গগনবাবুর গাড়ি – দুলেন্দ্র ভৌমিক

পৌলোমী সেনগুপ্ত

আমাদের পাড়ায় নতুন বাড়ি কিনে এলেন গগনবাবু। ব্যাপারটা এমন কিছু নয়, একজন ভদ্রলোক, যাঁর নাম গগন গড়াই, তিনি আমাদের পাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা হলেন। এই সংবাদে শোরগোল পড়ে যাবার মতো কিছু নেই। কিন্তু গড়াইবাবুর আগমনে রীতিমতো শোরগোল পড়ে গেল। আমাদের পাড়াটি ছোট এবং অপেক্ষাকৃত শান্ত। আর সেই পাড়ায় বিস্তর বেকার ছেলে, অতএব শোরগোল তোলবার লোকের অভাব ছিল না। গড়াইবাবুর নতুন বাড়ি আর আমার বাড়ির মধ্যে ছোটদের একটা পার্ক আছে। অর্থাৎ, পার্কের পুব দিকে আমার বাড়ি আর পশ্চিম দিকে গড়াইবাবুর বাড়ি। আমি যেটাকে পার্ক বলছি, একদা সেটাকে পার্কই বলা হত বটে। কিন্তু এখন তাকে পার্ক বলা যায় কি না সে বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে। পার্কে একটি ভাঙা দোলনা অত্যন্ত বিপজ্জনক ভাবে কাত হয়ে আছে, খানতিনেক পাতাহীন দেবদারু গাছ, মাঠের মধ্যে ঘাসের কোনও চিহ্ন নেই। কারও মাথা আরশোলাতে চেটে দিলে নাকি খাবলা খাবলা চুল উঠে চাঁদি বেরিয়ে পড়ে। পার্কের জমিতে কোনও আরশোলা কখনও বেদম চাটাচাটি করেছিল কিনা জানি না, কিন্তু জমির ঘাসগুলো যে কখন আর কীভাবে উধাও হল, সে-কথা আমরা কেউ বুঝতে পারিনি।

এমন পার্কে ছেলেদের কেউই পাঠায় না। পার্কটা ন্যাড়া আর বিচ্ছিরি বলেই যে পাঠায় না তা কিন্তু নয়। দিনে এবং রাত্রে এই পার্কের মধ্যে বিশাল চেহারার ঘোর কৃষ্ণবর্ণের খান-দুই ষাঁড় সব সময় ঘুরে বেড়ায়। ওদের স্বভাব-চরিত্র একেবারেই ভাল নয়। ওই অসহিষ্ণু ষাঁড় দুটির দুষ্ট স্বভাবের জন্য আমাদের পাড়ার অতি সাহসী দুই নাইটগার্ড কানাই পাল আর বলাই মহাপাত্র চাকরি ছেড়ে অন্য পাড়ায় চলে গেছেন। চাকরি ছেড়েই যে অন্য পাড়ায় গেছেন তা না, অন্য পাড়ায় যাওয়ার আগে জেলা-হাসপাতালে দেড় মাস শয্যা নিতে হয়েছিল। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আর এ-পাড়ায় আসেননি। কানাই পালের কোমরের হাড় আর বলাই মহাপাত্রের কণ্ঠার হাড় একই রাত্রে, প্রায় একই গুঁতোয় নাকি ভেঙে দিয়েছিল ওই দুটি ষাঁড়ের কোনও একটি। এ ছাড়া ছোটখাটো কিছু ঘটনা ঘটবার জন্য ষাঁড় দুটি গোটা পাড়ায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে রেখেছিল।

ওইসব ছোটখাটো ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল এমন দুটি ঘটনা, যার জন্য এই পাড়ার বাসিন্দা হিসেবে আমরা দীর্ঘদিন লজ্জিত ছিলাম। প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল গত ফাল্গুন মাসে। বঙ্কুবাবুর ছেলের বিয়ের দিন যখন খাওয়াদাওয়া সেরে কনেযাত্রীরা বাসে উঠছেন, তখন হঠাৎ একটি ষাঁড় এসে পেছন থেকে পাত্রীর বাবা ভোলানাথবাবুর গরদের পাঞ্জাবিটা এমনভাবে কামড়ে ধরে টেনেছিল যে, গোটা পাঞ্জাবিটাই ফ্যাড়ক্যাড় করে ছিঁড়ে চলে গিয়েছিল ষাঁড়ের মুখে। এই অতি আকস্মিক আক্রমণের জন্য বঙ্কুবাবুর বৈবাহিক-মহাশয় ভোলানাথবাবু আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি শুধু ‘ও বাবা গো’ বলে একটা দৌড় মেরে বাসে উঠতে চেষ্টা করেছিলেন। যেহেতু সবাই তখন বাসের দরজা দিয়ে প্রাণভয়ে ভেতরে ঢুকতে ব্যস্ত, তাই বোধহয় কোনও অর্বাচীন তাকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দেয়। তিনি হামাগুড়ি দিয়ে বাসের তলায় চলে গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু দুষ্ট ষাঁড়টি বাসের তলায় মুখ ঢুকিয়ে তাঁর চুনোট-করা ধুতির অনেকটাই টেনে এনে খেয়ে ফেলেছিল। অনেক পরিশ্রমের পর ষাঁড় বিদায় হল। ভোলানাথবাবুকে প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় টেনে বার করা হল। তিনি সেই যে গেলেন গত এক বছরে আর আমাদের পাড়ায় আসেননি। শুধু তিনি নন, তাদের আত্মীয়-স্বজনরাও আর এমুখো হননি।

দ্বিতীয় ঘটনাটা অবশ্য তেমন কিছু নয়। দুর্গাপূজার সময় পঞ্চমীর দিন সন্ধ্যায় উদ্বোধন-অনুষ্ঠানে সভাপতি রুদ্রপ্রতাপ মুখোপাধ্যায় যখন তাঁর ভাষণে উদাত্ত গলায় বলছিলেন, ‘ইনি হচ্ছেন মহাশক্তির আধার মহামায়া। আমরা চাই শক্তি। বাহুতে শক্তি, মনে শক্তি, শত্রু বিনাশে শক্তি…’ ব্যস, তখনই মঞ্চের পেছনের চট ফাটিয়ে কালো ষাঁড়টির আবির্ভাব। সে বিশেষ কিছুই করেনি। মুখ বাড়িয়ে সভাপতির গলার মালাটি টেনে নিয়েছিল। কিন্তু শক্তির সাধক রুদ্রপ্রতাপবাবু শুধু ওইটুকুতেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন মঞ্চের বাঁ দিকে চুনের পাহাড়ে। সদ্য সদ্য তৈরি করা পাহাড়। পাহাড় তো ধসলই, সেই সঙ্গে চুন-টুন মেখে রুদ্রবাবুর মুখটাই গেল বদলে। এই সামান্য ঘটনাটা এমন রাষ্ট্র হয়ে গেল যে, আমাদের পুজো-প্যান্ডেলে লোকই আসত না। বাধ্য হয়ে অষ্টমীর দিন মাইক দিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে প্রচার করতে হল, ‘ষাঁড় তাড়ানোর সুব্যবস্থা করা হয়েছে। আপনারা নির্ভয়ে প্যান্ডেলে এসে প্রতিমা দর্শন করুন। ষাঁড়ের ভয় থেকে মুক্ত হোন, মুক্ত হোন।’ প্রচারে কোনও ত্রুটি ঘটেনি। তবুও আশানুরূপ দর্শক সমাগম হয়নি।

রাত দশটা বাজে, রাস্তাঘাট ফাঁকা, আর দূরত্বও তো তেমন কিছু নয়। আমাদের কদমডাঙা থেকে নিউ মার্কেট মোটে সত্তর কিলোমিটার। ডান হাতের রুটি শেষ হওয়ার আগেই তিনি চিলি সস কিনে বাড়ি ফিরে এলেন। বাড়িতে এসে দেখেন, তাঁর স্ত্রী তখন সবেমাত্র দু’খানা রুটি শেষ করে তৃতীয়টির দিকে হাত বাড়াচ্ছেন।

এমন লোকের সঙ্গে যেচে আলাপ করতে কার না ইচ্ছে হয়। অতএব, আমি যেচেই আলাপ করতে তাঁর বাড়িতে গেলাম। দেখে চমকে ওঠার মতো চেহারা। প্রায় সাত ফুট লম্বা একটি কঞ্চির মাথায় মালসা বসিয়ে দিলে যেমন হয়, গগনবাবুকে দেখতে ঠিক তেমনই। ওঁর মাথার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল, এ-হল সেই মাথা যা আরশোলা বেদম চেটে গেছে। মাথার মধ্যে জায়গায় জায়গায় খাবলা খাবলা চুল নেই।

ওই দুটি ষাঁড় বিষয়ে এত কথা বলতে হল এই কারণে যে, গগনবাবুকে নাকি পাড়ার ছেলেরা ষাঁড়ের অতীত ক্রিয়াকর্মের কথা বলায় তিনি বলেছেন, ‘ষাঁড়? আমি তো মশায় সোঁদরবনে বাঘেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাত কাটিয়েছি। আমার একশো গজের মধ্যে বাঘ ঘেঁষতে পারে না, আর আপনারা আমাকে ষাঁড়ের কথা বলছেন। ছিঃ ছিঃ, এত ভিতু জানলে এখানে বাড়ি কিনতাম না।’

গগনবাবুর সঙ্গে চাক্ষুষ আলাপ হবার আগেই তাঁর সম্পর্কে নানা কথা আমার কানে এল। তাঁর সম্পর্কে যেসব কথা শোনা গেল, তাতে ভদ্রলোকের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। আমি মনে মনে এই ভেবে কৃতজ্ঞ বোধ করলাম যে, নানা গুণে গুণান্বিত একজন ভদ্রলোক আমাদের পাড়ার বাসিন্দা। গগনবাবু চণ্ডীগড়ে হিম্মত সিং নামে একজন শ্রেষ্ঠ ওস্তাদের কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখেছেন। রাজপুতানার দিকে কোনও এক মহারাজের কাছ থেকে শিখেছেন শিকার। তা ছাড়া বিহারের লটপট মিশ্রের তিনি প্রিয় শিষ্য। লটপট মিশ্র হচ্ছেন ভারতখ্যাত কুস্তিগির। কুস্তির ব্যাপারে কোনও প্রতিযোগিতা তাঁর পছন্দ নয় বলে ভারত সরকারের শত অনুরোধেও তিনি কোনও প্রতিযোগিতায় অংশ নেননি। মোটর চালানোতেও তিনি দক্ষ। ঘণ্টায় দেড়শো-দু’শো মাইল বেগে তিনি গাড়ি চালান। এক সময় নাকি মেচেদা থেকে গাড়ি চালিয়ে সস্ত্রীক এলাহাবাদ যেতেন গঙ্গা স্নান করতে। এই সেদিনও নাকি রাত্রে খেতে বসে খেয়াল হল চিলি সস ফুরিয়ে গেছে। কী আর করা যাবে। ডান হাতে একখানা রুটি নিয়ে বাঁ হাতে গাড়ি চালিয়ে চলে এলেন কলকাতার নিউ মার্কেটে।

খানিকক্ষণ আলাপ করার পর জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কি চাকরি করেন?”

গগনবাবু গর্বিত গলায় বললেন, “চাকরি আমার ধাতে সয় না। আমি প্রাইভেট বিজনেস করি।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার অফিস কোথায়? সদরে, না কলকাতায়?”

গগনবাবু উত্তর দিলেন, “আমি মশায় সেলফ মেইড ম্যান। যাঁরা আমাকে জানেন তাঁরা খুঁজে খুঁজে কদমডাঙাতেও এসে যাবেন। দেখুন না, ভিড় আরম্ভ হল বলে।”

আমি কিছুই বুঝতে না পেরে বললাম, “আপনার ব্যাবসাটা কীসের?”

গগনবাবু হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন, “কীসের নয় তাই বলুন। যে কোনও সমস্যা এবং সংকট, চাষ-আবাদ থেকে গৃহে শান্তি—সবই আমি সাপ্লাই করে থাকি।”

গগনবাবুর কথার কিছুই বুঝতে না পেরে যখন উঠে আসছি, তখন তিনি বললেন, “আপনি মার্গসংগীতে আগ্রহী?”

আমি বললাম, “খুব যে একটা বুঝি তা নয়। তবে শুনতে ভাল লাগে।”

উনি মাথাটা নাচিয়ে বললেন, “ইতিপূর্বে কার কার গান শুনেছেন?”

আমি বললাম, “ওই ধরুন, বড়ে গোলাম আলি, ভীমসেন যোশি, ভীষ্মদেববাবু, তারাপদ চক্রবর্তী…”

গগনবাবু বললেন, “ব্যস ব্যস, আর বলতে হবে না। মার্গসংগীতের আসল রস ও মজা যদি পেতে চান, তা হলে শনিবার সাতটায় এই অধমের গৃহে আসুন। পাড়ার সবাইকে বলেছি। পাড়ার লোকদের একটু গান শোনাতে চাই।”

আমি বিগলিত হয়ে বললাম, “অবশ্যই আসব।”

চলে আসবার সময় গগনবাবু ও তাঁর স্ত্রী বারান্দা পর্যন্ত এগিয়ে এলেন। কোনও দরকার ছিল না, তবুও গগনবাবুর স্ত্রী নিজে এসে গেট খুলে দিলেন। আমি গেট পেরোবার সময় ধীর গলায় বললেন, “বাচ্চাদের কিন্তু আনবেন না।”

আমি বললাম, “না না, মার্গসংগীতের আসরে বাচ্চারা এসে কী বুঝবে।”

গগনবাবুর স্ত্রী নিষেধ না করলেও মার্গসংগীতের আসরে আমি বাচ্চাদের আনতাম না। আনা উচিতও নয়। কিন্তু পাড়ার সবাই তো আমার মতো নয়। রাখালবাবু আর সন্তোষ দত্তগুপ্ত আসরে এলেন তাঁদের দুই নাবালক পুত্রকে নিয়ে। সাত-আট বছরের ছেলেদের এই আসরে আনার কোনও মানে হয় না। গগনবাবুর স্ত্রী বিব্রত এবং কিছুটা ক্ষুব্ধস্বরে আমাকে বললেন, “বাচ্চাদের কেন এনেছেন? আমি কিছু জানি না বাপু।”

ডান দিকে তবলিয়া, বাঁ দিকে তানপুরা ধরার লোক আর মাঝখানে গগন গড়াই। সামনের ফরাসে আমরা জনাপঞ্চাশেক সংগীতপিপাসু। গান শুরু হবার আগেই কাচের ডিশে করে লুচি আর গরম হালুয়া এসে গেল। গগনবাবু বললেন, “প্রথমে একটা ভজন গাইছি। পরিবেশটা তৈরি হোক। তারপর খেয়াল। আলাপের সময় আপনাদের চা দেওয়া হবে।”

গগনবাবু চোখ বুজলেন। হালুয়াটা অতিরিক্ত গরম থাকায় খেতে পারছিলাম না। আমাদের পঞ্চায়েত-প্রধান গুণময় গুন সব ব্যাপারেই একটু বেশি তড়িঘড়ি করেন। তিনি লুচিতে মুড়ে গরম হালুয়া তুলে যেইমাত্র মুখে তুলেছেন, ঠিক তখনই গগনবাবুর ভয়ংকর গলা থেকে বেরিয়ে এল ভজনের প্রথম ভয়ংকর কলিটি, “গঙ্গা যমুনা নির্মল পানি।”

ওদিকে গরম হালুয়া জিভে পড়ামাত্র গুণময়বাবু লাফিয়ে উঠে দু’হাত ছুড়তে ছুড়তে চিৎকার করে উঠলেন, “পানি, এদিকে পানি দিন।”

গগনবাবুর কোনও দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি সুর ছাড়ছেন, “নির্মল পা-নি-ই-ই-পাআ-আ-আ…”

ঠিক আমার ডান দিকে রাখালবাবু আর সন্তোষবাবুর দুই নাবালক পুত্র গরম হালুয়ার প্লেট নিয়ে টানাটানি করছিল। তারা তো গানের মর্ম বোঝে না। তাদের যে কী হল কে জানে, তারা দু’জনেই খাবার ফেলে বাবাকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। গগনবাবু যত গলা ছুড়ে পা-আ-আ-আ ডাক ছাড়েন ছেলে দুটো ততই ‘বাবা গো’ ‘মা গো’ বলে বাবাকে জাপটে ধরে কাঁদতে থাকে।

গগনবাবুর স্ত্রী অতি বুদ্ধিমতী। তিনি দু’হাতে দুটো স্টিলের চামচ এনে রাখালবাবু আর সন্তোষবাবুকে দিয়ে বললেন, “খোকাদের দাঁতে ঢুকিয়ে রাখুন, তা হলে আর দাঁত লেগে তড়কা লাগবে না।”

রাখালবাবু ভয় পেয়ে বললেন, “তড়কা লাগবে কেন?”

গগনবাবুর স্ত্রী বিরক্ত গলায় বললেন, “মিছে তর্ক না করে যা বলছি তাই করুন। মেচেদাতে ওঁর ভজন আর খেয়াল শুনে খোকার বাবাদেরও তড়কা হত।”

আমি বললাম, “সে কী! কেন?”

গগনবাবুর স্ত্রী ধমক দেওয়ার মতো করে বললেন, “আপনার প্লেটের চামচটাও হাতের কাছে রাখুন। খেয়াল শুরু হলে কাজে লাগবে।”

সে যাত্রায় আমরা প্রায় প্রাণে বেঁচে ফিরেছিলুম বলা যায়। গুণময়বাবুর জিভ পুড়ে গিয়েছিল অবশ্য তাঁরই দোষে। গরম হালুয়া জিভে দিয়ে আর নামাতে পারেননি। কিন্তু আমাদের মেয়েদের স্কুলের ফিজিকাল ট্রেনিং-এর দিদিমণি নবলতা নাগ খেয়াল শুরু হবার পরেই অজ্ঞান হয়ে যান। আমরা তাঁর মাথায়-মুখে জল দিচ্ছি, হাওয়া করছি, অথচ গগনবাবু এত কাণ্ডের পরও তাঁর গান কিন্তু থামাননি। গানের মধ্যপথেই জানলা টপকে তবলিয়া ও তানপুরা-বাদক পালালেও গগনবাবু পরোয়া করেননি। গানের শুরুতে সেই যে চোখ বুজেছিলেন সেটা খুললেন গান শেষ হবার পর। ইতিমধ্যে আমরা রিকশা ডেকে অচৈতন্য নবলতা নাগ আর দাঁত-লাগা দুটি নাবালককে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে গেছি।

পরদিন বাজার থেকে ফেরবার মুখে গগনবাবুর সঙ্গে দেখা। তিনি চোখ নাচিয়ে বললেন, “কেমন জমেছিল কাল?”

আমি সভয়ে বললাম, “দারুণ। তবে…”

গগনবাবু আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “বলতে হবে না, বুঝতে পেরেছি। আসল কথা কী জানেন, সুর-মূৰ্ছনা এমনই জিনিস, ওটা ঠিকমতো গলা থেকে নির্গত হলে তার চাপ অনেকেই সইতে পারে না। এটা ঠিক গঙ্গার মর্ত্যে অবতরণের মতো। ভার বহন করবার কান কোথায়? যাক, তবে বেশ জমেছিল আসরটা। আর-একদিন আসুন, ঠুংরি শোনাব।”

বাজারের ব্যাগ হাতে আমি সামনের দিকে দৌড় মেরেছিলুম। দৌড় মেরেই বিপদ বাধালাম। গগনবাবুও আমার পেছনে ছুটতে লাগলেন। আমার একহাতে বাজারের ব্যাগ, অন্যহাতে দুধের বোতল। আমি ঠুংরি শোনার প্রস্তাবে এতই দিশেহারা ছিলাম যে, দৌড়ে কিছুটা এসেই দেখলাম কৃষ্ণবর্ণের দুষ্ট ষাঁড় দুটি আমার সামনে এবং তারা এগোচ্ছে। পেছনে আসছেন গগনবাবু। ষাঁড়ের শিঙের গুঁতোয় অপমৃত্যু ঘটার চাইতে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া অনেক বেশি সম্মানজনক বিবেচনা করায় আমি উলটো দিকে দৌড় দিয়ে গগনবাবুর কাছে গেলাম।

গগনবাবু বললেন, “হঠাৎ দৌড় মারলেন কেন?”

আমি বললাম, “কেন দৌড়লাম সেটা বুঝতে পারিনি।”

গগনবাবু বললেন, “আমি পেরেছি। আপনার মধ্যে অসুর-প্রকৃতি রয়েছে। সুরের নামেই ভয় পান। অথচ সুরই কিন্তু আপনাকে আবার টেনে আনল। চলুন, যেতে যেতে ঠুংরি শোনাই।”

গগনবাবু চোখ বুজে রাস্তার মধ্যে ঠুংরি ধরলেন। আমি তাঁর পেছনে এসে দাঁড়ালাম। সামনের দিক থেকে ধেয়ে আসছে বিশাল চেহারার দুটি ষাঁড়। আমি ভয়ে কাঁপছি। কিন্তু হঠাৎ কী যে ঘটল কে জানে, প্রবল বেগে ধাবিত ষাঁড় দুটি মুদিত-নেত্র গগনবাবুর কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়াল এবং সেকেন্ড বিশেক স্থির দাঁড়িয়ে থেকে সহসা দ্বিগুণ বেগে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে দৌড়তে লাগল। গগনবাবুর ঠুংরি তখনও চলছে।

গগনবাবুর সংগীতচর্চার সঙ্গে ওই একদিনের বেশি আর কারও পরিচয় ঘটেনি। আমাদের পাড়ায় তেমন সাহসী বীরপুরুষ অথবা বীরাঙ্গনা কেউ ছিলেন না, যিনি দ্বিতীয়বার গগনবাবুর সুর-মূর্ছনা শুনতে যেতে পারেন। মোটামুটি কয়েকটা দিন স্বাভাবিক ভাবে কেটে গেল। হঠাৎ খবর পাওয়া গেল, গগনবাবু গ্যারাজ বানাচ্ছেন তাঁর গাড়ির জন্য। কেউ যদি গাড়ির জন্য গ্যারাজ বানায় তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বরং আমরা খুশি হলাম এই ভেবে যে, এ পাড়ায় মোটে চণ্ডী চাটুজ্যের একখানা ফিয়াট গাড়ি আছে। পাড়ার আপদ-বিপদে ওটাই চাইতে হয়। গগনবাবুর গাড়িটা থাকলে দশজনের কাজে লাগানো যাবে।

সেদিন ছিল কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি। আমরা পাড়ার ক্লাবে বসে পরিবেশ-দূষণ, বনসৃজন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করছিলাম। হঠাৎ আমাদের সবার কথা বন্ধ হয়ে গেল। চোখ বড় বড় করে আমরা বাইরের দিকে তাকালাম। আমাদের অনেকের গায়েই কাঁটা দিয়ে উঠল। পার্কের দিক থেকে একটা চাপা আর্তনাদ আসছে। ঠিক আর্তনাদ বললে ভুল বলা হবে। শব্দটা এমনই যে, মনে হচ্ছে কোনও হিংস্র জানোয়ার জালার মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে হাঁসফাস করছে আর থেকে থেকে গর্জন করছে। রক্ত-হিম-করা সেই শব্দে আমাদের বুক শুকিয়ে গেল। নবনীহরণবাবুর হার্টের দোষ ছিল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে ট্যাবলেট বার করে জিভের তলায় রেখে মাদুরের ওপর শুয়ে পড়লেন। একটু থেমে শব্দটা আবার হতে লাগল। গোঁ-ও-ও হু-হু-য়া-য়া ভস-স গোঁ-ও-ও, শব্দের চরিত্রটা খানিকটা এই রকম।

পাশের ঘরে যুবক ছেলেরা ক্যারাম আর তাস খেলছিল। তারাও ভয় পেয়েছে। কিন্তু কতক্ষণ এসব সহ্য করা যায়। হয়তো কোনও জানোয়ার পাড়ায় এসে গেছে, নয়তো খুনে-ডাকাতরা কোনও বাড়ির ওপর আক্রমণ করে মানুষ নিধন করছে। আসলে কী যে হচ্ছে, সেটা কেউ বুঝতে পারছি না। প্রথমে ছেলেরাই উদ্যোগ নিল। নবনীহরণবাবু এবং জনাতিনেক প্রৌঢ়কে ক্লাবে রেখে আমরা লাঠি, শাবল, লোহার রড ইত্যাদি নিয়ে বেরিয়ে এলাম। যাঁরা ক্লাবে থেকে গেলেন তাঁদেরই অনুরোধে ক্লাবের দরজায় বাইরে থেকে তালা লাগানো হল। যাতে ওই হিংস্র জানোয়ার কিংবা খুনে-ডাকাতরা তাড়া খেয়ে ক্লাব ঘরে ঢুকতে না পারে।

আমরা ভয়ে ভয়ে পার্কের দিকে এগোতে লাগলাম। আমরা দল বেঁধে এগোই, কিন্তু শব্দটা যেই গর্জন করে ওঠে অমনি আবার দল বেঁধে পেছন দিকে হটে আসি। এই রকম আগু-পিছু করতে করতে যখন পার্কের কাছে গেলাম, তখন আমাদের চক্ষুস্থির। ব্যাপারটা কিছুই নয়। গগনবাবু তাঁর বাড়ির সামনে গাড়ি চালাচ্ছেন আর হর্ন বাজাচ্ছেন। গাড়ি আর হর্নের মিলিত শব্দেই এহেন বিভ্রাট। গাড়িটা স্টার্ট দেবার আগে গর্জন করে, স্টার্ট নিয়ে চলতে আরম্ভ করলে আর্তনাদ ওঠে আর হর্ন বাজালে মনে হয় কারও গলা টিপে ধরে ছুরি মারা হচ্ছে, আর সেই ছুরি-খাওয়া লোকটি চিৎকার করার চেষ্টা করছে।

আমাদের দেখে গগনবাবু গাড়ি থেকে নেমে এসে বললেন, “আজ থাক, আজ রাত হয়ে গেছে। কাল আপনাদের গাড়ি চড়াব।”

আমাদের মধ্যে কেউ কেউ চাপাস্বরে রাগ প্রকাশ করল। কিন্তু গগনবাবু সেটা বুঝতে পারলেন না। আমরা বাড়ি চলে গেলাম। সকালে বাজার করতে যাবার সময় পকেটে হাত ঢুকিয়েই মনে পড়ল, এই যা! ক্লাব-ঘরে তালা দিয়ে ভেতরে নবনীহরণবাবুসহ তিনজন প্রৌঢ়কে গত রাত্রে রেখে এসেছিলাম। চাবিটা আমার পকেটে। এখন কী হবে।

যা হবার তাই হল। ক্লাব-ঘরের দরজা খুলে দিতেই ওঁরা এমন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন, তাতে মনে হল, চোখের যদি দাঁত থাকত তা হলে আমি এতক্ষণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতাম। বাংলা অভিধানে যত রকমের কটুবাক্য ছিল, তার সবগুলো আমার প্রতি প্রয়োগ হয়ে যাবার পরও ওঁদের রাগ কমল না। নবনীহরণবাবু রিকশায় উঠতে উঠতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি কাণ্ডজ্ঞানহীন নরাধমই শুধু নও, তুমি একটা পাটনাই ছাগল, ক্যানাডিয়ান ঘুঘু আর হনলুলুর বাঁদর আর…”

আর বোধহয় তৎক্ষণাৎ কোনও দেশের নাম এবং জন্তু মনে না পড়ায় তিনি ক্ষান্ত হলেন। অন্যরা তার আগেই আমাকে যথেচ্ছ গালাগালি করে চলে গিয়েছিলেন। আমি বাড়িতে এসে খুব মন দিয়ে বিশ্বের তাবৎ জন্তু-জানোয়ারদের বই ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখতে লাগলাম ক্যানাডিয়ান ঘুঘু আর হনলুলুর বাঁদর জগতের সবচেয়ে ঘৃণ্য কি না।

দিন দুই খুব লজ্জায় ছিলাম। কিন্তু গগনবাবুর জন্য সেটা ঘুচে গেল। গগনবাবু তাঁর শব্দকল্পদ্রুম গাড়িটি নিয়ে পার্কের চারপাশে সকাল থেকে দুপুর এবং বিকেল থেকে সন্ধে পর্যন্ত ক্রমাগত পাক দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যুদ্ধের সময় সাইরেনের বিপদ সংকেত পেলে মানুষজন যে আতঙ্কে দরজা-জানলা বন্ধ করেন, গগনবাবুর গাড়ি চলার শব্দ শুনলেও আমাদের পাড়ার সেই অবস্থা হয়। আমি দোতলার জানলা দিয়ে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখলাম সে বড় বিচিত্র দৃশ্য। গগনবাবুর গাড়ি পার্কের চারপাশে পাক দিচ্ছে আর পার্কের মধ্যে দুষ্ট ষাঁড় দুটি এলোপাথাড়ি দৌড়োদৌড়ি করছে। মানুষের গায়ে আগুন লাগলে মানুষ যেভাবে ছোটাছুটি করে, ষাঁড় দুটির ঠিক সেই অবস্থা।

এই ঘটনার একদিন পরেই পাড়ার মধ্যে রাষ্ট্র হয়ে গেল ষাঁড় দুটিকে নাকি আর দেখা যাচ্ছে না। সন্ধের দিকে ক্লাবের সম্পাদক খবর আনলেন, ষাঁড় দুটিকে সর্বশেষ দেখা গেছে হাইওয়েতে। ওরা নাকি গুটিগুটি পায়ে আমাদের পাড়ার দিকে এগোচ্ছিল। ঠিক সেই সময়েই গগনবাবু গাড়ি চালিয়ে ওদের সামনে গিয়ে পড়তেই ওরা চটজলদি মুখ ঘুরিয়ে হাইওয়ে দিয়ে যেভাবে দৌড় মেরেছে, তাতে এতক্ষণে খড়্গপুর পেরিয়ে খেমাশুলি পৌঁছে যাওয়ার কথা।

আমরা যখন ষাঁড়ের বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার চিন্তায় মশগুল, তখন কাঁপতে কাঁপতে নবনীহরণবাবু এসে বললেন, “ষাঁড় গেছে ভাল কথা, এদিকে যে আমার পোষা কুকুরটাও শিকল ছিঁড়ে পালিয়ে গেছে, তার কী হবে?”

আমরা দল বেঁধে নবনীহরণবাবুর কুকুর খুঁজতে বেরোলাম। কুকুরের নাম লালু। আমরা রাস্তায় বেরিয়ে ডাকতে লাগলাম, “লালু, আয়-তু-তু— লালু।”

খানিক পরেই অন্য বিপদ ঘটল। লালমোহনবাবুর ডাকনাম যে লালু, সে-কথা সত্যিই আমরা জানতাম না। উনি ডাক শুনে বেরিয়ে এলেন এবং ঠিক তখনই আমি ‘তু-তু আয় লা-লু’ বলে ফেলায়, তিনি এমন অসম্মানিত হলেন, হওয়াই স্বাভাবিক, হাতের লাঠি উঁচিয়ে বললেন, “আপনার বিরুদ্ধে আমি মানহানির মামলা করব। শ্রীঘর ঘুরিয়ে আনব। হাইকোর্টের উকিল আমার বউয়ের বউদির আপন মামাতো ভাই।”

অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে শান্ত করা গেল না। আর যাবেই বা কী করে। নবনীহরণবাবু আমাদের ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। অতএব, প্রেসিডেন্টের হারানো কুকুর খুঁজতে ক্লাবের সমস্ত ছেলে ততক্ষণে বেরিয়ে পড়েছে। সবাই ডাকছে ‘লালু তু-তু— লালু।’ পাড়ায় ঘুরে ঘুরে লটারির টিকিট বিক্রি করত দীনবন্ধু সাহা। ওর একটা ব্যাটারি-দেওয়া হ্যান্ড মাইক আছে। দীনবন্ধু নিজেই সেটা নিয়ে লালমোহনবাবুর শোবার ঘরের সংলগ্ন বাগানের কাছে এসে ডাকতে লাগল, “লালু-তু-তু— লা-লু-চুক-চুক-তুতু।”

পরিবেশটা বিপজ্জনক হয়ে ওঠায় আমি পালিয়ে এলাম। নিজের বাড়িতে এসে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, কুকুর খুঁজতে আমি আর যাচ্ছি না।

আমার রাগটা গিয়ে পড়ল গগনবাবুর ওপর। নবনীহরণবাবুকে ক্লাব-ঘরে তালাবন্ধ করা আর লালু খুঁজতে গিয়ে লালমোহনবাবুর কাছে অপদস্থ হওয়ার মূল কারণ ওই গগনবাবু। সেদিন বেলা করে বাজারে যাচ্ছিলাম। বাজার থেকে ফেরবার পথে ভাবলাম, গগনবাবুকে কিছু কথা শুনিয়ে আসি। গগনবাবুর বাড়ির কাছে এসে আমিই অবাক। বাড়ির সামনে বিস্তর লোক। সাদা ঝকঝকে একখানা অ্যামবাসাডর গাড়ি দাঁড়িয়ে। তবে কি গগনবাবুর কিছু হয়ে গেল!

বাড়ির গেটের সামনে ঠেলেঠুলে এসে পৌঁছলাম। ঘরের ভেতর থেকে তখন বেরিয়ে আসছেন বঙ্কুবাবুর বেয়াই ভোলানাথবাবু। বছর দেড়েক আগে আমাদের পাড়ার দুটি ষাঁড়ের কোনও একটি ষাঁড় গরদের পাঞ্জাবি খেয়ে নিয়ে বিচ্ছিরি কাণ্ড করেছিল। ভোলানাথবাবুর একপাশে বঙ্কুবাবু, অন্যপাশে গগনবাবু।

ভোলানাথবাবু আমাদের উদ্দেশে বললেন, “যে গাঁয়ে মেয়ে বিয়ে দিলুম, সে গাঁয়ে ইচ্ছে হলে মেয়েকে দেখতে আসতে পারব না, দুটো ষাঁড়ের ভয়ে দূরে থাকতে হবে। সেটা কেমন করে হয়। মেয়ের চিঠিতে জানলুম, ষাঁড় নাকি পিয়নকে তাড়া করে তার হাতের চিঠিও খেয়ে ফেলে। চিঠি পাঠাতুম বাবাজীবনের অফিসে। তখন থেকেই জেদ চেপে গেল। অবশেষে গগনের সন্ধান পেলুম।”

আমরা বিস্ময়ে ফেটে পড়ে জিজ্ঞেস করলুম, “সে কী! গগনবাবুকে আপনি চেনেন?”

ভোলানাথবাবু বললেন, “কেন চিনব না। আমিই তো বাড়ি কিনে ওকে এ পাড়ায় পাঠালুম। ও ছিল মেচেদার লিভিং-কাকতাড়ুয়া।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সেটা আবার কী জিনিস?”

ভোলানাথ গর্বের হাসি হাসতে হাসতে বললেন, “ফসলের খেতে কাকতাড়ুয়া থাকে জানে তো, গগনও ছিল তাই। মাঠের ধারে ঘুরে ঘুরে খেয়াল গাইত। ব্যস, পাখি তো দূরের কথা, পিঁপড়েও মাঠের ত্রিসীমানায় আসত না। ঘণ্টায় কুড়ি টাকা রেট ছিল। ওর গান শুনে একবার সজনেখালির পক্ষীনিবাসের সব পাখি উড়ে বাংলাদেশে চলে গিয়েছিল। ওকে বললাম, ‘তোমাকে বাড়ি কিনে দেব। তুমি শুধু কদমডাঙার ষাঁড় দুটিকে তাড়াও।’ সব শুনে গগন বলেছিল, ‘শুধু গানে হবে না, আমার গাড়িটাও লাগবে।’ ”

“আমি তাতেও রাজি হয়ে গেলাম। একদা এক ফাল্গুনে যেভাবে বেইজ্জত হয়েছিলাম, আজ ষোলো মাস সতেরো দিন বাদে তার প্রতিশোধ নিলাম।”

আমি খুব বিনীতভাবে প্রশ্ন করলাম, “এখন তো ষাঁড় নেই। এখনও কি তা হলে গাড়ি ও গান চলবে?”

ভোলানাথবাবু গগনের দিকে তাকালেন। গগনবাবু বললেন, “বা রে, প্র্যাকটিস বন্ধ করলে চলবে কী করে। এটা তো আমার প্রফেশন। সকালে একঘণ্টা গাড়ি আর সন্ধ্যায় এক ঘণ্টা গানের রেওয়াজ আমি ছাড়তে পারব না।”

আমরা মাথায় হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আর ওদিকে মদন মুদি চিৎকার করে বলে উঠল, ‘ভয় নেই বাবুসকল। আমার দোকানে এবার থেকে কানে দেওয়ার তুলো পাওয়া যাবে। এক প্যাকেট পঞ্চাশ পয়সা। গগনবাবু থেকে যান।”

পঞ্চায়েত-প্রধান গুণময় গুন মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “দুটি কালো ষাঁড় আর গগনবাবু, এর মধ্যে একপক্ষকে আমাদের বেছে নিতেই হবে। আপনারা রাজি থাকলে ভোটাভুটির ব্যবস্থা করতে পারি।”

আমরা অবশ্য ভেবে দেখবার জন্য কয়েকদিন সময় চেয়েছি।

২৩ ডিসেম্বর ১৯৮৭

সকল অধ্যায়

১. বিষে বিষক্ষয় – আশাপূর্ণা দেবী
২. আটচল্লিশ – অরবিন্দ গুহ
৩. ডোডো তাতাই পালা কাহিনি – তারাপদ রায়
৪. কৈলাসে চা পান – আশাপূর্ণা দেবী
৫. চোরে ডাকাতে – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৬. সাধু কালাচাঁদের নতুন কাজ – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
৭. ইলশেঘাই – লীলা মজুমদার
৮. শরচ্চন্দ্রের সন্ধিভেদ! – শিবরাম চক্রবর্তী
৯. ঝুনুমাসির বিড়াল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০. বিধু দারোগা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
১১. সাধু কালাচাঁদের পালাকীর্তন – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
১২. কে ফার্স্ট? – আশাপূর্ণা দেবী
১৩. ফ্ল্যাট রেস – জরাসন্ধ
১৪. চিত্তশুদ্ধি আশ্রম – বিমল কর
১৫. টেনাগড়ে টেনশান – বুদ্ধদেব গুহ
১৬. হাতি-চোর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৭. ছোটমাসির মেয়েরা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৮. মোটরবাইক, ষাঁড় ও লাকি – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১৯. ব্যাঙাচিদের লেজ – তারাপদ রায়
২০. বাজারদর – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২১. তেঁতুলমামার জগৎ – হিমানীশ গোস্বামী
২২. রাজার মন ভাল নেই – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৩. গজেনকাকার মাছ-ধরা – বিমল কর
২৪. দাদুর ইঁদুর – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
২৫. সাত নম্বর – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
২৬. মেজদার সার্কাস – চিত্তরঞ্জন সেনগুপ্ত
২৭. চোর – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৮. কুস্তির প্যাঁচ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৯. দুঃখহরা বড়ির শিশি – লীলা মজুমদার
৩০. পিলকিন’স ইলেভেন – বিমল কর
৩১. রাত যখন বারোটা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩২. ভুনিকাকার চৌরশতম – বিমল কর
৩৩. গ্রামের নাম জাঁকপুর – আশাপূর্ণা দেবী
৩৪. নিখোঁজ নিরুদ্দেশ হতে গেলে – আশাপূর্ণা দেবী
৩৫. বাঘের দুধ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৬. গগনবাবুর গাড়ি – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৭. গাবু – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৮. কুরুক্ষেত্র – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৯. কাক্কাবোক্কার ভুতুড়ে কাণ্ড – শৈলেন ঘোষ
৪০. হরিমতির বাগান – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪১. বড়দার বেড়াল – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৪২. মহাকর্ম – সমরেশ মজুমদার
৪৩. পায়রাডাঙায় রাতে – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৪. মামার বিশ্বকাপ দর্শন – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪৫. গটমটে সাহেব বটে – শৈলেন ঘোষ
৪৬. রাঘব বোয়াল – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
৪৭. স্কন্ধকুমার এবং অর্ধচন্দ্র – তারাপদ রায়
৪৮. পাগল হইবার সহজপাঠ – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪৯. বিপিনবিহারীর বিপদ – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৫০. সাদা রঙের পাঞ্জাবি – অনির্বাণ বসু
৫১. জগু যাবে বেড়াতে – বাণী বসু
৫২. কুঞ্জবাবুর পিঁপড়ে বাতিক – অমিতাভ গঙ্গোপাধ্যায়
৫৩. ভুলে যাওয়া – সিদ্ধার্থ ঘোষ
৫৪. ঝগড়ুটে ফাইভ – প্রচেত গুপ্ত
৫৫. বিপদভঞ্জনের সর্পদোষ – উল্লাস মল্লিক
৫৬. মাসির বাড়ি – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৫৭. জাগ্রত অসুরের গল্প – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৫৮. কাকাতুয়া ডট কম – প্রচেত গুপ্ত
৫৯. নতুন নাটকও ভন্ডুল – উল্লাস মল্লিক
৬০. রামখেলাওনের কেরামতি – সৌরভ মুখোপাধ্যায়
৬১. কলহগড়ের নিস্তব্ধতা – সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়
৬২. পটলার থিমপুজো – শক্তিপদ রাজগুরু
৬৩. সংকটমোচন কমিটি – প্রচেত গুপ্ত
৬৪. নতুন বন্ধু চিনু – জয়দীপ চক্রবর্তী
৬৫. বুঁচকির মেয়ের বিয়ে – নবনীতা দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন