পৌলোমী সেনগুপ্ত
ব্যাঙাচিদের লেজ খসে গেলে তারপর তারা ব্যাঙে পরিণত হয়। এইভাবে প্রত্যেক বছর বর্ষাকালে লক্ষ লক্ষ ব্যাঙাচি ব্যাঙত্ব প্রাপ্ত হয়। এই তথ্য মোটামুটি সকলেরই জানা আছে। কিন্তু ব্যাঙাচিদের সেই খসে পড়া লেজের টুকরোগুলো কী হয়? ব্যাঙ হওয়ার ঠিক আগে আগে ব্যাঙাচিরা যখন পূর্ণত্ব পায়, তখন একেকটা ব্যাঙাচির লেজের দৈর্ঘ্য অন্তত এক ইঞ্চি হয়। সমস্ত ভারতে বছরে অন্তত পঁচিশ লক্ষ ব্যাঙাচির পঁচিশ লক্ষ ইঞ্চি লেজ খসে পড়ে।
বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ও জীবতত্ত্ববিদ ডক্টর ঘনশ্যাম চক্রবর্তী অঙ্কটা কষে ফেলেছেন। প্রতি বছর ব্যাঙাচিদের খসে পড়া লেজের দৈর্ঘ্য হচ্ছে অনেক মাইল। বহু হাজার জোড়া জুতোর ফিতে এই খসে পড়া ব্যাঙাচির লেজ জুড়ে তৈরি করা যায়। আর পাকিয়ে যদি দড়ি বানানো যায় তো সারা দেশের সারা বছরের সমস্ত রেলযাত্রীর বিছানা বাঁধা যাবে।
সুতরাং ব্যাঙাচিদের খসে পড়া লেজের অপচয় দূর করতে হবে, এই অমূল্য জাতীয় সম্পদের সুব্যবহার চাই। যেদিন থেকে এই চিন্তা ঘনশ্যামবাবুর মাথায় প্রবেশ করেছে, তাঁর রাতের ঘুম ঘুচে গেছে।
এ বিষয়ে প্রথমে ঘনশ্যামবাবু তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা আরম্ভ করেন। দুঃখের বিষয় তাঁরা কেউই ঘনশ্যামবাবুর মতো সমাজহিতৈষী নন। তাঁরা সমস্ত বিষয়টি শুনে হো হো করে হেসে উড়িয়ে দিলেন। কেউ কেউ ধরেই নিলেন যে, ঘনশ্যাম চক্রবর্তী সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেছেন। এক বন্ধু তাঁকে এক কবিরাজের ঠিকানা দিলেন যাঁর কাছে মাথা ঠান্ডা হওয়ার ভাল তেল পাওয়া যায়।
ঘনশ্যামবাবু এতে দমে যাওয়ার লোক নন, তিনি যেবার মাছের আঁশ জুড়ে জুড়ে ওয়াটারপ্রুফ ছাতার কাপড় তৈরি করার বিষয়ে গবেষণা করছিলেন তখনও তাঁর এই বন্ধুরা এই রকমই হাসাহাসি করেছিল। দুঃখের বিষয় মাছের আঁশ জুড়ে জুড়ে সেই জলনিরোধ ছাতার আবরণ তৈরি আর হয়ে ওঠেনি, তবে এ বিষয়ে তাঁর গবেষণা-নিবন্ধ পড়ে দক্ষিণ-পূর্ব নাইজেরিয়ার ধীবর সমিতি তাঁকে একটি চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল, তারা বছরে দেড় হাজার মেট্রিক টন মাছের আঁশ সরবরাহ করতে পারবে।
সেসব পুরনো কথা এখন থাক। আপাতত ডক্টর ঘনশ্যাম চক্রবর্তী ব্যাঙাচির লেজ নিয়ে ব্যস্ত।
গ্রীষ্মের শেষ থেকে একটা হাতজাল দিয়ে বেলেঘাটা, মানিকতলা, বেহালা প্রভৃতি এলাকার বিখ্যাত বৃহৎ নর্দমাগুলি থেকে যথাসাধ্য ব্যাঙাচি ধরে জলভরতি ড্রামে করে নিয়ে এসেছেন নিজের বাড়িতে। কিন্তু ব্যাঙাচিগুলো বাঁচেনি, বোধহয় খাদ্যের অভাবেই। ব্যাঙেরা পোকামাকড়, মশামাছি ইত্যাদি খেয়ে জীবন ধারণ করে। কিন্তু ব্যাঙাচিরা কী খায়, কী খেয়ে বেঁচে থাকে একথা কোনও বইয়ে লেখা নেই। ব্যাঙ তো চতুষ্পদ প্রাণী, ব্যাঙাচি-শিশুরা কি ব্যাঙ-মায়ের দুধ খেয়ে বেঁচে থাকে?
ডক্টর ঘনশ্যাম চক্রবর্তী কয়েকটা বড় বড় ব্যাঙ ধরে আনলেন ব্যাঙাচিদের দুধ খাওয়ার জন্যে। কিন্তু এনে ড্রামের জলের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে বিশাল বিশাল লাফ দিয়ে ব্যাঙেরা অদৃশ্য হয়ে গেল। বন্দিদশা থেকে সদ্যমুক্ত ব্যাঙ কত লম্বা লম্বা লাফ দেয়, ঘনশ্যামবাবু স্বচক্ষে না দেখলে সেটা কখনওই বিশ্বাস করতেন না।
এর পরের বার ড্রামে করে ব্যাঙাচি নিয়ে আসার সময় সেই সঙ্গে ঘনশ্যামবাবু কয়েকটা ধাড়ি ব্যাঙও ধরে আনলেন। এনে সেগুলোকে পায়ে দড়ি বেঁধে ড্রামের আংটার মধ্যে দড়ির এক মাথা আটকিয়ে ড্রামে আবদ্ধ করলেন। বন্দি ব্যাঙেদের সে কী প্রতিবাদ শুরু হল। ব্যাঙের ডাক নিয়ে যুগযুগান্তের যে সব কবিরা কবিতা রচনা করেছেন সে ডাক শুনলে তাঁদের কবিতা লেখা চিরকালের মতো ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হত।
কিন্তু ঘনশ্যাম চক্রবর্তী হলেন গবেষক ও সমাজহিতৈষী। এত সহজে হাল ছেড়ে দিতে তিনি রাজি নন। তবে বাদ সাধলেন তাঁর নিকট প্রতিবেশীরা। তাঁরা থানায় নালিশ করলেন ডক্টর ঘনশ্যাম চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে, তিনি নাকি তাঁর শয়ন ঘরের মধ্যে একটি বেআইনি শূকর পালন কেন্দ্র শুরু করেছেন, সেই শূকরদের চিৎকারে পাড়ায় বসবাস করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। থানা থেকে পুলিশ এলে ঘনশ্যামবাবু তাঁদের বোঝালেন যে তাঁর ঘরে কোনও শূকর নেই, তবে কিছু পোষা ব্যাঙ আছে এবং সেই ব্যাঙগুলো তিনি পুষছেন শখ করে নয়, সমাজের উপকারের জন্যে। পুলিশের লোকেরা অনেক খুন-জখম, মারামারি, কাটাকাটি দেখেছে, কিন্তু এ রকম ব্যাঙ পোষার বৃত্তান্ত এর আগে কখনও শোনেনি, কী করণীয় তাও তারা জানে না। ঘনশ্যামবাবুকে তারা বিশেষ কিছু করল না, কিন্তু যাওয়ার সময় শাসিয়ে গেল, “ভদ্রলোকের পাড়ায় ওসব ব্যাঙ-ট্যাঙ পোষা চলতে দেওয়া যাবে না।”
ঘনশ্যামবাবু স্বভাবত নির্বিরোধ মানুষ। সুতরাং পুলিশের এই ধমকে তিনি বেশ ঘাবড়ে গেলেন। তিনি তাঁর কষ্ট করে সংগ্রহ করে আনা ব্যাঙগুলিকে ছেড়ে দিলেন, ব্যাঙাচিসুদ্ধ ড্রাম-ভরতি জল, পাড়ার মোড়ের মাথায় একটা রাস্তা ভাঙা গর্ত আছে যেখানে জলের টিউবওয়েল থেকে গড়িয়ে সারা বছর ধরে জল থাকে, সেই গর্তে ঢেলে দিলেন।
খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ঘনশ্যামবাবু আজকাল একটা বেতের মোড় নিয়ে মোড়ের মাথায় টিউবওয়েলের ধার ঘেঁষে ওই ব্যাঙাচিদের গর্তের পাশে চলে যান। তারপর সেখানে বসে বসে ব্যাঙাচিদের পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। তাঁর একটাই উদ্দেশ্য, কখন ব্যাঙাচিদের লেজ খসে যাবে এবং সেই খসে পড়া লেজ কোথায় যায় বা কী হয় সেটা লক্ষ করা।
বেলা আটটা নাগাদ একবার ঘনশ্যামবাবু বাড়িতে আসেন চা-জলখাবার খেতে, মিনিট পনেরোর মধ্যেই আবার ফিরে যান। ফিরে যাওয়ার সময় একটা ছাতা সঙ্গে করে নিয়ে যান, কারণ এই সময়টা রোদটা বেশ শানিয়ে ওঠে, আঢাকা মাথায় একটু সময় রোদে বসে থাকলেই মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। এরপর বেলা একটা নাগাদ ঘনশ্যামবাবু একবার আধঘণ্টার জন্যে স্নান-খাওয়া করতে আসেন, তারপর সেই সন্ধ্যা পর্যন্ত গর্তটার পাশে বসে থাকেন, যতক্ষণ না অন্ধকার হয় এক দৃষ্টিতে ব্যাঙাচিদের পর্যবেক্ষণ করে যান। মোড়ে যে নিয়ন আলোটা আছে সেটা একটু কমজোরি, সেটার আলোয় সন্ধ্যার পর গর্তের ঘোলা জলের মধ্যে কিছু চোখে পড়ে না, ফলে হাজার ইচ্ছা থাকলেও রাতের বেলায় ডক্টর ঘনশ্যাম চক্রবর্তী তাঁর গবেষণা চালাতে পারেন না। মোড়া হাতে করে ঘনশ্যামবাবু বাড়িতে ফিরে আসেন।
যারা ঘনশ্যামবাবুকে ভাল করে চেনে না তারা অবাক হয় যে, দিনের মধ্যে কয়েকবার এক ভদ্রলোক একটা মোড়া হাতে রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করছে, কখনও শুধু মোড়া হাতে, কখনও এক হাতে মোড়া এক হাতে ছাতা। মোড়ের মাথায় এ দুটো জিনিস রেখে বাড়িতে কয়েক মিনিটের জন্যে এলেও যে ফিরে গিয়ে সেগুলোকে ফেরত পাওয়া যাবে না সেটুকু বাস্তব বুদ্ধি ঘনশ্যামবাবুর এখনও আছে। তবে মোড়া সহ তাঁর এই অধিক যাতায়াত দেখে কিছু কিছু দুষ্ট লোক যে তার নতুন নামকরণ করেছে, ‘মোড়াবাবু’— এটা ঘনশ্যামবাবুর জানা নাই, জানলে নিশ্চয়ই খুব দুঃখিত হবেন।
ইতিমধ্যে আত্মায়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব সবাই ধরে নিয়েছে যে, ঘনশ্যামবাবু পাগল হয়ে গেছেন। শুধু এক ইংরেজি দৈনিকে ‘ভেক-বান্ধব ডক্টর চক্রবর্তী’ নামে একটি সচিত্র রিপোর্ট বেরিয়েছে, বেশ অনেকটা লেখা, একপাশে ফোটোতে দেখা যাচ্ছে ঘনশ্যামবাবু গর্তর পাশে হামাগুড়ি দিয়ে একেবারে জলের সমতলে প্রায় চোখ এনে গভীরভাবে কী দেখছেন, তার থেকে বেশ কিছু দূরে বেতের মোড়া এবং মোড়া-সংলগ্ন বাঁশের খুঁটিতে খোলা ছাতা টাঙানো।
ঠিক এই রিপোর্ট বেরনোর পনেরো দিন পরে ‘আন্তর্জাতিক জলজন্তু সংরক্ষণ সহায়ক মহাসমিতি’র লস এঞ্জেলস হেড কোয়ার্টার্স থেকে এক সাহেব আর দুই মেমসাহেব ঊর্ধ্বশ্বাসে কলকাতায় ছুটে এলেন, এসে তাঁরা ঘনশ্যামবাবুকে ধরলেন, কেন তিনি নিরীহ ব্যাঙাচিদের লেজ ছিঁড়ে দিচ্ছেন?
ঘনশ্যামবাবু অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে, তিনি তা করছেন না, তাঁর উদ্দেশ্য একেবারে আলাদা। আর তা ছাড়া সবচেয়ে বড় কথা হল ব্যাঙাচিদের লেজ ছেঁড়ার দরকার পড়ে না, সেটা আপনিই খসে পড়ে।
শুনে সাহেব-মেমসাহেবরা চেপে ধরল, “দেখাও লেজ খসে পড়া, প্রমাণ করো। এত সহজে ছাড়ব না, তোমাকে দেখাতে হবে ব্যাঙাচির খসে-পড়া লেজ।”
ঘনশ্যামবাবু বললেন, “সে খসে-পড়া লেজ আমি নিজেও এখনও দেখিনি। দেখব বলেই মোড়া নিয়ে এই গর্তের পাশে বসে আছি। যে মুহূর্তে আমি দেখতে পাব তোমাদের টেলিগ্রাম করে জানাব। তোমরা এসে দেখে যেয়ো।”
সাহেব-মেমসাহেবরা বলল, “তোমাকে কষ্ট করে টেলিগ্রাম করতে হবে না, আমরা তোমার পাশে বসে দেখছি তুমি ব্যাঙাচিদের কী করো।”
সুতরাং এখন একটা মোড়ার জায়গায় চারটে মোড়া হয়েছে। কলকাতার জনবহুল এক গলির মোড়ে রাস্তা-কাটা গর্তের ধারে যদি কেউ কখনও দেখতে পাও যে, একটা মোটা সাহেবের সঙ্গে দুই রোগা মেমসাহেব আর এক বাঙালি ভদ্রলোক মোড়ায় বসে নোংরা জলের মধ্যে উঁকি দিয়ে কী দেখছে, বুঝতে পারবে ওই বাঙালি ভদ্রলোকই বিখ্যাত সমাজহিতৈষী গবেষক ডক্টর ঘনশ্যাম চক্রবর্তী।
তবে ডক্টর চক্রবর্তীকে দেখতে যাওয়ার জন্যে কোনও তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। মানুষের চোখের সামনে লেজ খুলে ফেলতে ব্যাঙাচিরা ভীষণ লজ্জা পায়। ঘনশ্যামবাবুর কিংবা আন্তর্জাতিক জলজন্তু সংরক্ষণ সহায়ক মহাসমিতির সদস্য-সদস্যাদের কবে যে ব্যাঙাচির লেজ খসে পড়া দেখার সৌভাগ্য হবে কে জানে!
মে ১৯৭৯
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন