পৌলোমী সেনগুপ্ত
পায়রাডাঙা স্টেশনে নবকৃষ্ণ যখন ট্রেন থেকে নামল তখন রাত দশটা। গাঁ-গঞ্জ জায়গা, সন্ধেরাতেই ঝিমিয়ে পড়ে। শীতের রাত দশটায় চারদিক একেবারে শুনশান। ট্রেনটাও বেজায় ফাঁকা ছিল। দু’-চারজন যাত্রীর কেউই পায়রাডাঙায় নামল না। নবকৃষ্ণ একা।
স্টেশনটা এতই নির্জন যে, গাড়ি ছাড়বার ঘন্টিটা পর্যন্ত কেউ বাজাল না। গাড়ি নবকৃষ্ণকে নামিয়ে দিয়ে নিজেই চলে গেল। টিকিটঘর আর অফিসঘরে উঁকি দিয়ে নবকৃষ্ণ দেখল, দরজায় তালা ঝুলছে, ভেতরে অন্ধকার।
গা-টা একটু ছমছম করল নবকৃষ্ণর। কৃষ্ণপক্ষের রাত। চারদিক এমন কালিচাপা অন্ধকার যে, পথঘাট চেনার জো নেই। তার শ্বশুরবাড়িটাও বেশ দূর। মাইল দুই দূর তো হবেই। রাস্তাও বেশ প্যাঁচালো। এই অন্ধকারে সেখানে পৌঁছনো শক্ত। খবর একটা পাঠিয়েছিল বটে নবকৃষ্ণ, তবে পোস্টকার্ডটা বোধহয় সময়মতো এসে পৌঁছয়নি। পৌঁছলে স্টেশনে লোক থাকত।
সুটকেস হাতে স্টেশনের বাইরে এসে নবকৃষ্ণ হতাশ চোখে ইতিউতি তাকাতে লাগল। রাস্তাঘাট দেখা বা চেনার উপায় নেই। সেই বিয়ে করতে এসেছিল তিন মাস আগে, তারপর এই দ্বিতীয়বার আসা। পথঘাট চেনার কথাও নয় তার।
কে যেন খিক করে একটু হাসল।
নবকৃষ্ণ চমকে উঠে বলল, “কে?”
একটি মিনমিনে গলা বলে উঠল, “ঘাবড়ে গেলেন নাকি জামাইদাদা?”
নবকৃষ্ণ একটু ভরসা পেয়ে বলল, “অ, তা হলে চিঠি পেয়েছে ওরা! তুমিই নিতে এসেছ নাকি আমাকে? সুমুখে এসো বাপু, অন্ধকারে তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না যে!”
আবার খিক করে একটু হাসি।
“জামাইদাদার কথা শুনে হাসি পায়। সুমুখেই তো দাঁড়িয়ে আছি।”
“সে কী! দেখতে পাচ্ছি না যে! কে বলো তো তুমি!”
“আজ্ঞে, অধমের নাম শ্রীদাম। বিয়ে করতে যখন এয়েছিলেন তখন যারা আপনার পালকি ঘাড়ে করে নিয়ে গিয়েছিল আমি তাদের মধ্যে একজন। ওঃ, তোফা খাইয়েছিলেন বটে আপনার শ্বশুরমশাই। এই অ্যাত বড় মাছের ল্যাজা, পাঁটার ঠ্যাং, বড় বড় রসগোল্লা, এই অ্যাত্ত বোঁদে। ওঃ, এখনও ভাবলে যেন প্রাণ ঠান্ডা হয়।”
“তা পালকিটালকি কিছু এনেছ নাকি?”
“পালকি! না মশাই, পালকিটালকি কোথায় পাব!”
“তা হলে কি হেঁটেই যেতে হবে! টর্চ বা হারিকেন আনোনি?”
“ও বাবা, আলোটালো আমার মোটেই সহ্য হয় না।”
“তা হলে যাব কী করে?”
“তাড়াহুড়োর কী আছে! আপনার শালার বিয়ে তো পরশু। এখানে এই সিঁড়িতে চেপে বসে থাকুন, দুটো সুখ-দুঃখের কথা হোক। ভোর ভোর আলো ফুটলে রওনা হয়ে যাবেন। কপাল ভাল থাকলে ওদিকপানে যাওয়ার গোরুর গাড়িও পেয়ে যেতে পারেন।”
“স্টেশনে বসে থাকব! বলো কী। খিদে-তেষ্টা বলেও তো কথা আছে।”
“আ, কী কথাই শোনালেন। কতকাল আমার খিদে নেই, তেষ্টাও নেই। খিদেতেষ্টা শুনলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়।”
“খিদে পায় না। আশ্চর্য। খিদে পায় না কেন হে? পেটে বায়ু হয় নাকি?”
“আজ্ঞে, বায়ুর কথা আর কবেন না। বায়ুই তো খেয়েছে আমাকে। শুধু পেট কেন, হাত পা মগজ সবই বায়ুভূত কি না।”
“বাপ রে! এত বায়ু কারও হয় বলে তো জানতুম না। যাকগে বাপু, আমার আর কথা কওয়ার সময় নেই। এখনই রওনা হতে হবে। তোমার খিদেতেষ্টা না থাকলেও আমার আছে। চলো, রওনা হওয়া যাক।”
“আমি। আমি কেন যাব? আমার কী ঠেকা মশাই?”
“তুমি কি আমাকে নিতে আসোনি?”
“না তো। শ্রীদাম দাস এখন আর কারও চাকর নয়, বুঝলেন?”
“অ। তা হলে বাপু আগড়ম বাগড়ম বকে আমার সময় নষ্ট করছ কেন? আর স্টেশনেই বা এসেছ কেন?”
“সে আমার ইচ্ছে। এখন আমি কারও খাইও না, পরিও না। হাতে দেদার সময়। ইদিক-সিদিক ঘুরেটুরে বেড়াই। বেশ লাগে।”
“তা তোমার চলে কীসে?”
“কেন, চলার অসুবিধে কী? আগে খিদেতেষ্টা ছিল, তাই সমস্যাও ছিল। এখন ওই আপদ-বালাই চুকে গিয়ে দিব্যি আছি।”
“হুঁ, বুঝলুম। কিন্তু তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন বলো তো!”
“দেখবেন কী করে? শরীর থাকলে তো দেখাদেখি! আমার সে বালাইও নেই যে।”
“অ্যাঁ!”
“এতক্ষণে বুঝলেন নাকি? তিন মাস হল, সন্ন্যাস রোগে পটল তুলেছি।”
নবকৃষ্ণর ভয় পাওয়ার কথা। পাচ্ছিলও সে। কিন্তু মুশকিল হল, অন্ধকার রাত, প্রচণ্ড খিদেতেষ্টা এবং শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছনোর অনিশ্চয়তায় তার ভয়ের চেয়ে বেশি হচ্ছিল রাগ। লোকটার কথা শুনে বুকটা একটু ধড়াস ধড়াস করল বটে, কিন্তু মাথাটাও গরম হয়ে গেল। সে একটু রাগের গলায় বলল, “মরে মাথা কিনে নিয়েছ নাকি? খুব যে চ্যাটাং চ্যাটাং কতা কইছ!”
খিক করে একটু হেসে শ্রীদাম বলল, “যাক, জামাইদাদা তা হলে ভয় খেয়েছেন। গলাটা একটু কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে।”
নবকৃষ্ণ এবার একটা হুংকার ছেড়ে বলল, “কে বলে গলা কাঁপছে! কে বলে ভয় খেয়েছি?”
“খাননি। খুব খেয়েছেন। ভয় খাওয়ারই কথা কিনা।”
নবকৃষ্ণ এবার কঠিন গলায় বলল, “আমি কার নাতি জানো?”
“কার?”
“বটকৃষ্ণ রায়ের নাম শুনেছ?”
“আজ্ঞে না!”
“বটকৃষ্ণ রায়ের নাম না শুনেই ভূতগিরি করে বেড়াচ্ছ? বলি এ-লাইনে থাকতে হলে নামটা জেনে রাখো।”
“জামাইদাদা যে বেজায় গরম খাচ্ছেন দেখছি! তা আপনার ঠাকুরদা এমন কে লাট-বেলাট যে তাকে সেলাম বাজাতে হবে? কারও ধার ধারি না মশাই, এই বলে রাখছি।”
“তোমার যে পাখনা গজিয়েছে তা বেশ বুঝতে পারছি। তবে অত বাড় বেড়ো না হে। বলি বাদুড়বিদ্যে কাকে বলে জানো।”
“বাদুড়বিদ্যে! না মশাই, জম্মে শুনিনি।”
“সেইজন্যই অত চ্যাটাং ট্যাটাং কথা। আমার ঠাকুরদার এখন আটানব্বই বছর বয়স। এখনও গাছের ডালে ঝুলে হেঁটমুন্ডু হয়ে পাক্কা ছ’ঘণ্টা ধরে প্রতিদিন সাধনা করেন।”
খিক করে একটু হাসি, শ্রীদাম বলল, “আহা, কী কথাই শোনালেন। আমি তো সারাদিন গাছে গাছে ঝুলে থাকি।”
“তোমার ঝোলা আর বটকৃষ্ণ রায়ের ঝোলা তো এক নয় বাপু। তিনি স্কুলে বাদুড়বিদ্যে সাধনা করেন, আর তুমি ঝুলে সময় কাটাও। শোনো হে শ্রীদাম, আমার দাদুর পাঁচশো চাকরভূত আছে। তারা সব ভাল ভূত, ফাইফরমাস খাটে, দাদুকে ভালও বাসে খুব। আবার কিছু ব্যাদড়া পাজি ভূতও আছে তোমার মতো। দাদু মস্ত কবরেজ। দুরারোগ্য নানা ব্যাধি নিয়ে লোকে তাঁর কাছে আসে। বিটকেল একটা বাতব্যাধি আছে যার ওষুধ আয়ুর্বেদে নেই। দাদু কী করেন জানো? পাজি ভূত গোটা দশ-বারো ধরে এনে ঘুরনযন্ত্রে ফেলে চটকে ভূতের রস নিংড়ে বের করে তাই দিয়ে ওষুধ বানান। দাদুর কাছেই শুনেছি, সে ওষুধ শুধু পাজি ভূতের রস দিয়েই তৈরি করতে হয়। ভাল ভূত দিয়ে হয় না।”
এবার শ্রীদামের হাসি শোনা গেল না। বরং একটু উদ্বেগের সঙ্গেই বলল, “এ তো অন্যায় কথা!”
“কীসের অন্যায়? মানুষের উপকারে লেগে ভূতগুলোর তো পুণ্যই হচ্ছে। তবে রস বের করার পর ছিবড়ে ভূতগুলোর খুব কষ্ট।”
“তা ভূতের ছিবড়েরা তখন কী করে?”
“কী আর করবে? আঁস্তাকুড়ে পড়ে থাকে। কুকুর বেড়াল এসে শুঁকেটুকে অপকর্ম করে যায় তাদের গায়ে। ছিবড়েদের নড়াচড়ারও ক্ষমতা থাকে না কি না। আর সেই ঘুরনযন্ত্র দেখলে তুমি মূৰ্ছা যাবে। বড় বড় দাঁতওলা দুটো লোহার চাকায় যখন ভূত পেষাই হয় তখন তাদের চিৎকারে কান পাতা দায়।”
এবার শ্রীদামের গলা একটু কাহিল শোনাল, “তা ইয়ে, তাদের ধরা হয় কী করে?”
“ওই বাদুড়মন্ত্র দিয়ে। সে এমন মন্ত্র যে ভূতেরা সব পড়িমরি করে ছুটে এসে দাদুর সামনে ধড়াস ধড়াস করে পড়তে থাকে। বাদুড়মন্ত্র বড় সাংঘাতিক জিনিস হে। তাই বলছিলুম, ভূতগিরি করো বটে, কিন্তু এখনও অনেক কিছুই জানো না দেখছি। দাদুর ইদানীং সমস্যা হয়েছে কী জানো?”
“কী সমস্যা?”
“গদাধরপুরে আর পাজি ভূত বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। সব পেষাই হয়ে গেছে। তাই দাদু বলছিলেন, ওরে, পাজি ভূতের সন্ধান পেলে আমাকে জানাস তো। গিয়ে ধরে নিয়ে আসব।”
“তা ইয়ে, জামাইদাদা, আপনার না খিদে পেয়েছিল!”
“তা তো পেয়েইছে।”
“তা হলে আর দেরি করা ঠিক হবে না। চলুন পথটা দেখিয়ে নিয়ে যাই। দিন, সুটকেসটা আমাকে দিন।”
“না হে, তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না।”
‘না, না, ছিঃ ছিঃ, কী যে বলেন। জামাই বলে কথা। আসুন, পৌঁছে দিচ্ছি, লহমাও লাগবে না।’
তা লাগল না। হঠাৎ যেন একটা বাতাসের ঘোড়া তাকে পিঠে চাপিয়ে একেবারে উড়িয়ে নিয়ে চলল। নবকৃষ্ণ ভাল করে টের পাওয়ার আগেই দেখতে পেল, সে শ্বশুরবাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে।
বিয়েবাড়িতে লোকজন সব জেগেই ছিল। তাকে দেখে হইচই পড়ে গেল খুব।
শুধু নবকৃষ্ণের কানে কানে কে যেন বলল, “ঠাকুরদাকে আমার হদিশ আবার দিয়ে দেবেন না তো!”
নবকৃষ্ণ গম্ভীরভাবে বলল, “ঠিক আছে। আর যেন…”
“আজ্ঞে, কী যে বলেন। আর কখনও বেয়াদবি দেখবেন না।”
৪ নভেম্বর ১৯৯৮
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন