পৌলোমী সেনগুপ্ত
খামটা হাতে নিয়ে কনকেন্দুবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে বসে আছেন। বহুদিন পরে আজকের ডাকে তাঁর একটা চিঠি এসেছে। এ বাড়িতে চিঠিপত্র কদাচিৎ আসে। আসার কোনও কারণই নেই। আসবেই বা কেন? ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনি বিদেশে থাকে, সেই সুদূর কানাডায়। জামাই বিলেতে ডাক্তারি করে, মেয়েও সেখানে। তার স্ত্রী মালতী দেবী মেয়ের কাছে গিয়েছেন, তা প্রায় মাস দুয়েক হল। মেয়ের বাচ্চা হবে, মালতী দেবীকে মেয়ের কাছে আরও মাস চারেক অন্তত থাকতে হবে।
ছেলে-মেয়ে-জামাই কেউ চিঠিপত্র কিছুই লেখে না। তারা সরাসরি যোগাযোগ করে টেলিফোনে। নানারকম কথা হয়। তারপরে আর চিঠির প্রয়োজন পড়ে না।
চিঠি এ বাড়িতে যা দুয়েকটা আসে তার প্রায় সবই ইলেকট্রিক বিল, টেলিফোন বিল ইত্যাদি। বিশেষ প্রয়োজনে শ্যামপুরে গ্রামের বাড়ি থেকে খুড়তুতো ভাই নবেন্দু চিঠি লেখে।
আজ সেই শ্যামপুর থেকে নবেন্দুর চিঠি এসেছে। কী ব্যাপার কে জানে?
পূর্ব শহরতলির প্রায় শেষ প্রান্তে কনকেন্দুবাবুর এই বাড়ি, বাড়ির নাম ‘শেষ স্টেশন’। বছর দশেক আগে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি এই বাড়িটা করেছিলেন।
ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, লোকজন বাড়িতে এই সেদিন পর্যন্ত কিছু কিছু ছিল। এখন তো বাড়ি একদম ফাঁকা।
লোকজন বলতে কনকেন্দুবাবু ছাড়া আর মাত্র দু’জন; অবশ্য দু’জন না বলে দেড়জনই বলা যায়।
এর মধ্যে প্রথমজন হল দুর্যোধন। পুরনো কাজের লোক। বয়েস হয়েছে, এককালে খুবই কাজের ছিল, কিন্তু বছর সাতেক আগে নারকেল পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙে যায়, সে আর ভাল হয়নি। তা ছাড়া বয়েসও হয়েছে, দুর্যোধনের বয়েস কনকেন্দুর থেকে কম নয়, বরং বেশিই হবে।
তা হোক, সকালবেলা একবার বিছানা থেকে পাঁজাকোলা করে কনকেন্দুবাবু তাকে দাঁড় করিয়ে দেন, তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাসন মাজা, তরকারি কোটা, কাপড় কাচা, রান্নাবান্না করা, সব কলের পুতুলের মতো করে যায়। ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে বাজার দোকান করে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাওয়াদাওয়া করে, তারপর সন্ধ্যার পরে কাজকর্ম, খাওয়াদাওয়া মিটে গেলে কনকেন্দুবাবু আবার পাঁজাকোলা করে তাকে বিছানায় শুইয়ে দেন।
দুর্যোধন ছাড়া আর যে তৃতীয় তথা আধখানা জীব শেষ স্টেশনে বসবাস করে, সে একটি হাফ হুলো।
হাফ হুলো, কারণ বেড়ালটা এখনও পূর্ণত্ব প্রাপ্ত হয়নি, এটার বয়স নিতান্তই ছয় মাস। পাশের বাড়ির মেনি তার এই ছানাটিকে চোখ ফোটার পরেই ঘাড় কামড়ে ধরে কনকেন্দুবাবুর বৈঠকখানা ঘরে রেখে যায়। তারপর আর একদিনও খোঁজ নেয়নি তা নয়, মাঝে মাঝে এসে বেশ কিছুদিন দুধ খাইয়ে গেছে।
হালকা নীল রঙের চোখের মণি, সাদা ধবধবে লোমের চঞ্চল বেড়ালশাবকটি সহজেই কনকেন্দুবাবুর, বিশেষ করে তাঁর স্ত্রীর হৃদয় হরণ করে। এটাকে আর ফেলে দেওয়া বা তাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি।
এখন অবশ্য বেড়ালছানাটি আর তেমন সুন্দর নেই। এখনও সাবালক হয়নি, কিন্তু ক্রমশ একটি ঘাড় ও মাথামোটা হুলো বেড়ালে পরিণত হচ্ছে।
কনকেন্দুবাবু বেড়ালছানাটির নামকরণ করেছেন, স্কন্ধকুমার। অবশ্য এই নামকরণ শুধু ঘাড় মোটা বলে নয়। স্কন্ধকুমারকে সেই যে শিশুবয়সে তার মা-জননী কাঁধ কামড়ে ধরে এ বাড়িতে এনে রেখে গিয়েছিল, হয়তো-বা সেই কারণেই হুলোর একটা খারাপ অভ্যেস হয়েছে যে, সে সুযোগ পেলেই কনকেন্দুবাবুর, এমনকী অথর্ব দুর্যোধনের ঘাড়ে উঠে বসে পড়ে, তখন তাকে নামায় কার সাধ্য!
॥ ২ ॥
এবারে আমরা আজকের সকালের ডাকে আসা চিঠিটার কথা বলি।
আজকের এই চিঠিটা যথারীতি কনকেন্দুবাবুর দেশের বাড়ি শ্যামপুর থেকে এসেছে, লিখেছেন দেশের বাড়ির ভারপ্রাপ্ত খুড়তুতো ভাই নবেন্দু।
নবেন্দু বিনা কারণে চিঠি লেখার পাত্র নয়। খুব বেকায়দায় না পড়লে সে দাদাকে বিরক্ত করে না।
পুরো তিন টাকা দামের খামের চিঠি। ডাক খরচ তিন টাকা কী করে উসুল করতে হয় সেটা নবেন্দু জানে। তিন টাকা দামে কুড়ি গ্রাম ওজনের চিঠি পাঠানো যায়। কুড়ি গ্রাম কাগজ কম নয়, এক্সারসাইজ বুকের পাকা ছয় পৃষ্ঠা, খামের ওজন সুদ্ধ কুড়ি গ্রাম। খুদে খুদে হরফে, পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে চিঠি লেখেন নবেন্দু, সেও সাধুভাষায়।
আজ অনেকক্ষণ চিঠিটা হাতে ধরে উলটিয়ে পালটিয়ে দেখে ধীরেসুস্থে খামটা খুললেন কনকেন্দুবাবু। কোনও তাড়া নেই তাঁর।
কী আর লিখবে নবেন্দু?
গত মাসে লিখেছিল:
“কে বা কাহারা গত পরশু প্রবল বৃষ্টির মধ্যে রাত্রিগত ব্রাহ্ম মুহূর্তে ঢেঁকি ঘর হইতে বহু স্মৃতিবিজড়িত প্রাচীন ঢেঁকিটি অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে। শূন্য ঢেঁকিশাল দেখিলে হৃদয়ে হাহাকার জাগিয়া ওঠে। কর্তামার, বড় কর্তামার পুণ্য পাদস্পর্শ বিজড়িত ওই মহান ঢেঁকি…”
সেই চিঠিটাকে কনকেন্দুবাবু বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। পঞ্চাশ বছর বাড়িতে ধান ভানা হয় না, ঢেঁকিঘরে তালা। সেই ঢেঁকি চুরি গেলে কী আসে যায়।
তার আগের চিঠি বর্ষার সময়ে এসেছিল। নবেন্দু লিখেছিল:
“… এ বছর বর্ষা মরশুমে বড়ই ব্যাঙের উৎপাত। কোলা ব্যাঙ, সোনা ব্যাঙ, ধাই ব্যাঙ, চাঁই ব্যাঙ। ব্যাঙে ব্যাঙে জীবন দুর্বিষহ। কুয়োর মধ্যে, বিছানার ওপরে ব্যাঙ, রান্নাঘরে ব্যাঙ, ভাতের হাঁড়িতে ব্যাঙ, জামার পকেটে ব্যাঙ। এর একটা সুরাহা না হইলে শ্যামপুর ছাড়িয়া পলাইতে হইবে।…”
এ চিঠিটাকেও বিশেষ পাত্তা দেননি কনকেন্দুবাবু। তবে একটা মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছিলেন,
‘বিখ্যাত জাপানি যন্ত্র Bhek-Tarao অর্ডার দিয়েছি, এলেই পাঠিয়ে দেব। এই যন্ত্র দেখামাত্র সব রকম ব্যাঙ লেজ তুলে পালাবে।…’
কনকেন্দুবাবুর কাল্পনিক Bhek-Tarao বাংলায় হল ‘ভেক তাড়াও’। মনে রাখতে হবে, ভেক মানে হল ব্যাঙ। এও মনে রাখতে হবে ভেক তাড়াও নামে কোনও জাপানি যন্ত্র নেই। থাকার কথাও নয়। জাপানিরা ব্যাঙ খায়, চেটেপুটে খায়। তারা ব্যাঙ তাড়াতে যাবে কেন! তারা যদি কোনও যন্ত্র বানায় সেটা হবে ব্যাঙ বাড়াও অথবা ভেক বাড়াও যন্ত্র।
আজকের চিঠিটা অনেক বেশি গোলমেলে।
অবশ্য গোলমালটা বুঝতে কনকেন্দুবাবুর যথেষ্ট সময় লাগছে। তিনি নবেন্দুর চিঠিটা উলটো করে ধরেছেন। সেটা ভুল করে ধরেননি। কনকেন্দু কোনও কিছু ভুল করেন না, বা ভুল করে করেন না।
উলটো করে চিঠি পড়ার ব্যাপারে কনকেন্দুবাবুর নিজস্ব একটা চিন্তা আছে।
একটা চিঠি লিখতে আধ ঘণ্টা-এক ঘণ্টা সময় লাগে। অথচ সেই চিঠি দু’ মিনিটে পড়ে ফেলা যায়। এতে অত পরিশ্রমে লেখা চিঠিটার প্রতি সুবিচার করা হয় না।
তা ছাড়া উলটো করে পড়তে গেলে রীতিমতো মন দিয়ে, গভীর অভিনিবেশ সহকারে পড়তে হয়। যেমন সময় লাগে তেমনই চিঠির কথাগুলো মনে ছাপ ফেলে।
আজ খুবই ধীরে ধীরে নবেন্দুর চিঠিটার মর্মোদ্ধার করছিলেন কনকেন্দুবাবু।
নবেন্দু যা লিখেছে তা খুবই চিন্তার বিষয়।
কনকেন্দুবাবুদের গ্রাম শ্যামপুরের পাশেই যে গ্রাম, তার নাম বুড়োশিবপুর। সেখানে একটি প্রাচীন শিবমন্দির আছে, সেই শিবঠাকুর নাকি খুব জাগ্রত।
কাশীতে কিংবা কলকাতায় কালীঘাটে যেমন ধর্মের ষাঁড় আছে, বুড়োশিবপুরেও ঠিক তেমনই কয়েকটি ধর্মের ষাড় রয়েছে। শিবঠাকুরের কাছে মানত করে অনেকে পুরুষ বাছুর, যাকে এঁড়ে বাছুর বলে, মন্দিরে দান করে। তাদের কেউ ক্ষতি করবে না, তারা নিজের মতো চরে বেড়ায়। তবে সব সময়ে যে মন্দিরের কাছেই তারা চরে বেড়ায় তা নয়, দূরদূরান্তরে চলে যায়।
এইরকম একটি কালো রঙের ষাঁড় বাছুর, তার কপালে সাদা আধফালি চাঁদ রয়েছে, সেই বাছুরটি বছর দুয়েক আগে শ্যামপুরে কনকেন্দুবাবুদের বাড়ির কাছে চলে আসে।
সেই সময়ে কলকাতার শহরতলি থেকে ম্যালেরিয়ার অত্যাচারে পালিয়ে কনকেন্দুবাবু সস্ত্রীক শ্যামপুরে এসে বসবাস করছিলেন।
কনকেন্দুবাবুর স্ত্রী মালতী দেবীর খুব ন্যাওটা হয়ে পড়েছিল এই বাছুরটা। মালতী দেবী একে ভাতের ফ্যান, তরকারির খোসা খেতে দিতেন। বাড়ির উঠোনের কলাগাছ কেটে থোড়-মোচা সমেত খাইয়েছিলেন এই ভাবী ধর্মের ষাঁড়কে।
কনকেন্দুবাবুও জীবজন্তু পছন্দ করেন। তিনি অর্ধেক চাঁদকপালি এই বাছুরটির নাম দিলেন ‘অর্ধচন্দ্র’। কনকেন্দুবাবু অর্ধচন্দ্রের ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিতেন, কপাল চুলকিয়ে দিতেন। অর্ধচন্দ্র মাথা নিচু করে আদর খেত, কখনও গলা উঁচু করে দিত। সেখানেও হাত বুলিয়ে দেওয়ার জন্যে।
শুধু মালতী দেবী একবার ক্ষীণ আপত্তি করেছিলেন, অর্ধচন্দ্র নামটা যেন কেমন হল, অর্ধচন্দ্র মানে তো গলাধাক্কা। কনকেন্দুবাবু বুঝিয়েছিলেন, এখানে অর্ধচন্দ্র মানে গলা নয়, কপালের আধফালি চাঁদ।
এসব তো দু’বছর আগেকার কথা। আজকের চিঠিতে নবেন্দু যা বলেছে সে খুবই চিন্তার কথা।
অর্ধচন্দ্র নাকি ইতিমধ্যে একটি বিশাল ধর্মের ষাঁড়ে পরিণত হয়েছে। তার প্রতাপে আশপাশের দশ গ্রামের মানুষজন, ষাঁড়-বলদ অতিষ্ঠ। সে আজকাল কদাচিৎ শ্যামপুরে আসে। যখন আসে, হুড়মুড় করে বাইরের বেড়া ভেঙে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে। কখনও-বা দালানের মধ্যে ঢুকে এ-ঘর ও-ঘর করে, তারপর সিঁড়ি দিয়ে গট গট করে দোতলার ছাদে উঠে যায়। সেখান থেকে এই অতিকায় ষাঁড়কে নামায় কার সাধ্য! গৃহস্থ বাড়িতে ধর্মের ষাঁড় অভুক্ত থাকলে পাপ হবে, তাই নবেন্দু ছাদেই তাকে ভাত-ডাল, তরকারি খেতে দেয়। খড়-ঘাস এসব মোটেই অর্ধচন্দ্রের পছন্দ নয়। কট্টর প্রাচীন ভাষায় নবেন্দু জানিয়েছে:
“…যদিও ললাটের চন্দ্রটি এখনও অর্ধেকই আছে। আপনার সেই অর্ধচন্দ্র এখন আর অর্ধ নয়, সে পূর্ণচন্দ্র হইয়াছে।…
…অর্ধচন্দ্র ছাদ যথেচ্ছ নোংরা করে। অনেক সময় ছাদের কার্নিসে শৃঙ্গ বাঁধাইয়া একা-একাই গুঁতাগুঁতি করে।…”
এই চিঠিটা মধ্যে অন্তত সাতবার নবেন্দু লিখেছে—
“…আপনি শীঘ্র আসিবেন। আসিয়া অর্ধচন্দ্রের হাত হইতে আমাদের রক্ষা করিবেন, অন্যথায় দালানকোঠা কিছু থাকিবে না।…”
চিঠির এই অংশটা পাঠ করতে করতে কনকেন্দুবাবু একটু হাসলেন। নবেন্দুটা একটা মূর্খ। আর যাই হোক, অর্ধচন্দ্র একটা ষাঁড়, তার আবার হাত কোথায় যে তার হাত থেকে বাঁচাতে হবে।
চিঠি পড়া সাঙ্গ হলে, বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন কনকেন্দু। প্রকৃত সমস্যাটা যে কী, সেটা অনুধাবন করার চেষ্টা করলেন।
কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তা করার পর কনকেন্দু বুঝতে পারলেন এরকম জটিল সমস্যার সমাধান নবেন্দুর পক্ষে সম্ভব নয়।
নবেন্দু সাদামাঠা, সরল প্রকৃতির মানুষ। কনকেন্দুর মনে আছে একবার কলকাতার বাড়িতে মালতী দেবী নবেন্দুকে বাজারে পাঠিয়েছিলেন খাসির মাংস আনতে। ঘণ্টাদুয়েক পরে নবেন্দু খালি হাতে ফিরে এল।
কী ব্যাপার? নবেন্দু বলল, “পাঁঠা-খাসিরা স্ট্রাইক করেছে, মাংস পাওয়া যাবে না।”
পাঁঠা-খাসিরা স্ট্রাইক করেছে এ কথা শুনে মালতীদেবী, কনকেন্দুবাবু উভয়েই ধন্দে পড়েছিলেন, ব্যাপারটা কী? পরে অন্য লোকের কাছে শুনতে পেয়েছিলেন যে, পুলিশের সঙ্গে ঝগড়া করে বাজারে মাংসের দোকানিরা দোকান বন্ধ রেখেছে।
এই নবেন্দু যখন খুব ছোট তখন সে এক বছর বাৎসরিক পরীক্ষায় অঙ্কে শূন্য পেয়েছিল। তাতেই সে খুশি। কনকেন্দুবাবু তাকে বলেছিলেন, “শূন্য পেয়েই তুই খুশি?” সে কথায় নবেন্দু বলেছিল, “একেবারে কিছুই যে পাইনি, তা তো নয়, শূন্য তো পেয়েছি।”
কনকেন্দুবাবু বুঝতে পারলেন। ছাদ থেকে ধর্মের ষাঁড় অর্ধচন্দ্রকে নামানো নবেন্দুর দ্বারা কখনওই সম্ভব হবে না। অর্ধচন্দ্র নামতে না চাইলে তাকে নামানো অসম্ভব। একমাত্র কায়দা কৌশল করেই তাকে নামাতে হবে।
কনকেন্দুবাবু স্থির করলেন শ্যামপুরে চলে যাবেন। গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয়নি অনেকদিন। রেলগাড়িতে মাত্র আড়াই ঘণ্টার পথ।
শুধু দুর্যোধন আর স্কন্ধকুমারকে নিয়ে যা একটু সমস্যা।
তবে দুর্যোধনের এক ভাইপো ঘটোৎকচ কাছেই যাদবপুরে থাকে। সে এই কয়দিন এসে জ্যাঠার কাছে এখানে থাকবে। তা হলে এদিকে কোনও অসুবিধে হবে না।
॥ ৩ ॥
আর স্কন্ধকুমার? কনকেন্দুবাবু ঠিক করলেন তাকে একটা বাজারের থলেতে পুরে সঙ্গে নিয়ে শ্যামপুরে যাবেন।
বলা বাহুল্য, স্কন্ধকুমারসহ কনকেন্দুবাবুর শ্যামপুর যাত্রা খুব নির্বিঘ্নে হল না।
একটি টগবগে যুবক বেড়ালকে থলের মধ্যে ভরা যে কী কঠিন কাজ, সেটা যে কখনও এ কাজ করেছে, সে-ই শুধু বুঝবে। তার ওপরে স্কন্ধকুমার যাতে বন্ধ ব্যাগের মধ্যে দম আটকিয়ে মরে না যায় তাই চটের ব্যাগের গায়ে দুটো ফুটো করা হল।
ট্যাক্সি করে হাওড়া পৌঁছনোর আগেই স্কন্ধকুমার তার একটা ফুটো আঁচড়ে-কামড়ে বড় করে ফেলল। সেই ফুটোর মধ্য দিয়ে মুখ বের করে সে ‘ম্যাও-ম্যাও’ করে এই বন্দিদশার প্রতিবাদ করতে লাগল।
ট্যাক্সিওয়ালা প্রথমে বুঝতে পারেনি। কিন্তু যখন সে বুঝতে পারল তার গাড়িতে একটা বেড়াল রয়েছে, সে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল, আর যাবে না।
কারণ, ট্যাক্সিচালকেরা, শুধু ট্যাক্সিচালক কেন, প্রায় সব গাড়ির চালকই মনে করে বেড়াল খুবই অমঙ্গুলে। গাড়ি চালানোর সময় রাস্তায় সামনে দিয়ে যদি একটা বেড়াল চলে যায়, সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পরে, যখন সে মনে করে অমঙ্গলের প্রভাব কেটে গেছে, তখনই আবার গাড়ি চালায়। যদি তা না করে, ট্যাক্সিওলাদের ধারণা, তা হলে দুর্ঘটনা অনিবার্য।
সেই বেড়াল সশরীরে ট্যাক্সির মধ্যে। ট্যাক্সিওলা গাড়ি থামিয়ে কনকেন্দুবাবুকে বেড়ালের ব্যাগসমেত রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে ভাড়া-টাড়া কিছুই না নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে চলে গেল।
অগত্যা কনকেন্দুবাবু একটা রিকশা নিলেন। ততক্ষণে স্কন্ধকুমার থলে ছিড়ে প্রায় বেরিয়ে পড়েছে।
রিকশা নিয়ে প্রথমে একটা মুদিখানা দোকানে গেলেন কনকেন্দুবাবু, সেখান থেকে এক বড় আকারের বাজারের থলে কিনলেন। তারপর সেই থলের মধ্যে স্কন্ধকুমার সুদ্ধ আগের থলেটা ঢুকিয়ে দিলেন। তারপরে বড় থলেটার মুখটা গিট দিয়ে বাঁধলেন। এবার আর হাওয়া-বাতাসের অসুবিধে রইল না।
এরপর বিপদ কিছু কম হয়নি। রেলগাড়ির কামরায় চেকার উঠে প্রথমেই কনকেন্দুবাবুর হাতে শক্ত করে ধরা থলেটার দিকে তাকালেন। স্কন্ধকুমার তখন ম্যাও ম্যাও করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, আর আওয়াজ করছে না। তবে থলের মধ্যে বেশ নড়াচড়া করছে। বাইরে থেকে সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
যাত্রীগাড়িতে জীবজন্তু নিয়ে যাতায়াত নিষেধ। চেকার সাহেব এসে কনকেন্দুবাবুকে ধরলেন, “আপনার ব্যাগের মধ্যে কী আছে?”
চেকারসাহেব ভেবেছিলেন বোধ হয় কুকুরছানা অথবা হাঁস-মুরগি জাতীয় কিছু হতে পারে। কিন্তু কনকেন্দু যেই বললেন, “একটা বেড়াল আছে”, চেকার তাড়াতাড়ি ত্রস্তভাবে টিকিট-ফিকিট চেক না করেই পাশের কামরায় চলে গেলেন।
অনেককাল আগে অল্পবয়সে চেকারসাহেব যখন ইস্কুলের নিচু ক্লাসে পড়তেন তখন একবার বেড়ালের ওপর রচনা লিখে আনতে বলেছিল। চেকারসাহেব ভেবেছিলেন, বেড়ালের ওপর রচনা মানে বেড়ালের গায়ের ওপরে লিখতে হবে। তিনি বুঝতে পারেননি যে, আসলে বেড়াল বিষয়ে রচনা লিখে আনতে বলেছে। ফলে একটা বুড়ো বেড়াল ধরে সেটাকে চিত করে শুইয়ে তার পেটের ওপরে রচনা লেখার চেষ্টা করেছিলেন। কলমের নিবের খোঁচা খেয়ে বেড়াল খেপে গিয়ে বালক চেকারসাহেবকে আঁচড়ে-কামড়ে রক্তারক্তি করে দেয়। সেই থেকে এই চেকারসাহেব বেড়াল দেখলেই ভয় পান।
চেকারসাহেব কেন পালিয়ে গেলেন সেটা বুঝতে না পারলেও, এরপর নির্বিবাদে কনকেন্দুবাবু স্কন্ধকুমারকে নিয়ে শ্যামপুরে পৌঁছলেন।
॥ ৪ ॥
এই চেকারসাহেবের মতোই বাছুর বয়েসে অর্ধচন্দ্র বেড়াল দেখলে খুব ভয় পেত।
ককেন্দুবাবুর মনে আছে, সে-সময় অর্ধচন্দ্রকে তার প্রিয় খাদ্য কপির ডাঁটা, কলার খোসা, রাঙা আলু দেওয়া হলেও যদি কাছেপিঠে কোনও বেড়াল থাকত, সে কিছুতেই খাবারের লোভেও আসত না, বরং নিরাপদ দূরত্বে পালিয়ে যেত।
অল্পবয়েসের ভয়ভীতি বেশি বয়সেও যায় না। এই কথাটা মনে রেখেই আজ স্কন্ধকুমারকে কনকেন্দুবাবু নিয়ে এসেছেন, ছাদে উঠে অর্ধচন্দ্রের কাছে স্কন্দকুমারকে ছেড়ে দেবেন। বেগতিক দেখে অর্ধচন্দ্র অবশ্যই ছাদ ছেড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসবে।
পরিকল্পনা মতো কাজ হল।
বাড়িতে পৌঁছেই নবেন্দুকে সঙ্গে নিয়ে বেড়ালের থলে হাতে ছাদে উঠে গেলেন।
অর্ধচন্দ্র একবার দেখেই কনকেন্দুবাবুকে চিনতে পারল। সে এগিয়ে এসে গলা বাড়িয়ে দিল আদর খাওয়ার জন্যে।
এখন বিশাল একটা ষাঁড়ে পরিণত হয়েছে অর্ধচন্দ্র। তার ওপরে গোবরে- চোনায়, তরকারির খোসায় পুরো ছাদটা নোংরা করে রেখেছে।
এইরকম পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে খুব সন্তর্পণে ডান হাত দিয়ে অর্ধচন্দ্রের গলায় আলতো করে হাত বোলাতে বোলাতে তিনি ব্যাগটা নবেন্দুকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “নে, ঝোলাটা খুলে দে।”
ঝোলার মধ্যে কী আছে, সেটা নবেন্দুর জানার কথা নয়। ব্যাগ খুলতেই ফ্যাঁচ করে দাঁত বের করে স্কন্দকুমার নবেন্দুকে তাড়া করে গেল।
ব্যাপারটা যে কী, নবেন্দু কিছুই বুঝতে পারল না বটে, অর্ধচন্দ্র কিন্তু বেড়াল দেখেই চিনতে পেরেছে। খুব ভয় পেয়ে সে দ্রুত পিছিয়ে গিয়ে ছাদের কার্নিস ঘেঁষে দাঁড়াল।
কনকেন্দু ভয় পেলেন। ছাদের কার্নিস ভেঙে অর্ধচন্দ্র নীচে না পড়ে যায়, সে বড় ভয়াবহ ব্যাপার হবে।
কিন্তু ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিল। সামনে অতবড় একটা ষাঁড় দেখে স্কন্ধকুমার তার নিজের স্বভাবমতো একলাফে গিয়ে অর্ধচন্দ্রের কাঁধে গিয়ে বসল।
অর্ধচন্দ্র দু’বার কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে চেষ্টা করল স্কন্ধকুমারকে ফেলে দিতে। কিন্তু পারল না। এর পর অর্ধচন্দ্র দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে নবেন্দু এবং কনকেন্দুবাবুকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে সিঁড়ি দিয়ে হুড়মুড় করে নীচে নেমে গেল।
চারদিকে সম্পূর্ণ অপরিচিত পরিবেশ। ঘটনার আকস্মিকতায় স্কন্ধকুমার বিচলিত হয়ে অর্ধচন্দ্র নীচে নামতেই তার ঘাড় থেকে লাফিয়ে নেমে গেল। সামনের ভাঁটফুলের ঝোপ, কচুবন ভেদ করে অর্ধচন্দ্র পড়িমরি করে ছুটতে লাগল।
ততক্ষণে কনকেন্দুবাবুও নীচে নেমে এসেছেন। ভাগ্য ভাল, তার কিংব্বা নবেন্দুর বিশেষ কোনও চোট লাগেনি। নীচে নেমে, স্কন্ধকুমার তাঁর কাঁধে ওঠার আগেই তিনি তাকে কোলে তুলে নিলেন। সেদিন পুরো একবাটি ঘন দুধ স্কন্ধকুমারকে দেওয়া হল।
নবেন্দু লোক ডেকে ছাদ ঝেড়েমুছে পরিষ্কার করে ফেলল। তারপর ছাদের দরজায় তালা দিয়ে দিল।
অবশ্য তার বোধ হয় প্রয়োজন ছিল না। স্কন্ধকুমার এখন কিছুদিন শ্যামপুরেই থাকবে। এবং সম্ভবত অর্ধচন্দ্র এদিকে সহজে আসবে না। মধ্যে মধ্যে তাকে দেখা যায় দূরে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের পুরনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে কনকেন্দুবাবুদের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ফোঁস ফোঁস করে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়তে।
২০ মার্চ ২০০০
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন