পৌলোমী সেনগুপ্ত
ভোর হয়েছে কি হয়নি, গাছের পাখিরা ডেকেছে কি ডাকব ডাকব ভাবছে, শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বড়কর্তা, বাঘমুখো রুপো বাঁধানো ছড়িখানা শূন্যে নাচাতে নাচাতে। বেরিয়েই গর্জন করে উঠলেন, “এই, কে আছিস!”
বড়কর্তার পরনে ফরসা ধবধবে কাঁচি ধুতি, গায়ে ফরসা ধবধবে মেরজাই। ধুতির ফুলকোঁচার আগাটা মেরজাইয়ের বাঁ পকেটে গোঁজা! রাতে ঘুমনোর দরুন ধুতির পাট একটু লাট খেয়ে গেছে।
বড়কর্তা তার কলকাতার বাড়িতে সকালবেলা এমন সাজে ঘর থেকে বেরোচ্ছেন, এমন দৃশ্য ভাবাই যায় না। মানে এমন সাজ করেনই না। সেখানের স্টাইলই আলাদা।
তবে বড়কর্তার মতে দেশের বাড়িতে যখন এসেছেন, পূর্বপুরুষদের তৈরি চকমিলোনো বিশাল অট্টালিকার গেট খুলিয়ে ঢুকেছেন এবং এতদিনের বন্ধ-বাড়ির শ’খানেক জানলা-দরজা খুলিয়ে পুরনো চেহারাখানা বার করে ফেলেছেন, তখন এখানে চাই পুরনো স্টাইল। বাপ-জ্যাঠার সাজসজ্জা আচার-আচরণ।
জাঁকপুরের বাবুরা এই ধরনের সাজ আর এইরকম হাঁকডাকেই অভ্যস্ত ছিলেন। তা ভুলে তো আর যাননি সে-সব বড়কর্তা? চোখের সামনে ছবি হয়ে আছে সেই শৈশব-বাল্যের দিনটিনগুলো।
আর মনের মধ্যে? সে তো আছে খোদাই হয়ে।
‘বাবুদের বাড়ি’ মানেই ‘জমিদারবাবু’দের বাড়ি। এখন আর রাম-অযযাধ্যা কিছুই নেই। কিন্তু গ্রামের লোকের মুখে মুখে বাবুদের বাড়ি নামটাই চালু হয়ে আছে।
তা বাড়িটাও তো আছে।
জীর্ণ হয়ে এসেছে বটে, তবে ঠাটবাটটি হারায়নি। হারাবে কেন, এই বছর যোলো-আঠারো আগেও তো বড়কর্তার ছোটজ্যাঠা এখানে বসবাস করে গেছেন। অতঃপর স্বর্গে গেছেন। সেই বাবদই এখানে শেষ এসেছেন বড়কর্তা।
কেন এসেছেন?
হঠাৎ খেয়াল হয়েছে নাতি-নাতনিরা কেউ এখনও পর্যন্ত দেশের বাড়ি দেখেনি। মনে হয়েই মনে হল, ভেরি ব্যাড! ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাড়ি মেরামত করার ধুম পড়েছে, দরোয়ান কাম মালি নরহরিকে চিঠি দিয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং গতকাল বিকেলে একখানি বিরাট বালখিল্য বাহিনীকে নিয়ে জাঁকপুরে এসে পৌঁছেছেন বড়কর্তা।
হইহই কাণ্ড, রইরই ব্যাপার। জমজমাটি দৃশ্য।
কী না এসেছে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে। রেকর্ড প্লেয়ার, টেপ রেকর্ডার, (ফুচুং নাকি পাখিদের কলকাকলি টেপ করবে) ডজনকয়েক গানের ক্যাসেট, ক্যারম বোর্ড, ব্যাডমিন্টন সেট, কয়েক জোড়া ম্যাজিকের তাস। ভেঁপু তো আজকাল তাসের ম্যাজিকে ওস্তাদ হয়ে উঠেছে।
এ ছাড়া বেশ কয়েকটি ‘লোকজন’। মানে ‘কাজের লোক’। অকর্মার রাজা হলেও কাজের লোকই তো বলতে হবে।
কথা আছে, আমবাগানে দোলনা টাঙানো হবে। তার জন্যে অনেক গজ মজবুত নাইলন দড়ি এসেছে। দিন-দশেকের মতো ‘পিকনিক’ কম তো না। আর মেয়ের ঘর ছেলেদের ঘর মিলিয়ে নাতি-নাতনি ও কর্তার সংখ্যাও কম না।
এসব এনেছে ওরা অনেক কিছুই দাদুকে না জানিয়ে। জানে তো বুড়োদের স্বভাব, ছোটদের সব ব্যাপারেই বাধা দেওয়ার টেনডেনসি।
কিন্তু ওরাই কি জেনেছে, দাদুও তাদের অগোচরে দর্জিকে দিয়ে গোটাকতক মেরজাই বানিয়ে এনেছেন তাঁর জ্যাঠার মতো। এনেছেন ধুতি, হরিণের চামড়ার চটি, বাঘমুখো ছড়িটা।
এনেছেন এই সব, সেটা এই ভোরবেলায় দেখা গেল।
তা এনেছেন এনেছেন বেশ করেছেন, কিন্তু ঘুম ভেঙে উঠেই এমন হম্বিতম্বি কেন? কী হল রাতারাতি? বিছানায় ছারপোকা? মশারি ভেদ করে মশার উৎপাত?
নাকি পুরনো ঘরের খাট-আলমারির তলায় ইঁদুর-ছুঁচোর হুটোপাটি?
আরও একবার ‘কে আছিস’ হাঁকতেই একমুঠো নাতি-নাতনি যার যার বিছানা থেকে উঠে এসে হতভম্ব হয়ে দাঁড়াল। দাদুর এমন রণমূর্তি কেন?
বড়কর্তা হাতের ছড়ি আর-একবার নাচিয়ে বলে উঠলেন, “আমার ঘর থেকে ‘পোর্টম্যান্টো’টা কে কোথায় সরাল? অ্যাঁ। কে সরিয়েছে?”
পোর্টম্যান্টো!
এটা আবার কী শব্দ। কোনওদিন শুনেছে বলে তো মনে পড়ছে না।
“কেউ জানিস না?”
ভেঁপু সাহসে ভর করে বলে উঠল, “পোর্টম্যান্টো আবার কী? তাই তো জানি না।”
“ও হোহো,” বড়কর্তা বললেন, “তা জানবি কোথা থেকে? শহুরে বাবুরা। পোর্টম্যান্টো হচ্ছে গিয়ে ব্যাগ। মানে সুটকেস।”
“বাঃ, তা সেটাই বলবে তো!”
“কেন বলব? এই জাঁকপুরের বাবুদের বাড়ির কর্তারা চিরকাল পোর্টম্যান্টোই ব্যবহার করে এসেছে।”
টুকলি বলে ওঠে, “তুমি সেটা মানে ও-ই ‘ম্যান্টো’ না কী এনেছ?”
“আনব কোথা থেকে,” বড়কর্তা আবার হুংকার ছাড়েন, “এখন আর ও-জিনিস পাওয়া গেলে তো! তোদের গড়িয়াহাটের দোকানিরাও তোদেরই মতন হাঁদা-ল্যাবা! বলে নামই শোনেনি। তো বাধ্য হয়ে সুটকেসকেই পোর্টম্যান্টো বলতে হচ্ছে। সে যাক, জিনিসটা ঘর থেকে উপে গেল নাকি। শোবার সময় দেখেছি কোণের দিকে টেবিলে বসনো রয়েছে, আর মাঝরাতে দেখি যে হাওয়া! মানেটা কী এর, অ্যাঁ?”
টুকলি ভয়ে ভয়ে বলল, “চুরি যায়নি তো?”
বড়কর্তা আবার একবার ছড়িটায় পাক দিয়ে নিয়ে গর্জন করে উঠলেন, “গেলে তো চুকেই যেত। চোর আর চুরির সুযোগ পেল কই? তার আগেই তো কে বা কারা সেটাকে হাতিয়েছে। দেখছি একবার। আমি তাকে আস্ত রাখব না।”
বড়কর্তার দেশের ভাইঝি চারুশীল চান করে এসে পুজোর ঘরে যাবার মুখে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, “কাকে আবার ভেঙে টুকরো করবেন গো বড় জ্যাঠামশাই?”
বড়কর্তা রুদ্রমূর্তিতে বললেন, “একধার থেকে সব্বাইকে। বলি রাতারাতি আমার পোর্টম্যান্টোটা কোথায় উধাও হয়ে গেল শুনতে পাই?”
চারুশীলা বলল, “কোথায় আবার যাবে, আমিই এ-ঘরে এনে তুলে রেখেছি। আপনার তো চারটে দরজা হাটপাট করে খুলে শোওয়া অভ্যেস। কে কখন ঢুকে পড়ে চক্ষুদান করে বসে ঠিক কী!”
বড়কর্তা হাতের ছড়ি নাচানো থামিয়ে গম্ভীর হয়ে গিয়ে বললেন, “তুমিই তুলে রেখেছ? বড় কাজ করেছ, উত্তম করেছ। বলি ওহে বুদ্ধিমতী চারুশীলা, ওই ‘চক্ষুদান’ করাটাই যাদের পেশা, তাদের উপায়টা কী হবে?”
“অ্যাঁ, কী বলছেন!” চারুশীলা হাঁ।
“বলছি, কোনও ব্যাটা চোর যদি জাঁকপুরের বাবুদের বড়কর্তার ঘরে ঢুকে কিছু হাতাতে এসে শুধু ইঁদুরে-কাটা গদির তুলো হাতড়ে মরে, তাতে বড়কর্তার খুব মান বাড়ে? প্রেস্টিজ থাকে?”
“ইদুরে-কাটা গদির তুলো হাতড়াচ্ছিল! কে? অ্যাঁ?”
একঝাঁক ছেলেমেয়ের গলা, “কে দাদু? কে?”
“কে? কপালে তো নাম-লেখা টিকিট সেঁটে আসেনি মানিক, যে বুঝব কে!” আমিও তো তাই হাঁক পাড়লাম, ‘কে রে?’ তো মিনমিন করে কে যেন বলল, ‘আজ্ঞে কেউ না।’ বোঝে ব্যাপার। পুরনো অট্টালিকা, কত কত প্রেতাত্মা আনাচে কানাচে বসবাস করছে, কে জানে। ফশ করে বালিশের তলা থেকে টর্চটা বার করে জ্বেলে দেখি, এক ব্যাটা লুঙ্গি-গেঞ্জিপরা হাড়গিলে চেহারার মূর্তিমান মাথার কাছে দাঁড়িয়ে। হাতে একমুঠো ছেঁড়া তুলো।”
‘‘তুলো! তুলো কেন দাদু? তুলো চুরি করতে এসেছিল?”
বড়কর্তা রেগে বলেন, ‘হ্যাঁ আমিও তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তুলো কী হবে রে ব্যাটা?” পাজিটা বলে কিনা, “আজ্ঞে তুলো আর কী হবে। চাবির খোঁজে গদির তলা হাতড়াচ্ছি, আর মুঠোভরতি ছেঁড়া তুলো উঠে আসছে। বলিহারি কাণ্ড! চোর ঠকানোর ফন্দি বটে!”
“শুনেছিস আস্পর্দার কথা? বললাম, ‘বলি মতলবটা কী?’ বলে কিনা,‘ মতলব তো মহৎই ছিল, তো এসে দেখছি খেটে মরাই সার! কবে থেকে গাওন-বাজনা শুনছি, বাবুদের ঘর সারানো হচ্ছে, বড়কর্তা আসছেন, তিনখানা মোটরগাড়ি বোঝাই মাল আর মানুষ আসছে, তো বলি ভগবান বুঝি এতদিনে দিন দিল। তো হরেকেষ্ট। জাঁকপুরের বড়কর্তার ঘর উটকে লবডঙ্কা! শেষমেশ গদি-ছেঁড়া তুলো।’
“বোঝো চারু, শুনে পায়ের রক্ত মাথায় চড়ে কিনা! গর্জে বললাম, ‘বদমাশ, শয়তান! চুরি করতে এসেছিস, চুরি করবি। মিথ্যে বদনাম দিবি কী জন্যে? ওই দেয়ালের ও কোণে টেবিলের ওপর একখানা পোর্টম্যান্টো বসানো নেই? নিয়ে আয় এদিকে! নগদ হাজার দু’-তিন আছে, ইচ্ছে হয় নিয়ে যা!’ ব্যাটা দাঁত বার করে বলে কিনা, ‘কর্তা বুঝি ঘুমের ঘোরে পোর্টম্যান্টোর স্বপ্ন দেখতেছিলেন? হাজার দু’-তিন টাকা! ওরে বাপ রে। হ্যাঁ ছিল বটে, আগের কালের কর্তাদের। ঠাকুরদার কাছে গপপো শুনেছি, মানে এই বংশীবদনের তো তিনপুরুষে এই একই পেশা! তো ঠাকুরদারা মুখে কালিঝুলি মাখত, গায়ে পেছলা করে তেল মাখত, এখন আর অতসব কিছু লাগে না। তো ঠাকুরদা বলেছিল, জাঁকপুরের বাবুদের বাড়িতে কাজে সুখ আছে। যেখেনে-সেখেনে সোনাদানা টাকাটা পয়সাটা ছড়ানো থাকে। কোনওমতে একবার মাথাটা গলাতে পারলেই হল। আর এখন!’ ব্যাটা মুলো মুলো দাঁত বিছিয়ে বলে কিনা, ‘এখনকার বাবুর হচ্ছেন ঢুঁঢুঁ কোম্পানি। বড়কর্তার ঘরে ঢুকে হাতের মুঠোয় উঠে এল শুধু একমুঠো গদি-ছেঁড়া তুলো! ছি ছি! হিহি!’”
বড়কর্তা আবার শূন্যে ছড়ি আস্ফালন করে বললেন, “বল, বল তোরা! এত হেনস্থায় মেজাজ ঠিক রাখা যায়? চড়চড়িয়ে প্রেশার চড়ে যাবে না? দিয়ে দিলাম হতচ্ছাড়া ব্যাটাকে মুখের মতো জবাব। ভাগ্যিস আংটিটা আঙুলে ছিল। চারুশীলাবালা সেটিও আঙুল থেকে খুলে তুলে রাখতে যাননি, জ্যাঠামশাইয়ের ঘরের দরজা খোলা থাকে বলে।”
আংটি!
সকলের দৃষ্টি পড়ল গিয়ে বড়কর্তার ডান হাতের আংটির আঙুলে। আঙুলে শুধু একটি সাদা দাগ বসে আছে, আংটি নেই।
জ্বলজ্বলে সবুজ পান্নার আংটিটা বিরাট দামি। চারুশীলা কপালে হাত চাপড়ে বলে উঠল, “কী সর্বনাশ! ও জ্যাঠামশাই, চোরটা আপনার আংটিটা নিয়ে চলে গেল!”
কেঁদেই ফেলল চারুশীলা।
নাতি-নাতনিরা একযোগে চেঁচিয়ে উঠল, “ও দাদু, তোমার সেই সুন্দর সবুজ আংটিটা চোরে কেড়ে নিয়ে চলে গেল! তুমি তার সঙ্গে গায়ের জোরে পারলে না?”
“কেড়ে!” বড়কর্তা তেড়ে ওঠে, “ভবনারায়ণ রায়চৌধুরীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গেল? একটা হাড়গিলে, একটা চামচিকে, একটা কাকতাড়ুয়া, একটা পাক্যাটি, একটা তেজপাতা, একটা ইঁদুর, ছুঁচো, আরশোলা! এই ভাবলি তোরা? ভাবতে পারলি? নাঃ, তোদের কিছু হবে না। তোরা ওই রাতদিন বসে বসে ক্যাসেট শুনবি, ক্যারম পিটবি আর নয়তো গোয়েন্দা গল্প গিলবি! কেড়ে নিয়ে গেল। হা হা হা। বলে কী বুদ্ধুরা! আঙুল থেকে খুলে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললাম, ‘নিয়ে যা ব্যাটা। জাঁকপুরের বাবুদের বাড়ি থেকে শুধু হাতে ফিরবি, এ হয় না!’ তা ত্যাঁদোড় ব্যাটা কি সহজে নিতে চায়? বলে, ‘এ আমি বেচতে গেলে ধরা পড়ব! আমার দরকার নাই।’ তবে আমি ছাড়ব? বলি, ‘না নিলে তোমার গর্দান যাবে ব্যাটা। তুমি জাঁকপুরের বড়কর্তার মুখের ওপর ছি বলে তার প্রেস্টিজ পাংচার করে দিয়ে চলে যাবে আর আমি তাই সইব? হুঁ! অত সস্তা নয়।’ তো যত নষ্টের মূল হচ্ছেন এই আমার হিতৈষী ভাইঝি চারুশীলা দেবী! পোর্টম্যান্টোটা ঘরে থাকলে চুপিসাড়ে নিয়ে চলে যেত। আর চাবি খুঁজতে গদির তুলো হাতড়াতে আসত না! যাকগে, ওসব ফালতু কথা। আজ ব্রেকফাস্টের মেনুটা কী? ব্রেকফাস্টের মেনুটা কী হে ফুচাং? যারা সব কাজের লোকটোক সঙ্গে এসেছিল তারা এখনও নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে বুঝি? কোথায় তারা? এই কে আছিস!”
কলকাতার বাড়িতে ভবনারায়ণ রায়চৌধুরী কখনও এভাবে ‘এই কে আছিস’ বলে লোকজনকে ডাকেন না, যার যা নাম তাকে তাই বলে ডাক দেন। এ-ভাবটা হচ্ছে জমিদারবাবুদের বাড়ির পেটেন্ট। যাতে একটি হাঁকে দশজন দশদিক থেকে ছুটে আসে।
এখন সকালে চড়ে উঠেছে। গাছের মাথায় মাথায় রোদ। এখন আর আংটির শোক নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না নাতি-নাতনিরা। তারা গ্রামীণ ব্রেকফাস্ট মুড়ি নারকেল কচি শশা ফুলুরি আর গরম জিলিপি নিয়ে বসেছে এবং তারিয়ে খেতে খেতে তারস্বরে মন্তব্য করছে, এমন ফাস্টক্লাস খাদ্যটাদ্য জগতে থাকতে কী দুঃখে মানুষ দিনের পর দিন সকালবেলা একঘেয়ে টোস্ট, মাখন, ডিম আর কলা নিয়ে বসে। ছিঃ।
ওদিকে মনের দুঃখু ঝেড়ে ফেলে চারুশীলাও কলকাতা থেকে আসা রান্নার নোক মলয়কুমারকে নিয়ে রান্না বোঝাতে বসেছে, এবং বড়কর্তা বলছেন, “তোদের খাওয়া হলে চল তোদের একবার সারা বাড়িটা চোরকুঠুরি থেকে চিলেকোঠা পর্যন্ত দেখিয়ে আনি। কালকে তো আসতে-না-আসতেই সন্ধে হয়ে গেল। দেখিয়ে দেব ছেলেবেলায় আমরা কোথায় খেলতাম। বাবা জ্যাঠামশাই ঠাকুরদা-ঠাকুমা কোন ঘরে থাকতেন, কোথায় বসে বাড়ির সবাই মজলিশ করতেন।”
চুমকি বলে উঠল, “সব তোমার মনে আছে দাদু?”
‘মনে নেই? বলিস কী! ছবির মতো সব চোখে ভাসছে।”
“তো এত যদি ভালবাসা তো সাতজন্মে আসো না কেন শুনি? কলকাতাতেই পড়ে থাকো কেন?”
বড়কর্তা একটু গম্ভীর হাসি হেসে বলেন, “সে আর তোকে বোঝাই কী করে? আসলে কী জানিস—’’
কিন্তু ওই ‘আসলটা’ আর জানা হয় না চুমকির। মূর্তিমান ছন্দপতনের মতো নরহরি এসে দাঁড়ায়। তার পিছনে পিছমোড়া করে বাঁধা একটা রোগা কালো দাঁতলা হাড়গিলে লোক।
“কর্তা!” নরহরি তেজি গলায় বলে, “ব্যাটাকে ধরে ফেলেছি। দেউড়ির ধারে ঘুরঘুর করছিল। বোধহয় শুধু আংটিটায় আশা মেটেনি, আরও কিছুর মতলবে…’’
নরহরির দাপট থামিয়ে দিয়ে হাড়গিলে খ্যাঁকখেঁকিয়ে বলে ওঠে, “বেশি বাহাদুরি দেখাতে এসনি নরহরি পাল! ধরেছি মানেটা কী? ধরেছি মানে কী? আমি তো নিজেই আসতেছিলাম কর্তার কাছে। তুমি শুদুশুদু গামছা পাকিয়ে বাঁধতে বসলে। তো বোসো। বয়েই গেল। কর্তা আপনার আংটিতে আমার কাজ নাই, ফেরত ন্যান। এই নরহরি পাল, হয় আমার বাঁধন খুলে দাও নচেৎ আমার ট্যাঁক থেকে আংটিটা বার করো। আচ্ছা ঝকমারি বাবুদের বাড়ি চুরি করতে এসে!”
শোনামাত্র বড়কর্তার আবার প্রেশার চড়ে যায়। “মানে? ঝকমারিটা কীসের, অ্যাঁ!”
“আজ্ঞে আংটির মধ্যে নাম খোদাই করে রেখে হতভাগা বংশীকে দাতব্যি করা। বলি বংশী হতভাগা কি ওই আংটি আঙুলে গলিয়ে বাহার দিয়ে বেড়াবে? বেচেই তো খাবে। তো বেচতে গেলে যমে ধরবে না? এই তো সকালবেলাই বিরিঞ্চি স্যাকরার ঘরে গিয়ে শুধোলাম, পাথর ছাড়া সোনাটুকুর কত দাম হবে খুড়ো? তো দেখামাত্তর একেবারে ক্যাঁক করে ধরল, এ জিনিস কোথায় পেলি রে?… তো কর্তামশাই দান করে দেছেন বলায় কী হাসি! বলে কী, একখানা সদ্ ব্রাহ্মণ পেলেন রে তোকে কর্তাবাবু, যে তোকে আঙুরি দান করেছেন? চল তো পুলিশে…”
বংশী শরীরটা নড়িয়েচড়িয়ে বেজার গলায় বলে, “তবে! ঝকমারি আর কারে কয়? নরহরি পাল বাঁধনটা খোলো তো। বারবার বলতে ভাল লাগে না।’’
চোর বংশীর জোর গলার হুকুমে দরোয়ান-কাম-মালি নরহরি ওর বাঁধনটা খুলে দেয়।
বংশী ট্যাঁক থেকে কাগজ মোড়া আংটিটা ঠক করে বড়কর্তার পায়ের কাছে নামিয়ে দিয়ে বলে, “এবার আমারে রেহাই দ্যান। খুব শিক্ষে হয়েছে।”
কিন্তু রেহাই কে দেবে?
বড়কর্তা তো ততক্ষণে ফায়ার। চেঁচিয়ে বলে ওঠেন, “হতভাগা বেয়াদব, খুব যে সাহস দেখছি। জাঁকপুরের সর্বনারায়ণ রায়চৌধুরীর নাতি নরনারায়ণ রায়চৌধুরীর ছেলে ভবনারায়ণ রায়চৌধুরী ‘দেওয়া’ জিনিস ফিরিয়ে নেবে? উঠিয়ে নিয়ে যা বলছি।”
“কর্তা,” বংশী করজোড়ে বলে, “মাপ করবেন। উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারব না!”
“মাপ করব? আয় বদমাশ, তোকে এই ছড়ি দিয়ে মাপ করি আয়।”
ছড়ি উঠোবার আগেই বংশী হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে এবং সেই শব্দে বাড়ির সকলে ছুটে আসে।
ব্যাপার দেখে সবাই তাজ্জব।
চোর তার বাগিয়ে নিয়ে যাওয়া মালটি ফেরত দিয়ে আবার কাঁদে। কিন্তু কান্নাকে ডোন্ট কেয়ার কবে বড়কর্তা ছড়ি উঁচিয়ে হাঁক পাড়ছেন, “ওঠা, ওঠা বলছি। নইলে আগাপাশতলা বেত।”
নিরুপায় বংশী হঠাৎ বলে ওঠে, “তবে নয় জিনিসটা আপনি আমার কাছ থেকে কিনেই ন্যান।”
“কী, কিনে নেব। তোর কাছ থেকে? হা হা হা। ওরে চারু, এ ব্যাটা বলে কী!”
বংশীর জোর গলা, “ভুলটা কী বলেছি কর্তা? এ তো আর চোরাই মাল নয় যে, কিনতে বাধা? দানের দ্রব্য। পুরুতঠাকুরা দানের দ্রব্য বেচে না?”
‘অ্যাঁ! ওরে আমার জাদু। মন্দ বলিসনি তো। চারু, দেখেছিস শয়তানটার গাঁটে গাঁটে কী বুদ্ধি। ঠিক আছে কতয় ছাড়বি বল?”
“আজ্ঞে যা দেবেন।”
“যা দেবেন। যা দেবেন মানে? তোর জিনিস, তুই দর কষবি না? বল ব্যাটা কত’য় দিবি? হাজার? দু’হাজার? আড়াই হাজার? নাকি…”
“জ্যাঠামশাই!” চারুশীলা প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে, “আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন? শ’পাঁচেক টাকা ধরে দিলেই চোরটা বর্তে গিয়ে চলে যেত। অথচ আপনি…”
“অ্যাঁ ! কী বললি চারু? তোর জ্যাঠার হাতে একটা পাঁচশো টাকার আংটি ছিল?”
“আহা তা কেন? মানে…”
“মানে-ফানে রাখ। নিয়ে আয় আমার পোর্টম্যান্টো!”
পোর্টম্যান্টো আসে। ভবনারায়ণ সেটা খুলে পার্সটা বার করেন। নগদ আড়াই হাজারই ছিল। বার করে এগিয়ে ধরেন, “যা ব্যাটা নিয়ে যা! চোরের নাতি চোরের পুতি চোরের ব্যাটা চোর! যা বিদেয় হ। তবে বলে রাখছি, এ থেকে কিছু খরচা করে একটু ভালমন্দ খা। আয়নার সামনে নিজেকে দেখেছিস কখনও লক্ষ্মীছাড়া?”
বংশী সাষ্টাঙ্গে একটা প্রণাম করে দে দৌড়।
বড়কর্তা ওর দৌড়ের ধরন দেখে হাসির চোটে আকাশ ফাটান, “দেখছিস ফুচুং টিকাই বোলন ঘেঁচু! লোকটা কী বোকা। কতটা লোকসান খেল, তবু কী আহ্লাদ!”
হিংসেয় জ্বলতে জ্বলতে নরহরি বলে, “লোকসানটা কী হল বড়বাবু?”
“হল না? ধর, কাল রাত্তিরে যদি তোদের পিসিমা পোর্টম্যান্টোটা সরিয়ে না রাখত, সবসুদ্ধুই টুপ করে তুলে নিয়ে ভাগতে পারত ব্যাটা চোরের জামাই চোর। টাকা ছাড়াও কম জিনিস আছে এতে? দামি দামি জামাকাপড়, দামি দামি বই! যাক, লাভটা আমারই হল।”
চারুশীলা হঠাৎ ঢিপ করে একটা পেন্নাম ঠুকে বলে, “জ্যাঠামশাই, বুঝতে পারছি না আপনি পাগল না খ্যাপা।”
বড়কর্তা ভুরু কুঁচকে বলেন, “পাগল খ্যাপা, এত সব ভাবতে না গিয়ে ভাবতে পারলি না চারু, এই লোকটা হচ্ছে জাঁকপুরের রায়চৌধুরীদের বংশধর!… ওরে চারু, নাতি-নাতনিকে শুধু এই তিনমহলা বাড়িখানা দেখালেই হবে? বাড়ির কর্তারা কেমন ছিল, তার একটু নমুনা দেখানো দরকার কি না? বুঝলি ঘেঁচু, টুকাই, ঘন্টু জাঁকপুরের বাবুরা এই রকমই ছিলেন। পাগল বলিস পাগল। খ্যাপা বলিস খ্যাপা।”
৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন