার কুস্তি লড়তে চায় কেন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না। শের সিংয়ের বয়স এখন কত হবে বলো তো?”

অম্বিকাচরণ একটু চিন্তা করে বললেন, “আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় তো হবেই। তা তার এখন নব্বইয়ের কম না।”

চোখ কপালে তুলে বরদাচরণ বললেন, “নব্বই! এই বয়সেও লোকটা কুস্তি লড়তে চায়? নাঃ দাদু, লোকটা দেখছি সাংঘাতিক।”

অম্বিকাচরণ মাথা নেড়ে বললেন, “সাংঘাতিক তো বটেই। শের সিংয়ের নাম শের সিং হল তো খালি হাতে একটা রয়েল বেঙ্গল বাঘ মেরে। আসামের জঙ্গলে বুনো মোষের সঙ্গেও নাকি একবার হাতাহাতি করেছিল। এমন দাপট ছিল যে, সহজে তার সঙ্গে কেউ লড়তে রাজি হত না।”

বরদাচরণ বললেন, “এরকম লোককে একবার চোখের দেখা দেখে আসা দরকার। চলো দাদু, কাল তোমার সঙ্গে আমিও যাব।”

পরদিন অম্বিকাচরণ নাতি বরদাচরণের হাত ধরে বেরিয়ে পড়লেন। জেমিনি হোটেল তাঁদের বাড়ি থেকে বেশি দূরেও নয়। দোতলায় উঠে বারো নম্বর ঘরের বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিয়ে অম্বিকাচরণ বাজখাঁই গলায় চেঁচাতে লাগলেন, “কোথায় শের সিং? বেরিয়ে আয় ব্যাটা। অম্বিকাকে চিনিস না! আজ তোরই একদিন কি আমারই একদিন।”

ঘরের ভিতর থেকে একটা হুংকার শোনা গেল। “এসেছিস? সিংহের গুহায় শেষে ঢুকবার মতো সাহস হল তোর!”

বলতে বলতে দড়াম করে দরজা খুলে গেল।

শের সিংকে দেখে বরদাচরণের চোখ ছানাবড়া। পঁচাশি বছরেও তাঁর দাদু অম্বিকাচরণের স্বাস্থ্য যথেষ্ট ভাল বটে, কিন্তু নব্বইতে শের সিং যেন প্রকৃতই সিংহ। ইয়া বুকের ছাতি, বিশাল দুটো শালখুঁটির মতো হাত, পাকানো মোচ, বাবরি চুল।

দু’জনেই দু’জনের দিকে কিছুক্ষণ রোষকষায়িত লোচনে চেয়ে রইলেন। পাছে এখানেই দু’জনের লেগে যায়, সেই ভয়ে বরদাচরণ তাড়াতাড়ি দু’জনের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালেন।

শের সিং জিজ্ঞেস করলেন, “এটি কে?”

অম্বিকা বললেন, “নাতি।”

শের সিং সঙ্গে সঙ্গে ভারী নরম হয়ে বললেন, “নাতি! তা আগে বলতে হয়! এসো খোকা, এসো, তোমার দাদুর সঙ্গে ঝগড়া আছে বটে, কিন্তু তোমার সঙ্গে তো নেই। তা ছাড়া শিশুরা হচ্ছে জগতের আনন্দ।”

“খোকা” “শিশু” এইসব বিশেষণ শুনে বরদাচরণ হাসবেন কি কাঁদবেন তা বুঝতে পারছেন না।

ঘরে ঢুকে বরদা দেখেন বেশ লম্বাচওড়া চেহারার এক যুবক বসে বসে একটা পেতলের গামলায় ঘুঁটনি দিয়ে বাদামের শরবত বানাচ্ছে।

শের সিং বললেন, “অম্বিকা, এই দেখো, এ হচ্ছে আমার নাতি। ও ভাবে, আমি বুড়ো হয়েছি, তাই সবসময়ে সঙ্গে সঙ্গে থাকে।”

অম্বিকাচরণ যুবকটির থুতনি নেড়ে দিয়ে বললেন, “বাঃ বাঃ দিব্যি দেখতে হয়েছে তো খোকাটিকে!”

শের সিং বললেন, “কাজিয়া পরে হবে। আগে শরবত খাও।”

অম্বিকা বললেন, “শরবত না হয় খাচ্ছি। কিন্তু আমার বাড়িতে এ ক’দিন যে দুটো ডালভাত খেতেই হবে শের সিং।”

এরপর দু’পক্ষের বেশ সদ্ভাব হয়ে গেল। অনেকক্ষণ বসে দু’জনে নানা কথা কইলেন। হাসিঠাট্টাও হল। গল্পগুজবে অনেকটা বেলা কাবার করে অম্বিকা উঠলেন। বরদাচরণ স্বস্তির শ্বাস ছাড়লেন, দুই বুড়োর কুস্তিটা বোধহয় এড়ানো গেল।

কিন্তু বিদায় দেওয়ার সময় শের সিং হঠাৎ বললেন, “তা হলে অম্বিকা, কুস্তিটা কবে হচ্ছে?”

অম্বিকাচরণ সতেজে বললেন, “যেদিন বলবে। কাল বললে কাল।”

“তা হলে কালই, ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দাও। ফুটবল মাঠে দু’জনে নেমে পড়ব।”

“তাই হবে।”

খবরটা বিদ্যুৎবেগে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। অতীতের বিখ্যাত পালোয়ান শের সিং যে এখনও বেঁচে আছেন তাই অনেকে জানত না, তার ওপর অম্বিকাচরণ যে একদা শের সিংকে হারিয়েছিলেন, সে-খবরও অনেকের অজ্ঞাত। সুতরাং তুমুল উত্তেজনা দেখা দিল। রাতারাতি ফুটবল মাঠের মাঝখানে কুস্তির মাটি তৈরি হয়ে গেল। চারদিকে চেয়ার বেঞ্চি সাজানো হতে লাগল। ভিড় সামলানোর জন্য বাঁশের বেড়া তৈরি হল। সকাল থেকে ছেলে-মেয়ে-বুড়ো-বাচ্চা কাতারে কাতারে এসে চারদিকে জায়গা দখল করতে লাগল। পঁচাশি বছরের একজন মানুষের সঙ্গে নব্বই বছর বয়সি আর-একজনের লড়াই। সোজা কথা তো নয়।

কিন্তু মুশকিল হল, অম্বিকাচরণের সকাল থেকেই শরীর খারাপ, সকাল থেকেই রোদে বসে বারবার বগলে থার্মোমিটার দিচ্ছেন। বরদাচরণকে ডেকে বলছেন, “দেখ তো দাদু, কত উঠল।”

বরদাচরণ থার্মোমিটার দেখে বলেন, “সাড়ে সাতানব্বইতেই তো দাঁড়িয়ে আছে দেখছি।”

“থার্মোমিটারটা তা হলে একেবারেই গেছে। আমার তো মনে হয় একশো এক-এর কম না। দে তো, আবার লাগিয়ে দেখি।”

বরদাচরণ দাদুর কপালে হাত দিয়ে বলেন, “রোদে বসে গা একটু গরম হয়েছে বটে, কিন্তু জ্বর বলে তো মনে হয় না।”

অম্বিকাচরণ খেঁকিয়ে উঠে বলেন, “তুই জ্বরের কী বুঝিস? এ হল নাড়ির জ্বর। ভিতরে ভিতরে গুমরে গুমরে ওঠে।”

বরদাচরণ বুঝলেন দাদু লড়তে চান না, কিন্তু না লড়লেও নয়। চারদিকে খবর রটে গেছে। কাতারে কাতারে লোক আসছে লড়াই দেখতে।

বরদাচরণ বা অম্বিকাচরণ জানেন না যে, ওদিকে শের সিংয়ের শিবিরেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। ভোররাত্রি থেকেই শের সিং তাঁর নাতিকে বলছেন, “দেখো ভাই, আমার পেটে খুব ব্যথা হয়েছে।”

নাতি বলল, “জীবনে তোমার কোনওদিন তো পেটে ব্যথা হয়নি দাদু!”

শের সিং খিঁচিয়ে ওঠেন, “হয়নি বলেই কি হতে নেই? আমার দারুণ ব্যথা হয়েছে, মনে হয় কলেরাই হল বোধহয়।”

“কলেরা হলে তো ভেদবমি হয়।”

“তুই খুব বেশি জেনে গেছিস। কলেরা কতরকমের হয় জানিস? ভিতরে ভিতরে আমার ভেদবমি শুরু হয়ে গেছে।”

নাতি ফাঁপরে পড়ে গেল। লড়াই না হলে যে দাদুর সম্মান থাকবে না!

বেলা বাড়তে লাগল। অম্বিকাচরণ কম্বলমুড়ি দিয়ে সেই যে শুয়ে পড়েছেন, আর নড়াচড়ার নাম নেই। এদিকে শের সিং সেই যে বাথরুমে ঢুকে দরজা দিয়েছেন, আর বেরোনোর কোনও লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।

অগত্যা বরদাচরণ দাদুর অবস্থার কথা জানাতে শের সিংয়ের কাছে রওনা হল, আর শের সিংয়ের নাতিও নিজের দাদুর কথা জানিয়ে ট্রফিটা ফেরত দিয়ে আসতে রওনা হল অম্বিকাচরণের বাড়ি।

বরদাচরণ যখন শের সিংয়ের ঘরে এসে হাজির হলেন, তখনও শের সিং বাথরুমে।

বরদাচরণ খুব বিনয়ী গলায় ডাকলেন, “শেরদাদু! ও শেরদাদু!”

বাথরুমের ভিতর থেকে খুব সতর্ক গলায় শের সিং সাড়া দিলেন, “কে রে? কী চাই?”

বরদাচরণ খুব কুণ্ঠিতভাবে বললেন, “শেরদাদু, আমি বরদাচরণ, আমার দাদু অম্বিকাচরণের সকাল থেকেই টাইফয়েড।”

“অ্যাঁ!”

“আজ্ঞে হ্যা, ডাক্তাররা বলছে, ব্যামো খারাপের দিকে যেতে পারে।”

“সত্যি বলছ?”

“আজ্ঞে হ্যা।”

সঙ্গে সঙ্গে বাথরুমের ভিতরে একটা রণহুংকার শোনা গেল। তারপর দড়াম করে দরজা খুলে বেরিয়ে এসে শের সিং হাঃ হাঃ করে অট্টহাস্য হেসে বললেন, “আরে এ তো আমি আগেই জানতাম। অম্বিকার মুরোদ কী তা সেই ষাট বছর আগেই আমার জানা হয়ে গেছে। লড়াইয়ের নামে যার জ্বর আসে সে আবার মরদ! ছোঃ ছেঃ!”

ওদিকে শের সিংয়ের নাতি কঁচুমাচু মুখে গিয়ে অম্বিকাচরণের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ডাকল, “অম্বিকাদাদু! ও অম্বিকাদাদু!”

“কে?” কম্বলের ভিতর থেকে অম্বিকাচরণ ক্ষীণস্বরে বললেন, “কে?”

“আমি শের সিংয়ের নাতি। দাদুর যে ভোররাত্রি থেকে খুব ভেদবমি হচ্ছে। ডাক্তার বলছে কলেরা।”

“সত্যি তো?”

“আজ্ঞে সত্যি। দাদু তো বাথরুম থেকে বেরোতেই পারছেন না।”

কম্বলটা এক ঝটকায় নামিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন অম্বিকা। তারপর হাঃ হাঃ করে হেসে উঠে বললেন, “হবে না? ভয়ের চোটে পেটখারাপ হয়েছে। আমার আগেই জানা ছিল। মুর্শিদাবাদে সেই যে ওকে ধোবিপাটে আছাড় মেরেছিলাম, তা কি আর ও ভুলে গেছে?”

শের সিং আর অম্বিকাচরণ দু’জনেই ভাবলেন, লড়াইটা যখন হবেই না তখন ফুটবল মাঠে গিয়ে জনসাধারণের সামনে বুক ফুলিয়ে ওয়াকওভার নিয়ে আসবেন।

দু’জনেই তড়িঘড়ি রওনা হয়ে পড়লেন আসরে। অম্বিকা জানেন শের সিংয়ের কলেরা। শের সিং জানেন অম্বিকার টাইফয়েড। দু’জনেই তাই নিশ্চিন্ত।

ফুটবল মাঠ ভিড়ে ভিড়াক্কার। দু’দিক থেকে দু’জনকে ঢুকতে দেখে লোকেরা হইহই করে উঠল। অম্বিকা ভাবলেন তাঁকে দেখেই লোকে হইচই করছে। শের সিং ভাবলেন, তাঁকে দেখে।

হুংকার দিয়ে দু’জনেই লাফিয়ে পড়লেন দঙ্গলে। তারপরই দু’জনে নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলেন পরস্পরের দিকে। কেউই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

অম্বিকাচরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা হাত শের সিংয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, “দেখো তো নাড়িটা। জ্বর মনে হয় একশো এক ছাড়িয়ে গেল।”

শের সিং নাড়ি ধরে বললেন, “দুইয়ের কম না। এবার আমার পেটটা একটু টিপে দেখো তো, বড্ড ব্যথা।”

অম্বিকা শের সিংয়ের পেট টিপে দেখে বললেন, “ও বাবা, কলেরার একেবারে মস্ত একটা ডেলা দেখছি যে।”

ব্যাপারটা বুঝতে জনসাধারণের একটু সময় লাগল বটে, তারপর হোঃ-হোঃ করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সমস্ত মাঠ।

১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮৪

সকল অধ্যায়

১. বিষে বিষক্ষয় – আশাপূর্ণা দেবী
২. আটচল্লিশ – অরবিন্দ গুহ
৩. ডোডো তাতাই পালা কাহিনি – তারাপদ রায়
৪. কৈলাসে চা পান – আশাপূর্ণা দেবী
৫. চোরে ডাকাতে – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৬. সাধু কালাচাঁদের নতুন কাজ – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
৭. ইলশেঘাই – লীলা মজুমদার
৮. শরচ্চন্দ্রের সন্ধিভেদ! – শিবরাম চক্রবর্তী
৯. ঝুনুমাসির বিড়াল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০. বিধু দারোগা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
১১. সাধু কালাচাঁদের পালাকীর্তন – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
১২. কে ফার্স্ট? – আশাপূর্ণা দেবী
১৩. ফ্ল্যাট রেস – জরাসন্ধ
১৪. চিত্তশুদ্ধি আশ্রম – বিমল কর
১৫. টেনাগড়ে টেনশান – বুদ্ধদেব গুহ
১৬. হাতি-চোর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৭. ছোটমাসির মেয়েরা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৮. মোটরবাইক, ষাঁড় ও লাকি – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১৯. ব্যাঙাচিদের লেজ – তারাপদ রায়
২০. বাজারদর – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২১. তেঁতুলমামার জগৎ – হিমানীশ গোস্বামী
২২. রাজার মন ভাল নেই – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৩. গজেনকাকার মাছ-ধরা – বিমল কর
২৪. দাদুর ইঁদুর – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
২৫. সাত নম্বর – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
২৬. মেজদার সার্কাস – চিত্তরঞ্জন সেনগুপ্ত
২৭. চোর – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৮. কুস্তির প্যাঁচ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৯. দুঃখহরা বড়ির শিশি – লীলা মজুমদার
৩০. পিলকিন’স ইলেভেন – বিমল কর
৩১. রাত যখন বারোটা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩২. ভুনিকাকার চৌরশতম – বিমল কর
৩৩. গ্রামের নাম জাঁকপুর – আশাপূর্ণা দেবী
৩৪. নিখোঁজ নিরুদ্দেশ হতে গেলে – আশাপূর্ণা দেবী
৩৫. বাঘের দুধ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৬. গগনবাবুর গাড়ি – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৭. গাবু – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৮. কুরুক্ষেত্র – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৯. কাক্কাবোক্কার ভুতুড়ে কাণ্ড – শৈলেন ঘোষ
৪০. হরিমতির বাগান – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪১. বড়দার বেড়াল – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৪২. মহাকর্ম – সমরেশ মজুমদার
৪৩. পায়রাডাঙায় রাতে – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৪. মামার বিশ্বকাপ দর্শন – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪৫. গটমটে সাহেব বটে – শৈলেন ঘোষ
৪৬. রাঘব বোয়াল – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
৪৭. স্কন্ধকুমার এবং অর্ধচন্দ্র – তারাপদ রায়
৪৮. পাগল হইবার সহজপাঠ – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪৯. বিপিনবিহারীর বিপদ – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৫০. সাদা রঙের পাঞ্জাবি – অনির্বাণ বসু
৫১. জগু যাবে বেড়াতে – বাণী বসু
৫২. কুঞ্জবাবুর পিঁপড়ে বাতিক – অমিতাভ গঙ্গোপাধ্যায়
৫৩. ভুলে যাওয়া – সিদ্ধার্থ ঘোষ
৫৪. ঝগড়ুটে ফাইভ – প্রচেত গুপ্ত
৫৫. বিপদভঞ্জনের সর্পদোষ – উল্লাস মল্লিক
৫৬. মাসির বাড়ি – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৫৭. জাগ্রত অসুরের গল্প – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৫৮. কাকাতুয়া ডট কম – প্রচেত গুপ্ত
৫৯. নতুন নাটকও ভন্ডুল – উল্লাস মল্লিক
৬০. রামখেলাওনের কেরামতি – সৌরভ মুখোপাধ্যায়
৬১. কলহগড়ের নিস্তব্ধতা – সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়
৬২. পটলার থিমপুজো – শক্তিপদ রাজগুরু
৬৩. সংকটমোচন কমিটি – প্রচেত গুপ্ত
৬৪. নতুন বন্ধু চিনু – জয়দীপ চক্রবর্তী
৬৫. বুঁচকির মেয়ের বিয়ে – নবনীতা দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন