পৌলোমী সেনগুপ্ত
বাতাসে ফুটবলের গন্ধ উড়তে আরম্ভ করলেই আমাদের বাড়িতে মামার উপস্থিতি অনিবার্য। বাবা বলতেন, পাকা কাঁঠাল ভাঙলেই যেমন ভনভনিয়ে মাছি উড়ে আসে, তেমনই ফুটবল হলেই মামা হাজির। আমার এই ফুটবল-খ্যাপা মামার সঙ্গে ইতিপূর্বে যাঁদের পরিচয় হয়েছে তাঁদের কাছে মামা সম্পর্কে আর নতুন করে কিছু বলার নেই। এবার মামা শুধু মামিমাকে সঙ্গে নিয়েই এলেন না, সঙ্গে আনলেন নবদাকে। নবদার পুরো নাম নবগোপাল বসু। কিন্তু ওই নামে তাকে বিশেষ কেউ ডাকে না। সব বয়সি লোকেরাই তাকে ‘নবদা’ বলে ডেকে আসছে। নবদা দূর সম্পর্কে আমাদের কেমন দাদা হয় সে নিয়ে আমরা কখনও মাথা ঘামাইনি। আমরা নবদার গল্প শুনতেই আগ্রহী। মামা সম্পর্কে নবদা বলে, “মামা ফুটবলের খ্যাপা। কিন্তু খেলাটার মাথামুন্ডু কিছুই বোঝে না, বোঝবার চেষ্টাও করে না।”
আর নবদা সম্পর্কে মামার মন্তব্য, “একটি বৃহৎ পাঁঠা। মুখে বুলি ফুটনের পর থেইক্যা সজ্ঞানে একটাও সাচা কথা কয় নাই। লোকে ব্যাংক থেইকা ওভারড্রাফট নেয়। নবটা মিথ্যার ওভারড্রাফট লয়।”
আমাদের পরম সৌভাগ্য, এই প্রথম দু’জনকে আমাদের বাড়িতে একসঙ্গে পাওয়া গেল। মামা সম্পর্কে অনেকেই অল্পবিস্তর জানেন, কিন্তু নবদা সম্পর্কে তেমন কিছু অনেকেই জানেন না। সেই কারণে আমরা নবদাকে যেমন জানি তার কিছু পরিচয় দিয়ে রাখলে নবদাকে বুঝতে সুবিধে হবে। অন্তত কেউ তাকে ভুল বুঝবে না। নবদা একসময় দারুণ ফুটবল খেলত। মামার ভাষায় অবশ্য দারুণটা ‘নিদারুণ’। খেলতে খেলতেই নবদা কলকাতার প্রথম ডিভিশনের একটা ছোট টিমে চান্স পেয়ে গেল। টিম যত ছোটই হোক, কলকাতার প্রথম ডিভিশনে খেলার সুযোগ পাওয়া তো কম কথা নয়। নবদা অবশ্য বলেছিল, তাদের জনাইয়ের বাড়ির বারান্দায় দু’হাঁড়ি মনোহরা নিয়ে ইস্টবেঙ্গল, বাড়ির উঠোনে নকুড়ের কড়া পাকের সন্দেশ নিয়ে মোহনবাগান আর বাড়ির সামনে যে লাউগাছের মাচা সেই মাচার নীচে হাঁড়িভরতি মটন টিকিয়া নিয়ে মহমেডান স্পোর্টিং হত্যে দিয়ে বসে ছিল। কিন্তু নবদা টাকা এবং খাদ্যের লোভে আদর্শচ্যুত হয়নি। সবাইকে এক গ্লাস করে ঘোলের শরবত খাইয়ে করজোড়ে বিদায় করেছিল। বিদায়কালে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান এবং মহমেডানের বিরুদ্ধে আমি অন্যদের দিয়ে গোল করাব কিন্তু নিজে কখনও গোল করব না।
নবদার এই কথা শুনে মামা মন্তব্য করেছিলেন, “নব একটা ব্যাপারে সাচা কথা কইছে। প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। এক বছরই খেলছিল। মোট দশটা খেলায় মাঠে নাইম্যা আটবারের বেশি পায়ে বল ঠেকাইতে পারে নাই। আমি তো চোখে বাইনাকুলার লাগাইয়া গোটা মাঠে ভাইগানারে খুঁজি। কোথায় আমার নব। হেই নব এক বছর কইলকাতার মাঠে খেইলা পরে শুনি নিজের গ্রামে গিয়া কোচ হইয়া বইসে।”
নবদা নিজের গ্রামে এখন ফুটবলের কোচ। এইবারের বিশ্বকাপে নবদার নাকি ফ্রান্স থেকে নিমন্ত্রণ এসেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর যেতে পারেনি। না যাওয়ার কারণটাও বড় বিচিত্র। বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে নিজের বাড়ির আমগাছ থেকে নাকি দেড় কিলো ওজনের একটা ডাঁসা ফজলি মাথায় পড়ে। সেই আঘাত এতই গুরুতর যে, সরকারি হাসপাতালে ফার্স্ট এড নিতে হয়েছিল। অভিজ্ঞ ডাক্তাররা নবদার মাথা আর আম দুটোকে দেখতে দেখতে বলেছিলেন, “এই জিনিস পড়েও যে আপনার মাথা ফাটেনি এটাই তো আশ্চর্য।”
নবদা বলেছিল, “আপনারা ভুলে যাচ্ছেন, আমি একজন ক্যালকাটা মাঠের ফুটবলার। মাথার যে-কোনও জায়গা দিয়ে হেড করতে পারতাম। একজন দক্ষ হেডার হিসেবে আমার সুনাম ছিল।”
আমরা বললাম, “তুমি কি শুধু এইজন্যই গেলে না?”
নবদা একবার মামার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল, “এ ছাড়া অন্য একটা কারণও ছিল। আফটার অল মামার রিকোয়েস্ট তো ফেলতে পারি না।”
আমরা সবাই মামার দিকে তাকালাম। মামা পানের ভেতর থেকে সুপুরির বড় কুচিগুলো বেছে বেছে ফেলে দিচ্ছিলেন। মামা আমাদের দিকে না তাকিয়েই বললেন, “সারা জীবন পায়ে বল লাগাইতে পারলি না, তুই আবার হেডার। তবে আমার যদি টাকা থাকত, তাইলে তরে আমি ফ্রান্সে পাঠাইতাম। তর পক্ষে এখন কইলকাতার থেইকা ফ্রান্স নিরাপদ।”
নবদা ফুঁসে উঠে বলে, “ফ্রান্স নিরাপদ, কলকাতা নিরাপদ নয় কেন? তুমি কী বলতে চাইছ মামু?”
মামা পান মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে বললেন, “ফ্রান্সে তো তরে কেউ চেনে না, তর ভাষাও বুঝব না। গ্যালারিতে বইস্যা তালিবালি কথা কইলেও ওরা কিছু করব না। মানে গ্যালারির মধ্যে কিল-চড় খাইয়া মরণের ভয় ছিল না। শুধু এইখানে আছে। তাই কই কি কথাটা কম কইস।”
নবদা সোফা থেকে দুম করে উঠে দাঁড়াল। কোমরে হাত দিয়ে বলল, “হোয়াট ডু ইউ মিন মামু? তুমি কী বলতে চাইছ?”
মামা পিচ করে পানের পিক ফেলে বলেন, “আগে ইংরাজি কয়, পরে আবার নিজেই অনুবাদ কইরা কয়। ভাইগনা, আমি খালি বলতে চাইতাছি, দিনকাল ভাল না। মানুষের সহনশীলতা বেজায় কইমা গ্যাছে। দ্যাশের দাদারা দিবা-রাত্র তালিবালি কথা কইতে আছে। তুই আর এর মইধ্যে ফুটবল লইয়া তালিবালি কথা কইয়া পথেঘাটে মাইর-ধইর খাইস না।”
নবদা হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলল, “জাস্ট এ মিনিট! এক মিনিট।”
ইংরেজি বলেই সঙ্গে বাংলা বলাটা নবদার স্বভাব। আমরা এবার হেসে উঠতেই নবদা ধমকের সুরে আমাদের বললেন, “ডোন্ট লাফ। হেসো না।”
নবদা প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে একটা খাম বার করে মামার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “বলো তো এটা কী?”
মামা খামটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “একটা খাম।”
নবদা বেশ গর্বের গলায় বলল, “খামের কোনায় কী লেখা আছে?”
মামা খামটার কাছে চোখ এনে বললেন, “নবদিগন্ত। তুই কি নতুন ফ্ল্যাট কিনবি নাকি?”
নবদা বলল, “কেন? ফ্ল্যাট কিনব কেন?”
মামা বললেন, “ফ্ল্যাট বাড়ির কমপ্লেক্সগুলোর ওইরকমই নাম হয় কিনা।”
নবদা খামের ভেতর থেকে একটা চিঠি বার করতে করতে বলে, “এটা একটা সাপ্তাহিক কাগজের নাম। এই কাগজে বিশ্বকাপ নিয়ে আমাকে বিশেষজ্ঞর মতামত লিখতে হবে।”
মামা বিষম খেয়ে বললেন, “কাম সারছে। জনাই থেইক্যা তুইও ডাক পাইলি।”
নবদা চিঠিটা আমাদের দেখাতে দেখাতে বললেন, “এমনি পাইনি মামা। মনে রেখো, আমি কলকাতা মাঠের একজন এক্স-ফুটবলার।”
মামা বললেন, “তরা আমারে এক গ্লাস ঠান্ডা জল খাওয়া। ভাগ্যিস এই দ্যাশে বাংলা কাগজ কম। যদি শ-তিনেক থাকত তাইলে তো বিশেষজ্ঞের আকাল পড়ত। তবে ওর একটা সুবিধা আছে।”
নবদা তার ব্যাগ থেকে বাদামি কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট বার করতে করতে বলল, “কীসের সুবিধে?”
মামা বললেন, “তুই তো সপ্তাহে একদিন লেখবি। রোজকার কাগজে রোজ যা লেখব, হেইগুলি দিব্যি টুইকা দিতে পারবি। লোক অত মনে রাখব না।”
আমি বললাম, “নবদা, তোমার ওই প্যাকেটে কী আছে?”
নবদা বললেন, “চুইংগাম। টিভিতে খেলা দেখার সময় কাজে লাগবে।”
মামা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, “নব রে যে আমি পাঁঠা কই হেইটা কি সাধে কই। খ্যালব ওরা, আর নব চুইংগাম চাবাইয়া দাঁতের পাটি আলগা করব।”
নবদা মামার সামনে বসতে বসতে বলল, “অত হেলাফেলা কোরো না মামা। বিশ্বকাপ খেলাতে নিয়ে গেছেন যে কোচেরা আমি আমার যুক্তি আর লেখনীতে তাঁদের ফালাফালা করে ফেলব। ওঁদের প্রত্যেকটা ভুল আমি ধরে দেব।”
মামা বললেন, “এইডা তুই ভালই পারবি। অন্যের ভুল ধইরা মুখে আর কলমে তুলাধুনা করতে বাঙালির চাইতে আর কেউ ভাল পারে না। ভাইগনা, তুই বাঙালির মান রাখ। বিশ্বকাপের আসর থেইকা আমরা কয়েক হাজার মাইল দূরে থাকলেও ঘরে থম ধইরা বইসা বিশ্বের তাবড় তাবড় কোচের মুণ্ডপাত তো করতে পারি। ঠ্যাকাব ক্যাডা। এই বঙ্গের পথেঘাটে এখন বিশেষজ্ঞের হুড়াহুড়ি। আমাগো অন্নদমাসি বারো বছর বয়স থেইক্যা দেওয়ালে ঘুইটা দেয়। আইজ পর্যন্ত একটা ঘুইটাও আকারে পারফেক্ট গোল করতে পারে নাই। হেই মাসি টিভির সামনে বইসা কয়, সাহেবগুলার নিশানা ঠিক না। রোনাল্ডো থেইক্যা মাথা কামানো খেলোয়াড় দেখলেই কয়, দাদা ওগরে কি এই বয়সে পৈতা হইল। মাথা কামাইছে ক্যান। কিছুই কওন যায় না, কোনও এক দিগন্ত থেইক্যা বিশেষজ্ঞের মতামত দেওনের জন্য হয়তো বা অন্নদমাসির কাছেও প্রস্তাব আইতে পারে।”
আমরা চুইংগামের প্যাকেটের দিকে হাত বাড়াতে যাওয়ার আগেই নবদা প্যাকেট খুলে সবাইকে দিয়ে অবশেষে মামাকে বলল, “মামু চলবে নাকি?”
মামা বললেন, “ব্যাবাক দাঁত বান্দাইয়া ফালাইছি। ওই দাঁতে চুইংগাম চলব না। এখন ঘাটে যাওন অব্দি গামটুকু রাখতে পারলেই বাঁচি।”
রাত্রি সাড়ে ন’টার খেলা দেখার আগে নবদা মামাকে বলল, “আমার লেখার একটু নমুনা শুনবে?”
মামা একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। চেয়ার থেকে নেমে নীচে বসতে বসতে বললেন, “একটু শুনা।”
নবদা বলল, “একটু কেন?”
মামা বললেন, “একটু দিয়া শুরু করি। সহ্য করতে পারলে পুরাটা শুনুম।”
আমরা বললাম, “মামা, আপনি চেয়ার ছেড়ে নীচে বসলেন কেন?”
মামা উত্তর দিলেন, “নবর ভাষার বেগ সহ্য করতে না পাইরা যদি চেয়ার উলটাইয়া পইরা যাই, হেই কারণে চেয়ার ছাইড়া নীচে বসলাম। এতে পতনের আশঙ্কা নাই।”
নবদা তার ব্যাগের ভেতর থেকে কয়েকটা কাগজ বার করে বলল, “ডোন্ট টক! কেউ কথা বলবে না। আমি পড়া শুরু করছি।”
মামা বললেন, “ওরে, তোরা দরজা-জানলা বন্ধ কইরা এলাকায় কার্ফু জারি কর। নব এখন বিশেষজ্ঞের মতামত দিতাছে।”
নবদা কেমন লিখেছে সেটা শোনার জন্য আমাদের বেজায় আগ্রহ হচ্ছিল। আমরা বললাম, “নবদা, তুমি কোন ম্যাচটা নিয়ে লিখেছ?”
নবদা বললেন, “প্রথম লেখাটায় আমি বিশেষ কোনও ম্যাচ নিয়ে লিখিনি। যে ক’টা খেলা হয়ে গেছে আমি তারই পরিপ্রেক্ষিতে সবার ভুলগুলো ধরিয়ে দিচ্ছি।”
নবদা একজোড়া চুইংগাম মুখে দিয়ে চিবোতে লাগল। মামা বললেন, “খেলনের সময় চুইংগাম চিবায়, এ যে দেখি পড়নের সময়ও চিবাইতে আছে।”
নবদা শুরু করলেন, “ব্রাজিলের খেলার মধ্যে ওয়ান টাচের ছন্দটা আর নেই। রোনাল্ডো বুদ্ধি দিয়ে খেলতে পারছে না। ব্রাজিলের কোচের বড় ভুল, টিমটাকে রোনাল্ডো-নির্ভর করে ফেলা। অথচ রোনাল্ডোর মধ্যে সেই রিফ্লেক্স নেই। আমি যখন খেলতাম, আমার পেছনেও দু’জন পাহারাদার বসানো হত। আমি তাদের যেভাবে বোকা বানাতাম, রোনাল্ডো তা পারছে না।”
এই পর্যন্ত পড়ার পর মামা চিৎকার করে বলে উঠলেন, “ওরে, তরা ওই পাগলডারে থামা। ও যখন খেলত, পয়লা দিনেই ওর খেলা দেখার পর মাঠের একটা মাছিও ওরে গার্ড দিত না।”
নবদা গর্জে উঠে বলল, “আমি কি ভুল লিখছি?”
মামা উত্তর দেন, “বাগজোলা খালের মশা যদি গির অরণ্যের সিংহের লগে নিজের তুলনা করে তাইলে কী মনে হয় জানস?”
নবদা বলল, “কী মনে হয়?”
মামা বললেন, “মনে হয় তরে পাগলা গারদে পাঠাই, নয়তো তর হাত থেইক্যা বাচনের লেইগা আমি গারদে ঢুকি।”
নবদা পড়া বন্ধ করে বললেন, “এসব নিয়ে তোমার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই না। এখন খেলা শুরু হবে। খেলাটা আমায় স্টাডি করতে দাও।”
খেলা শুরু হওয়ার পর নবদা প্রথমে কোলে বালিশ নিয়ে বসল। সামনের টেবিলে কাগজ, দু’রকমের কলম, জলের গ্লাস, চুইংগাম, স্টপওয়াচ। মিনিট তিনেক খেলা হওয়ার পরই নবদা ঘর ছাড়ার লম্বা ফুলঝাড়ু নিয়ে এল। আমরা বললাম, “এটা দিয়ে কী হবে?”
নবদা বলল, “তোদের, বিশেষ করে, মামাকে এই ফুলঝাড়ুর সাহায্যে পয়েন্ট করে করে দেখিয়ে দেব কোথায় কী ভুল হচ্ছে। এটাকেই বলে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো।”
মামা বিশেষ কিছু বললেন না। নবদার টেবিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “নব তো দুকান সাজাইয়া বইসে। ও খেলা দেখব না দোকানদারি করব।”
খেলার মধ্যে উত্তেজনা যত বাড়ে নবদার চিৎকারও তত বাড়ে। চিলির সালাস যখন বল নিয়ে ইতালির বক্সে দুরন্ত গতিতে ঢুকছে তখন নবদা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলছে, “সালসা, বাঁ দিকের পোস্টে মার, বাঁ পায়ে নে।” গোলটা যখন হল না তখন আমাদের ঘরের মধ্যে কী যে ঘটল তা প্রথমে বোঝা গেল না। দুপ করে একটা আওয়াজ তারপরই পাখার হাওয়ায় ঘরময় ছড়িয়ে পড়তে লাগল তুলো।
ব্যাপারটা কী, সেটা বুঝে ওঠার আগেই মাসিমা আর্ত চিৎকার করে বলে উঠলেন, “আমার নয়া বালিশটারে নব ফাটাইয়া ফালাইছে। রাইতে মাথায় দিমু কী?”
মাসিমার বালিশ ফাটানোর শোকে আমাদের তখন কর্ণপাত করার অবস্থা নয়। আবার একটা বল ধরে চিলির ক্যাপ্টেন জামোরানো যখন ইতালির দু’ডিফেন্ডারকে পেছনে ফেলে ছুটছে আর কোনাকুনি ভাবে বক্সের কাছে ছুটে এসে যাচ্ছে গোলপিপাসু সালাস, তখন কাচের টেবিল নিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ল নবদা।
মামা চিৎকার করে বলছেন, “ঘরের মইধ্যে যা ঘটে ঘটুক, আমি টিভি থেইকা চোখ সরামু না।”
আমার দিদিমা বেড়াল তাড়ানোর ডান্ডা এনে নবদার পিঠে বসিয়ে দিয়ে বললেন, “অতিসাইরা, খেলা হয় ফ্রান্সে, তুই ক্যান কাচের টেবিলডার উপর উইঠ্যা খারইসস নাচতে আরম্ভ করলি। এত দামের টেবিলটা তো ফুটিফাটা হইয়া গেল।”
এই ঘটনায় নবদাকে খুব একটা বিব্রত দেখাল না। সে বলল, “লেখার টাকা পেয়ে তোমার টেবিল আমি করে দেব। আসলে জামদাগ্নি যেভাবে অ্যাটাক বানাল…”
আমরা বলি, “জামদাগ্নি কাকে বলছ, উনি তো জামোরানো।”
নবদা বলল, “ওই হল।”
হাফ টাইমে মামা ঘরের দিকে চোখ বুলিয়ে বললেন, “নব যেরকম দাপাদাপি আরম্ভ করছে তাতে খেলা শেষ হওয়া পর্যন্ত ঘরের কিছুই আস্ত থাকব না। আমার মাথাও লাথ্থি দিয়া ফাটাইয়া ফালাইতে পারে। তোরা ব্যাবাকে মিইলা নব’র হাত-পা বাইন্দা ফালা। নইলে শরীর অক্ষত রাইখা খেলা দেখন যাব না।”
খেলা যতক্ষণ চলে নবদার মুখ আর হাত দুটোই সমানতালে চলতে থাকে। দিদিমা তাঁর কাচের টেবিলের শোক তখনও ভুলতে পারেননি। নবদার দিকে একবার আগুন চোখে তাকিয়ে দিদিমা বললেন, ‘নব’র মুখে গামছা বাইন্দা দে। ওরা খেলে আর নবটা এইখানে দাপাদাপি কইরা ঘরের জিনিস ভাঙে।”
আমরা নবদাকে বললাম, “নবদা, তুমি একটু চুপ করে থাকতে পারো না?”
নবদা উত্তর দিল, “এটা তো শোকসভা নয়। ফুটবল খেলা। এখানে একটু চ্যাঁচামেচি হবেই।”
রাত সাড়ে বারোটার খেলা শুরু হওয়ার আগে দিদিমার তাড়ায় আমরা খেয়ে নিলাম। আমরা কয়েকজনে মিলে খেলা দেখছি। নবদা খুব একটা বাড়াবাড়ি করেনি। শুধু একবার উত্তেজিত হয়ে নিজেই হেড করতে গিয়ে আচমকা মামার মাথায় গোত্তা মেরে ফেলেছে। মামা দু’হাতে মাথা চেপে আমাদের বললেন, “বিশ্বকাপের ফাইনালের আগে নব আমারে মাইরা ফালাব। মাথায় এমন গুতা মারছে যে মনে হইল মানুষ না ষাড়ে গুতাইছে। মগজে ঘিলু থাকলে মাথাটা একটু নরম হয়। নব জীবনে মাথায় বল ঠেকাইয়া গোল করতে পারে নাই, কিন্তু চাইরজন ডিফেন্ডারের দাঁত ভাইঙ্গা ফালাইছে খালি মাথার গুতা মাইরা।”
নবদাকে এই সময় একটু লজ্জিত দেখাল। মিনিটখানেক চুপ করে থেকে আবার আগের মতো হাত-পা ছুড়ে চ্যাঁচাতে আরম্ভ করল। কোনও দলের গোলের পাশ দিয়ে বল গেলেই নবদা ‘গোল’, ‘গোল’ বলে চিৎকার করে ওঠে আর মামা ধমক দিয়ে বলেন, “তুই কি চোখেও কম দেখস। পোস্টের তিন হাত দূর দিয়া বল যায়, আর নব ‘গোল’ ‘গোল’ বইলা চিল্লাই।”
অনেক রাত্রে খেলা শেষ হওয়ার পর মামা বললেন, “এইবারের বিশ্বকাপে একটা জিনিস বড় চোখে লাগতাছে।”
আমরা বললাম, “কী?”
নবদা বলল, “কোন ব্যাপারটা চোখে লাগছে বলো তো। আমি নোট করে নিই।”
মামা বললেন, “দুনিয়াকাঁপানো এক-একজন প্লেয়ার। এরাও যদি বক্সের তিন গজ দূরে থেইকা বারের উপর দিয়া বল মারে তাইলে আর ভাইচুং-বিজয়নদের খামাখা গাল পাড়ি ক্যান। ওরাও তো তাই করে।”
নবদা সঙ্গে সঙ্গে কীসব যেন লিখতে লাগল। মামার ঘরেই নবদা’র শোয়ার ব্যবস্থা। আমরা ভাইয়েরা মিলে নিজেদের ঘরে শুতে যাওয়ার আগে বুঝিনি যে, মামা আর নবদার এক ঘরে শোয়াটা গভীর রাতে কোনও অঘটন ঘটাতে পারে। আমাদের তখনও ভাল করে ঘুম আসেনি। হঠাৎ আমাদের দরজায় ধাক্কা। বাইরে থেকে দিদিমা আর মামিমার উত্তেজিত গলা।
আমরা দরজা খুলে বাইরে আসতেই দিদিমা বললেন, “তোরা সবাই রাস্তা গিয়া দ্যাখ। লোহার ডান্ডা লইয়া পরেশ নব’রে তাড়া করছে।”
আমরা তো হতবাক। সবাই বাইরে এসে দেখি নবদা একটা উঁচু পাঁচিলের ওপর বসে আছে আর মামার হাতে একটা লিকলিকে লোহার শিক। আমরা দেখি মামা নীচ থেকে শাসাচ্ছেন, আর উঁচু থেকে নবদা বলছে, “সরি মামা, সরি। আমি খুঁজে দিচ্ছি।”
আমরা বললাম, “কী হয়েছে?”
মামা রাগে ফেটে পড়ে বললেন, “নবটা একটা কলির পাঁঠা। শোওনের আগে আমারে ব্যাকভলির কায়দা দেখাইতে গিয়া এমন পাও চালাইল যে, আমার জলের বাটি জানালা দিয়া একেবারে রাস্তায়।”
আমরা বললাম, “এর জন্য এত কাণ্ড কেন? চলুন, আমরা বাটি খুঁজে দিচ্ছি।”
মামা গর্জন করে উঠে বললেন, “বাটি তো আমি পাইছি। কিন্তু বাটির মইধ্যে যে দাঁত ভিজাইয়া রাখছিলাম, হেই দাঁত গেল কোথায়?”
সমস্যাটা গুরুতর। আমরা টর্চ জ্বেলে রাস্তায় মামার দাঁত খুঁজতে লাগলাম। মামিমা জানলা দিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, “খবরদার, রাস্তায় পড়া দাঁত তর মামা যেন মুখে না তোলে।”
আমাদের শোরগোলে অন্যান্য বাড়ির লোক জেগে উঠেছে। নবদা যে বাড়ির পাঁচিলের ওপর উঠে বসেছে সেই বাড়ির মহিলারা তাদের পাঁচিলের ওপর লোক দেখে ‘চোর’ ‘চোর’ বলে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে আর নবদা তাদের বোঝাবার চেষ্টা করছে, “আমি চোর নই। আমি একজন এক্স ফুটবলার। প্লিজ় আন্ডারস্ট্যান্ড মি, আমাকে বোঝার চেষ্টা করুন।”
ইতিমধ্যে পেট্রোল ডিউটি দেওয়া পুলিশ জিপ এসে হাজির। এক পুলিশ অফিসার জিপ থেকে নেমে বললেন, “কী হচ্ছে এখানে? টর্চ জ্বেলে কী খুঁজছেন?”
মামা উত্তর দিলেন, “আমার দাঁত।”
পুলিশ অফিসারের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। তিনি বললেন, “দাঁত! মুখের দাঁত রাস্তায় খুঁজছেন? আসল ব্যাপারটা কী?”
জিপ গাড়ির হেডলাইটের জোরালো আলোয় রাস্তা আলোকিত। আমার ভাই হঠাৎ সোল্লাসে চিৎকার করে বলল, “ওই তো মামুর দাঁত।”
আমরা দেখলাম, সেটি নর্দমার জলে শান্ত হয়ে পড়ে আছে। মামা দাঁতের পাটি দেখলেন। বিষণ্ণ গলায় বললেন, “এই দাঁত কি আর মুখে তোলন যাব!”
নবদা ততক্ষণে নেমে এসে বলল, “বাকি রাতটুকু ডেটল জলে ভিজিয়ে রাখো। তা হলে আর অসুবিধে নেই।”
দিদিমা আর মামিমা প্রবল আপত্তি করলেন। মামিমা বললেন, “ওইটা নব’র মুখে ঢুকাইয়া দে।”
দিদিমা বললেন, “কইলকাতায় খোলা ম্যানহোলের অভাব নাই। দুই পা হাঁটলেই পাবি। তার মইধ্যে ওই দাঁত আর নব দুইটারেই ফালাইয়া দে।”
মামা নবদার দিকে তাকালেন। ঠোঁটে হাসি। এগিয়ে এসে পিঠে হাত রেখে বললেন, “আর রাগ নাই। তোর ব্যাকভলিটার কথা ভাবতাছি। দুই বাই এক ফুটের জানালা দিয়া তুই তো বাটিটারে ঠিক বাইরে পাঠাইতে পারছস। তোর এই জিনিসটা আমারে মুগ্ধ করছে। এই দ্যাশের কত পোলা সুযোগ না পাইয়া বইস্যা গেল।”
বাইরে তখন রাতশেষের মৃদুল হাওয়া। নবদার কাঁধে হাত দিয়ে মামা এগিয়ে যাচ্ছেন বাড়ির দিকে। আমরা তখনও দাঁত পাহারায় দাঁড়িয়ে।
৪ নভেম্বর ১৯৯৮
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন