পৌলোমী সেনগুপ্ত
তখন আমাদের আধাশহরটিতে ফি-বছর সার্কাসের দল আসত। ছোট বড় মাঝারি। রেজিষ্ট্রি অফিসের লাগোয়া ময়দানে বিশাল তাঁবু পড়ত। একপাশে খেলোয়াড়দের ছাউনি, অন্যপাশে জন্তু-জানোয়ারদের আস্তানা। তক্তা দিয়ে তৈরি গ্যালারি আর কাঠের ফোল্ডিং চেয়ার পেতে দর্শকদের আসন সাজানো হত।
ডিসেম্বর মাসে পরীক্ষা শেষ হয়ে যেত। আমরাও রাতের বেলায়, কখনও টিকেট কেটে, কখনও বা টিকেট না কেটে তাঁবুর ফাঁকফোকর দিয়ে মৌজ করে সার্কাস দেখতাম।
সেই সময়ে একটা বেশ বড় সার্কাস পার্টিকে আমরা লাটে উঠতে দেখেছিলাম। মানে নিলেম হয়ে যাওয়া। সেটার নাম ছিল হোয়াইটওয়ে সার্কাস।
যুদ্ধ তখন সবে শুরু হয়েছে। তখনকার হিসেবে জিনিসপত্রের দাম তুঙ্গে। চাল যখন টাকায় চার সের মা তখন আক্ষেপ করতেন, এ কী হাল হল দেশের, সংসার চলবে কী করে! এ তো সাধারণ গেরস্থ সংসারের হিসেব। সার্কাস পার্টির সংসার মানে তো একটা বিরাট ব্যাপার। তার অত লোকলশকর, জন্তু-জানোয়ার, তা ছাড়া অন্যান্য খরচ-খরচা তো আছেই। বোধহয় খরচ মেটাতে না পেরেই সার্কাস পার্টিটাকে লালবাতি জ্বালতে হয়েছিল। আর ঘটনাটা ঘটল আমাদের শহরেই। সবকিছু বিক্রি হয়ে গেল— জন্তু-জানোয়ার, একচাকা দু’চাকা তিনচাকার সাইকেল, যে বিশাল চার পায়ার ওপর দাঁড়িয়ে দাঁতাল হাতিটা কসরত দেখাত মায় সেটাও।
বাদামি রঙের আরবি ঘোড়াটা কিনেছিল পানের পাইকের দিনু সাও। বহুদিন ওই ঘোড়াটায় চড়ে ও হাটে হাটে পান ফিরি করত। স্টেশন-পাড়ার গণেশ হালুইকর কিনেছিল হাতির পা রাখার বিশাল চারপায়াটা। ওটা ওর দোকানের সামনে পড়ে থাকত। একসঙ্গে পাঁচ-সাত জন খদ্দের ওর ওপর বসে চা খেত। জন্তু-জানোয়ারগুলো সম্ভবত অন্য কোনও সার্কাস পার্টি কিনে নিয়ে গিয়েছিল। খেলোয়াড়রাও এদিক-ওদিক চলে গেল। একদিন সেই সার্কাস পার্টির দক্ষিণ-ভারতীয় ম্যানেজারটিও আমাদের শহর ছেড়ে চলে গেলেন। ময়দানে পড়ে রইল ছেঁড়া তাঁবুর টুকরো আর এখানে-সেখানে ছড়ানো ভাঙা কাঠ আর বাখারি।
ময়দানের কাছেই ছিল আমাদের এক বন্ধু মনোহরের বাড়ি। একটা ছেঁড়া তাঁবুর টুকরো কীভাবে যেন ওদের বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিল। তাই দেখে উৎসাহিত হয়ে মনোহর একদিন মেজদাকে বলল, “মেজদা, একটা সার্কাসের দল খুলবে?”
“সার্কাস?” মেজদা ঢোক গিলে বলল, “কিন্তু আমাদের খেলোয়াড় কই? জন্তু-জানোয়ার, রিংমাস্টার?”
মনোহর বলল, “জন্তু-জানোয়ার না-হয় না-ই রইল, আমরা শরীরের কসরত দেখাব, ম্যাজিক দেখাব, যেমন ফিরোজসায়েবের কার্নিভালে দেখায়।”
কিছুদিন আগে শহরের প্রান্তে একটা মিলিটারি ছাউনি পড়েছিল। সৈনিকদের মনোরঞ্জনের জন্য একটা কার্নিভালের দল এসেছিল। একটা কানাত-ঘেরা হলের মধ্যে গান, ম্যাজিক, নানান শারীরিক কলাকৌশল ইত্যাদি দেখানো হত। মানে পাঁচমিশেলি চিত্তবিনোদন। তারই মালিক ছিল ফিরোজসায়েব।
মনোহরের কথায় সায় দিয়ে বিল্টু বলল, “মনোহর কথাটা বুরা বলেনি মেজদা। আমরা একটা সার্কাসের দল খুলতে পারি। তুমি হাতিবাগান জিমন্যাস্টিক ক্লাবের মেম্বার। তুমি দেখাবে ব্যায়ামের কসরত, ঘণ্টা দেখাবে দোলনা— মানে ট্রাপিজের খেলা, আর আমি দেখাব ম্যাজিক। তা ছাড়া মুখে রং মেখে জোকারের কাজটাও চালিয়ে দিতে পারি।”
মেজদা মাথা চুলকে বলল, “আইডিয়া ভাল, কিন্তু টিকিট?”
বিল্টু পরম উৎসাহের সঙ্গে বলল, “টিকিটের দাম হবে এক পয়সা। যাদের দেখার ইচ্ছে তারা টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে দেখবে।”
টিফিনের জন্য আমরা বাড়ি থেকে এক পয়সা করে পেতাম এবং তাই দিয়ে পরমানন্দে চিনেবাদাম, ফুচকা অথবা আলুকাবলি কিনে খেতাম। মনোহরের প্রস্তাবটা মেজদার বেশ মনে ধরল। মেজদা বলল, “তা হলে তো প্র্যাকটিস করা দরকার। ঘণ্টা, তুই দোলনার খেলা প্র্যাকটিস কর। আমি দেখাব ব্যায়ামের কসরত, আর একটা তাক-লাগানো নতুন খেলা, তবে সেটা কী এখন বলব না। আর বিল্টু, তুই তোর ছোটকার কাছে ম্যাজিক শেখ।”
নতুন খেলাটা কী আমরা জিজ্ঞেস করলাম না মেজদাকে। মেজদার মাথায় নানান রকমের বুদ্ধি খেলে। নিশ্চয়ই এমন-কিছু দেখাবে যেটা হবে আমাদের সার্কাসের সেরা কসরত।
যাই হোক প্রস্তাবটা যখন সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়ে গেল, আমরা সবাই রীতিমতো প্র্যাকটিস আরম্ভ করলাম। মনোহরের ওপর দেওয়া হল তাঁবু খাটানোর ভার। তাঁবুটা ওর হেফাজতেই ছিল। বিল্টু ওর ছোটকাকার কাছে নতুন নতুন ম্যাজিক শিখতে লাগল। আমিও প্রতিদিন ভোরে উঠে ইস্কুল বোর্ডিং-এর ব্যায়ামাগারে দোলনার খেলা অভ্যাস করতে লাগলাম। দিন-সাতেক পর ইস্কুলের দেওয়ালে হাতে আঁকা পোস্টার আঁটা হল, “আসুন! আসুন! অভিনব সুযোগ! চিলড্রেনস সার্কাস। টিকিটের হার মাত্র এক পয়সা। মাস্টার ঘণ্টার রোমহর্ষক ট্রাপিজের খেলা। জাদুকর বিল্টুর চমকপ্রদ ম্যাজিক। ব্যায়ামবিদ প্রবীরকুমারের (মেজদার ভাল নাম) শ্বাসরোধকারী ব্যায়ামের কসরত। এ-সুযোগ হেলায় হারাইবেন না।’’
কিন্তু এত পাবলিসিটি সত্ত্বেও টিকেট বিক্রি হল মাত্র সাড়ে-সাত পয়সার। রেলের বুকিং ক্লার্ক সান্যালবাবুর তিন ছেলে-মেয়ে, সেকেন্ড মাস্টারের ছেলে আর ভাইপো এবং মোক্ষদা জেলেনির তিন নাতনি ভিন গাঁ থেকে মামাবাড়ি বেড়াতে এসেছিল তারা। তার মধ্যে একজনার চার বছর বয়স, তার হাফটিকেট।
ছেঁড়া তাঁবুর নীচে সার্কাসের আসর। গ্যালারি বা চেয়ার নেই, মেঝেতে খড় বিছিয়ে তার ওপর ছেঁড়া তাঁবুরই একটা টুকরো বিছিয়ে দর্শকদের বসার আসন। মাঝখানে একচিলতে জায়গা গোল করে দড়ি দিয়ে ঘেরা, যাকে বলে এরিনা। দিনের বেলা তো, কাজেই লাইটের বালাই নেই।
সার্কাস শুরু হল। প্রথমেই আমার খেলা, তার সঙ্গে জোকার সেজে বিল্টুর ভাঁড়ামো। আমাদের খেলা বেশ ভালভাবেই উতরে গেল। তারপর মেজদার প্রথম প্রবেশ। বাসন্তী রঙের ফুলহাতা গেঞ্জি আর হাফপ্যান্টে মেজদাকে চমৎকার মানিয়েছিল। মেজদা দেখাল চাইনিজ অ্যাক্রোব্যাটস-এর খেলা। তারপর বিল্টুর ম্যাজিক। তাসের ম্যাজিক। রঙিন বলের ম্যাজিক। দর্শকদের মধ্য থেকে হাততালিও পড়ল ক’বার। সবশেষে এল মেজদার সেই তাক-লাগানো খেলার পালা। ওদিকে তাঁবুর এক কোণে কনসার্ট বাজছে। কনসার্ট মানে ক্যানেস্তারা আর একটা ভাঙা কাঁসর। বাজাচ্ছিল মনোহরের দুই ছোট ভাই, কানাই আর বলাই। বিল্টু টিনের চোঙায় মুখ দিয়ে ঘোষণা করল, “এবার চিলড্রেনস সার্কাসের সবচেয়ে শানদার খেলা, দেখাচ্ছেন কলকাতার হাতিবাগান জিমন্যাস্টিক ক্লাবের মেম্বার বিখ্যাত ব্যায়ামবিদ প্রবীরকুমার।”
কনসার্ট বাজতে লাগল। মেজদা এরিনার মধ্যে এসে দর্শকদের অভিবাদন করেই সটান শুয়ে পড়ল মেঝের উপরে। মনোহর সঙ্গে সঙ্গে মেজদার বুকের উপর খানকয়েক গাবদা গাবদা বালিশ চাপিয়ে তার উপর একটা কপাটের পাল্লা ফেলে চার কোণে দড়ি দিয়ে মজবুত করে বাঁধল।
এতক্ষণে আমরা ব্যাপারটা বুঝলাম। ও হরি, এ সেই বুকের উপর হাতি চাপানোর খেলা। যা হোয়াইটওয়ে সার্কাসে প্রফেসর রামমূর্তি দেখাত। কিন্তু হাতি কোথায়? হোয়াইটওয়ে সার্কাসের হাতি তো অন্য সার্কাস কোম্পানি কিনে নিয়ে গেছে। তা হলে?
হেন সময়ে মনোহর একটা দড়িতে বাঁধা বাছুর নিয়ে এরিনায় প্রবেশ করল। কনসার্ট বাজছে দ্রুততালে। মেজদা ইশারা করতেই মনোহর বাছুরটার দড়ি ধরে তার বুকের চাপানো কপাটের পাল্লাটার উপর চড়াল। কিন্তু হঠাৎ কী খেয়ালে মেজদার মুখের দিকে মুখ না করে পিছু ফিরে দাঁড়াল বাছুরটা। তারপর দিব্যি ল্যাজ নাড়তে লাগল। ওর ল্যাজের লোমের গোছাটা মেজদার নাকের মধ্যে ঢুকে সুড়সুড়ি দিতে লাগল। মেজদা দু’-একবার মুখ এপাশ ওপাশ করে সামলাতে না পেরে ঝাড়ল এক বোম্বাই হাঁচি— হাঁচ্চো।
এক লহমার মধ্যে কী যেন ঘটে গেল। বাছুরটা ঘাবড়ে গিয়ে দড়ি ছিঁড়ে ল্যাজ উঁচিয়ে লাফ দিয়ে পালাল। যাবার সময় দর্শকদের বসার আসনের তলা থেকে একগোছা খড়ও মুখে টানল। তার ফলে হাফ-টিকেটের খুদে দর্শকটি উলটে চিতপটাং এবং ভ্যাঁ।
মেজদা মুখটা এদিক-ওদিক ঘোরাচ্ছে, অথচ শরীর নাড়াবার উপায় নেই, কারণ কপাটের পাল্লাটা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা! সেই অবস্থাতেই মেজদা বলল, “দেখছিস কী, তক্তার দড়িগুলো খুলে দে, কক্সকম্ব কোথাকার।”
আমরা তড়িঘড়ি কপাটের পাল্লার দড়িগুলো খুলে দিয়ে মেজদাকে মুক্ত করলাম। মেজদা উঠেই অস্থির হয়ে হাতের কাছে অন্য কিছু না পেয়ে বিল্টুর জামাতেই মুখটা মুছতে লাগল। মেজদা চিৎকার করে বলল, “তখনই মনোহরকে পইপই করে বললাম, বাছুর দিয়ে কাজ হবে না।”
মনোহর বলল, “বা রে, সে-কথা আবার কখন বললে, বুকের ওপর বাছুর তোলার প্ল্যান তো তোমারই।”
মেজদা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলল, “বাজে বকিসনি। আমি যদি কারও ঘরে আগুন লাগাতে বলি তো তুই লাগাবি?”
আমরা ভাবলাম, সত্যিই মেজদার জবাব নেই।
১৯ মে ১৯৮২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন