পৌলোমী সেনগুপ্ত
বাবাকে নিয়েই মাথায় এখন রাজ্যের চিন্তা।
এগারো মাস হয়ে গেল বাবা বলতে গেলে বিছানায় শুয়ে আছেন। ঘরের মধ্যে এক-আধটু হাঁটাচলা করেন বটে, কিন্তু সেটুকু ধর্তব্যের মধ্যে নয়। কী তেজি চেহারা ছিল, রাশি রাশি খেতে পারতেন, দৌড়ঝাঁপ করে বেড়াতেন। কোথায় গেল সেসব, লিকলিক করছে চেহারা, বার্লি খেলে পর্যন্ত ঢেকুর গেলেন, ঘরের মধ্যে কখনও-সখনও বাচ্চা ছেলের মতো থিরথির করে হাঁটেন। মোট কথা, নিজের চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না কী মানুষ কী হয়ে গেছেন।
অথচ ডাক্তারবদ্যি তো কম দেখানো হল না। ইঞ্জেকশনের ঠ্যালায় হাত আর কোমর অসাড় হয়ে আছে, বোতল বোতল ওষুধ গেছে পেটে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। দিনের পর দিন আরও কাহিল হয়ে যাচ্ছেন।
কী করা যায়। ভেবেচিন্তে নৃপেন কোনও কূলকিনারা পাচ্ছে না। কাতর হয়ে নৃপেন একদিন বলল, বাবা, কী করা যায়, আমার মাথায় তো কিছু আসছে না, একটু হোমিয়োপ্যাথি করাবেন নাকি?
বাবা চিঁ চিঁ করে বললেন, না, না, মিষ্টি আমি বরাবরই অপছন্দ করি। মিষ্টি খেলে ছেলেবেলা থেকেই আমার গা গুলোয়, হোমিয়োপ্যাথি ওষুধ খেলেই আমার বমি হয়ে যাবে। খবদ্দার, হোমিয়োপ্যাথি ডাক্তার যেন আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় না আসে।
নৃপেন চুপ করে রইল। মিষ্টি সম্পর্কে বাবার সঙ্গে নৃপেনের একদম মেলে না। হোমিয়োপ্যাথি ডাক্তার দেখলে পর্যন্ত নৃপেনের জিভে জল আসে।
কিন্তু অ্যালোপাথির তো মনে হয় চূড়ান্ত হয়ে গেছে। বাঘা বাঘা ডাক্তারদের মধ্যে কাউকেই বাদ দেওয়া হয়নি। কবরেজিতে কি বাবা রাজি হবেন?
নৃপেন কিন্তু কিন্তু হয়ে বলল, বাবা, তা হলে কি একজন বিচক্ষণ কবরেজকে ডেকে আনব?
যেন সদ্য খানিক তেতো পাচন গিলেছেন বাবার মুখখানা এমন করুণ হয়ে উঠল। কবরেজদের নাম শুনেই এই অবস্থা, চোখের সামনে একজন জলজ্যান্ত কবরেজ দেখলে বাবা হয়তো অজ্ঞনই হয়ে যাবেন। থাক বাবা, কবরেজে কাজ নেই।
বাবার বুকে হাত বুলোতে বুলোতে নৃপেন বলল, মুখ ফসকে কবরেজের কথা বেরিয়ে গেছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন বাবা, কোনও কবরেজের সাধ্য নেই যে আপনার ধারে কাছে আসে, আমি গ্যারান্টি দিলাম।
গ্যারান্টি পেয়ে বাবা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। নৃপেন সমানে বাবার বুকে হাত বুলিয়ে যেতে লাগল। না নৃপেন আর কিছু বলবে না। বাবার কষ্ট বাড়িয়ে লাভ কী। বরং বাবা যদি কোনও ডাক্তারকে ডেকে আনতে বলেন তো নৃপেন, নিতান্ত অসাধ্য না হলে, তাঁকে ডেকে নিয়ে আসবে।
অনেকক্ষণ চুপচাপ। কারও মুখে কোনও কথা নেই। কিন্তু বাবার মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভেবেচিন্তে উনি একটা সিদ্ধান্তে এসেছেন।
ভুল মনে হয়নি।
নিশ্বাস ফেলে বাবা বললেন, নীপু, আমার মনে হচ্ছে ডাক্তার হারাধন দত্ত ছাড়া আর কোনও ডাক্তারের পক্ষে আমাকে বাঁচানো অসম্ভব। যদি হারাধন ডাক্তারকে একবার ডেকে আনতে পারো তো, আমার মনে হয়, এ যাত্রা তোমাকে আর মাথা ঘামাতে হবে না।
ডাক্তার হারাধন দত্ত!!!
নাম শুনেই নৃপেনের বুকের মধ্যে ধড়ফড় করে উঠল। হারাধন ডাক্তারকে ডাকা কি যেনতেন লোকের কাজ। উনি তো লাট-বেলাটের ডাক্তার। উনি অবশ্যই বড় ডাক্তার, খুব বড় ডাক্তার, কিন্তু তোমার-আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। বাড়িতে এলে ভিজিট, শোনা যায়, আড়াইশো টাকা।
ডাক্তার হারাধন দত্ত সম্পর্কে নৃপেনের একটি ঘটনা জানা আছে। কে একজন মোটামুটি বড় মানুষ—বাড়ি-গাড়ির মালিক—বহুদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে না পেরে অগত্যা হারাধন ডাক্তারকে ডেকে এনেছিলেন। দেখেশুনে হারাধন ডাক্তার তাঁকে বলেছিলেন—বছরখানেকের চিকিৎসায় আমি এমন করে দেব যে আপনাকে আর বাড়িতে শুয়ে থাকতে হবে না, রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে বেড়াবেন।
হারাধন ডাক্তার কথা রেখেছেন। ডাক্তারের খরচ মেটাতে গিয়ে ভদ্রলোককে বাড়ি-গাড়ি বেচে দিতে হয়েছে, উনি রাস্তায় টো-টো করে বেড়াচ্ছেন।
নৃপেন মরিয়া হয়ে বলল, তা সে যাই হোক বাবা, আপনার যখন সাধ হয়েছে, আমি হারাধন ডাক্তারকেই নিয়ে আসব।
জীবনে হারাধন ডাক্তারকে চোখে দেখেনি নৃপেন। কিন্তু তাতে কিছু যায়-আসে না। আর স্বনামধন্য ডাক্তারের ঠিকানা পাওয়াও খুব সোজা কাজ।
হারাধন ডাক্তারের চেম্বার পার্ক স্ট্রিটে।
দু’ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর নৃপেনের ডাক পড়ল। আহা, কী সৌম্য চেহারা ডাক্তারের, মুখখানা হাসিখুশি, মাথায় খাঁটি টাক, একটি চুলেরও ভেজাল নেই।
নৃপেন ঢোক গিলে বলল, ডাক্তারবাবু, আমার বাবার খুব কঠিন অসুখ, আপনাকে একবার দয়া করে আমাদের বাড়িতে যেতে হবে।
ডাক্তারবাবু গমগম করে বললেন, আপনাদের বাড়ি কোথায়?
ভবানীপুর।
নোটবুক খুলে ডাক্তারবাবু বললেন, একুশ দিন পরে যাব। তার আগে সময় নেই। এনগেজড। ভাল কথা, আমার ভিজিট জানেন তো?
নৃপেন মিনমিন করে বলল, জানি। আড়াইশো টাকা।
ডাক্তারবাবু হা-হা করে হাসলেন, বললেন, স্বাধীনতার আগে আমার ভিজিট আড়াইশো টাকা ছিল বটে। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট থেকে আমি পাঁচশো টাকা ভিজিট নিচ্ছি। তারপর জিনিসপত্তরের দাম অঢেল বেড়েছে, কিন্তু ভিজিট আমি আর এক পয়সাও বাড়াইনি। স্বাধীন হয়েছি, নিজের দেশের রুগিদের সেবা করব, কথায় কথায় ভিজিট বাড়ালে চলবে কেন?
নৃপেন সায় দিয়ে বলল, তা তো বটেই। হেঁ হেঁ, পাঁচশো টাকা ভিজিট। হুঁ হুঁ, দেব, দিতেই হবে।
ডাক্তারবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, সঙ্গে তেলের দামটাও দিতে হবে কিন্তু। নিজের পয়সায় তেল পুড়িয়ে গিয়ে আমি রুগি দেখি না। আপনার বাড়ি ভবানীপুরে তো? তা হলে তেল বাবদ আরও পঁচিশ টাকা লাগবে। উঃ, তেলের যা দাম!
নৃপেন ঘাড় নেড়ে বলল, শুধু তেল কেন, সব জিনিসেরই দারুণ দাম। তা, যার যেমন দক্ষিণা, আমি পাঁচশো পঁচিশ টাকা মজুত রাখব। কবে আসবেন ডাক্তারবাবু?
ওই যে বললাম একুশ দিন পরে। দাঁড়ান, আপনার নাম-ঠিকানা নোট করে নিচ্ছি।—নোটবুকে খসখস করে দু’লাইন লিখে ডাক্তারবাবু বললেন, আচ্ছা। আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে চলে যান।
ঠিক তারিখে সময়মতো গিয়ে ডাক্তার হারাধন দত্তকে নিয়ে এল নৃপেন।
বাঘের মতো চোখ পাকিয়ে রুগিকে একবার দেখে নিলেন ডাক্তার হারাধন দত্ত। পুরনো সমস্ত প্রেসক্রিপসন উলটেপালটে দেখলেন। আপনমনে বললেন, রুগিকে খতম করার জন্য কেউ কোনও চেষ্টার কসুর করেনি দেখছি। বরাতের জোরে এখনও টিকে আছে। যাক, আমি যখন এসে পড়েছি, আর কোনও ভাবনা নেই, সব ভাল যার শেষ ভাল।
তারপর ডাক্তার হারাধন দত্ত রুগিকে আগাপাশতলা পরীক্ষা করলেন। পরীক্ষা করার কায়দাকানুন এমন চমৎকার যে, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। পরীক্ষা-টরীক্ষা শেষ করে ডাক্তারবাবু বললেন, ওজোন দরকার। ওজোনই আসল কথা।
নৃপেন ব্যস্ত হয়ে বলল, হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, বাবার ওজন ভয়ংকর কমে গেছে। আগে ওজন ছিল…
নৃপেনকে থামিয়ে দিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, ওজন না, ওজোনের কথা বলছি। অক্সিজেনের তিনটি পরমাণু নিয়ে ওজোনের একটি অণু জন্মায়। অ্যাটমিক ওয়েট আটচল্লিশ।
নৃপেন নিচু গলায় বলল, আজকাল তো বাজার থেকে অনেক ওষুধ উধাও হয়ে গেছে। দোকানে ওজোন কিনতে পাব তো?
না। কেনাকাটার কোনও ব্যাপার নয়। সমুদ্রের হাওয়ায় বিস্তর ওজোন পাওয়া যায়। কাছাকাছির মধ্যে ধরুন পুরীর সমুদ্রের হাওয়া হলেই চমৎকার হবে।
নৃপেন গলে গিয়ে বলল, আমার বড়মামার পুরীর সমুদ্রের ধারে মস্ত বাড়ি আছে। বহুকাল থেকে বড়মামা সেখানেই থাকেন, ফলাও ব্যাবসা করেন।
ডাক্তারবাবু তুষ্ট হয়ে বললেন, তা হলে তো আর কোনও সমস্যাই নেই। তিন মাস পুরীর সমুদ্রের হাওয়া পেলেই সব অসুখ সেরে যাবে, চনমনে খিদে হবে, শরীরে মত্ত হাতির বল আসবে। তিন মাস বাদে আবার আমাকে ডাকবেন, আমি আরেকবার দেখে যাব, ব্যস। না না না, কোনও ওষুধ-বিষুধ লাগবে না, ওজোনই এই রুগির একমাত্র ওষুধ।
নৃপেনের হাত থেকে পাঁচশো পঁচিশ টাকা নিয়ে পকেটে পুরে ডাক্তার হারাধন দত্ত গটগট করে চলে গেলেন।
ধন্বন্তরি, সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি। লোকে কি আর অযথা ডাক্তার হারাধন দত্তের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়? চালাকি দ্বারা কখনও মহৎ কার্য হয় না।
বাস্তবিক, তিন মাসে নৃপেনের বাবার সব অসুখ সেরে গেল, চনমনে খিদে হল, শরীরে মত্ত হাতির বল এল। ডাক্তার হারাধন দত্তের প্রত্যেকটি কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে।
আবার ডাক্তার হারাধন দত্তকে ডেকে নিয়ে এল নৃপেন।
রুগি দেখে ডাক্তার হারাধন দত্ত খুব খুশি হলেন। এত উন্নতি যেন তিনিও ঠিক আশা করেননি। ডাক্তারবাবু বললেন, দেখুন, আমার অনেক রুগিকেই পুরী ঘুরিয়ে এনেছি কিন্তু ওজোনের এমন চমৎকার ফল জীবনে আর কখনও দেখিনি। কবে পুরী থেকে ফিরলেন?
নৃপেন শান্ত গলায় বলল, আজ্ঞে, বাবা তো কস্মিনকালেও পুরী যাননি। কলকাতার বাইরে যাবেন আমার বাবা? তা হলেই হয়েছে।
কথাটা যেন ডাক্তার হারাধন দত্ত ঠিকমতো শুনতে পেলেন না। বললেন, অ্যাঁ?
ডাক্তারের কাছে সত্য কথা গোপন করলে পাপ হয়। অতএব নৃপেন পরিষ্কার করে বলল, আজ্ঞে, আগেই আপনাকে বলেছি, পুরীতে বড়মামার ফলাও ব্যাবসা। কীসের ব্যাবসা জানেন? লরির ব্যাবসা। রোজ সকালে পুরী থেকে বড়মামার লরি আসে কলকাতায়। আপনি ওজোনের কথা বলে যাওয়ার পর এই তিন মাস আমাদের দরজায় বড়মামার লরি এসেছে, ঢাউস লরি, একেকটা লরিতে ছ’খানা চাকা, সামনে দু’খানা, পিছনে চারখানা।
হারাধন ডাক্তার আবার আওয়াজ করে উঠলেন, অ্যাঁ?
নৃপেন গড়গড় করে বলে যেতে লাগল, ডাক্তারবাবু তিন মাস ধরে রোজ বাবার এই ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করেছি, রোজ ছ’খানা টায়ার থেকে পুরীর হাওয়া ছেড়ে দিয়েছি এই ঘরের মধ্যে, আপনার কথা একতিল অমান্য করিনি ঘরখানা তিন মাস ধরে রোজ ওজোনে টইটম্বুর করে ছেড়েছি। তা আপনার কথা মিথ্যে হয়নি, নিজের চোখেই বাবাকে দেখুন, দেখুন ওজোনের কী অসীম ক্ষমতা।
হারাধন ডাক্তারের মুখ থেকে আর কোনও আওয়াজ বেরোল না। চোখ টকটকে লাল হয়ে গেল, মুখখানা থমথম করতে লাগল, টাক ভরতি হল ফোঁটা ফোঁটা ঘামে। ওজোনের এমন চমৎকার ফল এই প্রথম দেখলেন ডাক্তারবাবু এবং সম্ভবত এই প্রথম ভিজিট আর তেলের দাম না নিয়ে হতভম্বের মতো বেরিয়ে গেলেন, কেবল বিড়বিড় করে বললেন, অক্সিজেনের তিনটি পরমাণু মিলে ওজোনের একটি অণু জন্মায়। অ্যাটমিক ওয়েট আটচল্লিশ।
জ্যৈষ্ঠ ১৩৮২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন